শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

এমন কি ঘুমঘোর স্বপ্নেও কবিতা লেখা সম্ভব… : সাখাওয়াত টিপু

0

স্লোভেনিয়ান কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক পিটার সেমোলিচ বাংলাদেশি কবি ও প্রাবন্ধিক সাখাওয়াত টিপুর সাক্ষাৎকারটি নেন ২০১৯ সালে। সময় ছিল বেলগ্রেডের আলমা প্রকাশনী থেকে সাখাওয়াত টিপুর ‘Absence of Eye’ নামের কাব্যপুস্তিকা প্রকাশিত হওয়ার পর। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে স্লোভেনিয়ান ‘পোয়েসিস’ ম্যাগাজিন তাঁকে ফিচার পোয়েট আকারে উপস্থাপন করেন। ‘পোয়েসিস’ তখন সাতদিন ধারাবাহিকভাবে সাখাওয়াত টিপুর কবিতা, প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। ‘পোয়েসিসে’ প্রকাশিত তাঁর সেই সাক্ষাৎকারের বাংলা রূপান্তর এখানে উপস্থাপন করা হলো।


পিটার সেমোলিচ: আপনার জন্ম ১৯৭১ সালে—মুক্তিযুদ্ধের বছরে—সে সময় বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের কবি ও কবিতায় সেই প্রভাব কতটুকু? সেই সময়ের শিশু হিসাবে কীভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনাকে প্রভাবিত করেছিল এবং সেই পরিস্থিতি আপনার লেখায় কতটা প্রতিফলিত হয়েছিল? অথবা আমি যদি কিছুটা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করি, আপনি কীভাবে আপনার শৈশবকে স্মরণ করেন এবং আপনার শৈশব আপনার লেখায় কতটা প্রভাব ফেলেছে?

 

সাখাওয়াত টিপু: আপনাকে ও ‘পোয়েসিস’কে অনেক ধন্যবাদ। বিশেষত সাক্ষাৎকারের জন্য আমাকে নির্বাচিত করায় সম্মানিত বোধ করছি। আমার জন্ম হয়েছিল সন্দ্বীপে, বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত উপজেলায়। আমার পরম ভাগ্য, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কালে আমি জন্মেছিলাম, নানা বাড়িতেই। আমার নানাবাড়ি ছিল জমিদার বাড়ি। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আমার বাবার বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। সে সময় আমার বাবা-চাচারা বামপন্থী রাজনীতি করতেন। ফলে ওই সংকটময় সময়ে আমার মাকে নানা বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। আর কৃষি সম্পদের কারণে আমাদের পরিবার সংকটাপন্ন যুদ্ধাবস্থা থেকে উৎরে গেছে।

বাবা-মায়ের কাছে নানা গল্প শুনেছি সেই সময়ের। আমার নানা বলতেন, ‘আমার নাতি অভ্যুদয়ের নতুন সূর্য ছোঁবে। সে অনেক ভাগ্যবান। আমরা স্বাধীন হতে যাচ্ছি।’ মূলত সন্দ্বীপ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ। হানাদার বাহিনী সেখানে গিয়েছিল অনেক পরে। ঐতিহাসিকভাবে তাকালে দেখব, যে কোনো রাষ্ট্রকে কব্জা করতে দখলদার বাহিনী প্রথমে পতন ঘটায় রাজধানীর। তারপর দেশের অন্য বড়ো শহর। কিন্তু উৎকণ্ঠা আর ভয়াবহ ব্যাপার সেখানেও কম ছিল না। ধ্বংসলীলা সেখানেও কম হয়নি। তবে মূল শহর থেকে কিছুটা কম। তবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল দেশের সমস্ত জায়গায়। ফলে ৯ মাসেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আর পৃথিবী পেল নতুন রাষ্ট্র, নতুন সীমানা আর নতুন এক দেশ।

বাংলাদেশের আধুনিক কবিরা নতুন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের পতনের পর। ১৯৪৭ সালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত ভাগ হয় হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে। দেশ ভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে। কিন্তু তার ৩ বছরের মাথায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানে, মানে বর্তমান বাংলাদেশে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মানুষের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা বাঙালিদের ভাষাভিত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের কাছে পরাস্ত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে সে সময়ের প্রধান কবিরা নতুন রাজধানীর স্বপ্ন দেখছিলেন। বাংলা কবিতার প্রধান প্রবণতার একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আর স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঔপনিবেশ বিরোধী একটা দর্শনগত জায়গা আছে এঁদের কবিতায়।

বাংলা কবিতার প্রধান প্রবণতার একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আর স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঔপনিবেশ বিরোধী একটা দর্শনগত জায়গা আছে এঁদের কবিতায়।

আমি একাত্তরের যুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ কিভাবে গড়ে উঠেছে বড়ো হতে হতে সেটা পরখ করেছি। কিভাবে একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকরা তাদের অধিকারের অর্জনকে ক্রমাগত বড়ো করে তুলছেন। স্বাধীন সীমানার মানুষ কিভাবে মুক্ত হয়ে উঠছেন।

বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে ইংরেজি সাহিত্য আমাদের পাঠ্যক্রমেই ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না আর, বাংলা তো আমার মাতৃভাষা। কিন্তু বাংলা, ফার্সি, ইংরেজি সাহিত্যের বাইরে আমার মনন গঠনে হয়তো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সাহিত্যের একটা প্রভাব আছে। পরিবারের অগ্রজ সদস্যদের বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ফলে আমাদের বাসায় ঐ দেশগুলোর প্রধান সাহিত্যিকদের বইয়ে ভরা ছিল। এখন মনে হয়, এসব বই নিয়ে খেলতে খেলতেই আমি বড়ো হয়েছি। আমরা মজা করে বলতাম—‘লাল বই’। বাংলা প্রাচীন আর বর্তমান লেখকদের পাশাপাশি নাম শুনেছি আলেকজান্দর পুশকিন থেকে ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কুর। আন্তন চেখভ থেকে ভ্লাদিমির নবোকভ। আরও অনেক অনেক। এটা ঠিক বলা যাবে না—কে বেশি প্রভাবিত করেছিল আমাকে। তখন আমার খুব প্রিয় ছিল রূপকথা। নানাদেশের রূপকথা আর ছড়া। তবে একটা সময় অভ্যাসে দাঁড়ায় হাতের কাছে যা-ই পেতাম তাই পড়তাম।

 

সেমোলিচ: কবিতা কখন এবং কিভাবে আপনার জীবনে প্রবেশ করেছিল? আপনি কখন লেখা শুরু করেছিলেন এবং কোন লেখক আপনাকে শুরুতে প্রভাবিত করেছিলেন?

টিপু: তিনটি দিবস আমাদের দেশে বড়ো করে পালিত হয়। ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস। দিবসকে সামনে রেখে স্কুলে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ হতো। সেখানে প্রথম ছড়া লিখি। ছোটোবেলায় সে সময় ছড়া লিখেছিলাম কিছু। পরে সেগুলো ফেলে দেই। তবে কখনো কবি কিংবা সাহিত্যিক হবো সেটা ভাবিনি। কারণ স্কুল জীবনেই আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম রাজনৈতিক নেতা হবো। তা আর হয়ে ওঠা হয়নি! সবচে বিরক্ত লাগত স্কুলের গৎবাঁধা পড়াশোনা। কোনো আনন্দ নেই। বৈচিত্র্য নেই। কিন্তু সাহিত্য, দর্শন, আইনশাস্ত্র আর ধর্মতত্ত্ব আমাকে বেশ টানত। হাতের নাগালে যা পাই, তাই পড়ি। ভাবলাম, জীবন থেকে সময় চলে যাচ্ছে। কী করব আমি? একটা সময় এসে সাহিত্যের ভেতর ঢুকে পড়লাম। তখন সাহিত্য চর্চা করা ছাড়া বিকল্প আর অন্য পথ ছিল না। আসলে আমি একটা পথ খুঁজছিলাম কিভাবে নিজের ভাষাকে মুক্ত করা যায়। কিভাবে নতুন অধরা জগতে পৌঁছানো যায়।

আমার শুরুর দিকে বাংলা প্রাচীন আর আধুনিক কবিদের প্রভাব ছিল। অনেক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী নাম বলে শেষ করা যাবে না। আমি সব সময় বোঝার চেষ্টা করেছি—তাদের ভাষা আর চিন্তার পদ্ধতিগত কাঠামো কেমন! তারা কেমন সৌন্দর্যের সন্ধান করছেন! যাতে নিজের একটা নতুন পথ সৃষ্টি করা যায়। প্রথম প্রথম আমার পাঠের প্রক্রিয়া ছিল, পঠিত সাহিত্যকে নিয়ে প্রশ্ন করা। সেটার ভেতরগত দুর্বলতা আর রূপ সন্ধান করা। ফলে নির্দিষ্ট কারো প্রভাবটা সরাসরি কাজ করেনি আমার বেলায়। হয়তো প্রভাবটা কাজ করেছে অচেতনভাবে।

 

সেমোলিচ: আপনি আপনার প্রজন্মের অন্যতম আলোচিত কবি, বা নতুন বাংলা কাব্যিক ভাষা আন্দোলনের ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচিত হন। আপনি এই আন্দোলন এবং এর সাথে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের সম্পর্ক সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পারেন? কোন উপায়ে নতুন কাব্যভাষা পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাব্যভাষার চেয়ে আলাদা?

টিপু: ওয়েল। বেশ আগে লেখা, তবে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এলা হি বরষা’ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে, লেখালেখি শুরু করার প্রায় ১৫ বছর পর। আগের বেশির ভাগ লেখাই গ্রন্থভূক্ত করিনি। বারবার মনে হয়েছে, নিজের নতুন ভাষাভঙ্গিটা রপ্ত হয়নি। যে নতুন কথা বলতে চাই, তা হচ্ছে না। ‘এলা হি বরষা’ সিরিজ কবিতার প্রথম কবিতা যখন প্রকাশিত হয়, তখন আমাদের অন্যতম আধুনিক কবি সিকদার আমিনুল হক লিখলেন—ভাষা নতুন, তবে গিমিক ভরা, চমকে দেওয়ার মতো। কিন্তু কবিতাটি বাংলা আধুনিক কবিতার থেকে বহু তফাৎ। তিনি খানিকটা আধুনিকতার জায়গা থেকে কবিতাটিকে নন্দনতাত্ত্বিকভাবে নাকচ করেন। বলে নেওয়া ভালো, আমাদের আধুনিক কবিতা রূপতত্ত্বের দিক থেকে প্রতীকবাদী কবিতার সম্প্রসারণ। বাংলা সাহিত্যের আদি কাঠামোগত দিক দিয়ে এটাকে ঔপনিবেশিক রূপ বলে মনে হতো। ফলে আমরা এর বিরোধিতা করতে থাকি।

বলে নেওয়া ভালো, আমাদের আধুনিক কবিতা রূপতত্ত্বের দিক থেকে প্রতীকবাদী কবিতার সম্প্রসারণ। বাংলা সাহিত্যের আদি কাঠামোগত দিক দিয়ে এটাকে ঔপনিবেশিক রূপ বলে মনে হতো। ফলে আমরা এর বিরোধিতা করতে থাকি।

আদি বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে একটা নতুন সম্বন্ধ তৈরির চেষ্টা চালায়। এটা ঠিক আমাদের বলা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ছিল না, মাত্র কয়েকজন কবি, যে যার মতো নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছি। এটা ছিল প্রথাগত কবিতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ। পরে সেটা অনেক তরুণ কবিকে প্রভাবিত করে। আর তারাও এমন চর্চা শুরু করেন। এটাই কিন্তু প্রথম প্রথাগত ‘প্রমিত বাংলা ভাষা’র বাইরে কাব্য ভাষার সন্ধান করা।

‘এলা হি বরষা’ প্রকাশের পর বাংলাদেশের প্রখ্যাত লাকানিয়ান-মার্কসবাদী ভাবুক ও সমালোচক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বইটির সমালোচনা লিখেন। সেটা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আর চিন্তাকে সামনে রেখেই। এবং তিনি আমার কবিতার নতুন এই ফর্মকে সমর্থন দেন। সেটাও বিপুল বিতর্ক সৃষ্টি করে। পরে আমাদের দেশের অন্যতম তাত্ত্বিক, লেখক ও অধ্যাপক আজফার হোসেন আমার কবিতার বিশেষ দিক নিয়ে আলোকপাত করেন। এগুলো বেশ আলোচিত ব্যাপার ছিল।

বলা যায়, অসংগঠিত এক কাব্য রূপ বাংলা আধুনিক কবিতার বিপরীতে ‘বিকল্প আধুনিক কবিতা’ আকারে হাজির হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে। কবিতা নিয়ে আমার ছোটো একটি ইশতেহার আছে। হয়তো এটা বই আকারে প্রকাশ পাবে কোনো একদিন। আমাদের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল ভাষাকে দূরবর্তী করার চেয়ে মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসা।

 

সেমোলিচ: আপনি কবি এবং সাংবাদিক। স্লোভেনিয়ায় এমন মিল সাধারণত দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সাংবাদিকতাকে কবিতাবিরোধী হিসাবে দেখি। কবিতা ও সাংবাদিকতা লেখার মিল ও পার্থক্য কীভাবে দেখেন? কবিতা এবং সাংবাদিকতায় লেখার ক্ষেত্রে আপনার পদ্ধতি কী?

টিপু: ভালো, আসলেই স্লোভেনিয়ার লেখকরা খুবই ভাগ্যবান। তবে এটি আমার জন্য খুব মজার প্রশ্ন। আমারও বারবার মনে হয়েছে, একজন কবির জন্য এটা একটা শোচনীয় পরিস্থিতি। আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগে বাংলা ভাষার প্রখ্যাত আধুনিক কবি রফিক আজাদ একই কথা বলেছিলেন আমাকে। তিনি বলেছিলেন, তুমি এতো সুন্দর প্রবন্ধ আর কবিতা লেখো, সাংবাদিকতা তোমার এই লেখার ব্যাঘাত ঘটাবে। আসলেই প্রাত্যহিক বস্তুগত জীবন চালানোর মতো অন্য উপায় ছিল না আমার। কারণ আমাদের বইয়ের বাজার খুব ছোটো। ফলে শুধু লেখার রয়্যালিটি দিয়ে প্রাত্যহিক জীবন চলে না। এসব ব্যাপারে আমি দুজন লেখক, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আর নাগিব মাহফুজের সাংবাদিক জীবনটার অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। তারা সাংবাদিকতা করলেও দুজনেই বিশ্বের নামজাদা লেখক। প্রায় দু’দশকের মতো আমি বিভিন্ন সময়ে দৈনিক পত্রিকার উপ-সম্পাদক, সাহিত্য ম্যাগাজিনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও শিল্প বিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকীয় পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি। আসলেই সাহিত্য আর সাংবাদিকতার দুটোর ভাষাই আলাদা। যেহেতু বাংলা ভাষায় অল্প-বিস্তর দখল আছে—ফলে কাজটা আমার জন্য বিরোধ তৈরি করেনি। আমার তত্ত্বের ভিত হলো, আমি যখন কাগজে কলমে লিখি না, শুধুই চিন্তা করি, তখনও আমি লেখার ভেতর থাকি। এমন কি ঘুমঘোর স্বপ্নেও কবিতা লেখা সম্ভব। লেখাকে সর্ব মুহূর্তের চিন্তা আকারে নিলে সবই সম্ভব। আপনি যে কাজই করুন না কেন, এমনকি চাকরি সম্পর্কিত জিনিসগুলো আপনার কবিতায় প্রবেশ করবে। এটি বাদ দেওয়া কঠিন, তবে জীবনের সান্নিধ্যে থাকার জন্য এটাই এক সহজ উপায়। আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, সমস্ত অভিজ্ঞতাই স্মৃতির আসল পথ। এটাই সাহিত্যের পক্ষে সহায়ক বলে মনে হয়। তবে খোদাই জানেন যে কোনটি একজন কবির পক্ষে ভালো! আমি আপনার সঙ্গে একমত, যদিও একজন লেখকের বেঁচে থাকার আর উপার্জনের সর্বোত্তম উপায় শুধুমাত্র লেখাই। সত্যিই আমি এমন সুদিনের জন্য অপেক্ষা করছি।

 

সেমোলিচ: আপনি নানা ধরনের কবিতা লিখেছেন—হাইকু থেকে দীর্ঘ কবিতা। কবিতার আধার, বিষয় নির্বাচন, কাব্যিক সূত্রগুলো নিয়ে আপনার কী মত? কবিতার বিষয় ও প্রকৃতির সম্পর্ককে কিভাবে দেখেন?

টিপু: ছোটোবেলায় স্কুলে আমাদের পড়ানো হয়েছিল, সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার জননী। সংস্কৃত একটি বিলুপ্ত ভাষা। হিন্দু ধর্মীয় আচার ছাড়া এটার কোনো ব্যবহার নাই। পরে বিশদ জেনে দেখলাম, দুটি দুই ধরনের ভাষা। প্রথম দিকে আমি সংস্কৃত ছন্দ বাংলা কবিতায় প্রয়োগ করি। তারপর দেখলাম, বাংলা ভাষার ভেতরগত গঠন তো এমন না। বাদ দিলাম ওই সব কবিতা। বাংলা ভাষার সব ছন্দেই আমি কবিতা লিখেছি। বিচিত্র ধরনের কবিতা। একবার বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব পড়তে গিয়ে আমি জেন সাধকদের চিন্তার প্রকৃতি ও দর্শন বোঝার চেষ্টা করি। সে সময় হাইকুর বিভিন্ন রূপ আর কাঠামো সম্পর্কে পড়েছিলাম। যেহেতু ভাষাটা অচেতনভাবে আসে, আচমকা বাংলা হাইকু লিখি প্রচুর। পরে ইংরেজিতে লেখা শুরু করি। আমার দুটো অপ্রকাশিত হাইকুর পাণ্ডুলিপি আছে। একটা বাংলা, আরেকটা ইংরেজি। আশাকরি শিগগির প্রকাশ পাবে এগুলো।

একজন সত্যিকার কবি তো ছন্দ মেপে মেপে কবিতা লেখেন না। কিন্তু চিন্তার ভেতরে চিত্র আর কল্পনাই কবির নিজস্ব ফর্ম তৈরি করে। মনে হয়, প্রকৃতিই একজন কবি কিংবা শিল্পীর প্রকৃত বন্ধু। তাই কবি অধরা চিন্তা-ভাবনা আর রূপকে নানা ফর্মে আকার দেন। বিষয়ের আধারই বলে দেয় ভাষা কেমন হবে, কবিতা কি ছোটো না দীর্ঘ হবে। কবি ভাষার শক্তি দিয়ে অদেখা সৌন্দর্যকে স্পষ্ট সুষমায় রূপান্তর করেন। একজন শিল্পীর মাহাত্ম্য সেখানে, যেখানে সাধারণের ভাষা কিংবা সৌন্দর্য দেখার সুযোগ থাকে না, সেখানেই সে নতুন পথের স্রষ্টা।

 

সেমোলিচ: কয়েক বছর ধরে আপনার কবিতা কীভাবে বদল ঘটেছে, আপনি কি সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পারেন?

টিপু: নানা কারণে কবিতা বদলে যায়। প্রথমত সব ধরনের বাস্তবতা, দ্বিতীয়ত স্মৃতি নির্ভরতা, তৃতীয়ত অভিজ্ঞতা, চতুর্থত প্রকৃতির রূপ-রূপান্তর, পঞ্চমত কল্পনার বিস্তার, ষষ্ঠত দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আর নানা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশ মানুষ সমাজ প্রকৃতি—এমন অনেক তালিকা দেওয়া যাবে। সব মিলিয়ে কবির মনোজগত এক অধরা সুন্দর আর সত্যের কাছে পৌঁছাতে চায়। কাঠামোগতভাবে এটাকে বলা যেতে পারে কোনো সত্যের ঘটনা কিংবা কবির প্রপঞ্চ! প্রত্যেকেই সেভাবেই বদলায়। এটাই একজন কবির সহজ স্বভাব। যদি কেউ না বদলায়, তাতে তার কবি সত্তা ও কাব্য কাঠামো সংকুচিত হয়ে মৃত্যু ঘটে। আমি প্রকৃতির মতো বদলাই, আর প্রকৃতিও আমার মতো বদলায়। এটা কবিতার উপর চাপানোর বিষয় নয়, স্বভাবগত এবং দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। প্রকৃতি এবং বাস্তবতা আমার মতোই সবকিছুকে পরিবর্তন করে। তাই একজন কবিকে নতুন সময়ে প্রবেশ করতে হয়।

 

সেমোলিচ: আপনি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখেন। দুই ভাষাতে লেখার অভিজ্ঞতা কিভাবে মেলান? কোন ভিত্তিতে আপনি বাংলা বা ইংরেজিতে একটি কবিতা লেখার সিদ্ধান্ত নেন?

টিপু: কবিতা কী করে হয় কিংবা কী করে আসে, সেটা স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে কবিতা আর কবিতার ভাষা আমার দেহের ভেতরে রক্তের মতো সচল। এটা অনেকটা প্রাকৃতিক তরঙ্গের মতো ব্যাপার। একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, আমার প্রধান ভাষা বাংলা, দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি। আমি অনেক ইংরেজি আর বিভিন্ন ভাষার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা পড়েছি। কিন্তু আমি যাদের লেখা পড়ছি, তারা জানল না আমি কি কবিতা লিখছি কিংবা কীভাবে কবিতা লিখছি, এটা আমার জন্য বেদনাদায়ক ঘটনা ছিল। আরেকটা বিষয় কাজ করেছে, আমার কবিতায় এমন কিছু সার্বজনীন বিষয়-আশয় আছে, সেটা বিশ্বের অপর ভাষার কবিরা জানুক। কথাটা হয়তো অতুক্তি হবে না, সংবেদনশীলতা আর মানবিকতার প্রশ্নে আমার কবিতা সেখানেই দাঁড়াতে পারে হয়তো! তবে আমি কখনো ইংরেজিতে লিখব ভাবিনি। কারণ ভাষাটা আমার স্বভাবের ছিল না। তবে চিন্তাটা ছিল। সত্যিকার অর্থে, বাংলা কবিতার ভালো ইংরেজি অনুবাদক পাইনি বলে আমি ইংরেজিতে কবিতা লেখা শুরু করি। প্রথম অবস্থায় জড়তা ছিল, এখন হালকা সয়ে গেছে। তবে মনের আনন্দের জোর থাকলে সব কিছুই করা সম্ভব।

 

সেমোলিচ: আপনি ভাষাবিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ক ম্যাগাজিনসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন এবং আপনি শিল্প সম্পর্কেও লেখেন। বিজ্ঞান, দর্শন এবং শিল্পের অভিজ্ঞতা কীভাবে আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলেছে?

টিপু: হ্যাঁ, আমি ‘জাতীয় সাহিত্য’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছি। সেটাতে বাংলাভাষা বিষয়ে কিছু বিতর্কের বিষয় ছিল। বাংলা ভাষার উপর সবচে বেশি প্রভাব সংস্কৃত আর ফার্সি ভাষার। হিন্দু সম্প্রদারের ধর্মীয় আচারের কারণে সংস্কৃত ভাষাকে বলা হয় দেবতার ভাষা। ধর্মীয় আচার ছাড়া এর ব্যবহার একদমই নাই। আরেকটি হলো বাংলা অঞ্চলে ইরানিয়ান আর আরবদের শাসনের ফলে বহু ফার্সি আর আরবি শব্দ সরাসরি, অর্ধ-বিকৃত কিংবা বিকৃতভাবে বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে। প্রায় দুশো বছর আগে বাংলা ব্যাকরণ যখন লেখা হচ্ছিল, তখন থেকেই ভাষার নানা বিষয় নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। বিশেষত, ব্যাকরণ প্রণয়ন, বানানরীতি আর বিদেশি শব্দের প্রয়োগের প্রশ্নে। আমাদের প্রস্তাবনা ছিল, বাংলা ভাষার প্রকৃতি অনুসারে ভাষার গঠন ঠিক রাখা। বাংলা ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষা ও উৎপাদন কাঠামোর কাছাকাছি রাখা। যে সব বিদেশি শব্দ সহজে ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে—সেগুলো এখন বাংলা শব্দই বলেই ভাষার স্বতঃস্ফূর্তাকে আমলে নেওয়া।

দ্বিতীয় যে কাজটি করেছি, ‘চাড়ালনামা’ নামে একটা সংকলনের সম্পাদনা। আমাদের দেশের লেখক ও প্রখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ঘরহীন সেই সব মানুষের সাক্ষাৎকার নেন—যারা ভবঘুরে, হিজড়া, গরীব, অসহায় ও নানা অপ্রকৃতিস্থ মানুষ। সাধারণত রাস্তাঘাট, উদ্যান, রেলস্টেশন, খোলা আকাশের নিচে থাকেন তারা। এটায় মূলত এসব ভূখানাঙ্গা মানুষ কীভাবে কথা বলেন, প্রচলিত উৎপাদন ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে থেকে কীভাবে জীবন-যাপন করেন, তার একটা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ খাড়া করা হয়েছে। ভবিষ্যত গবেষকরা যাতে আরও ভালো গবেষণা করতে পারেন, তার জন্য একটি ‘চাড়ালি ভাষার অভিধান’ রচনা করেছি। বাংলায় এটি মুখের ভাষার কাছাকাছি বা কথোপকথনের একটি ধরন।

মোটের ওপর—সমকালীন শিল্পীদের সঙ্গে মেলামেশা আর অসংখ্য প্রদর্শনী দেখার পর আমি শিল্প সমালোচনায় প্রবেশ করি। আমি অনুভব করি—ব্যাপারটা আমার অন্তর্গত আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই আমার কবিতা বিষয়ক শিল্পচিন্তা থেকে চারুকলা বিষয়ে প্রবেশ বলা যায়। তবে কবিতা আর চিত্রকলার সৌন্দর্যের বিষয়টা পারস্পরিক বটে। বেশ ক’বছর আগে আমি প্রথম একটি তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখি বাঙালি ধ্রুপদী শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে, যা আমার শিল্প সমালোচনায় প্রবেশের পথকে প্রশস্ত করেছিল। আমি মনে করি না, কবিতার নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে চিত্রকলার খুব বেশি দূরত্ব আছে। শিল্পের ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম হলেও, এটাতে পারস্পরিক সৌন্দর্যের মেলামেশা আছে বিস্তর।

 

সেমোলিচ: আপনি কি আমাদের কথোপকথনের শেষে বাংলাদেশের সমসাময়িক কবিতা সম্পর্কে কিছুটা বলতে পারেন? এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির পাশাপাশি বাংলাদেশের কবিতার মূলধারার দৃশ্যপটগুলো—এটি কীভাবে সংগঠিত হয়েছিল ইত্যাদি?

টিপু: বাংলাদেশে নানা প্রবণতার কবি ও বিভিন্ন ধরনের কবিতার চর্চা হয়। স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের প্রধান প্রবণতার একটি জাতীয়তাবাদী ধারা, একটি নতুন রাষ্ট্রের উত্তাপ তাতে পাওয়া যায়। আর আরেকটি ক্ষীণ ধারা এর ভেতরে প্রতীকবাদী কবিতা লেখা। ১৯৭০-এর প্রজন্ম পর্যন্ত এই চর্চা চলতে থাকে। আশির কিছু কবি বলতে থাকেন, কবিতা হবে রাজনীতি স্লোগান মুক্ত। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা ১৯৩০ দশকের কবিতার দিকে ফিরে গেছেন। নব্বইয়ে সামরিক শাসকের পতনের পর গণতান্ত্রিক বাতাবরণে নতুন কবিতায় প্রবেশ করে। তারা চেষ্টা করেছেন কবিতাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি রাখতে। তার পরবর্তী কবিদের মধ্যে বেশ কিছু প্রতিভাবান কবি আছেন। তাদের চিহ্নিত করতে আমাদের আরও সময় ব্যয় করতে হবে।

 


Shakhawat Tipu_Proসাখাওয়াত টিপু একজন বাংলাদেশি কবি, প্রাবন্ধিক ও শিল্প সমালোচক।  জন্ম ১৯৭১ সালে, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। ‘এলা হি বরষা’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ আট। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয় ‘রাজার কঙ্কাল’ আর হাইকু সংকলন ‘পাপ পুণ্য’। শিল্প সমালোচনার বই ‘নভেরার রূপ’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। সম্পাদনা করেছেন ‘জাতীয় সাহিত্য’, ‘চাড়ালনামা’ ও ‘আহমদ ছফা: বাছাই জবাব’। বাংলার মতোই তাঁর কবিতা সমাদৃত অপর ভাষায়। স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, গ্রিক, স্লোভেনিয়ান, সার্বিয়ান, ইংরেজিসহ কয়েক এশীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। নিয়মিত লিখছেন দেশি-বিদেশি একাধিক সাহিত্য পত্রিকায়। বর্তমানে ইতালির পোয়েসিয়া ইনভার্সো ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় সদস্য। তিনি তর্ক বাংলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক


Peter Semolic

পিটার সেমোলিচ স্লোভেনিয়ান কবি, লেখক, রেডিও নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। এখন অবধি, তিনি বারোটি স্বতন্ত্র কবিতা সংগ্রহ আর একটি শিশুতোষ উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। দেশ-বিদেশের প্রায় পঞ্চাশটি সংকলনে তাঁর লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেনকো পুরস্কার [১৯৯৭] ও প্রিয়েরেন ফান্ড অ্যাওয়ার্ড [২০০১]। কবিতা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘পোয়েসিস’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। পোয়েসিস কালচারাল অ্যান্ড আর্টিস্টিক সোসাইটিরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুব্লিয়ানায় বসবাস করেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।