শুক্রবার, মার্চ ২৯

ডালিমকুমার

0

ডালিমকুমারের সমস্যা একটাই তার শুধু লজ্জা করে! ডালিমকুমারের বয়স ১৭/১৮ গ্রামে সে আর তার মা থাকে!

ডালিমকুমার দেখতে ভীষণ সুন্দর, গোলাপি ঠোঁট, গায়ের রঙ দুধেআলতা কিসিমের! যখন সে লজ্জা পায় তখন গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে! ডালিমকুমারের ভীষণ লজ্জা, তাকে কেউ কিছু বললেই সে মাথা গুটিয়ে বলে, ‘আমার যম্মের লজ্জা কত্তিছে! কন দিনি কি করি!’ গ্রামের ফাউল লোকেরা ডালিমকুমারকে দেখলে ইশারা দেয়, দুষ্ট কথা বলে! ডালিমকুমার মাথা নিচু করে হেঁটে যায়, কখনো একা একা কান্দে!

করোনা মহামারীর দিনগুলোতে গ্রামে যখন খাবারের সংকট দেখা দেয়, ডালিমকুমারের মা বিপাকে পড়ে যায়! কয়দিন চেয়েচিন্তে চলে; কিন্তু দুর্যোগের দিনে কে চাল দেবে? ত্রাণ সহায়তা যা আসে তা ডালিমকুমারদের হাত পর্যন্ত ঠিকঠাক পৌঁছায় না। ফলে এক মহাদুর্যোগে নিপাতিত হয় ডালিমকুমার! কিন্তু লজ্জা তার পিছু ছাড়ে না! লজ্জায় সে আরও কুণ্ঠিত হয়ে থাকে! কার কাছে গেলে চাল পাওয়া যাবে? তার বন্ধু নাই কেউ! তার মাও বেরিয়েছে চাল খুঁজতে!

ভিড়ের ভেতর একজন বলে ওঠে, ‘ঐ ডালিম তুই এহেনে কি চাচ্ছিস?’ ডালিমকুমার বলে, ‘এম্নি কাকা!’ লোকটা হেসে দিয়ে বলে, ‘মেম্বারের চেহারে দেখতি আইছিস? হে হে!’

ডালিমকুমার শুনতে পায় মেম্বারের কাছে গিয়ে নাম লেখালে ত্রাণ পাওয়া যাবে! ডালিমকুমার মেম্বারের বাড়ি যায়! সেখানে উঠোনে অনেক অভাবী লোক দেখে ডালিমকুমার আরও গুটিয়ে যায়! তার মুখ লাল হয়ে আসে!

ভিড়ের ভেতর একজন বলে ওঠে, ‘ঐ ডালিম তুই এহেনে কি চাচ্ছিস?’ ডালিমকুমার বলে, ‘এম্নি কাকা!’ লোকটা হেসে দিয়ে বলে, ‘মেম্বারের চেহারে দেখতি আইছিস? হে হে!’

অন্যরাও হেসে দেয়! অন্য একজন বলে, ‘মেম্বার না একবার তোর পোঙ্গায় থাবা দিইলো?’ সবাই হো হো করে হেসে ওঠে!

 

Motif
ডালিমকুমারের ঘনঘন শ্বাস পড়তে থাকে! মাথা গোটানো ডালিমকুমার ছলছল চোখে বলে, ‘আমার কলাম যম্মের লজ্জা লাগতিছে কাকা!’ লোকজনের এই তামাশা দেখে মেম্বার খেঁকিয়ে বলে ওঠে, ‘হেই বজ্জাদের দল, না খায়ে আছিস তার উপর খোঁচাখুঁচি কিসির?’ এক ফাজিল লোক বলে ওঠে, ‘ডালিমকুমার আপনারে দেখতি আইছে মেম্বার সাব!’ মেম্বার বলে, ‘ঐ ছিমড়া, কি চাইস এহেনে?’ ডালিমকুমার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে! মেম্বার কয়, ‘জিয়েল গাছের মতন দাঁড়ায় রইছিস ক্যান বলদ? কিছু কবি?’

ডালিমকুমার মিনমিন সুরে বলে, ‘আমার না যম্মের লজ্জা কত্তিছে, কি করি কন দিনি?’ মেম্বার মজা পায় সে বলে, ‘এতো লজ্জা লাগে ক্যান তোর? হাফলেডিস নিকি তুই?’ সবাই এবার হল্লা করে হেসে ওঠে!

ডালিমকুমার বলে, ‘কাকা কয়ডা চাইল পাওয়া যাবে? না খায়ে আছি!’ মেম্বার বলে, ‘না যাবে না! সিরিয়াল দেখিছির? তুই যুওন মানুষ, বুড়ো থুয়ে তোরে দেবো ক্যান?’ লোকদের ভিড় থেকে একজন বলে, ‘কিরাম বিটা মানুষ তুই? শিকার কইরে খাতি পারিস না? নাকি মেশিনে গেঞ্জাম আছে?’ সবাই এবার হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে! ছলছল চোখে ডালিমকুমার বেরিয়ে আসে!

একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সামান্য কিছু ত্রাণ সাহায্য করছে অতিদরিদ্রদের! ডালিমকুমার সেখানে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে!

সংগঠনের একজন জিজ্ঞেস করে, ‘কি চাই?’

ডালিমকুমার বলে, ‘এট্টা কথা কতাম, তা আমার যম্মের লজ্জা লাগতিছে; কোতি পাত্তিছি না!’

ভেতর থেকে ডালিমকুমারের চেনা একলোক বেরিয়ে এসে বলে, ‘কিরে সোনা চাইল নাই?’

ডালিমকুমার মাথা নিচু করে থাকে! লোকটা ডালিমকুমারের বাহু ধরে চাপ দেয় আর বলে, ‘চিন্তা করিস না! তুই মরবি না, খালি আমার সাথে থাক ডালিম! রাজি হয়ে যা সোনা!’ ডালিমকুমার বলে, ‘আমার যম্মের লজ্জা কত্তিছে কাকা! কন্‌ দিনি কি করি?’

লোকটা ডালিমকুমারের বাহু ধরে চাপ দেয় আর বলে, ‘চিন্তা করিস না! তুই মরবি না, খালি আমার সাথে থাক ডালিম! রাজি হয়ে যা সোনা!’ ডালিমকুমার বলে, ‘আমার যম্মের লজ্জা কত্তিছে কাকা! কন্‌ দিনি কি করি?’

 

Motif
তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে! ডালিমকুমার চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে মায়া নদীর কিনারে এসে দাঁড়ায়! বৈশাখের রোদে তার অস্থির লাগে! মায়ের জন্য খারাপ লাগে! মেম্বার বাড়ির ঐ লোকের কথা কানে বাজে, ‘সে কেমন বেটা?’ চারদিকের মানুষের জন্য ঘেন্না লাগে! সঙ্গে সঙ্গে তার ভীষণ লজ্জাও লাগে! নিজের জন্য লজ্জা লাগে! না-পারার জন্য লজ্জা লাগে! তখন তার মনে পড়ে ছোটোবেলায় সে শুনেছিল মায়া নদীর জলের মধ্যে অনেক খাবার! সেইখানে যে যায় সে খাবার পায়! সেই দুনিয়ায় একবার যেতে পারলে ক্ষুধার সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! ফলে সে এগোতে থাকে আর তখন আচানক একটা ঘোড়া এসে দাঁড়ায়! ঘোড়ার মাথাটা আর লেজটা মাছের, শরীরটা ঘোড়ার! ডালিমকুমার উঠে পড়ে জলঘোড়ার পিঠে! তারপর, টগবগ টগবগ টগবগ…!

ডালিমকুমার মায়া নদীর জলে নেমে যেতে যায়!

 

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও নাট্যকার। প্রকাশিত কবিতার বই : বিনিদ্র ক্যারাভান (২০১৫, অনন্যা)। বাংলাদেশের খুলনায় থাকেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।