বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮

প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা : সভ্যতা যেখানে থমকে দাঁড়িয়ে

0

Startএকটা ময়লা ও দুর্গন্ধ বোঝাই উপত্যকা। পাশে ঝিমধরা এক জলকুপ। না আছে স্রোত, না আছে ফুটন্ত পদ্ম বা পানাফুল, বা কোনো সোনালি-রুপালী মাছ। নগরের শ্মশানখলা, উকিলপাড়া, গরুহাট্টাসহ নানা মহল্লা থেকে ফেলা ময়লার ভাগাড় বর্ষায় দগদগে ঘা-এর মতো পেকে-গলে একাকার হয়ে যায়। নর্দমা ঘেষা জলাপাড়ে শ্যাওলা চিটচিটে পাথর কটা পিচ্ছিল থেকে পিচ্ছিলতর হয়। ওখানে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে বা বসে হরিজন পল্লির বউ-ঝিয়েরা কাপড় কাঁচে, ঘরকন্নার কাজ করে। শিশুরা ময়লা শরীরে সাবানের ফেনা ছড়িয়ে ডোবায় লাফিয়ে পড়ে। ময়লা জলে গা ধুইয়ে কুচকুচে কালো শরীর শো শো করে এলোপাথারী ছুটে আর জল ছিটিয়ে খেলা করে। অচ্ছুতের কাছ থেকে গাঁ বাঁচাতে ভদ্রলোকেরা সহজে ওপল্লি মাড়ায় না। ওদের পালিত শুকোর ড্রেনে-ড্রোবায় লুটোপুটি খায়। শুকোরের ভোটকা গন্ধে ভদ্রলোকদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অপারগতায় অনেকে নাকে আঙ্গুল চেপে, ওয়াক থু থু শব্দে কোনোরকম পাশ কাটিয়ে ছুটে মালগুদাম হয়ে কোর্ট স্টেশন, শ্মশানখলা অথবা উকিলপাড়ার দিকে। অথচ এই মানুষগুলো সভ্য মানুষের তৈরি করা ময়লার ভাগাড় দুহাতে পরিস্কার করে, তারমধ্যেই জীবন পাড়ি দিয়ে চলেছে।

হরিজন পল্লির বউ-ঝিয়েরা কাপড় কাঁচে, ঘরকন্নার কাজ করে। শিশুরা ময়লা শরীরে সাবানের ফেনা ছড়িয়ে ডোবায় লাফিয়ে পড়ে।

এত গেল বাহিরানা। ঘরানার চিত্র আরও ভয়ংকর। ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ১০/১২ বর্গফুটের ঘরখানিতে যুগের পর যুগ ধরে কেবল বংশবিস্তারই ঘটেছে, ঘরের আয়তন বাড়েনি। ছোট্ট ঘরে গড়ে ১০ থেকে ১২ জন সম্পর্কের ঘিঞ্জি বাস। বহুবছরের পুরনো বিদ্যুতের সংযোগ, ফুঁটো চাল, ড্রেনের জলে হাটু ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টিউবওয়েল, বাথরুম-ঘেষা টাইমকল। ড্রেনের থকথকে ময়লা জল পেরিয়ে যেখানে পৌঁছতে হয়। তারই পাশে এনজিও অর্থায়নে শিক্ষালয়। প্রকল্প আছে তো সরস্বতী আছে, প্রকল্প নেই তো সরস্বতী উধাও। তুমুল গপ্প, তর্কবিতর্ক, আচমকা চুলোচুলি, দারুর খুঁজে বাঙালিদের আনাগোনা, মধ্যরাতে হঠাৎসঠাৎ পুলিশবাবুদের হানা, ওপারের বাঙালি সুইপারদের সাথে হঠাৎ মল্লযুদ্ধ— এই হলো এঁদের জীবনছবি। অভাব, ক্ষুধা, অজ্ঞতা, অবিচার, অত্যাচার, অসম্মান, অসময়ে বিয়ে-বৈধব্য, কলহ-বহুবিয়েসহ নানা নিপীড়নের সাথে এঁদের সহবাস।

একটু শৈশব পরিভ্রমণ করে আসা যাক। ভোরের আজানের সাথে পড়তে বসার চল ছিল তখন। রাতশেষে মুয়াজ্জিনের মধুময় সুর, আখড়ার ঘন্টাধ্বনির সাথে বারাহাট্টা রোডের প্রশস্ত রাস্তা থেকে ভেসে আসত একলয়ে বাজতে থাকা ঝাড়–র শব্দ। স্মৃতিপটে এখনো ভাসমান, টকটকে লাল-হলুদ-কমলা-সবুজ শাড়িতে ফুলতোলা কুচি আর কাঁধছুঁইয়ে আসা আঁচলের ছড়ানো পেখম। ধূতি-লুঙ্গি-সেন্টুগেঞ্জি পরা জমাদার, কব্জির ভাজে বিশাল লম্বা ঝাড়— কাচুমুচু ভঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়ে অবোধ্য ভাষায় রুটি-হালুয়া চাওয়া, বিনাপানী স্কুলের পিছনের বেঞ্চে আঁটোসাটো হয়ে বসে থাকা শ্যামারঙের মেয়েটি, লছমনের পুকুর থেকে জল তুলে মল পরিষ্কারের পর স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিদিমণিদের প্রণাম ঠুকা, চায়ের দোকানে বসে কোমড়ে গুজে রাখা টিনের মগটা বাড়িয়ে দিলে দোকানীর স্পর্শদোষ বাঁচিয়ে চা ঢেলে দেওয়া। কোনোমতে চায়ের টাকা নিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা! আরো কত কী! স্বভাবতই জিজ্ঞাসা জাগে, এরা কারা? যশবন্ত বাঘেলার ‘ব্যক্তিগত পরিচয়’ কাব্য থেকে কিছু লাইন এখানে উল্লেখ্য— ‘এই মাথাটা শম্বুকের, হাত দুটো একলব্যর, এই হৃদয় কবীরের… কিন্তু এই পা দুটো অস্পৃশ্য এখনো।’

সনাতন ধর্মের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঋগবেদের প্রথম দিকের শ্লোকে ‘ক্ষত্র’ বা অভিজাত এবং ‘বিশ’ বা সাধারণ মানুষ এই দুই শ্রেণির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। পুরুষসূক্তের দশম মণ্ডলের অর্ন্তভূক্ত অধ্যায়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার বর্ণের উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। পুরুষসূক্তের শ্লোকে বলা হয়েছে যে, আদি পুরুষ ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শূদ্রের জন্ম। বর্ণাশ্রম অনুসারে ব্রাহ্মণ জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিক্ষা ও চিন্তা শক্তিতে পূর্ণ। ক্ষত্রিয় শোর্য-বীর্যে পূর্ণ। বৈশ্য ব্যবসা ও অর্থ সংগ্রহে উৎসাহী আর শূদ্র স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন যাদের কাজ উপরের তিন সম্প্রদায়ের সেবা শ্মশ্রুষা করা। তারা শুধু কায়িক পরিশ্রমের উপযুক্ত, সীমিত চিন্তার বাইরে কোনো কাজ করতে পারে না।

বর্ণপ্রথা এমনই এক বিষয় যা সামাজিকভাবে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। তাই যারা উচ্চ বর্ণে জন্মগ্রহণ করেছে তারা সম্মানিত আর যারা নিচু বর্ণে জন্মগ্রহণ করেছে তারা লাঞ্চিত, অবহেলিত। যেহেতু বর্ণভেদ মতে শূদ্রই সবচেয়ে নিচু, তাই নিচুকূলে জন্মগ্রহণ করায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সকল দিক থেকে তারা অবহেলা বঞ্চনার শিকার। ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র হাত মিলিয়ে নিম্নতম শ্রেণী অর্থাৎ শূদ্রকে প্রথমে মানসিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দাসত্বে বন্দি করল, পরে তাঁরা অস্পৃশ্যতার নাগপাশে বাঁধা পড়লেন। অস্পৃশ্যদের জীবন যাপন ছিল লজ্জাজনক। তাঁদের যেমন চাষাবাদের জমি ছিল না, তেমন তাঁদের কোন নির্দিষ্ট পেশাও ছিল না। রোদ হোক, বৃষ্টি হোক তাঁরা উচ্চ শ্রেণীর হুকুমমত কায়িক শ্রম করতেন। অন্তহীন শ্রমের বিনিময়ে তাঁরা পেতেন পশুর মত ব্যবহার। গ্রামের বাইরে একপ্রান্তে পৃথকভাবে তাঁদের বসবাস করতে হত এবং উচ্চ শ্রেণীর মানুষের পরিত্যক্ত দ্রব্য গ্রহণ করতে হত। তাদের ছোঁয়া লাগলে এমনকি ছায়া মাড়ালে উচ্চ শ্রেণীর স্পর্শদোষ ঘটত।’

শূদ্র্রদের একটি অংশ উচ্চ বর্ণের হুকুমমতে মৃত মানুষ পোড়ানো, মৃত পশু অপসারণ, গ্রামের পাটিলের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি নিম্ন শ্রেণির কাজ করতে করতে কালক্রমে আলাদা সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে পড়ে। পেশার কারণে তারা হয়ে যায় অতিঃশূদ্র্র্র। তাদের থুথু যেন মাটিতে না পড়ে সেজন্য গলায় মাটির পাত্র বাঁধতে হতো। জুতা পরার অধিকার তো ছিলই না বরং পায়ের ছাপ যেন রাস্তায় না থাকে সেজন্য পিঠে বেঁধে রাখতে হতো লম্বা ঝাঁড়—। এমনকি তৃষ্ণার জলের জন্যেও তাদের নির্ভর করতে হতো উচ্চ বর্ণের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর। ১৯২৭ সালের ১৯ মার্চ মাহাড় এর চাভাদর সরোবরে জল আনতে গেলে বর্ণ হিন্দুরা দলিতদের আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের প্রতিবাদে ভিমরাও আম্বেদকারের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর এক জনসভা ডাকা হয়। দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেখানে তিনি এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেন ‘ভদ্রমোহদয়গণ, আপনারা ভাববেন না যে, সত্যাগ্রহ সমিতি শুধুমাত্র চাভাদর লেকের জলপান করার জন্যই আপনাদের ডেকে এনেছে। এমন নয় যে, চাভাদর লেকের জল খেলেই আমরা অমর হয়ে যাব। আমরা এই জল না খেয়েই খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকেতে পারব। আমরা লেকের জল পান করার জন্য সেখানে যাচ্ছি না। আমরা সেখানে যাচ্ছি এটাই প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে, আমরা অন্যদের মতোই মানুষ।’

‘ভদ্রমোহদয়গণ, আপনারা ভাববেন না যে, সত্যাগ্রহ সমিতি শুধুমাত্র চাভাদর লেকের জলপান করার জন্যই আপনাদের ডেকে এনেছে। এমন নয় যে, চাভাদর লেকের জল খেলেই আমরা অমর হয়ে যাব। আমরা এই জল না খেয়েই খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকেতে পারব। আমরা লেকের জল পান করার জন্য সেখানে যাচ্ছি না। আমরা সেখানে যাচ্ছি এটাই প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে, আমরা অন্যদের মতোই মানুষ।’

আনুমানিক আঠারো শতকের প্রথমদিকে ১৭০৬-১৭১০ এর মধ্যে ভারত উপমহাদেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে আগমণ ঘটে হরিজনদের। একদিকে অভাব অন্যদিকে উচ্চবর্ণের নিপিড়ণ নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে এ জনগোষ্ঠী বাঁচার নানা পথ খুঁজছিল। এ অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তৎকালীন জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের নানা প্রলোভন ও প্ররোচনায় হরিজনরাও দেশত্যাগে উৎসাহী হয়ে উঠে। এ বঙ্গে পা বাড়ায়। নগরায়ন তাদের হাতে তুলে দেয় ময়লার ঝাড়—। বাংলাদেশের এমন কোনো শহর নেই যেখানে হরিজন নেই। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার কাছে এরা শুধুই মেথর। মেথর ছাড়াও নিম্নবর্ণের এই জাতিসত্তাকে হরিজন, দলিত, অস্পৃশ্য, অচ্ছুত ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশে বসবাসরত হরিজনরা পেশাগত দিক দিয়ে পরস্পর সর্ম্পকযুক্ত হলেও তাদের মধ্যে উঁচু নিচু ভেদাভেদ লক্ষণীয়। তাদের ভাষায় এক একটি গোত্র থেকেই তাদের নামাকরণ করা হয়েছে। গোত্র বিভাজনে যেসকল নাম পাওয়া যায়— বাসফোর, হেলা, হারি, ডোম, বাগদি, ডোমার, তেলেগু, রাউত, লালবেগি, বাল্মিকী, টাঁক, রবিদাস ইত্যাদি। এদের মধ্যে তেলেগু, রবিদাসদের নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এ সম্প্রদায়ের অনেক গোত্র আবার বৃহৎ গোত্রের সাথে সংকরায়িত হয়ে বিলুপ্তির পথে। হরিজনদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ বা সম্বল হলো, সুইপারের চাকরি। দীর্ঘকাল ময়লা আর্বজনা পরিষ্কারের পেশায় নিয়জিত হরিজনরা মনে করে সুইপিং তাদের পৈর্তৃক পেশা। বর্তমানে এই জনগোষ্ঠী পেশার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশে বসবাসকারী হরিজনদের মধ্যে এঁরা সংখ্যাধিক্য। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে হরিজন পল্লিতে বাসফোরদের অবস্থান রয়েছে। নেত্রকোণা জেলার গরুহাট্টা সংলগ্ন হরিজন পল্লীর সকলেই বাসফোর। বাসফোরদের আদি নিবাস ভারতের বিহার, কানপুর, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশে। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, বিহারের গোরখ ও ছাপড়া জেলায় এঁরা সংখ্যাধিক্য। ধারণা করা হয়, ১৮১০ থেকে ১৮৮৯ সালের দিকে দূর্ভিক্ষের শিকার হয়ে পূর্ববঙ্গে চলে আসে বাসফোর পূর্ব পুরুষের একটি বিরাট অংশ। ভারতবর্ষে শূদ্রবর্ণের যে সম্প্রদায় বা গোত্র বাঁশ বা বেতের কাজ করত তাদেরকেই বাসফোর বলা হতো। মূলত বাঁশ ফোঁরে যে শ্রেণিটা জীবীকা নির্বাহ করত তারাই বাসফোর। কালের বিবর্তনে শৈল্পিকতা ভুলে মেথর বনে গেলেও এদের আদি পেশা ছিল টুকরী বানানো। বাংলাদেশে বাসফোরদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখের উপরে। লাকসাম, সান্তাহার, যশোর, কুমিল্লা, টঙ্গি, কুষ্টিয়া, পাবনা, খুলনা, যশোর, সৈয়দপুর, বগুড়ায় তাদের বড়ো পল্লি রয়েছে। পারিবারিকভাবে ভোজপুরী ভাষায় কথা বলে তাই ধারনা করা হয় বাঁশফোড়দের আদিভাষা নাগরী। উল্লেখযোগ্য পূজার মধ্যে কালীপূজা, শীতলাপূজা, ছটপূজা, দোলপূজা। বাসফোর ছাড়াও নেত্রকোণায় ডোম শ্রেণি রয়েছে যারা লাশ টানা, কাটা ও অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার কাজ করে। এ এক বঞ্চনা আর তাচ্ছিল্যের জীবন।

ঠারে ঠারে ভোট লেইকে চল গেয়ি। হামলোগকে চেরম্যান ভুল গেয়া। ভোট লেনে আকে বোলাথা, কল বাইঠা দেবে, পানিকা অভাব না রাইয়া, যে লোগকো নকরী নেইকা, ওসকো নকরী দেওকা বেকার কোই না গুরি। পাস কারকা বাবুকো চেহারা নেই দেখা, ভুল গেয়ি।

ভিন্নভাষী এ জনগোষ্ঠীর কথা শুধু চেয়ারম্যান নয় সকল ধর্মের, সকল শ্রেণির মানুষ ভুলে যেতে চায়। কী মানুষ, কী ঈশ্বর সকলের কাছেই এঁরা অস্পৃশ্যজন। যুগের পর যুগ ধরে কত নদীর গতি পরিবর্তন হয়ে গেল, কত নদী গতি হারালো, কত নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল কিন্তু হরিজনদের জীবনধারায় বড়োবেশি একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। একালেও তারা ভদ্র বসতি এলাকায় জায়গায় কিনতে পারে না, ভদ্রলোকদের সাথে চলতে পারে না, তাদের ঘরের ভিতর ঢুকতে পারে না, একই পুকুরে স্নান করতে গেলে গোল বাঁধে, একই কল থেকে জল খেতে পারে না। যারা শিক্ষা ও সচেনতার আলোমেখে পৈতৃক পেশা থেকে বের হতে পেরেছে তাদের জীবন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্ত অস্পৃশ্যতার গ্লানি থেকে মুক্তি মেলেনি। সকলেই প্রয়োজনহীন ওমুখো হতে ভয় পায়। ঘাবড়ে যায় এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চোহদ্দিতে প্রবেশকরণে। একবার দলিত সাহিত্য পাঠকালে কেশব মেশরামের একটি কবিতা প্রাণে রেখাপাত করেছিল, ‘আমাদের মহল্লায়’:

‘আমাদের মহল্লায় ঢুকে ডাকপিওনেরা ঘাবড়ে যায়
সবকিছু পড়াশুনোও ঘুলিয়ে যায়
সভ্যতা এখানে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে
এমনকি—সূর্যও এখানে কালো হয়ে যায়।
কাদার ওপরে গোরু-বাছুরের পায়ের ছাপের মতো
আমাদের বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকে।’

কালের বির্বতনে ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছে, আমরা দাবী করি মানুষ জাতপাতের গণ্ডি থেকে বের হয়ে এসেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগেও যাদের বসবাস শতাব্দীকাল আগের সেই খুপরী ঘরে, যাদের কাজের স্বীকৃতি নেই, পল্লীতে নিজেদের মতো ঈশ্বরের মন্দির তৈরি করে পুরোহিত ছাড়াই পূজা করতে হয়, নেই ন্যায্য মজুরী, যাদের বাঁচার তাগিদে বাড়তি আয়ের উৎস দারু (চোলাই মদ), ক্ষুধা,দারিদ্র, অস্বাস্থ্য-অশিক্ষা নিত্যদিনের সঙ্গী তারা সাহিত্য রচনার উপাদেয় বটে কিন্তু সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় যে কত কঠিন তা গান্ধীজী, মহাত্মা ফুলে ও আম্বেদকারের কর্মকাণ্ড থেকে সুস্পষ্ট। এই মেথররা যদি একদিনও কাজ বন্ধ রাখে তাহলে সভ্য সমাজের বসবাসের স্থান প্রতিটি শহর বন্দর নগর ময়লার ভাগারে পরিণত হবে। অথচ এই কাজটির কারণেই ভদ্র সমাজ চিরপরিশ্রমী এ জনগোষ্ঠীকে সমাজে আস্তাকুড়েঁ করে রেখেছে, রেখেছে সমাজের এক প্রান্তে। ভিমরাও আম্বেদকর এই চরম সত্য উপলব্ধি করে বলেছিলেন—

ধনবৈষম্য বুঝা যায় এবং বুঝানো যায়
কিন্তু বর্ণবৈষম্যের স্বরূপ অনুভবের ব্যাপার
প্রথমটা আঘাত করে প্রাণে, পরেরটা অঘাত করে মনে।
They have nothing, they are nothing.


ফুটনোট

১. ছদ্মনাম
২. দলিত, সংকলন ও সম্পাদনা দেবেশ রায়, পৃষ্ঠা: ৩৭
৩. প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা, জয়শ্রী সরকার, পৃষ্ঠা: ২৪
৪. সংলাপ, নাটক বাসফোর, রচনা ও নির্দেশনা রাজন তালুকদার, উদীচী নেত্রকোনা জেলা সংসদ প্রযোজনা, ২০০৭।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

ভরা বাদলে নেত্রকোণা জেলার মগড়া নদীর পাড়ে জন্ম। তারিখটি ছিল ১১ আষাঢ়। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে মেজো। সমাজকর্মে  স্নাতোকোত্তোর। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। গবেষক ও কথাসাহিত্যিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : গবেষণা : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক্সট্রা অভিনেত্রী, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, তথ্য মন্ত্রণালয়। প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা, জুন, ২০১২, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন। ছোটোগল্প : ফিরে আয় মাটির পুতুল, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬, চিত্রা প্রকাশনী। উপন্যাস: অম্বা আখ্যান, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন। (জলসিঁড়ি কথা সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত), কবিতার বই : শূন্যাতা, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৬, বইপত্র গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।