শনিবার, এপ্রিল ২৭

আমার ফকিরভাই

0

Startসে রাতে বজ্রসহ বৃষ্টি ছিল। আর কী ঝড়! ঘণ্টা দেড়েকের কালবৈশাখী। মুহূর্তেই যেন সব তছনছ। গাছের ডালাপালা ভেঙে একাকার। উপড়ে গেছে গাছও। বিদ্যুতের খুঁটি আর তার হেলে পড়েছে রাস্তায়। একটা সময় আকাশ শান্ত হয়ে এলেও পুরো এলাকা ছিল বিদ্যুৎহীন। ঝড়ের কবলে পড়ে রাস্তার পাশের একটা দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে বৃষ্টি থেমে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হেঁটে শাহপরান মাজারের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। মাজারের ঠিক সামনেই বিরাটাকার একটি গাছ। গুড়ি ঘেঁষে এক ব্যক্তিকে বসা থাকতে দেখি।

গাছের নিচে একজনকে বসা থাকতে দেখে কাছে যাই। চমকে উঠি— আরে, এ যে ফকিরভাই! দেখি, তাঁর শরীরে জড়ানো চাদর ভিজে জবুথবু হয়ে আছে। অন্ধকারেও আন্দাজ করে নিই—তাঁর লম্বা চুল-দাড়ি বেয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি।

গাছের নিচে একজনকে বসা থাকতে দেখে কাছে যাই। চমকে উঠি— আরে, এ যে ফকিরভাই! দেখি, তাঁর শরীরে জড়ানো চাদর ভিজে জবুথবু হয়ে আছে। অন্ধকারেও আন্দাজ করে নিই—তাঁর লম্বা চুল-দাড়ি বেয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। শত চেষ্টা করেও ফকিরভাইয়ের চাদর শরীর থেকে সরানো সম্ভব হবে না, জানি। রোদ-বৃষ্টি বারোমাসই তিনি চাদর জড়িয়ে রাখেন শরীরে। এরপরও বলি— ‘ফকিরভাই, আপনি ভিজে গেছেন। চাদর চিপে নিন।’ কথায় কাজ দেয়। ফকির ভাই বাধ্য শিশুর মতো চাদর চিপে নিয়ে চুল-দাড়ি-শরীর মুছে আবার গায়ে জড়িয়ে নেন। এরপর বললেন— ‘খিদা লাগছে। কুনতা খাইতাম!’

ফকিরভাইয়ের প্রিয় খাবার মানেই পাউরুটি আর কলা। এর আগেও অনেকবার তাঁকে নিয়ে এমন খাবার খেয়েছি। এমনও হয়েছে, ফকিরভাই আমার বাসায় গিয়েও ভাত-তরকারির বদলে পাউরুটি-কলাই খেতে চেয়েছেন! তখন আমার বাসা ছিল শাহপরান মাজারের ঠিক পাশেই, সিলেট শহরতলির বহর নোয়াগাঁও গ্রামে। একটা ভাড়া বাসার দোতলায় থাকতাম। মাজার বাসার পাশে হওয়ায় অফিস শেষে প্রায়ই রাতের বেলা কারণে-অকারণে যেতাম। তখনই একদিন ফকিরভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। এরপর শাহজালালের মাজার, শাহপরানের মাজারসহ বিভিন্ন উরস-মাহফিলে তাঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে। সবাই তাঁকে ভিক্ষুক হিসেবেই চেনেন, জানেন। তবে কারও কাছে হাত পাতেন না, কেউ কিছু দিলেই কেবল নেন। সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের নানা অঞ্চলের মাজার, উরস আর মাহফিল ঘুরে ঘুরেই তাঁর সময় কাটে। এসব গল্প ফকিরভাই-ই আমাকে শুনিয়েছেন।

ঝড়-তুফানের রাতে ফকিরভাইকে একা মাজারে রেখে যেতে মন চাইল না। বললাম— ‘চলেন ফকিরভাই, আজ আমার বাসাতেই চলেন। সেখানেই গিয়ে খাব।’ ফকিরভাইও এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি আর থিকথিকে কাদা মাড়িয়ে অন্ধকার রাস্তা ধরে ফকিরভাই আর আমি হেঁটে চলি। রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে কিনে নিই—এক লিটারের পানির বোতল, একটা পাউরুটি আর কয়েক হালি কলা।

ফকিরভাইয়ের কণ্ঠ খুবই সুন্দর। সব সময়ে গান গাইতেন না, কালেভদ্রে গাইতেন। বিশেষত শাহজালাল (রহ.) আর শাহপরান (রহ.)-এর উরসের সময়ে বিভিন্ন আসরে বসে গাইতেন। শিতালং শাহ, ইয়াসিন শাহ, ইব্রাহিম তশনা, ভেলা শাহ, সৈয়দ আবদুল লতিফ, আরকুম শাহ, শেখ ভানু— এঁদের গান জানতেন। গাইতেন শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ আর কারি আমীর উদ্দিন আহমদের গানও। ভালো বাঁশিও বাজাতেন। আমাকে তিনি-ই বলেছেন এসব কথা। সে রাতে আমার বাসায় গিয়ে কোনওরকমে বলেকয়ে তাঁর ভেজা পোশাক বদলাতে সম্মতি আদায় করতে পারি। তাঁর হাতে আমারই একটি লুঙ্গি আর টি-শার্ট তুলে দিই। ফকিরভাইয়ের পোশাক বদালানো শেষে পাউরুটি-কলা মুখে পুরতে পুরতে আমরা গল্পে মেতে উঠি। তাঁর বাঁশির সুর শুনে গ্রামের এক তরুণী কীভাবে তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন, সে গল্প শোনান। পরে ওই তরুণীর বিয়ে হয়ে গেলে দেশান্তরী হন তিনি।

প্রেম-ভালোবাসার গল্প বলতে বলতেই একসময়ে ফকিরভাই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিই। বলি— ‘ফকিরভাই, মাওলানা ইয়াসিন শাহের একটা গান শোনান তো!’ কিন্তু ফকিরভাই ইয়াসিন শাহ নয়, শোনান শেখ ভানুর গান—

মন কই যাও রে, কে নিলো ধরিয়া
সোনার পিঞ্জিরা রইল জমিনে পড়িয়া
ও মন কই যাও রে।
মন কই যাও রে, কে নিলো ধরিয়া
সোনার পিঞ্জিরা রইল জমিনে পড়িয়া
ও মন কই যাও রে।

যাইও না যাইও না মন রে নিষ্ঠুর হইয়া
যাইও না যাইও না মন রে নিষ্ঠুর হইয়া
তোর মা জননী কানবে, পিঞ্জিরার পানে চাইয়া রে
ও মন কই যাও রে
ও মন কই যাও রে।

সোনার কটরা রইল, খাইতায় বইয়া দানা
সোনার কটরা রইল, খাইতায় বইয়া দানা
পালংগে পইড়া রইল তোর ফুলেরই বিছানা
ও মন কই যাও রে
ও মন কই যাও রে।

সুন্দরী রমণী হইল আরও আত্মীয় বন্ধুগণ
সুন্দরী রমণী হইল আরও আত্মীয় বন্ধুগণ
কার ঠাঁই সঁপিয়া গেলায় রাজ্য সিংহাসন
ও মন কই যাও রে
ও মন কই যাও রে।

পুত্র হইল সুপণ্ডিত, তোর ভ্রাতা গুণবান
পুত্র হইল সুপণ্ডিত, তোর ভ্রাতা গুণবান
তোর লাগিয়া কান্দিয়া কান্দিয়া গলাইব পাষাণ
অধীন শেখ ভানু বলে, আফসোস হাজার
খালি হাতে যাইতে হবে ছাড়িয়া সংসার
ও মন কই যাও রে
ও মন কই যাও রে।

প্রেম-ভালোবাসার গল্প থেকে হঠাৎ করে কেনই বা এমন ধরনের গান গাইলেন ফকিরভাই, বুঝে উঠতে পারলাম না। গান শেষ করেই উঠে দাঁড়ান তিনি। আর বসতে ইচ্ছুক নন। তাঁর পরনে থাকা শুকনো পোশাকের ওপর আবার ভেজা কাপড়গুলো জড়িয়ে নেন। ‘দাদা, যাই’ বলেই দরজা খুলে হাঁটা শুরু করেন। তখনও বিদ্যুৎহীন ছিল। অন্ধকার রাস্তায় মিলিয়ে যান ফকিরভাই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি চেয়ে থাকি তাঁর চলে যাওয়ার পথে। কিন্তু তাঁকে দেখা যায় না আর! কেবল বাতাসের হু হু শব্দ শোনা যায়।

গান শেষ করেই উঠে দাঁড়ান তিনি। আর বসতে ইচ্ছুক নন। তাঁর পরনে থাকা শুকনো পোশাকের ওপর আবার ভেজা কাপড়গুলো জড়িয়ে নেন। ‘দাদা, যাই’ বলেই দরজা খুলে হাঁটা শুরু করেন।

ফকিরভাই অস্থির স্বভাবের মানুষ। কোথাও একটানা কয়েকদিন থাকতে পারতেন না। এই মাজার থেকে সেই মাজারে ঘুরে বেড়াতেন। কেউ তাঁর আসল নাম জানেন না, ‘ফকিরভাই’— শব্দবন্ধটিই যেন-বা তাঁর পোশাকি নাম হয়ে যায়! মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ানো এক ভিক্ষুকের নাম জানার প্রয়োজনটাই-বা আছে কার? তবে, আমি, কেবল আমিই জানতাম পঞ্চাশোর্ধ্ব ফকিরভাইয়ের আসল নাম আর ধাম। তাঁর নাম জামাল, বাড়ি নেত্রকোনায়। এর বাইরে আর কিছুই জানা হয়নি। কারণ এর বেশি কিছু যে তিনি নিজেই আর গল্প করেননি আমার কাছে!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

লোকায়ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ষাটেরও অধিক। বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে বেরিয়েছে তাঁর বই। লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে দুই বাংলাতেই এখন সুপরিচিত। তাঁর সংগ্রহে আছে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি লোকগান আর লোকনাট্য। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘বাউলের আখড়ায় ফকিরের ডেরায়’, ‘শাহ আবদুল করিম : জীবন ও গান’, ‘বাউলকোষ’, ‘বাংলাদেশের বাউল-ফকির : পরিচিতি ও গান’, ‘বাউলসাধনা, লালন সাঁই ও অন্যান্য’, ‘বেদে-সংগীত’, ‘লোকগান লোকসংস্কৃতি’, ‘লোকায়ত বাংলার পথ ধরে’, ‘গান থেকে গানে’, ‘লোকগানের বিচিত্র ধারা’, ‘লোকায়ত জীবন ও লোকসংস্কৃতি’, ‘বাংলাদেশের বাউল ফকির লোকশিল্পী’, ‘লোকভাবন’ উল্লেখযোগ্য। সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার সুখলাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। পিতা বারীন্দ্রকুমার দাশ, মা যমুনাবালা চৌধুরী। সম্পাদনা করেছেন ‘দইয়ল’ নামে গানের একটি ছোটো কাগজ। ইমেইল : sumankumardash@gmail.com

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।