সোমবার, এপ্রিল ২৯

উৎসবের উৎস সন্ধানে : মোস্তাক শরীফ

0

Utsob-Songkha_Motif‘দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিম্ ডিম্ রবে, সাঁওতাল পল্লীতে উৎসব হবে। পূর্ণিমাচন্দ্রের জ্যোৎস্নাধারায়, সান্ধ্য বসুন্ধরা তন্দ্রা হারায়।’ রবীন্দ্রনাথের ‘উৎসব’ কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙ্‌ক্তি পড়লেই সাঁওতাল পল্লিতে পূর্ণিমা রাতের এই উৎসব যেন আমাদের হৃদয়েও এসে দোলা দেয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে চরাচর ভেসে যাওয়া জ্যোৎস্না। পাহাড়, প্রকৃতি, মানুষ যেন দুধের সরের মধ্যে ভাসছে। ওদিকে পাহাড়ে পাহাড়ে বেজে উঠেছে ঢাক, তার উত্তাল ছন্দে নাচছে গোটা সাঁওতাল পল্লি।

মানবসভ্যতা যত দিনের, উৎসবও তত দিনের। ধারণা করতে পারি, গুহাবাসের অনিশ্চিত সেই পাশব জীবনেও উৎসবের প্রচলন ছিল। অপ্রত্যাশিত কোনো শিকার, নবজাতকের জন্ম বা ছোটোবড়ো নানা প্রাপ্তিকে উপলক্ষ্য করে হাসি আনন্দে মেতে উঠত গুহামানব, এ কল্পনা করা যেতেই পারে। উৎসবের ইংরেজি প্রতিশব্দ festival আর ভোজ-এর প্রতিশব্দ feast-এর মধ্যে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে গেছেন ডুর্খেইম থেকে শুরু করে অনেক সমাজতাত্ত্বিকই। উৎসব মানেই ভূরিভোজ—একুশ শতকের এই বাস্তবতার সূচনা, সঙ্গত কারণেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, সুদূরতম অতীতে।


মোস্তাখ শরীফ

ফারাওদের হাতে আঁকা প্রাচীন মিশরের ম্যুরালচিত্র।


ইতিহাস বলছে, উৎসব আয়োজনের জন্ম প্রাক-ঐতিহাসিক পর্বে এবং সকল প্রাচীন সংস্কৃতিতেই এর অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যায়। চীন, ভারতবর্ষ, সুমেরিয়া, মিশর হয়ে গ্রিক, রোমান, মায়া, আজটেক প্রতিটি সভ্যতারই উৎসবের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল। এমনই এক উৎসব ‘আকিতু’, যার সূচনা যিশুর জন্মের তিন হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায়। যব বা বার্লি চাষের ঋতু এলেই শুরু হতো আকিতু উৎসব, যেটি প্রাণ ও প্রকৃতির নবজন্মের ইঙ্গিত দিত। শীর্ষ দেবতা মারদুক, তাঁর পুত্র নেবু-সহ ব্যাবিলন ও এর নৃপতিদের রক্ষাকর্তা সব দেবদেবীকে স্মরণ করার উপলক্ষ্য ছিল এটি। বারো দিন স্থায়ী ছিল এ উৎসব। প্রতিটি দিনই ভিন্ন ভিন্ন প্রথা ও আচার মানা হতো, যাতে অংশ নিতেন রাজা, পুরেহিতবৃন্দ এবং ব্যাবিলনের সর্বস্তরের মানুষ। নগরপ্রাচীরের বাইরে ‘বাইত আকিত’ বা আকিতুগৃহ নামে বিশেষ একটি মন্দিরে পালিত হতো এসব আচার।

যব বা বার্লি চাষের ঋতু এলেই শুরু হতো আকিতু উৎসব, যেটি প্রাণ ও প্রকৃতির নবজন্মের ইঙ্গিত দিত। শীর্ষ দেবতা মারদুক, তাঁর পুত্র নেবু-সহ ব্যাবিলন ও এর নৃপতিদের রক্ষাকর্তা সব দেবদেবীকে স্মরণ করার উপলক্ষ্য ছিল এটি। বারো দিন স্থায়ী ছিল এ উৎসব।

গ্রিকদের প্রাচীন উৎসবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল থার্গেলিয়া। দেবতা অ্যাপোলো ও আর্টেমিসের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত এ উৎসব গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোতে মহা ধুমধামে পালন করা হতো। সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হতো এথেন্সে। পালনের সময় ছিল থার্গেলিয়ন মাস, আধুনিক ক্যালেন্ডারে যেটি মে মাস। প্রধানত নতুন ফসল ওঠার জন্য দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো ছিল উৎসবের প্রধান আচার। প্রচুর পরিমাণে ফল উৎসর্গ করা হতো তাঁদের উদ্দেশে। মানুষ ইচ্ছেমতো ভূরিভোজ করত, গান গাইত আর নাচত। উৎসবে এমন একটি আচারও পালন করা হতো যেটি ছিল একেবারেই ব্যতিক্রমী। এটি ছিল ‘ফারমাকোস’ নামে একটি শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান, যেখানে সমাজর প্রান্তিক শ্রেণির দুজন মানুষকে বেছে নেওয়া হতো। সাধারণত মুসাফির অথবা ভিক্ষুকরাই প্রাধান্য পেতেন। এঁদের কাজ ছিল সমাজের বাকি সবার পাপতাপকে শুষে নেওয়া। এদেরকে ছেঁড়া ন্যাকড়া পরিয়ে শহরময় ঘোরানো হতো। তারপর শহর থেকে নির্বাসন দেওয়া হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলি দেওয়া হতো দেবতার উদ্দেশে।


মোস্তাক শরীফ ২

১৬ শতকের ফ্লোরেনটাইন কোডেক্সের একটি উৎসবের চিত্র।


চৈনিকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ছিল বসন্ত উৎসব, যেটি ছিল মূলত বর্ষবরণের উৎসব। টানা পনেরো দিন চলত এটি, শেষ হতো ‘প্রদীপ প্রজ্বলন উৎসব’ দিয়ে। আজ থেকে হাজারতিনেক বছর আগে শাং সাম্রাজ্যের সময়কালে এটির সূচনা। পুরাণ মতে, নিয়ান নামে এক অপদেবতাকে তাড়ানোর জন্য এক ছোটো গ্রামের বাসিন্দারা আতশবাজি জ্বেলে আর ড্রাম বাজিয়ে ব্যাপক হই-হুলুস্থুল শুরু করেছিল। সেখান থেকেই সূচনা উৎসবের। আর ছিল বসন্ত উৎসব। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুনর্মিলনী, উপহার বিনিময় আর আতশবাজি জ্বালানো ছিল এর মূল আয়োজন। এসময় লাল রঙের প্রচুর ব্যবহার হতো, যাতে অপদেবতা নিয়ান কোনোমতেই কাছে ঘেঁষতে না পারে।

এসময় ভূরিভোজ আর শোভাযাত্রা ছাড়াও কখনো কখনো দেবতাদের উদ্দেশে শিশুদের বলি দেওয়া হতো। মে মাসে হতো খরার উৎসব টক্সকাট্ল। উৎসর্গ করা হতো রাত্রির আকাশের দেবতা তেজকাটলিপোকার উদ্দেশে। এসময় কতিপয় তরুণকে দেবতার প্রতিভূ হিসেবে বেছে নেওয়া হতো। তাদের সম্মান জানিয়ে শহরময় প্যারেড করানো হতো। শেষে বলি দেওয়া হতো দেবতার উদ্দেশে।

মেক্সিকোর আজটেকরা ছিল উৎসবপ্রবণ। সারা বছরই নানা রকমের উৎসব আয়োজনে মেতে থাকত। আজটেকদের ক্যালেন্ডারে ছিল দুটো পৃথক চক্র। প্রথম চক্রে ছিল ৩৬৫ দিনের সৌরবর্ষ, যার নাম ছিল ‘জিউপোহুয়ালি’। এরপর ছিল ২৬০ দিনের পবিত্র বর্ষ, যার নাম ছিল ‘টোনালপোহুয়ালি’। একটার পর একটা চক্র ঘুরে ঘুরে আসত। সৌরচক্রে ছিল ১৮ মাস, প্রতিটিতে ২০ দিন। প্রতি মাস পৃথক একজন দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত ছিল। আজটেকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের মধ্যে একটি ছিল আত্লকাহুয়ালো, যেটি হতো ফেব্রুয়ারি মাসে। এটি ছিল মূলত জলোৎসব, উৎসর্গ করা হতো বৃষ্টির দেবতা তেলালোক এবং জল ও উর্বরতার দেবী চালচিয়ুৎলিকুর উদ্দেশে। এসময় ভূরিভোজ আর শোভাযাত্রা ছাড়াও কখনো কখনো দেবতাদের উদ্দেশে শিশুদের বলি দেওয়া হতো। মে মাসে হতো খরার উৎসব টক্সকাট্ল। উৎসর্গ করা হতো রাত্রির আকাশের দেবতা তেজকাটলিপোকার উদ্দেশে। এসময় কতিপয় তরুণকে দেবতার প্রতিভূ হিসেবে বেছে নেওয়া হতো। তাদের সম্মান জানিয়ে শহরময় প্যারেড করানো হতো। শেষে বলি দেওয়া হতো দেবতার উদ্দেশে। সেপ্টেম্বরে হতো কৃষি ও উর্বরতার দেবী তোকির উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত ওকপানিজতিলি উৎসব। এ উৎসবের সময় মন্দির ও দেবগৃহগুলো ধোয়ামোছা করা হতো। হাতে লম্বা লম্বা ঝাড়ু নিয়ে পূজারিরা উদ্বাহু ঝাড়ু নৃত্যে অংশ নিতেন।

শেষ করব প্রাচীন মিশরীয়দের উৎসবের কথা বলে। মিশরীয়রা ছিল উৎসব আয়োজনের জন্য বিখ্যাত। তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসব ছিল ওয়েপেত-রেনপেত উৎসব, যা ছিল বস্তুত নতুন বছরকে বরণের আয়োজন। এটি ছিল এক ধরনের চলমান ভোজ। দেবতা ওসিরিসের মৃত্যু ও পুনর্জন্মকে উদ্‌যাপন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। উৎসবের সূচনা ঘটে আজ থেকে হাজারপাঁচেক বছর আগে। এখানে মূল বিষয়ই ছিল খানাপিনা ও মদ্যপান। বেশ কয়েক দিন চালু থাকত এই ভোজোৎসব। ওসিরিসের জন্ম ও মৃত্যুকে স্মরণ করে মন্দিরে নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হতো। ‘আইসিস ও নেফথিসের আহাজারি’ নামে একটি গীতিকবিতা আবৃত্তি করা হতো উৎসবের শুরুতে। আরেক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ছিল ‘ওয়াগ’। এটি আয়োজন করা হতো দেবতা ওসিরিসের মৃত্যুকে স্মরণ করে। এছাড়াও মৃত আত্মীয় স্বজনের শেষযাত্রা যাতে শান্তিময় হয় তার জন্য প্রার্থনা করাও ছিল এর অন্যতম অনুষঙ্গ। এটি ওয়েপেত-রেনপেতের পরপরই আয়োজিত হতো। মিশরের প্রাচীনতম উৎসব ছিল এটি। এসময় মানুষ ছোটো ছোটো কাগজের নৌকা বানিয়ে সেগুলোকে পশ্চিমমুখী করে ভাসিয়ে দিত। এছাড়া কাগজ দিয়ে মন্দিরের মতো স্থাপনা বানিয়ে সেগুলোকে নীলনদে ভাসিয়ে দিত। নীলনদে ভেসে চলা হাজার হাজার কাগজের নৌকা আর মন্দির সৃষ্টি করত এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।