সোমবার, মে ৬

কুমির তোর জলে নেমেছি : লুনা রুশদী

0

স্বপ্নের সেই দরজাটা বাস্তবেও ছিল কি না ভাবছি।

দরজা দেখারও বহু আগে বোধহয় একটা বিড়াল দেখেছিলাম। অন্তত দূর থেকে সেরকমই ভাবলাম। তবে মোটেও সে বিড়াল ছিল না। রোমশ যদিও, উস্কোখুস্কো। হাত না দিলেও তার গায়ের আঠালো ভাব বুঝতে পারা যাচ্ছিল আর কেমন একটা মরা মরা গন্ধ। মুখটা লম্বা মতন, গাল ভাঙা, বিড়ালদের গাল থাকে? লম্বা হতে হতে কিছুটা কুকুর আর কিছুটা হায়না হতে থাকে সে, নাকি শেয়াল? ঘেঁউউউ করে উঠল…

আমি পাশ ফিরছি, এপাশে জানালা। ভার্টিকাল ব্লাইন্ড খোলা, চাঁদ উঠেছিল। ঘরের মেঝেতে পড়ছিল সমান্তরাল আলো, লাইনটানা খাতার মতন। আমার একটা গানের খাতা ছিল ছোটোবেলায় আর গ্রিলের টবে গোলাপ গাছ। এখন চাঁদ নেই বোধহয়, অথবা চোখের আড়ালে কোথাও। বেড়ার ওইপাশ থেকে গাছের মাথাটা দুলে উঠছে, আমি আধ চোখেও দেখছি। খুব শীত আর জনালায় ফ্রস্ট জমছে। কয়েকটা কুকুর ডাকছে গলা টেনে টেনে… ঘুমাই।

গাড়িবারান্দার থাম জড়িয়ে জড়িয়ে উঠছে বাগানবিলাস। গাঢ় গোলাপি কাগজ কাগজ ফুল। বাতাস লেগে খসখস শব্দ হচ্ছে, যেন কেউ লিখে রাখছে এইসব। এমাথা ওমাথা একটা অদৃশ্য বল বাউন্স করতে করতে পায়চারী করে যাচ্ছে পাগলা রোমেল, নাকি মীর্জা গালিব রুপি নাসিরুদ্দিন শাহ?

কুকুর, হায়না ও শেয়াল মেশানো রোমশ সেই অস্তিত্ব আমাকে তাড়া করছিল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম আর একটুও নড়তে পারছিলাম না। ছোটোবেলায় দেখা কার্টুন চরিত্রের মতন এক জায়গায় দাঁড়িয়েই ছুটছিলাম প্রাণপণ। কানে কানে বলছিল রেড কুইন ‘যত জোরে পারো, তত জোরে দৌড়াতে হয়, একই জায়গায় টিকে থাকার জন্য…’। আমি কি অ্যালিস তবে? তীর বেগে ছুটে এলো আঠালো রোমশ, গোড়ালির কয়েক ইঞ্চি উপরে গেঁথে গেল আর আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করতে না পারতে পারতে পা ঝাঁকাচ্ছিলাম। চোখের সামনে জজ সাহেবের লাল বাংলোবাড়ি। গাড়িবারান্দার থাম জড়িয়ে জড়িয়ে উঠছে বাগানবিলাস। গাঢ় গোলাপি কাগজ কাগজ ফুল। বাতাস লেগে খসখস শব্দ হচ্ছে, যেন কেউ লিখে রাখছে এইসব। এমাথা ওমাথা একটা অদৃশ্য বল বাউন্স করতে করতে পায়চারী করে যাচ্ছে পাগলা রোমেল, নাকি মীর্জা গালিব রুপি নাসিরুদ্দিন শাহ? ‘ক্যায়দে হায়াত বান্দে গাম, আসল মে দোনো এক হ্যায়, মওত সে প্যাহলে আদমি গমসে নাজাত পায়ে কিঁউ…’ । একটা ভারি কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম, দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে খুব হাঁফাচ্ছিলাম আমি। দরজার ওপাশে নখের আঁচড়।

উফফ! একটা তীব্র স্থবির করে দেওয়ার মতন ব্যথা হচ্ছে পায়ে। ব্যথার চোটে জেগে উঠেছি। মনে হচ্ছে পায়ের ভেতরের হাড়-মাংস সব চামড়া ফেটে বের হয়ে যাওয়ার জন্য অস্থির। মাসল পুল। আম্মা-আব্বা বলে ‘বাইঙ্গায় ধরছে’। এই শব্দ আর কেউ বলে না বোধহয়। তবে উচ্চারণের সময় বাইঙ্গা শব্দটায় প্রাথমিকভাবে ব এর সাথে একটা আর্তনাদের মতন মুখটা হা করতে হয়, তারপর সর্বশক্তিতে ই আর শেষমেষ ঙ আর গ এর একটা যুক্তাক্ষর এবং গোঙানিসহ হা, তাতে এই শব্দটাই যথাযথ লাগছে এ মুহূর্তে। গা থেকে লেপ ফেলে দিয়ে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। আর বেশিক্ষণ পারব না চুপ থাকতে। চিৎকার করলেই ছুটে আসবে সবাই। সানিয়া তো আসবেই। কি করতে হয় যেন এখন? পায়ের আঙুল দিয়ে বর্ণমালা লেখ বাতাসে, নার্স বলেছিল আব্বাকে। আমিও তাই করছি। থামবে, থেমে যাচ্ছে। একটা ঝিম ধরা ভাব থাকে তারপরও। পায়ের পাতায় অজস্র পিনের সুড়সুড়ি। উঠে বসলাম। পা কার্পেটে। দমকে দমকে আসছে ব্যথাটা। একদম সেরে যায়নি জানাচ্ছে আমাকে। ইশ যেন জানি না আমি! কোনো ব্যথাই সারে না পুরোপুরি।

মনিটরের নীল আলো জোড়া লাগছে বাইরের ক্ষয় হতে থাকা চাঁদের আলোর সাথে। আলোর অহংকার নাই, অনায়াসে মিলেমিশে যায়। একদিন নেরুদার ক্যাপ্টেনস ভারসেস পড়েছিলাম আমরা। বিনয় মজুমদার, বেই দাও এবং মার্ক স্ট্র্যান্ড। বলেছিলে অক্তাভিও পাজ লিখেছেন যাওয়া আসার মাঝামাঝি একটা কম্পমান দিনের কথা। তারও আগে একজন তরুণ কবিকে লেখা রিলকের চিঠি পড়তে দিয়েছ আমাকে। রিলকের এপিটাফ ‘রোওজ, ওহ পিওর কন্ট্রাডিকশন, জয় অফ বিয়িং নো ওয়ান’স স্লিপ, আন্ডার সো মেনি লিডস’… আর শঙ্খ ঘোষের অনুবাদ ‘গোলাপ, পবিত্র বিরোধ তুমি, এত সব চোখের পাতায় কারো ঘুম না হবার সুখ…’। তুমি বলেছিলে গোলাপের পাপড়ির পরতের পর পরত শেষ করে ভেতরে ঘুমায় এক রহস্যময় নিস্তব্ধতা, মৃত্যুও তাকে বলা যায়। গোলাপ যখন পাপড়ি মেলে দিয়ে ফুটে থাকে, এই স্তব্ধতা সাথেই থাকে তার। পবিত্র বিরোধ। পিওর কন্ট্রাডিকশন। বাহ! আজ তোমাদের ফেসবুকিয় প্রাত্যাহিকতায় আমি জেনে যাই প্রেমের পর্যায়। আমার মনিটরে হাসিমুখ তোমাদের। আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড─তুমি ও তোমার বন্ধুরা, ঘিরে আছো তাকে, যেমন একদিন আমাকেও ঘিরে ছিলে। সিঁড়িতে বসে আছো, ধোঁয়া ধোঁয়া সন্ধ্যা দেখছে সে তোমার হাঁটুতে থুতনি রেখে। আমার সেই ভারি ওক কাঠের বইয়ের তাকের সামনে তোমার দুই বছর বয়সী রাজকন্যা, তার হাতে জাদুর কাঠি।

‘এখন
যদি অল্পে অল্পে আমায় ভালো না তুমি বাসো
আমিও ধীরে ধীরে তোমায় ভালোবাসা থামাব…’

আহারে! তার চেয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলি। লাল, কমলা, সবুজ, খয়েরী নকল লজেন্সের দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াই কিছুক্ষণ। ছোটোবেলায় স্কুলে গানের আপা ঝাল লজেন্স খেতেন সবসময়। আর একটা লাল টিপ। সেই লজেন্স পাওয়া যায় আর? একটাকায় চারটা…বনানী লজেন্স। ফারহানার ফেসবুক রেস্তোরাঁর নাম বনলতা। আমার চোখ জ্বালা করে, বুজে আসে…।

একটা ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম। ঘুণে ধরা রেলিং। পায়ের তলায় মটমট করে ভেঙে পড়তে চাইছে কাঠের ধাপ আর আমি বিপুল অতলে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে রেলিং জাপটে ধরছি। অনেক ওপরে ডানা ঝাপটাচ্ছিল কবুতর কিংবা বাদুর অথবা কাকাতুয়া। আমার অনন্ত উত্তরণ। ‘বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে সেখানে নেমে আসে চাঁদের আলো, কাউকে চেনো না তুমি, তোমাকে চেনে না কেউ সেই তো ভালো…’। দরজাটা মৃদু ঠেলতেই খুলে গেল। ওপাশে চওড়া শ্বেত পাথরের বারান্দা, সেখানে সম্রাট শাহ-জাহান টান দিচ্ছেন বিষণ্ণ আলবোলায়, নাকি আনারকলির সাজে মধুবালা? সে নেচে নেচে সরে যেতে থাকে দূরে। তখন গোধূলি। গোলাপি রঙের মেঘ ভাসছে আকাশে। কোন প্রান্তে সরে গেছে মধুবালা নাকি জেবুন্নিসা মেহজাবিন? তোমার প্রাক্তন প্রেমিকা। সে একটা সিংহাসনে বসে আছে, হাতে জীবনানন্দের কবিতার বই। চোখ তুলে আমাকে বলল ‘তোমার তো এখানেই আসার কথা ছিল…’। দরজাটা আলগোছে বন্ধ হতে হতে সেই বারান্দাতেই বন্দি করে দিচ্ছিল আমাদের। উলটোপাশের বারান্দায় একটা পুরোনো ডায়রি খুলে শুকিয়ে যাওয়া ফুল দেখে কাঁদছেন রাজেশ খান্না ‘বাবুমশাই, এত ভালোবাসা ভালো নয়…’। একদম নিচে এই সন্ধ্যাবেলাতেও থমকে আছে এক টুকরো ভোর। সেখানে ছেলে কুশানকে সাথে স্ট্রবেরি তুলছে তানিয়া। হাতের আঙুল, গাল, ঠোঁট সব স্ট্রবেরি আর শিশিরে মাখামাখি করে খলখল হাসতে হাসতে সারা মাঠ দৌড়াচ্ছে কুশান, সে বলছে ‘মেমে, ইউ শ্যুড গো টু মার্স!’ তিথির পা জোড়া কিছুতেই স্টকিংস বন্দি থাকতে চাইছিল না। সে রোদেলা উঠানে আসনপিঁড়ি বসে সবুজ চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অনাবিল হাসছিল।

সেখানে আমি যাচ্ছিলাম। ‘যত গেছি তত ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে পথ…’। বদ্দারহাটের উড়াল সেতু উড়ে যাচ্ছিল দেওয়াল ফুঁড়ে। আমি দৌড়াচ্ছিলাম। পায়ের তলায় খসে পড়ছিল ইট, সিমেন্ট, সুড়কি। অনেক নিচে…প্রায় পাতালের এক বাড়িতে আগুন দিচ্ছিল কেউ, একটা জ্যন্ত গরু ঘাস খেতে খেতে পুড়ে যাচ্ছিল। শূন্যে বাঁধা কাঁটাতারে ফেলানি ঝুলছিল। কপাল চাপড়ে হাহাকার ছড়াচ্ছিল দুলালী না প্রিয়বালা? সেই সুরটাই ধুঁকতে ধুঁকতে ঢুকে গেল প্রায়ান্ধকার জানালায়। সেখানে গান গাইছিল সদ্য কৈশোর পেরোনো ত্বকীর মা। সুরে সুরে সে মিনতি করছিল ছেলেকে ঘরে ফিরতে, সে বলছিল সন্ধ্যা পার হয়ে আসন্ন চাঁদহীন রাত্রির বিভীষিকার কথা। বইভর্তি তাকের সামনে ত্বকীর স্থির হয়ে যাওয়া হাসিমুখ বাতাসে ভাসতে ভাসতে বেহালার সুর হয়ে যাচ্ছিল। রাতের শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর বেহালা বাজাচ্ছিলেন বালিকা বধুর মাস্টার মশাই আর নদীর পারের কাশবনে চিৎ হয়ে শুয়ে তারা গুনছিল ছয় বছর বয়সী মেঘ। তাকে কেউ ডাকছিল না।

বাংলা বিহার ঊড়িষ্যার সর্বশেষ সুলতান তানিম কবির বিধ্বস্ত হাঁটছিল শাহবাগ প্রাঙ্গনে। খুব আপনহীন, ‘সে যে ফিল করে এক গগণবিদারী হাগ’…রামপালের বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঘরছাড়া রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার অনশন ধর্মঘট করছিল…পিছু নিল তানিমের। ওরা হাঁটছিল ছবির হাটের দিকে, একটা বাদাম ওয়ালাও কি থাকবে না কোথাও? একটা বেঞ্চে বসে আনমনে কবিতা আওড়ায় তানিম ‘এমনই আজান এক ধ্বনিত আকাশে, বিকেলের ছায়া সেও ফিরে গেছে ঘাসে…’, টাইগার বলে ‘ম্যাও!’ জারিফ আর নিনি লুকিয়ে বৃষ্টি দেখছিল, তারা তেঁতুলের আচার খেতে খেতে ভাল্লুক বিষয়ক কিছু আলাপ সেরে নিচ্ছিল। আমি ছুটছিলাম রানা প্লাজার দিকে, কে-মার্ট থেকে ছয় ডলারে কেনা সবুজ টি-শার্ট গায়ে দিয়ে। লেবেলে লেখা ছিল ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। রানা প্লাজার মাথায় বাঁধা হচ্ছিল ফাঁসির দড়ি তেঁতুলগাছের সাথে। মঞ্চে জোরদার হচ্ছিল আমার ফাঁসির দাবি, ‘কিন্তু তবে চলবে না’ তারা বলছিল আর উল্লসিত গান গাইছিল ‘চোর চাই যে করেই হোক, হোক না সে যেকোনো লোক, নইলে মোদের যাবে মান…’। বিকট হুংকারে জানানো হলো ‘মেশিন চলবে’…সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করেছিল হাজার হাজার সেলাই মেশিন। ঠিক তখনই ধসে পড়ছিল ছাদ আর আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। আমরা মরে যাচ্ছিলাম দেখ! বিশ্বজিৎ ফিনকি তোলা রক্ত নিয়ে জড়িয়ে ধরতে আসছিল আমাকে, আগুন লেগেছে? গান বাজছিল ‘দাশতে তানহাই মে, দুরী কে খাসো-খাক তলে, খিল রাহি হ্যায় তেরে প্যাহলু কে সামান অওর গুলাব…’ একটা নূপুর পড়া পা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল…

বিছানাতেই কেঁপে উঠেছি। ঘরটা দুলছে। আপনা-আপনি গলায় হাত চলে গেল, নাহ এখনো ফাঁসি হয় নাই। অন্তত স্বপ্নের ভেতর ঊর্দু গান শোনার কারণে হতেও পারত। কী আশ্চর্য, মারাই তো যাব! তবু…যে পায়ের নূপুর জীবনভর ঢেকে ছিল আধময়লা সালোয়ার, মৃত্যু তাকে দৃশ্যমান করে তোলে। সে ইটচাপা সম্মানে উঠে আসে আমাদের ফেসবুক কভারে। সকালে হান্টিংডেল যাচ্ছিলাম, ‘অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল…’। রাস্তার কিনার ঘেঁষে নিথর পরে ছিল শান্ত পসাম, নাকি বিড়াল? একপাশ ফিরে, গুটিসুটি গোছালো ভঙ্গিতে, যেন ঘুমাচ্ছে। তার পাশ দিয়ে একশ কিলোমিটার বেগে হুশহাশ ছুটছিল গাড়িরা, কিছুই এসে যাচ্ছিল না তাতে তার। গান বাজছিল ‘দিয়েছে সোনালি সুখী জীবনের দৃপ্ত অঙ্গীকার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’…

সিঁড়ি দিয়ে নামলেই সারবাঁধা কাঠের দরজা, মাঝে একটা উঠান। কোণের দিকের দরজাটা সবুজ রং করা। জায়গায় জায়গায় রং উঠে গিয়ে সস্তা কাঠ বেরিয়ে পরেছে, রঙের ওপর ধুলা আর কাদার প্রলেপ। ভাঙা একটু, নিচের দিকে মনে হয় ইঁদুর কেটে যাওয়া… সেই পথে অনায়াসে বৃষ্টির পানি ঢুকে যেতে পারে ঘরে। ঘরে থাকেন আহমাদ মোস্তফা কামাল।

সেই বাস্তবসম্মত দরজা। কোথায় ছেড়ে এসেছি তাকে? অকল্যন্ড? ওয়েলিংটন? আরও অনেক দূরে কোথাও? সিঁড়ি দিয়ে নামলেই সারবাঁধা কাঠের দরজা, মাঝে একটা উঠান। কোণের দিকের দরজাটা সবুজ রং করা। জায়গায় জায়গায় রং উঠে গিয়ে সস্তা কাঠ বেরিয়ে পরেছে, রঙের ওপর ধুলা আর কাদার প্রলেপ। ভাঙা একটু, নিচের দিকে মনে হয় ইঁদুর কেটে যাওয়া… সেই পথে অনায়াসে বৃষ্টির পানি ঢুকে যেতে পারে ঘরে। ঘরে থাকেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। তিনি রাত জেগে লেখেন ‘বড্ড ঘুম পাচ্ছে রে নিতির, একটু কোল পেতে দিবি, নইলে বুক?’ আমি এবং ছায়াসঙ্গী অসংখ্য আমরা, একটা অশেষ কুমড়া কাটতে থাকি। তিনি বলেন বিদেশে শুধু ঝালমুড়ি ভালো লাগে।

কোনো এক জলসার মঞ্চে খুব হইচই আর তীব্র আলোয় নির্জনতম হতে চাওয়ার সাধনায় উন্মত্ত এক কবিগুরু পাঠশালা খুলে সবক দিচ্ছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপে। তাকে ঘিরে ভক্তকুল অদম্য আবেগে পান করছে দশ খণ্ডে সমাপ্য কোর্স ‘আসল কবি চিনে নিন’। মঞ্চের আলোর আভায় প্রথম সাড়িতে শিল্পসম্মত স্মিতহাস্যে অসংখ্য সাদা শাড়ি লাল পাড়। অন্ধকার গাঢ় হচ্ছিল মঞ্চ থেকে দূরে যেতে যেতে। আনিকা আর আমি ছিলাম একদম পেছনে, নাকি সানিয়া? আমি তাকে দেখালাম তোমার মতন কেউ আবছায়া। দেখলাম হেঁটে আসছো, দেখলাম ঠিক সামনেই বসেছ আমার। বললে ‘আমি খুব ক্ষুধার্ত, বৃষ্টিতে ভিজে গেছি, জ্বর এসেছে দেখ!’ তোমার কপালে হাত রাখলাম আর হাত বেয়ে জ্বরটা একদম আমার বুকের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল, রক্তের মতো। তুমি আমার হাতে কপাল ঘষতে ঘষতে কি যেন মুছে ফেলতে চাইছিলে।

দেখি রমনা পার্কের দুঃখিত বেঞ্চে এক ছটাক বাদাম হাতে বসে থাকেন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। তাঁর সামনে ডোরাকাটা বাদামওয়ালা। সন্ধ্যা নামে আর বাদামের গায়ে জড়িয়ে থাকা লাল আস্তরণটুকু এক ফুঁয়ে উড়ে যায়। সে বাতাসে ভাসতে ভাসতে মিশতে থাকে ধুলায়, বিপন্ন বিস্ময়ে বুঝে ফেলে বাদামের অস্তিত্বের জন্য মোটেই সে অপরিহার্য নয়। অস্তমুখী সূর্যের শেষ স্পটলাইটে বাদামের মসৃণ ত্বক ঝিকমিক করে। কাগজের ঠোঙা খুলে সুব্রত দা পবিত্র স্তোত্র পাঠ করেন─কুমিরের সাথে শত্রুতা করলে কিছুতেই পানিতে থাকা যায় না…

তোমার অসুখ বুঝি? তোমার অসুখ নাকি খুব?

 

 

জুলাই ২৮, ২০১৩
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ঔপন্যাসিক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। প্রকাশিত বইসমূহ: অনুবাদগ্রন্থ অরুন্ধতি রায় এর ‘দ্যা ব্রোকেন রিপাব্‌লিক’ (২০১৩), প্রকাশক শুদ্ধস্বর। উপন্যাস: ‘আনবাড়ি’ (শুদ্ধস্বর, ২০১৪), এবং প্রকাশের অপেক্ষায় আছে উপন্যাস ‘আর জনমে’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।