রবিবার, অক্টোবর ১৩

অবদমনের কালে : ফারুক আহমেদ

0

ডিমের অমলেট, এক বাটি স্যুপ, পরোটা, ব্রেড, জেলি, কয়েক টুকরো আপেল। সকালের এমন এক টেবিলে রোদ এসে পড়েছে আলপনার মতো। ফারিয়া প্রথম টেনে নেয় স্যুপের বাটি, তারপর পরোটার প্লেটটা টানবে বলে হাত বাড়ায়। কিন্তু শেফালি এসে আজকের সংবাদপত্রটি ধরিয়ে দিলে ফারিয়ার হাতে কালির ছোপ লেগে যায়। সংবাদপত্রের বেশির ভাগ ছাপে নিউজপ্রিন্ট আর সস্তা কালিতে। মাঝে মাঝে সংবাদের সঙ্গে এমন বীভৎস ছবি যোগ করে, যাতে কালি লেপ্টে আরও বীভৎস দেখায়। ফারিয়া অবশ্য হাতে কালি লাগায় বিরক্ত নয়, বরং হাসিতে তার মুখ ভরে যায়। শেফালি পত্রিকাটা দিয়ে, ম্যাডাম নাস্তার টেবিলে বসেছে, এরপর কফি খাবে— তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফারিয়া কাগজটি পাশে সরিয়ে বেসিনের দিকে যায়। হ্যান্ডওয়াশ তার হাতে ফেনার বুদ্বুদ বানিয়ে কবজি পর্যন্ত ডুবিয়ে দেয়। অনেকটা সময় ধরে সে কাজটা করে। কেননা, তার মুখের হাসিটা বিদ্যুতের বাল্বে পোকার আসা-যাওয়ার মতো এমনভাবে যাওয়া-আসা করে যে, খেয়ালই থাকে না, কতক্ষণ ধরে সে হাত ধোয়ায় ব্যস্ত।

শেফালি পত্রিকাটা দিয়ে, ম্যাডাম নাস্তার টেবিলে বসেছে, এরপর কফি খাবে— তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফারিয়া কাগজটি পাশে সরিয়ে বেসিনের দিকে যায়। হ্যান্ডওয়াশ তার হাতে ফেনার বুদ্বুদ বানিয়ে কবজি পর্যন্ত ডুবিয়ে দেয়। অনেকটা সময় ধরে সে কাজটা করে।

প্রথম পৃষ্ঠায় জ্বলজ্বল করছে সংবাদটা: ‘পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা, পুড়ে মৃত্যু তিনজনের।’ এরপর সাব হেড: ছয় বছরের একটি বাচ্চা রাত কাটিয়েছে বাঁশঝাড়ে, সে ভয়ে বাকরুদ্ধ, কথা বলতে পারছে না, মাকে জড়িয়ে ধরে রাখছে শুধু।’ এরপর বিস্তারিত।

টেবিলে সাজানো নাস্তার কিছুই অবশিষ্ট নাই। আলোও আলপনা তৈরির কাজ রেখে চলে গেছে। এই ব্যাপারগুলো খুব দ্রুত ঘটল।

‘কফি হলো শেফালি?’ ফারিয়া হাঁক দেয়। ‘ব্ল্যাক কফি দিস, কড়া করে।’

এমন একটা দিবসে ফারিয়া সারাদিনে যা যা করেছে, তার মধ্যে প্রথমে প্রিয় বান্ধবী মুক্তার খোঁজ নেওয়া। এরপর অনেকটা সময় ধরে রবীন্দ্রসংগীত এবং ব্লুজ গান শোনা। তার প্রিয় বো ডিডলিকে অনেক সময় নিয়ে শুনেছে সে। বিকালবেলা ঘুমায়নি আর। বিকালটা বই পড়েই কাটাতে চাইল। তার মনে হলো, আজকের বিকালটা কোমিলো হোসে সেলার ‘পাস্কুয়াল দুয়ার্তের পরিবার’ পড়ে কাটানোর মতো। অনেক বছর আগে পড়া উপন্যাসটা আজ আবারও পড়তে ইচ্ছা করছে। এরকম ইচ্ছা ফারিয়ার ভেতর ডুব দিয়ে থাকে এবং সময়ে সময়ে তা বেরিয়ে আসে। একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার খুব কফি খেতে ইচ্ছে করে; কফিটা খেতে হবে সত্যজিতের ‘আগন্তুক’ দেখতে দেখতে। সে চুপচাপ কফি বানায়, টেলিভিশনে ‘আগন্তুক’ ছাড়ে, তারপর সোফায় বসে একসঙ্গে কফি এবং আগন্তুক খেতে শুরু করে। রাত তখন ৩.৩০, হাসনাত এসে বিস্ময়ভরা চোখে দেখে ফারিয়া টিভি ছেড়ে কফি খাচ্ছে। যাহোক, এখন মুশকিল হলো, কোনোমতেই বইটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িটি পুরোনো, কিন্তু সংসারটা নতুন হওয়ায় এমন মুশকিলের ব্যাপার ঘটে। কোথায় কী রাখা আছে, খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ কয়েকদিন আগেই এই বইটা সে দেখেছে বাসার লাইব্রেরিতে। বাড়ির মাত্র দুজন মানুষ লাইব্রেরিটা ব্যবহার করে, আর যারা কাজের সহযোগী, বইয়ের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ নাই। ফলে এদের জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হবে না। বইটা খুঁজে না পেয়ে ফারিয়া বরকে ফোন করে। বর হাসনাত ফোন ধরে না, অটো মেসেজ আসে, আই উইল কল ইউ লেটার। সে তখন বুঝে উঠতে পারে না বিকালটা কীভাবে কাটাবে। বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো ইচ্ছা তৈরি হচ্ছে না, বা মাথায়ও কিছু আসছে না— যা করে সময়টা যাবে। আবারও মুক্তাকে ফোন করে। মুক্তা ফোন পেয়ে জানতে চায়, ফারিয়ার মন খারাপ কি না? উত্তরে ফারিয়া ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দেয়। বরং তার মন যে খুবই ভালো, তা জানিয়ে পরস্পর ফোনালাপ শেষ করে।

 

২.
দুজনের দেখা হয় খাবার টেবিলে। রাত সাড়ে দশটা তখন। ফারিয়া-হাসনাতের নৈশভোজ এবং আলাপচারিতা চলতে থাকে।

—খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে তোমার?

—আর বোলো না, দেড়শ কোটি টাকার একটা লোন প্রসেস হচ্ছে, বড়ো শিল্পগ্রুপের। এ সপ্তাহেই ডেসপাশ করতে হবে। পুরো অফিস ভয়ংকর ব্যস্ত। কাল সকালে বোর্ড মিটিং। লোনটা হলে দারুণ একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।

এতগুলো কথা একটানা বলে হাসনাত। অনেক বড়ো ব্যাপার বলেই হয়তো। ফারিয়ার অবশ্য ব্যাপারটায় কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। সে হাসনাতের কাছে জানতে চায়, আজকে পত্রিকা দেখেছে কি না।

উত্তরে হাসনাত জানায়, কাজের চাপের মধ্যে পত্রিকা বা মোবাইল মনিটরের দিকে তাকালে মাথা ব্যথা শুরু হয় এবং সেটা ঘুমানো ছাড়া আর কিছুতে সারে না।

দেখে নাই জেনে ফারিয়াকে মনে হলো খুব আহ্লাদিত। মুহূর্তের মধ্যে প্রায় একটা প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে যায় এবং পত্রিকাটা এনে হাসনাতের সামনে ফেলে। প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে খবরটা। সঙ্গে ছবি; আগুনে পুড়তে থাকা ঘরগুলোর। কালি লেপ্টে গিয়ে ঘর আর ঘর নাই, আগুনের ভেতর আরও বেশি ঢুকে গেছে। হাসনাত প্রথম পৃষ্ঠায় একবার চোখ বুলিয়ে ফারিয়া যেভাবে লাফ দিয়ে উঠেছিল, সেও প্রায় সেভাবে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। কিন্তু ফারিয়ার মতো প্রজাপতি হতে পারে না। এদিকে টেবিলে বসে ফারিয়া শব্দ করে পড়তে থাকে, ‘পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা, পুড়ে মৃত্যু তিনজনের।’

ফারিয়ার ঠোঁট সুন্দর। কথা বলার ভঙ্গিও। এতে তার পাঠ টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদপাঠিকার খবর পড়ার মতো হলো। হেডিং পড়ে ফারিয়া সাবহেডে যাবে, ততক্ষণে হাসনাত ড্রয়িংরুম থেকে বেডরুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। ফারিয়ার পড়া থামাতে হয়। তবে তার মুখে হাসি ফুটে থাকে বলে, সে যে সুন্দরী এই ব্যাপারটা আরও প্রকটভাবে ধরা দেয়।

 

৩.
বিছানা থেকে আসছে দুরকম ঘ্রাণ। চোখ বন্ধ করে থাকলে মনে হবে, দুটা পারফিউম পাশাপাশি শুয়ে আছে।

‘বাচ্চা ছেলেটার কথা ভাবো একবার। মাত্র ছয় বছর বয়স, সারারাত একা অন্ধকারে বাঁশবনের ভেতর বসে ছিল। ভয় পায়নি সে, বাবা-মাকে খোঁজেনি, কী আশ্চর্য?’

‘উহ্!’ হাসনাত ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এভাবে আধো আলোর ভেতর পরস্পরের দু-জোড়া চোখ মিলিত হয়।

‘রাতটা বাচ্চাটার মায়ের জন্য কেমন দীর্ঘ ছিল, বলো। মা তো দম বন্ধ হয়ে মরে যেতে পারত। বোধহয় মরে যেতে যেতে বাচ্চার কথা ভেবে বেঁচে ছিল।’ ফারিয়া বলেই যায়।

হাসনাত কোনো উত্তর না দিয়ে দু-হাতে ফারিয়াকে কাছে টেনে আনে। সঙ্গে সঙ্গে ফারিয়া হাসনাতের ঠোঁটে নিজের দু-ঠোঁট চেপে ধরে। এভাবে ব্যাপারটা খুব দ্রুততার সঙ্গে গাঢ় হতে থাকে। মনে হয় পত্রিকায় ছাপা হওয়া সংবাদটা কোথাও নাই আর। হাসনাত ফারিয়ার ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট ছাড়িয়ে নিয়ে গলা কামড়ে ধরলে ফারিয়া চিৎকার করে। চিৎকার দেয়ালের ভেতরই থাকে এবং এ চিৎকার আনন্দবিহ্বলতা নাকি ব্যথার, বোঝা যায় না। ফারিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়, পারে না। ছাড়িয়ে নেওয়াটাও সত্যি সত্যি নাকি কপট— আধো অন্ধকারে তা স্পষ্ট নয়। হাসনাত এরপর যা যা করণীয় ধারাবাহিকভাবে তা করে যায়। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত এমনই তীব্র হয়ে ওঠে যে, মনে হয়, ফারিয়া ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। শেষে হাসনাত ক্লান্ত হয়ে পড়লে কোনোমতে দু-হাতে ঠেলে ফারিয়া একগ্লাস পানির জন্য বিছানার পাশটা হাতড়াতে থাকে।

শেফালি আজকের সংবাদপত্রটি ফারিয়ার সামনে এনে ধরে। কিন্তু ফারিয়া পত্রিকা হাতে না নিয়ে নাস্তায় মনোযোগ দেয়। নাস্তা শেষ হতে না হতেই শেফালি কফির কাপ নিয়ে হাজির। ফারিয়া জানায়, আজকে ব্ল্যাক কফি না। শেফালি নতুন করে আরেক কাপ কফি বানাতে চলে যায়।

৪.
টেবিলটা গতকালের মতোই তৈরি। ডিমের অমলেট, এক বাটি স্যুপ, ব্রেড, জেলি, শুধু পরোটার জায়গায় আজ লুচি, আপেলের জায়গায় কয়েক টুকরো পেঁপে। আলো এসে আলপনা বানিয়েছে এবং টেবিলে বসামাত্র শেফালি আজকের সংবাদপত্রটি ফারিয়ার সামনে এনে ধরে। কিন্তু ফারিয়া পত্রিকা হাতে না নিয়ে নাস্তায় মনোযোগ দেয়। নাস্তা শেষ হতে না হতেই শেফালি কফির কাপ নিয়ে হাজির। ফারিয়া জানায়, আজকে ব্ল্যাক কফি না। শেফালি নতুন করে আরেক কাপ কফি বানাতে চলে যায়। এর মধ্যে ফারিয়া পত্রিকাটা টেনে নিয়ে দেখে গতকালের নিউজের নানারকম আপডেট। ‘সন্দেহভাজন কেউ ধরা পড়েনি’, ‘গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’— এরকম আরও কিছু খবরে প্রথম পৃষ্ঠা ভরে আছে। শেষ পৃষ্ঠায় গতকালের মা-ছেলের স্টোরির আপডেট। সঙ্গে নতুন আরেকটা গল্প, এটাও গতকালের মতো ভয়াবহ। কিন্তু কেন জানি প্রথম পৃষ্ঠায় জায়গা পায়নি। তবে শেষ পৃষ্ঠায় ঘটনার বিরাট একটি ছবি ছাপা হয়েছে।

মুক্তাকে ফোন করে ফারিয়া দেখা করতে চাইলে মুক্তা জানায়, অফিস গলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, গলা থেকে কথাও বেরুনোর রাস্তা পাচ্ছে না। কিন্তু ফারিয়াকে কথা বলতেই হবে এবং তা মুক্তা ছাড়া আর কারো সঙ্গে নয়! এমন এক পরিস্থিতিতে মুক্তা জানায়, ছুটি নিয়ে হলেও চারটায় সে বেরুবে।

নর্থ অ্যান্ডে এসে মুক্তা দেখে ফারিয়া কর্নারের টেবিলটায় বসে মোবাইলের বাটন চাপছে। মুক্তা ফারিয়াকে অলিঙ্গন করে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে। বলে, তোর চোখ দেখে প্রতিবার আমি প্রেমে পড়ে যাই।

উত্তরে ফারিয়ার হাসার কথা থাকলেও তেমন কিছু ঘটে না। গুলশান অ্যাভিন্যুয়ে এই সময়ে একটু একটু করে গাড়ি বাড়তে থাকে। অফিসও ছুটি হতে শুরু করলে কফিশপগুলোতে ভিড় বেড়ে যায়। কফিশপে বসে কাচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে যে রাস্তা চোখে আসে, তার ফুটপাত সুন্দর। এরকম সুন্দর ফুটপাত ঢাকার আর কোথাও নাই। মোলায়েম, পরিষ্কার, একটু কম ধাক্কাধাক্কি করা মানুষ এসব ফুটপাত ধরে ঘরের দিকে যায়। তাছাড়া এ রাস্তায় মার্সিডিজ, বিএমডব্লিও, পোর্সে, প্রাডো বা এরকম গাড়ি এত বেশি ঘুরে বেড়ায় যে, মনে হবে, এরা পরস্পর পরস্পরকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে।

ফারিয়ার মুখ বিষণ্ণ। মুক্তা কোনো কথা না বলে কাউন্টারে খাবারের অর্ডার করতে চলে যায়। ফিরে এসে বলে, আমি খনার কথা ভাবি প্রায়শই। প্রতিভা বলতে যা বুঝায় তার শীর্ষ চূড়া, আমরা বলি কিংবদন্তি, তা-ই তো। নারী বলে এমন প্রতিভা নিয়েও ঠিকঠাক জীবন পায়নি মানুষটি। চারদিকে পিষে ফেলার জন্য কতজন তৈরি ছিল, তার হিসাব নাই।

মুক্তার কথায় মনে হলো, ফারিয়ার চোখ একটু জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ রাস্তায় ইতিউতি দৃষ্টি ঘুরে ফিরে এলো মুক্তার মুখে, আজকের পত্রিকা দেখেছিস?

—না, সে সময় কোথায় পাব। তুই তোর কথা বল।

এক ক্যাফে কর্মী দু-কাপ কফি দিয়ে গেলে একটা নিজের কাছে রেখে, অন্যটা ফারিয়ার দিকে ঠেলে দেয়।

ফারিয়া কোনো ভনিতা না করে ‘আচ্ছা শোন তাহলে’ বলে বলতে শুরু করে—

হাসনাত সৌন্দর্য এবং দারুণ একটা ক্যারিয়ার পকেটে পুরেছে। বিয়ের আগে একদিন আমরা মুখোমুখি বসেছিলাম। ওর সঙ্গ উষ্ণ, তবে একটা বিষণ্ণতার ছাপ কোথায় জানি লুকিয়ে আছে। হাসনাতে আমার মুগ্ধতা তৈরি হলো। মনে হলো, আমি তার জন্য তৈরি আছি। বয়সটা আমার তুলনায় একটু বেশি হলেও তা টের পাওয়া যাচ্ছিল না। তার যে বিষণ্ণতা, তাও বোধহয় আমার জন্য রেখে দিয়েছে, একটু একটু করে ব্রাশ দিয়ে মুছে দেব বলে। তার সঙ্গে দারুণ একটা সংসারজীবন পাব বলে মনে হয় আমার। এভাবে একটা তারিখ ধরে, আলো ঝলমলে উৎসবটি আমাদের মিলিয়ে দিল। যাকে ভাবতে লাগলাম, আনন্দ এবং উত্তেজনার এক যুগপৎ ঘটনা।

আলো ঝলমলে সন্ধ্যাটা পেরিয়ে আমরা রাতের দিকে এগোলাম। হাসনাতদের বাড়িটা ওর ভাই-বোন, তাদের স্ত্রী এবং বর, বাচ্চাদের উপস্থিতিতে ছলকে উঠল। আমরা আমাদের রুমে ঢুকে যাওয়ার পর বাচ্চাদের হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কেউ কেউ বাড়ির লনে হাঁটতে নেমেছে। ছোটো ছোটো ঝাড়বাতি দিয়ে বাড়িটা সেজেছে। জানালা ঘেঁষে যে আমগাছটা, সেটার পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলোর ইশারা। দুজন পোশাক বদলে, পাশাপাশি বসে এক টুকরো হাসিতে নিজেদের অভিবাদন জানালাম। আমাদের ভেতর উষ্ণ চুমু বিনিময় হলো। দেখতে পাচ্ছি, সামনে হাতছানি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরো একটা রাত। তারপর আমরা যে গল্পে ঢুকে গেলাম, তা ছিল হাসনাতের বাবা-মায়ের মৃত্যুর গল্প। প্রথম রাতটা যেখানে শহরের প্রিয় জায়গা, হানিমুনে যাওয়ার চিন্তা, হানিমুনে দেশে নাকি বাইরে যাব, বা এরকম কোনো গল্পে শুরু হবে, শেষ হবে পরস্পরকে উপভোগ করে। সেখানে শুরু হলো বাবা-মায়ের মৃত্যুর গল্প দিয়ে। হাসনাত পরিবারের ছোটো ছেলে, বাবা-মাকে ভীষণ ভালোবাসে এবং সে কারণে এ বাড়িতে হাসনাত থাকে। অন্য ভাইয়েরা বলেছে, এখানে তুই থাক হাসনাত। তারপরও আজকের রাতে এই গল্পটাই কেন, এর কারণ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না! শুনেছি, তার বাবা-মায়ের মৃত্যুটা খুবই বেদনাদায়ক ছিল। সে রাতে ওই ঘটনার দৃশ্য থেকে দৃশ্যের বর্ণনা শুনে আমাকে বিবশ হয়ে যেতে হলো। ছেলে স্কুলে, বাবা-মা যাচ্ছে ছেলেকে আনতে। ছেলের আজ স্কুল ফাইনালের শেষ দিন। আগামীকাল পরিবারের সবাই মিলে সমুদ্র দেখতে যাবে। দেশজুড়ে সামরিক জান্তা থেকে গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠা এক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। পথে বিরাট এক মিছিল এমনভাবে ফুঁসে উঠেছে যে, জান্তাকে যেন গদি থেকে আজই নামিয়ে ফেলবে। সে মিছিলের মুখোমুখি হতে হলো বাবা-মাকেও। এমন পরিস্থিতিতে গাড়ি নিয়ে এক পা এগোনোও সম্ভব নয়। বাবা-মা গাড়ি থেকে নেমে স্কুলের দিকে হাঁটতে শুরু করে। এর মধ্যে ঘটে ঘটনাটা। দুইটা বুলেট দুজনকে পৃথিবী থেকে অবসান করে দিল। দুজন হাত ধরে আছে পরস্পর, রক্তাক্ত। ছোট্ট ছেলেটা স্কুলে বাবা-মায়ের অপেক্ষায়। এই হলো গল্প, হাসনাতের বর্ণনা এমন দৃশ্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। বিয়ের প্রথম রাতটা এভাবে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকল, তাকে আর টেনে ওঠানো সম্ভব হলো না।

প্রথম রাতের স্মৃতি আর আমাকে তাড়িত করছে না। হাসনাত সুপুরুষ, আমাকেও যথেষ্ট সুন্দরীই বলে সবাই। দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। আমার বুক টিপটিপ। সহসাই ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করবে, তার অপেক্ষা করছি। কিন্তু দেখা গেল দ্বিতীয় রাতে হাসনাত ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ভাবলাম, ধাক্কা দিই, ঠোঁট ধরে চুমু খাই, জেগে উঠুক।

দ্বিতীয় রাতে বাড়িটা খালি হয়ে গেছে। আমরা দুজন, কাজের মানুষ, দারোয়ান— এই। প্রথম রাতের স্মৃতি আর আমাকে তাড়িত করছে না। হাসনাত সুপুরুষ, আমাকেও যথেষ্ট সুন্দরীই বলে সবাই। দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। আমার বুক টিপটিপ। সহসাই ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করবে, তার অপেক্ষা করছি। কিন্তু দেখা গেল দ্বিতীয় রাতে হাসনাত ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ভাবলাম, ধাক্কা দিই, ঠোঁট ধরে চুমু খাই, জেগে উঠুক। জানালায় তাকিয়ে দেখি আমগাছের সবুজ পাতা অন্ধকারে কোনো রঙের আভাস দিচ্ছে না। শুধু বাতাসে পাতার সরসর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন দেখি, সকালটা আমার গলা চেপে ধরে রেখেছে। আমি পৃথিবীর কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।

ব্যাপারটা একইরকম চলতে থাকে। বিছানায় দুটা শীতল প্রাণ পাশাপাশি ঘুমানোর জন্য শোয়। যারা পৃথিবীতে আদম এবং ইভেরও আগে আসা মানুষ। যারা নারী-পুরুষের বিশেষ সম্পর্কের ব্যাপারটা জানে না এখনো। চার দিন পর আমি মায়ের কাছে চলে যাই। মায়ের সঙ্গে দুদিন থাকব। তৃতীয় দিন মা চলে যাবে কানাডায়, তার বড়ো ছেলের কাছে, আমি ফিরে আসব হাসনাতের বাসায়। তোর সঙ্গে দেখা হয় তখন। তুই জানতে চাইলে বলি, ‘সবকিছু দারুণ।’ মা’র জন্য মনখারাপ লাগে, দেশে আমি একা হয়ে গেলাম।

ফয়সালের সঙ্গে প্রেমের যে ক্লান্তি, তা আর টেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। এর মধ্যে হাসনাতকে ভালো লেগে যাওয়ায় বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। বিয়ের সাত দিন পর ফয়সাল আবার আমার মগজে এসে হাজির হয়। বিয়ের আগের সাত দিন সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার সকল পথে হেঁটেছে। ফোন, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ই-মেইল— মনে হচ্ছিল একটা ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া ছিদ্র খুঁজছে, পেলেই ঢুকে পড়বে। বিয়ের সাত দিনের ব্যবধানে আমি ফয়সালের কথা আবার ভাবতে শুরু করি। খুব দ্রুতই তার সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে যাবে, এমন একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। এর মধ্যে মা চলে যায় এবং আমি হাসনাতের বাসায় ফিরে আসি। ফয়সালের সঙ্গে আমার দেহ বিষয়ক সম্পর্কগুলো শীতের রাতের স্মৃতির মতো ফিরে আসতে থাকে। শীতের রাতে দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট গানের মতো সেসব আমাকে তাড়িত করে। মনে হয়, খুব দ্রুতই ফয়সালের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

হাসনাতের প্রতি একটা শীতলতা কাজ করে। সুদর্শন এক নপুংশককে আমার সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখি। কিন্তু ও কোনো ব্যাপারে বিব্রত, তা মনে হয় না। মনে হয় সব স্বাভাবিক, সুন্দর, প্রাণময়। আমাকে এর মধ্যে একদিন সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়। বলে, প্ল্যান করো, কোথায় যাওয়া যায়। আমরা বিয়ের অবসরে ওর ভাই-বোনদের বাসায় দাওয়াত খেয়ে বেড়াই। হাসি-উচ্ছ্বাসে সন্ধ্যাগুলো কেটে যায়। কিন্তু রাতগুলো হয়ে ওঠে স্তব্ধ, প্রাণহীন। আমাদের ভেতর কিছুই ঘটে না। মনে হয়, বিয়ের আগে যে বিষণ্ণতা টের পেয়েছিলাম, সেটা হয়তো তার এই অক্ষমতার অবচেতন রূপ, যা বিষণ্ণতার চেহারায় প্রকাশিত।

এর মধ্যে ঘটল ব্যাপারটা, সকালে ঘুম থেকে ওঠে দুজন একসঙ্গে নাস্তার টেবিলে বসেছি। হাসনাত কিছু একটা আমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল, তখনই সংবাদপত্রটি আসে। একটা বীভৎস দুর্ঘটনার খবর প্রথম পৃষ্ঠার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত। সংবাদপত্রটি বাম হাতে ধরে দ্রুত চোখ বুলিয়ে হাসনাত টেবিল থেকে উঠে যায়। সংবাদের সঙ্গে ছবিও আছে, রঙিন। মনে হলো পত্রিকাওয়ালা ঘাড় ধরে বলছে, দেখ, দেখ কত বীভৎস! সকালবেলা এই বীভৎস খবরটা আমাকে আরও হতাশ ও ক্লান্ত করে তুলল। মনে হলো, এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যাব আমি।

হাসনাত টেবিল থেকে উঠে বেডরুমে চলে গেছে, আর ফিরে আসছে না। নাস্তা শেষ করে, কেন হাসনাত অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেডরুমে গেল এবং ফিরছে না, তা দেখতে সেদিকে যাই। ঘরে ঢোকামাত্র হাসনাত দরজা বন্ধ করে দেয় এবং কোনোকিছু বোঝার আগে আমাকে চুমুয় ভরিয়ে তোলে। প্রথমে লজ্জা এবং আনন্দে চোখ বন্ধ করে স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর হাসনাতের সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে সমুদ্রে নেমে যাই। আমাদের সমুদ্রস্নাত বিস্ময়কর আনন্দে পরিণত হয়। ওইদিন সে আর অফিসে যায়নি। রাতে আবারও আমাদের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে এবং আমি অনুভব করতে থাকি, এরকম আনন্দের অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। হাসনাত আমাকে অভাবনীয় এক অভিজ্ঞতা দিল।

‘আচ্ছা, একটু থামি, স্যান্ডউইচটা খেয়ে নিই। তুইও নে।’ বলে টেবিলে রাখা দু-টুকরো স্যান্ডউইচ থেকে এক টুকরো টেনে ফারিয়া খেতে শুরু করে। আরেকটা মুক্তার দিকে এগিয়ে দেয়। খাওয়ার সময় মুক্তা বা ফারিয়া কেউই একটি কথাও বলে না। ব্যাপারটা এমন যে, পাঁচ মিনিট পর ক্লাস শুরু হওয়ায় এক্ষুনি খেতে নিয়ে সেদিকে দৌড়াতে হবে।

হাসনাত বিয়ের পর থেকে কেন আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যায়নি। হুট করে ওই দিন কী এমন হলো যে, ব্যাপারটা ঘটাল এবং তাও একই দিনে দু-দুবার! সেদিনের পর, নপুংসক বরটি পরিণত হলো একটি কামনাময় পুরুষে।

ফারিয়া আবার বলতে শুরু করে— ওইদিনের পর আমি একটা স্বস্তির জায়গায় পৌঁছাই, একইসঙ্গে আমার ওপর একটা চিন্তা ভর করে। ভেবে পাই না, হাসনাত বিয়ের পর থেকে কেন আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যায়নি। হুট করে ওই দিন কী এমন হলো যে, ব্যাপারটা ঘটাল এবং তাও একই দিনে দু-দুবার! সেদিনের পর, নপুংসক বরটি পরিণত হলো একটি কামনাময় পুরুষে।

এরপর আবারও নিস্পৃহ হাসনাতকে দেখা যেতে থাকে। এক রাতে আমি তার ঠোঁটে চুমু দিই, তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করি। সে তাতে কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। বরং তার ভেতর অনীহা এবং বিরক্তির ছাপ টের পাওয়া যায়। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না— কী করব। অনেকবার ভেবেছি ব্যাপারটা তোকে বলি। কিন্তু আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে চাইলাম। এদিকে আমার একটা দিনও যাচ্ছিল না।

শেষ পর্যন্ত দিন দশ পর ব্যাপারটা আবারও ঘটল। হাসনাত খুব সকালে অফিসে চলে গেছে, আমি নাস্তার টেবিলে বসে সেদিনের কাগজটি হাতে পাই। পত্রিকার পৃষ্ঠা জুড়ে একটি লঞ্চডুবির সংবাদ। অনেককে উদ্ধার করা হয়েছে, তার মধ্যে থেকে যারা মরা গেছে, সেসব মৃত মানুষের ছবি বিশেষভাবে ছাপিয়েছে সংবাদপত্রটি। ওই রাতে সে ফিরে খেতে খেতে পত্রিকাটা দেখে নেয়। খাবার শেষে সরাসরি বেডরুমে চলে যায়। আমাদের ভেতর দ্বিতীয় দিনের মতো ব্যাপারটা ঘটে। সারারাত হাসনাত আদর করে। আমি আনন্দ-আহ্লাদে দিশেহারা এক বালিকায় পরিণত হই।

ওই দিনের পর আমার চিন্তায় নতুন একটা ব্যাপার যুক্ত হলো। ব্যাপারটায় প্রায় নিশ্চিতই আমি। অপেক্ষা করতে থাকলাম পরবর্তী ঘটনাটা কবে ঘটবে, তার জন্য। পাঁচ দিন পর প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে খবরটা ছাপা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্রসফায়ারে একজনকে হত্যা করেছে। এরকম ঘটনা যদিও অহরহ ঘটে এবং সেসব সংবাদ সর্বনিম্ন গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় পত্রিকার ভেতরের কোনো পাতায়। এই সংবাদগুলো পরিসংখ্যানের সুবিধার জন্য বোধহয় ছাপে বা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে ছাপার ব্যাপারে কোনো চুক্তি-টুক্তি থেকেও ছাপাতে পারে। তবে সেদিনের ঘটনাটা ছিল অন্যরকম; মিডিয়ার বিশেষ নজর আকর্ষণে সক্ষম হয়। মৃত লোকটির দুই মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে— এই সংবাদটা বড়ো হেডিং পায়, সঙ্গে এ নিয়ে অনেক সাইট স্টোরি। ইয়াবা কারবারের ছোটোখাটো গডফাদার ছিলেন লোকটা— আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি তেমনই। কিন্তু মিডিয়া তা বিশ্বাস করছে না। মিডিয়া বলছে, মানুষ এটা বিশ্বাস করছে না। হাসনাত বেশির ভাগ দিনই খুব সকালে চলে যায়, সেদিনও তা-ই। সংবাদটা পড়ে উত্তেজনায় কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

রাতে এলে পত্রিকাটা তার সামনে এগিয়ে দিই। দেখি হাসনাত কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখে একটা অস্পষ্ট হাসি ছড়িয়ে পড়ে। আড়চোখে হাসনাতকে দেখি। সে আর দেরি করে না, কোনোরকমে খাবার শেষে বেডরুমে চলে যায়। ওইদিন বিছানায় আমি কিছুটা অনাগ্রহ দেখালে হাসনাত খুব ক্রেজি হয়ে ওঠে। তারপর আমাদের ভেতর ব্যাপারটা ঘটে। সারারাত হাসনাতের ঘুম নাই, থেমে থেমে সে আমাকে আদর করতে থাকে। আমার অনাগ্রহের জন্য মনে হয় ওই রাতে সে আরও বেশি মরিয়া হয়ে গেছে। এরপর একে একে লাশের ভেসে ওঠা, খুন, দালানে আগুন লেগে অর্ধশত মানুষ পুড়ে ছাই। একটানা সাতদিন এমন সব সংবাদ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা দখল করে থাকে। প্রতিদিন সকালে হাসনাত চলে যায়। নাস্তার টেবিলে আমি একা, পত্রিকা হাতে এসব সংবাদ দেখে ঘর জুড়ে পায়চারি করতে থাকি। পুরোটা দিন কাটাই আমার প্রিয় সব কাজ করে। হাসনাত ফিরে এলে, খাবার টেবিলে, ওর খাবার শেষ হওয়ামাত্র পত্রিকাটা মুখের সামনে তুলে ধরি। হাসনাতের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এরপর আমরা সরাসরি বেডরুমে চলে যাই। আমাদের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করে।

একটানা সাত দিন এমন সব ঘটনা চলার পর একদম বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো, কোনো ম্যাজিশিয়ান এসে সব ঠিক করে দিয়েছে। বলেছে, এখন থেকে বাড়ি পুড়বে না, লঞ্চ ডুববে না, কেউ কাউকে খুন করবে না, নো ক্রসফায়ার। ভালো ভালো সংবাদে পত্রিকার পাতা ভরে আছে। প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবর, ‘এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে, কৃষকের মুখে হাসি’। আমার গিয়ে কৃষকের মুখে সব আলু পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এরপর দেখা যায়, ‘মেয়েদের ফুটবল দলের বিশ্বজয়।’ আমি সহ্য করতে পারি না। বিশ্বজয় করা মেয়েগুলোর দু-একটা যদি রেপ হতো, তাহলে বিশ্বজয়টা যথাযথ হতো বলে মনে হয়। তখন আমার একদা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কুখ্যাত র্যা পিস্টকে ভাড়া করে পাঠাতে ইচ্ছে করে, যেন এদের কারো ওপর বর্বরটা একটা যৌন সন্ত্রাস চালিয়ে আসতে পারে। এভাবে আমার ক্রোধ বেড়ে চলেছে। আমি উত্তেজনা বোধ করি, এমন কোনো সংবাদ আর ছাপা হচ্ছিল না। পত্রিকাওয়ালারাও কোনো সংবাদ বানাচ্ছে না। বিশ বছর আগের কোনো খুনের সংবাদের পোস্টমর্টেম— তা হলেও তো হয়। মিডিয়াগুলো সবসময় বাড়াবাড়ি করে বলে যে দুর্নাম শোনা যায়— কেউ একজন কান শহরে উৎসবের সময় গেলে বলে বসে, ‘কানের জুরিবোর্ডে মুবারকের নাম, দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’ তেমন কিছু কোথাও ছাপা হচ্ছে না। এখন মিডিয়া আর কোনোরকম বাড়াবাড়ি করছে না বলে সবাই রায় দিচ্ছে। হলুদ সংবাদিকতাকে সংবাদিকরা ঘৃণা করছে নাকি খুব। হলুদ সাংবাদিকতা এই দেশে আর জায়গা পাবে না সোজা বলে দিয়েছে।

আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আবারও ফয়সালের কথা মনে পড়তে থাকে। অনেক অপেক্ষার এক মাস পর গতকাল ছাপা হলো— ‘পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা, পুড়ে মৃত্যু তিনজনের।’ আমি খুশিতে আর সময় কাটাতে পারছিলাম না। তোকে দুবার ফোন করেছি, যদিও বলতে পারি নাই কিছু। সারাদিন অপেক্ষা করে রাতে যখন আমরা মিলিত হলাম, তখন অন্য হাসনাতকে দেখতে পাই। মনে হলো, সে আজ আমাকে খুন করে ফেলবে। আদর করতে গিয়ে সে আমাকে পিষে ফেলবে। ফারিয়া জামা সরিয়ে মুক্তাকে দেখায়, দাগটা। কামড়ে, ফারিয়ার ফর্সা চামরায় গলগল করছে।

মুক্তা ফারিয়ার গল্পে এবং এই গলগলে ব্যাপারটা দেখে কিছুই বলছে না। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে শুধু। আর এক দৃষ্টিতে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘আজ একটা মানুষ পুড়ে বিছানায় আটকে গেছে, সেই ছবিটা ছাপা হয়েছে। এই বলে ফারিয়া মুক্তার হাত চেপে ধরে। বলে, সেই মানুষটাকে তার ছোটো বাচ্চাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে আছে। কিছুই নাই ছাই ছাড়া, সেটাই জড়িয়ে ধরে আছে।’

আর কোনো হয় না। দুজন চুপচাপ বসে থাকে অনেকক্ষণ, ফারিয়া মুক্তার হাত ধরে রাখে। বেশ কিছুক্ষণ পর মুক্তা হাত ছাড়িয়ে কাউন্টারের দিকে যায়। আরও দুইটা কফি অর্ডার করে ফিরে আসে।

মুক্তা, বল আমি কী করব, আজ হাসনাত বোধহয় আমাকে মেরে ফেলবে। আমি পত্রিকাটা পুড়িয়ে এসেছি। তারপরও জানি, চ্যানেল, ফেসবুক নিউজফিড বা অনলাইন, কত কী আছে, তার দেখতে হবেই। আমি কী করব বল?

‘মুক্তা, বল আমি কী করব, আজ হাসনাত বোধহয় আমাকে মেরে ফেলবে। আমি পত্রিকাটা পুড়িয়ে এসেছি। তারপরও জানি, চ্যানেল, ফেসবুক নিউজফিড বা অনলাইন, কত কী আছে, তার দেখতে হবেই। আমি কী করব বল? আমার যদি ভিসা থাকত, মায়ের কাছে পালিয়ে যেতাম।’

কফি এসেছে। মুক্তা নিজের কাপে চুমুক দিয়ে ফারিয়ার দিকে অন্যটা বাড়িয়ে দেয়। ফারিয়া কফির দিকে ফিরেও তাকায় না। সে বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গুলশান অ্যাভিনিউ তার চোখে ঝাপসা এখন।

মুক্তা বলে, তুই বাসায় যা। যে পত্রিকাটা পুড়িয়েছিস, তার এক কপি হকারের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যা। আর আজ তোর সঙ্গে বাসায় আমিও যাব।

এ কথায় ফারিয়া শব্দ করে হেসে ওঠে। তারপর মুক্তার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলে, আমি নিজের প্রস্তুতিটুকু নিয়ে নিয়েছি। চিন্তা করিস না। আজকের রাতটা আমাকে দে, দেখি কী হয়। তুই শুধু জেনে রাখিস এই কালটুকুর কথা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২১ মে  ১৯৮০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। সাহিত্য সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২০ বছর। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি: ‘কয়েকজন দীর্ঘশ্বাস', ‘অবজ্ঞাফল আবেগসকল বিবিধ’ ও ‘মন এইভাবে স্থির করা আছে’। ২০২২-এর বইমেলায় প্রকাশ হচ্ছে চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘উপমাজংশন’। এছাড়া রয়েছে উপন্যাস, 'ঘূর্ণির ভেতর জীবন,' শিশুতোষ, ‘গল্পগুলো সবুজ, মেঘেদের মাঠে গহীন’ গল্পগ্রন্থ ‌‘আজিজুল একটি গোপন নামতা’ ইত্যাদি প্রকাশিত গদ্য। বর্তমানে ‘অধ্যায়’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।