রবিবার, ডিসেম্বর ১

অরূপরতন হালদারের দীর্ঘ কবিতা : জাদু লণ্ঠন

0

গভীর অনিশ্চয় খুলে গেলে স্মরণের বিক্ষিপ্ত
অন্ধকার হাসে যেন সে স্নাত হলো প্রেমের বিনাশে
মাতৃতান্ত্রিক আলো ভালোবেসে। নম্র ছায়ার আদল
খুলে যায় আমাদের কামনায়, হে নক্ষত্ররাশি, এই
বিস্তার সমুদ্রের অন্তিম কাফন ছুঁয়ে বাঁচে, যেন এক
আয়ত হ্রেষার আরও দ্রব কোনো এককের সাথে
দেয়া-নেয়া আমাদের জীবনের ভেতর মুগ্ধ ফুলের
বিস্তার। ক্রমশ রক্তের ধ্বনি বদলে যায় বিষণ্ণ, আর্দ্র
এক অবলোকনে, আমিও মহাতন্তুর অংশমাত্র, দেখি
রঙের কেন্দ্রে প্রকৃত যে আঁধার মাঠের কুয়াশামদির
শস্যে ভেঙে পড়ে। হীনযান আলোগুলি পায়ে পায়ে
মহাভার নিয়ে চলেছে ধূলিপথে, এ এক ব্রত, ব্রতের
ভেতরে যে বীজ ক্রমে নিঃশব্দ বিন্দুতে মেশে ইতিহাস
তার অপেক্ষায় শয়ান। মৃত্যু ললিতরেখায় মুখ রেখে
কাঁদে, এ বিহ্বলতা একটি মান্দাসে ভেসে আছে,
ভাসমান সে গ্রহ আগুনবাহক, কেবলই এক স্বপ্ন
নিরুদ্দিষ্ট হয়, প্রেমের আঙরাখা জ্বলে গোপন
পতাকার মতো অসম্পূর্ণ আঙুরের গুচ্ছ ভালোবেসে।
হাসি ফিরে আসে, সে জানে জীবনের ভ্রম, আঁধারে
সহর্ষ ছায়াগুলি আমাদের শ্বাসের ক্লীবতা জানে।
সিংহরাশি অনুজ্জ্বল আকাশে ছড়ানো ছাই থেকে
স্তব্ধতা নিয়ে ক্রমশ কেন্দ্রের ভেতর আরক্তিম, এ
রং অবরোহী, শেকড়ের ঋদ্ধি নিয়ে শরীরে পেয়েছে
অনুচ্চারিত সিঁড়িদের, জলের আগমন ঘটে সে দেহে
যেন গোপন অক্ষর ভূমি আকর্ষণ করে অবিরত,
অথচ স্বপ্নের মধ্যে অন্ধতা করুণ হৃদয় ছেনে দেখে
একটি পাখির আর্দ্র স্বর জ্বলে আছে প্রত্ন প্রদীপের
মতো। অনেক দূরের বিষাদ পরমায়ু পেয়েছে ধীরে,
ফেটে যায় তীব্র তুলোর বীজেরা আমার যাত্রাপথ ধরে,
আগুনের গ্রহ ফিরে আসে, তুমি অসমাপিত, তবু গভীর
এক কোলাহল তোমার দোতারা বেয়ে নেমেছে পৃথিবীর
অতলে। এ প্রিয় হন্তারক, আমার জবানে দেখে মৃদু
দুলে ওঠে জাদু লণ্ঠন কোনো, স্মৃতির প্রতিটি খিলানে
যে গান পড়ে আছে আদিকাল থেকে সে এক আবিষ্ট
গৃহ, নিজের দেওয়ালে দেখে প্রচ্ছন্ন কারাগার জ্বলে
আছে রক্তের পুরোনো অভ্যাস যেমন। সারেঙ্গী বাজে,
নিষাদের কোমল অতিক্রম করেছে ছায়াপথ, কাঁটাতার
ভিজে যেতে থাকে কুয়াশায়, এ এক মন্ত্রের স্বাদ, তবু
একদিন মন্ত্রহীন সূর্য ঢলে পড়ে আমাদের প্রতি লাঞ্ছনায়,
কালকূট-লগ্ন পথের আলোয় তোমার মুখ সান্দ্র পাথরে
দেখে ঘাম, ঘামের একটি বিন্দু বপন করেছে তার
কপালের মধ্যমায়। কেউ জেগে ওঠে ধীরে, কেবল তার
কম্পনটুকু বয়ে যায় যেন ভয়-জাগানো সঞ্চার, তার
দৃষ্টিপথে তুমি অতিক্রমণকামী নও আর। অন্তর্হিত সে
ঘৃণা, গুঁড়ি মেরে সময় এগোয়, নৃত্যরত তারাবীজগুলি
এখনো ঘুমোয়, তোমার ভেতরে ডুবে যায় সেই বাতিঘর
যে করুণার মৃত্যু চেয়েছিল। এভাবেই বীতকাম একটি
পৃথিবী দেখে মন্থনশূন্য অন্ধকার তার পাঁজরে ঝুলে
আছে একেকটি কালখণ্ডের মতো। প্রেমের তীব্র স্রোত
হঠাৎ স্থবির, রক্তিম হল ঘর, ঘরের আমোদ ধীরে
ছায়া-কবলিত চাঁপাফুলটির মতো। এমন মায়াবী উল্লেখ
সব ছিরিছাঁদ উড়িয়ে দিয়েছে জগতের, কেবল এক
যন্ত্রের মতো সমপর্যায় রয়েছে কোথাও এইসব মৃত্যুর
আলোকিত গহীনে। সে এক আচ্ছন্ন ক্রীড়া, আমাদের
বহু শীর্ষ ও প্রতীতি যাত্রাপথের মতো অবনত নিজের
শরীরের কাছে; এক অন্ধ কামুক শুধু ভিতর বার করে,
তার নৈশ আঙুলে ছায়া পড়ে প্রাগিতিহাসের। রঙের
সৌধে আগুনের খেলা কালান্তক, হে পুনর্বসু, শমিত
হয়ে আছে যে শেকড় ও অস্তরাগ আমাদের স্মরণে
তার জীবন অক্ষরে আন্দোলিত, কেবল একটি মাধবী
শুয়ে আছে, মাটির রক্ত গড়িয়ে আসে তার ইতিহাসে।
পঙ্‌ক্তিরা ভাসমান শিমুলের হর্ষ, অথচ হর্ষ নয়, কেবল
একটা ভাসমান তারা ক্রমে আরাধ্য হয়ে ওঠে, এমন
শস্য ফলনের কুয়াশায় নামহীন জগতের অন্ধকারে
পড়ে আছে মায়াবী স্নেহের মতো। দুরারোহ তোমার
ক্ষত, এই জানু থেকে উদিত হয় একটা বৃত্ত, বৃত্তটি
ধারণ করে আছে একটামাত্র মাছ, মাছের চোখের
ভেতর আমাদের অবসান বিন্দুবৎ। আমি অন্তরিন
এক দেহবোধ, সে পরিণাম চেয়েছে প্রতিটা চিহ্নের
যেমন নিরক্ষর উন্মাদনা রয়েছে। আমি সৌকর্যের
প্রাণিত আহার চেয়ে দেখি যেন আলোকের দমিত
বাহার আমাকে আত্মসাৎ করেছে এক শব্দে, সে
ঘণ্টা স্থিরচিত্রের মদিরতা নিয়ে ঈষৎ আন্দোলিত
হলে এক তৃষিত বিড়াল অসম্পূর্ণ আহারের পর
কোনো বিকেলের কাছে এসে তার পৌরুষ জাগায়।
অন্তিম খিলানের ভেতর স্নায়ুর অক্ষর পুড়েছে
মায়ায়, জায়মান মেঘ, মেঘের আকর উঠে এলো
হাতে, তুমি শিলাবতী ঘুমিয়ে পড়েছে আমার
রুদ্ধ পাঁজরের নিচে।

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

পেশায় শিশু চিকিৎসক, কিন্তু কবিতা লেখাও তাঁর সর্বক্ষণের কাজ বলে তিনি মনে করেন। কলেজে পড়ার দিনগুলো থেকে লেখালেখির সূত্রপাত। কবিতা লেখা ছাড়া বিদেশি কবিতার অনুবাদ, শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদ ও মুক্ত গদ্য লিখে থাকেন। এখনো পর্যন্ত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত। ‘শূন্য রক্ত গাথা’ তাঁর প্রকাশিত সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।