শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

লাল সালুতে মোড়া সাদা ঘোড়া ও চা পানের বিজ্ঞাপন

0

Startরোদ উঠতেই ফলালিনের বাহারে শার্টের উপর হাতকাটা সুয়েটারটি পরে শোল্ডারব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন শরীফুল হাসান। রেসিডেনসিয়েল সেন্টারের বাগানটির আধখানা জুড়ে পুকুর। তার বাঁধানো ঘাটে বসে দুটি সহকর্মী মেয়ে। এরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফিল্ড ওয়ার্কার। আজ শুক্রবারের ছুটি, তাই কারো কাজ-বাজের কোনো তাড়া নেই। সচিত্র সন্ধানীতে কোনো কিছুর ছবি দেখে মেয়েগুলো খিলখিলিয়ে পরষ্পরের গায়ে এলিয়ে পড়ছে। আড়চোখে তারা গমনোদ্যত শরীফকে দেখে নেয়, কিন্তু কিছু বলে না। এদের সাথে মিলেঝুলে মাঠ পর্যায়ে বছর দুয়েক হলো কাজ করছেন শরীফ, তবে বন্ধুত্বের সাবলীল সম্পর্কটি গড়ে ওঠেনি। পুকুরের পরিসর পেরোতেই দেখতে পান, সেন্টারের বারান্দায় বেতের চেয়ারে আয়েশ করে বসে তার চার পুরুষ সহকর্মী ব্রিজ খেলছে। সেন্টার ম্যানেজার তরুণটি তাস ডিল করতে করতে চশমার ফাঁকে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শরীফ ভাই, টাউনের দিকে মেলা দিলেন…আজকের হরতালে গণ্ডগোল হইবো তো…।’ শরীফ চলতে চলতে দায়সারাভাবে জবাব দেন, ‘মেলা কাজ আছে, টাউনে একবার যাওন লাগে যে।’ ম্যানেজার কিছু বলে না, সে নির্লিপ্তভাবে মুখ ফিরিয়ে কার্ড বাটাতে হাত লাগায়।

একটি আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংস্থার ফিল্ড স্টেশন মোল্লারগাঁও এর রেসিডেনসিয়েল সেন্টারে বাস করছে শরীফ ছাড়া আরো ছয়জন সহকর্মী, দুজন নারী ও চার জন পুরুষ ফিল্ড ওয়ার্কার। এদের সাথে পুরো সপ্তাহ জুড়ে শরীফ নানা গ্রামে সঞ্চয় ও ঋণদান কর্মসূচীতে কাজ করেন। সন্ধ্যার পরও তাদের মেলা কাজ থাকে, খেলাপি ঋণ আদায়ের তাগাদায় যেতে হয় ঘরে ঘরে। কাজকর্মের সুবিধার জন্য সাহায্যকারী সংস্থা ফ্রি বাসস্থান ও খাবারের যোগান দিচ্ছে, বিনিময়ে সন্ধ্যার পরও পেপার-ওয়ার্ক করতে হয়। তাই তাদের ব্যক্তিগত কাজে শহরে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

কিন্তু মাঝরাতে হামেশা দুঃস্বপ্ন দেখে হল্লা-চিৎকার ও কান্নাকাটি করার স্বভাবের ফলে তার রুমমেট কমপ্লেন করতে থাকে। উপরন্তু স্বপ্নের ঘোরে মাঝেসাঝে তিনি হাঁটাচলা শুরু করলে ম্যানেজার তাকে কামরা থেকে সরিয়ে দেয়। সেন্টারের পেছন দিকের স্টোররুমটি সাফসুরতা করে তাকে দেয়া হয়।

শরীফ টিম ওয়ার্কের প্রেরণায় পুরো সপ্তাহ জুড়ে সহকর্মীদের সাথে একত্রে কাজ করেন, কিন্তু আজ অব্দি তাদের বন্ধু হয়ে ওঠেননি। এর প্রধান কারণ বোধ করি তার বয়স, গড়পড়তা সহকর্মীদের চেয়ে তিনি বারো কিংবা চৌদ্ধ বছরের ব্যবধানে বয়োজেষ্ঠ্য। অবসরে তাস পিটানোতে আগ্রহ বোধ করেন না, রাতে রেডিওটি ঘিরে গোল হয়ে বসে বিবিসি কিংবা ভয়েস অব আমেরিকা শুনে স্বদেশ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ নিয়ে জোর বিতর্ক করতেও উৎসাহ পান না। আড্ডাবিমুখ স্বভাব তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এ ছাড়া আরেকটি শরীরিক সমস্যার কারণে তিনি সহকর্মী সমাজ থেকে সরে গেছেন বেশ দূরে। রেসিডেনসিয়েল সেন্টারে ছেলে ও মেয়েরা দু’জন-দু’জন করে একটি কামরা ও এটাচড্ বাথরুম শেয়ার করে থাকে। শুধু ম্যানেজার সিঙ্গেল রুমে বসবাসের ফেসিলিটি পায়। তো চাকুরির শুরুতে তিনি আরেকটি পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে একই কামরা শেয়ার করে দিনযাপন করছিলেন। কিন্তু মাঝরাতে হামেশা দুঃস্বপ্ন দেখে হল্লা-চিৎকার ও কান্নাকাটি করার স্বভাবের ফলে তার রুমমেট কমপ্লেন করতে থাকে। উপরন্তু স্বপ্নের ঘোরে মাঝেসাঝে তিনি হাঁটাচলা শুরু করলে ম্যানেজার তাকে কামরা থেকে সরিয়ে দেয়। সেন্টারের পেছন দিকের স্টোররুমটি সাফসুরতা করে তাকে দেয়া হয়। এ কামরাতে একাকী বসবাসের কল্যাণে তার লেখালেখিতে ব্যাপক সুবিধা হয়েছে বটে, কিন্তু এতে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়েছেন আরও বিঘতভাবে।

প্যাকেটের শেষ সিগ্রেটটি ধরিয়ে শরীফ রাজআইল ধরে দ্রুত গোয়ালঘাটের দিকে হাঁটেন। ওখান থেকে শেয়ারে টেম্পো পাকড়ে সিলেট শহরে যাবেন। পুরো সপ্তা তুলনামূলকভাবে তরুণদের চেয়ে অনেক বেশি খাটেন তিনি। কোনো কাজ একবারে গোছাতে না পারলে, মাথা বেঁধে লেগে থেকে বার বার চেষ্টা করে তা সম্পন্ন করেন। তার কোনো ঘরসংসার নেই, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে কোনো চিঠিপত্র পান না, কেউ তাকে দাওয়াত জিয়াফতেও ডাকে না। তো নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ছন্নের মতো শনি থেকে বৃহস্পতিবার অব্দি তিনি খাটেন। তবে শুক্রবারে ছুটির ফ্রিডমটা পুরোমাত্রায় কাজে লাগান। ওই দিন শরীফ সুন্দর জামা-কাপড় পরেন, শেভ করে, কাজের কাকুন ছিড়ে প্রজাপতিটি হয়ে, ফুরফরে মেজাজে রওনা দেন সিলেট টাউনের দিকে। কখনোসখনো তার সহকর্মীরা চাঁদা তুলে টাউন থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসে ভিসিআর ও হিন্দি ফিল্মের ভিডিও ক্যাসেট। সাথে চিকেন রোস্ট ও কইমাছের পিকনিক জাতীয় ভোজেরও আয়োজন হয়। কিন্তু তাকে বলে-কয়েও কোনোভাবে সেন্টারে ধরে রাখা যায় না। ডিম ফুটে বেরিয়ে আসা ছানাটির মতো অস্থির হয়ে তিনি শুক্রবারে শহরের দিকে মেলা দেন।

সেন্টারে বেশ রাত করে নিরিবিলিতে ফিচার লিখতে বসেন শরীফ। শুক্রবারে সচরাচর তিনি সিলেট শহরের নানা জায়গায় যথাযথ তথ্যের তালাশে ঘুরপাক করেন। কোনো বিষয়বস্তু মনে ধরলে সস্তা ক্যামেরায় তুলে নেন তার একাধিক আলোকচিত্র। তারপর রাতে লন্ঠনের টিমটিমে আলোয় ফুলস্কেপ কাগজের নিচে কার্বন রেখে টানা হাতে লিখেন উদ্দিষ্ট ফিচারটি। পরবর্তী শুক্রবারে শহরের পোস্টাফিস থেকে তা মেইল করেন কোনো না কোনো পত্রিকায়। এ ফিচার লেখার ব্যাপারটি অবসেশনের মতো, না লিখে শরীফ শান্তি পান না। তার রচিত অধিকাংশ ফিচারই প্রকাশিত হয় না। তবে কিছু কিছু ফিচার ছেপে যায় কাকতালীয়ভাবে। যেমন, মাস কয়েক আগে তিনি চান্নিঘাটের আলী আমজদের ঘড়িঘর নিয়ে একটি ফিচার তৈরি করেছিলেন। ঘড়িঘরটির সাথে প্রখ্যাত জমিদার আলী আমজদ খানের নাম যুক্ত হলেও তা তাঁর আমলে তৈরি হয়নি। তাঁর পিতা মৌলভী আলী আহমদ খান ঘড়িঘরটি পুত্র আলী আমজদের জন্মের দুই বৎসর আগে নির্মাণ করিয়েছিলেন। বোধ করি নতুন এ তথ্যের জন্য ফিচারটি ছাপা হয় স্থানীয় একটি পত্রিকায়। সাথে ভিন্ন ভিন্ন এঙ্গেল থেকে তার তোলা তিনটি ফটোগ্রাফস্। পরবর্তীতে সাহস করে তিনি একটি ফিচার জাতীয় দৈনিকে পাঠান। বিষয়বস্তু ছিল, সিলেট শহরের আম্বরখানায় প্রাপ্ত একটি শিলালিপি, যা পাঠ করে পাওয়া যায়, এয়োদশ শতকে অত্র এলাকায় হজরত শাহ জালাল (রঃ) এর আগমনের সংবাদ। আজও তার শোল্ডারব্যাগে আছে সিলেটের কিন ব্রীজ নিয়ে লেখা আরেকটি ফিচার। এ ফিচারের প্রসঙ্গিক ছবিগুলো গেল সপ্তায় শরীফ ডেভেলপ করার জন্য একটি স্টুডিওতে দিয়েছিলেন। আজকে স্টুডিও থেকে তা ডেলিভারি নিয়ে ডাকে ফিচারটি পত্রিকায় পাঠাবেন। নতুন এক রোল ফিল্ম কেনাও দরকার। শহরে তার কাজ অনেক, তাই শরীফ হাঁটার গতি বাড়ান।

হাঁটতে হাঁটতে স্পন্জের স্যান্ডেল ফুঁড়ে পায়ে কাঁটা ফোটার মতো— দিন দুয়েক আগের একটি নেগেটিভ অভিজ্ঞতা তাকে পীড়া দেয়। মাঠ-পর্যায়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও চাকুরির পারফরমেন্স ইভালুয়েশনে তিনি সফলভাবে উতরাননি, তাই বঞ্চিত হয়েছেন স্যালারির ইনক্রিমেন্ট থেকে। নেগেটিভ অভিজ্ঞতা তার জীবনে আগেও ঘটেছে একাধিকবার। তরুণ বয়সে তিনি মিলিটারির কমিশন রেঙ্কে রিক্রুট হয়েছিলেন। কিন্তু ট্রেনিং এর স্ট্রেস নিতে পারছিলেন না। উপরন্তু, ঘুমের ঘোরে একাকী হাঁটা ও দুঃস্বপ্নজনিত চিল্লা-চিৎকারের জন্য শিকার হচ্ছিলেন ক্রমাগত কঠোর পানিসমেন্টের। আর্মির ট্রেনিং ফেসিলিটি থেকে পালিয়ে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নসীব মন্দ, পলাতকাবস্থায় ধরা পড়ে তাকে মাস ছয়েক জেল খাটতে হয়েছিল।

এ ঘটনার বছর কয়েক পরের কথা। তার জননী তখনো জীবিত আছেন। তার উদ্যোগে কুটুমখেশদের মাধ্যমে তিনি বিবাহিত হয়েছিলেন বিলাতে অভিবাসি হওয়া এক পরিবারের কন্যার সঙ্গে। মেয়েটি আধভাঙ্গা বাংলায় কথা বলত, কখনো বা কামরার দরোজা-জানালা বন্ধ করে জোরে স্টিরিও বাজিয়ে ড্যান্স করত। তার সাথে রুচির প্রচুর প্রভেদ থাকলেও মেয়েটিকে তিনি ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার দুঃস্বপ্নজনিত স্বভাবের সাথে সে এডজাস্ট করতে পারল না। জোর করে তাকে ঢাকায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেল। চিকিৎসায় কোনো সুফল পাওয়া না গেলে, মেয়েটি নানা রকমের পারিবারিক ঝুটঝামেলার মধ্যে ক্রমাগত কাজিয়া বিবাদ করতে করতে, অবশেষে ডিভোর্স নিয়ে বিলেতে ফিরে যায়।

এ সব অভিজ্ঞতার কারণে বোধ করি শরীফের মধ্যে জন্ম নিয়েছে ক্রনিক বিষণ্নতার। সামাজিকভাবে তিনি তেমন স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। একলা চলাই তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার দিনযাপনে অনেক বছর হয় পজেটিভ কিছু ঘটছে না, তবে তিনি ফিচার লেখাটাকে কানা-অন্ধল ভিখারির লাঠিটির মতো আঁকড়ে আছেন। একটি ফিচার কোথাও মুদ্রিত হলে, বিষণ্নতার কালশিটে স্যাঁতসেঁতে জমিন ফুঁড়ে যেন গজায় শুভ্র ছত্রাক। কিন ব্রীজ নিয়ে লেখা ফিচারটি সম্পর্কে তিনি আশাবাদী। হরতালের সময় মাঝেমধ্যে পোস্টাফিস খোলা থাকে। ব্যাকডোর দিয়ে আলগোছে স্টুডিওতে ঢুকে ছবিগুলো ডেলিভারি নিয়ে হয়তো আজই ফিচারটি মেইল করা যাবে।

ভদ্রলোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে এক দিনের পুরানো ইত্তেফাক পত্রিকাটি তার হাতে তুলে দেন। প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি দিয়ে ছাপা হয়েছে নূর হোসেন নামে এক তরুণের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার সংবাদ। মৃত্যুর সময় মানুষটির বুকে ধবধবে সাদা কালিতে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক।’

লাগাতার হরতাল হলেও সড়কে একটি দুটি রিক্সা ও বেবিট্যাক্সি চলছে। শেয়ারে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে একটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে শরীফ সিলেট শহরের দিকে রওনা হন। চৌহাট্টার কাছে রোডব্লকে থামতে হয়। একটি খণ্ড মিছিল এদিকে আসছে। লাঠি ও টিয়ারগ্যাসের শেল নিয়ে ঢালওয়ালা পুলিশরা রোডব্লকের কাছে ওত পেতে আছে। নেমে পড়ে একটি ফার্মেসির বারান্দায় দাঁড়ান শরীফ। তখন দেখা হয়, মুখচেনা আরেক সাহায্যকারী সংস্থার কর্মীর সঙ্গে। ভদ্রলোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে এক দিনের পুরানো ইত্তেফাক পত্রিকাটি তার হাতে তুলে দেন। প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি দিয়ে ছাপা হয়েছে নূর হোসেন নামে এক তরুণের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার সংবাদ। মৃত্যুর সময় মানুষটির বুকে ধবধবে সাদা কালিতে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক।’ বড়ো খিন্ন লাগে। অনেক দিন হলো জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলছে। মোল্লারগাঁও-এ রাজনৈতিক খবরাদি জানার একমাত্র উপায় বিবিসি শোনা। শরীফ তা শোনেন না, দেশ কোন পথে চলছে, এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল না থাকার জন্য খারাপ লাগে। অজানা এ যুবকটির নাহকভাবে খুন হওয়াতেও তিনি ব্যথিত হন। কাছেই একটি টিয়ারগ্যাসের শেল বিষ্ফোরিত হয়। দৌড়ে পেছন ফিরে ঢিল-পাটকেল ছোড়া মানুষজনের সাথে তিনি ছুট লাগিয়ে ঢুকে পড়েন গলিতে।

না, হরতালের হট্টগোলে স্টুডিও কিংবা পোস্টাফিস কোথাও যাওয়া হয় না শরীফের। পুলিশের ধাওয়ায় ছুটতে ছুটতে, উষ্টাবিষ্টা খেয়ে দৌড়ে কোনোক্রমে বেরিয়ে আসেন শহর থেকে। তারপর খানিকটা পথ রিক্সায়, বাকি মাইল তিনেক হেঁটে ফিরে আসেন গোয়ালঘাটে। ভারি পেরেশান লাগে। তৃষ্ণাও পেয়েছে। সড়কের পাশে মাথায় গামছা বাঁধা এক লোক বিক্রি করছে তালের রস। দাঁড়িয়ে পড়ে পরপর দুই গ্লাস খেয়ে তার জান একটু তর হয়। তখন রওনা দেন মোল্লাগাঁও-এ ফিরে যাওয়ার রাজআইলের দিকে।

অন্যমনষ্ক হয়ে দ্রুত হাঁটছিলেন শরীফ। হঠাৎ করে খেয়াল হয়— পায়ের নিচে রাজআইলটি কোথায়? তিনি যে খালেরমুখ নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য বাঁধানো পাড় ধরে হাঁটছেন, তা দেখে ভারি তাজ্জব হন! ইতিপূর্বেও তিনি বার কয়েক আউরি লেগে, পথের নিশানায় তালগোল পাকিয়ে, যে গ্রামে যাওয়ার কথা সেখানে না গিয়ে অন্য গ্রামে গিয়ে হাজির হয়েছেন। নিজের এ আত্মভোলা আচরণে ব্যাপকভাবে শরমিন্দা হয়ে শরীফ চারদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হন, না তার সহকর্মীদের কেউ এদিকের ত্রিসীমানায় কোথাও নেই। রাজআইলে অনেকটা পথ হেঁটে ফিরে যাওয়াটা একটু ঝকমারি হবে, তবে অসুবিধা কিছু নেই। নদীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটেও সেন্টারে ফেরা যায়। ঘুরপথে মিনিট পয়তাল্লিশ একটু বেশি হাঁটতে হবে— এই যা। নদীর মৃদূমন্দ হাওয়ায় তার ক্লান্ত শরীরটি জুড়ায়। চলমান পানির দিকে ঝুঁকে পড়া একটি গাছের ডালে বসে কালোয় তীব্র হলুদ পালকের ইষ্টকুটুম পাখিটি বেজায় আর্তি নিয়ে ডেকে যাচ্ছে। জলে পড়েছে তার ডালসহ ছায়া, স্রোতে প্রতিবিম্বটি ভেঙেচুরে ছত্রখান হচ্ছে । দৃশ্যটির মাঝে আছে এক ধরনের উদাস বিভ্রম। আরও নিবিড়ভাবে ইমেজটি অবলোকনের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন শরীফ।

তখনই জল বিষ্ফোরিত করে মাথা তুলে হু-উ-উ শব্দে শ্বাস ফেলে একটি শুশুক। ভারি আজব তো! যতটা জানেন, এদিককার নদীনালায় শুশুক চরে বেড়াত আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে। শুশুক যে নদীপ্রিয় ডলফিনের একটি প্রজাতি, তা জেনেছেন শরীফ পত্রিকা পড়ে। মাস দেড়েক আগেই তো তিনি পত্রিকায় পড়লেন—এদিককার নদীনালা থেকে শুশুকের বিলুপ্তির সংবাদ। তারা যে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে, বোধ করি তা প্রমাণ করার জন্য একসাথে লাফিয়ে ওঠে জোড়া শুশুক। তাদের পেছন পেছন ছোট্ট দুটি শিশু-শুশুক। জলচর পরিবারটি শ্বাসপ্রশ্বাসের তীব্র শব্দে জল আউলামাড়া করে ভাটির দিকে ভেসে যায়। ফের পা চালাতে গিয়ে শরীফের ভীষণ হতাশ লাগে। এক রোল ফিল্ম জোগাড় করতে পারলে, ফটাফট ভাসমান শুশুকের গোটা সাতেক ছবি তুলে, তাদের খালেরমুখ নদীতে ফিরে আসার সংবাদকে ভিত্তি করে তৈরি করতে পারতেন একটি ফিচার। যাক, কী আর করা যাবে। আবার জোরে হাঁটেন শরীফ।

রায়বাবু সফেদ একটি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরপাক করতেন। তার দাঁব-রোয়াবে সবাই তটস্থ থাকত। তিনি কদমতলীর মাঠে ফি-বছর আয়োজন করতেন ঘৌড়দৌড়ের। কিন্তু এসব তো পার্টিশনের আগে ব্রিটিশ আমলের কথা।

সেন্টারে যাওয়ার পথে পড়ে ধানী জমিনের বিশাল একটি প্রান্তর। পরিসরটি কদমতলীর মাঠ নামে পরিচিত। ওখানে জমায়েত হয়েছে প্রচুর মানুষজন। ঢোলকে চাটি পড়ছে। বাদ্যবাজনায় সরগরম বিষয়টি কী— তা দেখতে কাছে ভেড়েন শরীফ। মাঠের মধ্যখানে গোলাকার পরিসরে খাড়িমাটি দিয়ে দাগ কাটা হয়েছে। কয়েকটি ঘোড়া সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কীসের যেন প্রতীক্ষা করছে। একটি সাদা ঘোড়ার গায়ে লাল সালুর রিবনে কালো হরফে লেখা ‘রায়পাশা এস্টেট’। পুরো ব্যাপারটাই ভারি গোলমেলে ঠেকে! সাহায্যকারী সংস্থায় চাকুরির পয়লা দিকে খানা-জরিপ করতে শরীফকে যেতে হয়েছিল এদিকের পাঁচখানা গ্রামের প্রতিটি ঘরে। তখন এক থুরথুরে বুড়োর মুখে অত্র এলাকার জমিদার রায়পাশা এস্টেটের নিহার রঞ্জন রায়ের গল্প শুনেছিলেন। রায়বাবু সফেদ একটি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরপাক করতেন। তার দাঁব-রোয়াবে সবাই তটস্থ থাকত। তিনি কদমতলীর মাঠে ফি-বছর আয়োজন করতেন ঘৌড়দৌড়ের। কিন্তু এসব তো পার্টিশনের আগে ব্রিটিশ আমলের কথা। তবে কী এলাকার লোকজন বিগত জামানার স্মৃতিবাহী ঘোড়দৌড়ের রেওয়াজটিকে ফিরিয়ে আনছে? আরও খানিকটা তথ্য জানতে পারলে— এ বিষয় নিয়ে লেখা যেত আরেকটি ফিচার। দূর ছাই, ফিল্ম না থাকাতে আরেকপ্রস্থ হতাশ হন শরীফ।

ঘোড়দৌড় শুরু হতে খানিক দেরি আছে। এখনই সেন্টারে ফিরে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। বুড়ো কদমগাছটির তলায় আছে একটি দোকান। তাতে চা-বিস্কিটসহ তেল-চিনি-সাবান প্রভৃতি কিনতে পাওয়া যায়। শরীফ ওখানে ঢুকে এক পেয়ালা চা এর কথা বলে বসে পড়েন। দোকানটিকে কেন জানি অন্য রকম দেখায়! মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে যাওয়ার সময় কখনোসখনো থেমে শরীফ এ দোকান থেকে সিগ্রেট কিনেছেন। তার প্রিয় ব্র্যান্ড ব্রিস্টল এখানে পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু স্টার সিগ্রেটেও তার কাজ চলে। তিনি এক প্যাকেট স্টারের কথা বলে দেয়ালের দিকে তাকান। কী আশ্চর্য! ওখানে টিনের পাতের উপর এনামেল প্রিন্টে ছাপা চা এর উপকারিতা বিষয়ক একটি বিজ্ঞাপন। বস্তুটিতো আগে কখনো চাক্ষুষ করেননি। আগ্রহ নিয়ে শরীফ বিজ্ঞাপনটি পড়তে শুরু করেন, ‘চা খাইতে বেশ সুস্বাদু। ইহাতে মাদকতাশক্তি নাই। ইহা ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড ও প্লেগ রোগের আক্রমণ হইতে রক্ষা করে।’ নিচে পদ্যের দুটি ছত্র, ‘গরম চা-তে নাহিক মাদকতাদোষ/পানে করে তাহা চিত্তপরিতোষ’, দিয়ে বিজ্ঞাপনটি শেষ হয়েছে। বাহ, তপ্ত এ পানীয়র গুণাবলী প্রচারের জন্য চা-কররা এককালে কী না করেছে। এ বিষয়কে অবলম্বন করেও লেখা যায় আরেকটি ফিচার। শরীফ বিজ্ঞাপনটির টেক্সট টুকে নেয়ার জন্য শোল্ডারব্যাগ থেকে নোটবুক বের করতে যান। তার চোখে এসে পড়ে ঠান্ডা জলের ছিটা! চোখ খুলতেই দেখেন—গামছা পরা এক লোক ভিজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছেন তার চোখমুখ।

কোথায় বিজ্ঞাপনঅলা চা এর দোকান, কোথায়-বা ঘোড়দৌড়ের মাঠ? তিনি খেয়া পারপারের উরা বা ন্যাড়া দিয়ে তৈরি কুঁড়েঘরের চাটাইতে শুয়ে আছেন। খেয়াঘাটে এসে নৌকায় ওঠার সময় বেঁহুশ হয়ে পড়েছিলেন, মাঝির কাছ থেকে তা জানতে পেরে ভারি তাজ্জব হন! অতঃপর তাকে সেবা দেয়া মাঝির হাতে পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে খিন্ন মনে শরীফ সেন্টারের পথে ফের রওনা হন। যেতে যেতে তার কেবলই মনে হতে থাকে— ফিচার লেখার চমকপ্রদ কয়েকটি আইডিয়া হাতের কাছে এসেও ফসকে গেল। তিনি দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগ্রেট ধরান।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম শ্রীহট্ট জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে। নব্বই দশকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটসে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে লেখাপড়া করেন কয়েক বছর। পেশাগত অছিলা হিসাবে লিপ্ত থাকেন কখনো ভিজিটিং প্রফেসার, কখনো প্রশিক্ষক কিংবা কনসালট্যান্ট হিসাবে। এ ছাড়া জর্জিয়া, সাউথ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, নেপাল, জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, ফিলিপাইনস্, কসবো, মেসিডোনিয়া কিংবা কিরগিস্তানে গবেষণা অথবা শিক্ষা-বিষয়ক কনসালটেন্সির কাজে ভ্রমণ করেন। তাঁর ‘জিম্বাবুয়ে : বোবাপাথর সালানিনি’ গ্রন্থটি বর্ষের সেরা বই হিসাবে প্রথম আলো পুরষ্কার পায়।  তিনি ভ্রমণ সাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরষ্কারও লাভ করেন। লেখক সম্প্রতি সিয়েরা লিওনে প্রথমে ডেমোক্রেসী এন্ড হিউম্যান রাইটস্ এবং পরে ইবোলা রিকাভারি ফান্ড নামক বলে দুটি কর্মসূচীর সমন্বকারী হিসাবে কাজ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচীশিল্প, পান্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।