রবিবার, অক্টোবর ১৩

আঞ্চলিকভাবে নির্মিত আন্তর্জাতিকমানের ওয়েবসিরিজ ‘শাটিকাপ’ : মারুফ ইমন

0

Eid Motifশুরুরকথা

তখন করোনা মহামারীর ঘোর অন্ধকার সময় চলছে। জনজীবন অনেকটাই স্থবির আর সৃজনশীল কাজের জন্য দৌড়ঝাপ করার ব্যাপারটাও অনেকক্ষেত্রে তখন সীমিত বা স্তব্ধ। রাজশাহীর ছেলে মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামকে সবাই চেনেন শাইক নামে। তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছেন দিল্লির এশিয়ান স্কুল অব মিডিয়া স্টাডিজে ‘সিনেমাটোগ্রাফির’ ওপর। ফিল্মে তার অনুপ্রেরণার নাম ‘অনুরাগ কাশ্যপ’। মহামারীর সেই সময়টায় ঘরবন্দি হয়ে বসেছিলেন শাইকও। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া গল্পটা হয়তো কিছুতেই তাকে স্থির রাখতে পারছিল না। সেই পোকার অবিরাম ছোটাছুটি তিনি এবার ছড়িয়ে দিলেন বন্ধুদের মাঝে, জানতে চাইলেন ‘এমন কিছু করা যায় কি না!’। বন্ধুরা ছিল সবাই এলাকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনির্দিষ্টকালের ছুটিটা তারাও কাজে লাগাতে চাইলেন ‘মজার’ কিছু করে। সেটা যদি কোনো বন্ধুর গল্পে ‘সিরিজ’ হয় তাতে মন্দ কী। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু কাজে বারবার বাধা হয়ে এলো অর্থস্বল্পতা আর চলমানতা। কিন্তু উদ্যম যুবকের দল কি সেই বাধার সামনে থেকে ফিরে আসবে! না, তারা বন্ধুর কাজটা বের করে তবেই ফিরল। নিজেদের সেদিনকার আঞ্চলিক সিরিজটি এখন বিশ্বময় দেখা যাচ্ছে ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’র সাহচর্যে।


শাটিকাপ ২

‘শাটিকাপ’ ওয়েবসিরিজের একটি দৃশ্যে নাজমুস সাকিব ও আহসাবুল ইয়ামিন রিয়াদ


‘শাটিকাপ’ একেবারে তাওকীরের এলাকার কথ্য ভাষায় বহুল চর্চিত একটা শব্দ যা আপনাকে বলছে, ‘লুকিয়ে পড়’ বা ‘গা ঢাকা দে’। সিরিজটি যারা দেখেছেন তারা খুব ভালোভাবেই শুনেছেন অনেকবার ‘শাটিকাপ মার’! কিসের জন্য এই গা ঢাকা দেওয়া, কে কাকে বলছে গা ঢাকা দিতে আর কেনই বা বলছে সেসবই সিরিজটির প্রথম সিজনের গল্প।

 

গল্প

সীমান্তবর্তী এলাকা রাজশাহী, সীমান্ত পেরোলেই ভারত। আর এই সীমান্তে প্রতিদিন ঘটে যায় নানা ঘটনা, তার বেশিরভাগেই অবৈধ ব্যাপার আর লুকোচুরির গল্প জুড়ে থাকে। আর সেসব ঘটনা থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। সীমান্তের এই অবৈধ কারবারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এলাকায় মাথাচাড়া দেয় কিশোর গ্যাংগুলো। আর সবার উপরে থাকে হর্তাকর্তা যারা আইনের সাথে সহাবস্থান মেনে বিস্তার করে আধিপত্য। এভাবেই নেশা, আধিপত্য আর নেশার বিরাট বাজারের চক্রের কাজ চলতে থাকে। একদিন ঘটে যায় সেই চক্রে ছেদ। এক এলাকার কিশোর গ্যাং আরেক এলাকার মাদক কারবারির একচেটিয়া আধিপত্যে বড়োসড়ো বাধা সৃষ্টি করে। একটা বড়ো চালান তারা অভিনব কায়দায় ছিনিয়ে নেয় কারবারির হাত থেকে। এই কিশোর গ্যাংকে ধরার জন্য নিজের বিশ্বস্ত ইনভেস্টিগেটিভ অফিসারকে কাজে লাগায় প্রভাবশালী মাদক কারবারি। শুরু হয় সাপলুডুর মতো এক অদ্ভুত কিন্তু ভয়ংকর কাটাকুটি খেলার। সেই খেলায় যেমন দৌড়াতে হয়, তেমনি দৌড় করাতেও হয়। শেষমেশ সেই খেলায় কে জিতবে তাই দেখানো হয়েছে ‘শাটিকাপ’ এ।

 

পজিটিভ দিক

কেউ যদি নেটফ্লিক্সের ২০২০ এর আঞ্চলিক সিরিজ ‘জামতারা ‘সাবকা নাম্বার আয়েগা’ দেখে থাকেন তাহলে তারা ‘শাটিকাপ’কেও আপন করে নিতে পারেন, মিশে যেতে পারেন সিরিজটিতে দেখানো এলাকাটির ঘটনাপ্রবাহে। ‘শাটিকাপ’ এর সবচেয়ে বড়ো ইতিবাচক দিক এর নির্মাণের সাহস। আঞ্চলিকভাবে একটা আন্তর্জাতিক মানের শো বানানোর চিন্তা করার সাহসটাই একে এগিয়ে রাখবে অনেকটা। পরিচালক তাওকীর আড্ডায় বলেছিলেন, ‘আমরা সিরিজটি যখন বানাচ্ছিলাম তখন জানতাম না এটা কোথায় যাবে, কীভাবে মানুষ দেখবে। আনন্দ পাচ্ছিলাম তাই কাজটা করে যাচ্ছিলাম।’ একটা অনিশ্চিত যাত্রায় হাঁটতে হবে জেনেও বারবার শুটিং অফ করে আবার অর্থ যোগাড় করে শুট করাটা একটা সংগ্রামের গল্পের মতোই। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সেই সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে যায় কারণ স্টারকাস্ট বা তথাকথিত কোনো প্রডিউসার ছিল না এই টিমের মাথার ওপর। ‘শাটিকাপ’-এর অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী সবাই রাজশাহীর স্থানীয়। গল্পের প্রেক্ষাপট, ভাষা, দৃশ্যধারণ সবই হয়েছে রাজশাহীতেই। তাই শাটিকাপ-কে শতভাগ লোকাল সিরিজ বলা যায়।


শাটিকাপ

‘শাটিকাপ’ ওয়েবসিরিজের একটি দৃশ্যে আহসাবুল ইয়ামিন রিয়াদ


দ্বিতীয় ইতিবাচক দিক, সিরিজটির জনরা ও গল্পের বিন্যাস। নার্কোথ্রিলার এদেশে আগে হয়নি বললেই চলে। তার মধ্যে একটা ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ টাইপ ফ্লেভার দেওয়াটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। গল্পে সিরিজটির প্রতি পর্বে যেভাবে ভাগ করা আছে, সেটা বাধ্য করে পরের পর্ব দেখতে। আট পর্বের নামগুলোও খুব কৌতূহল উদ্দীপক। সেগুলো হলো— পাপের শুরু, খিদিরবিদির, ভ্যাটাম, ভ্যানতারা, হাঁসের প্যাঁচ, ভেলকি, লে ঘিরে লে, মাথার উপর সাপ বাপরে বাপ।

এরপরের পজিটিভ ও শক্তিশালী দিক পারফরমেন্স। ‘শাটিকাপ’ এর কেউ এর আগে কোনো ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় কাজ করেনি, হয়তো মঞ্চে কাজ করেছে। কিন্তু প্রত্যেকে তাদের একশোভাগ দিয়ে একেকটা চরিত্রের সাথে যেভাবে মিশে গেছে সেটা দুর্দান্ত। এক্ষেত্রে নির্মাতা তাওকীরের নির্মাণ ধরন নিয়েও বলতে হবে। অনুপ্রেরণায় সিরিজে নাম দেওয়া হয়েছে অনুরাগ কাশ্যপকে এবং সিরিজটি দেখতে থাকলে কাশ্যপের গল্প বলার ধরণ, গালিগালাজের জায়গামতো ব্যবহার আর রাফ টাফ একশনের ছায়া পাবেনই।


শাটিকাপ ৩

‘শাটিকাপ’-এর শুটিংয়ের সময় পরিচালক ও অন্যরা


আরেকটা চমকপ্রদ দিক সিরিজের চিত্রগ্রহণ। কোনো দর্শকই এত স্বল্প বাজেটের এই সিরিজের ক্যামেরার কাজকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ‘সিনেমাটোগ্রাফি’র ছাত্র হওয়ায় স্বভাবতই তাওকীরের নির্মাণে ঘুরে-ফিরে চিত্রগ্রহণের মুনশিয়ানাই নজরে এসেছে প্রতিটি পর্বে। সিনেমাটোগ্রাফিতে তাওকীর দেখিয়েছেন তার অভিনব ম্যাজিক। চেয়ার সমেত গরু ব্যবসায়ীকে নৌকায় তুলে দেওয়ার দৃশ্য, নগরবাড়িতে ভিলেনের চরিত্রকে লোয়ার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখিয়ে অফিসার উত্তমের মনস্তত্ত্ব বর্ণনা ও ক্ষমতার অবস্থানের মেটাফরিক বয়ান হয়ে উঠেছে। তেমনি সরু গলিতে অফিসার লিয়াকতের বাইক চালানোর দৃশ্যধারণে অপ্রচলিত এঙ্গেল বেছে নেওয়ায় চিত্রগ্রাহকের সৃজনশীলতা রয়েছে। অনুরূপভাবে ফাজুকে ধাওয়া করার সিনে কুকুরের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাওয়া কিংবা পাঁচিল টপকানোর সিনেও একরাশ মুগ্ধতা ধরা দেয়। অতঃপর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে শাটিকাপ মারার সেলফি শটকেও দুর্দান্ত বলতে হয়। এছাড়া মাদক কারবারি রসুর সাথে অফিসারের কাদামাটিতে হাতাহাতিতে ক্যামেরার সূক্ষ্ম কারিকুরি যথোপযুক্ত সিনেমাটিক আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে। ড্রোনশটে দৃষ্টিনন্দন বিষয়বস্তু আর কম্পোজিশন চোখের স্বস্তি দিয়েছে। বিশেষ করে, গরুর পালের দিগ্বিদিক ছোটাছুটির দৃশ্য আকস্মিকতায় হতবিহবলতা উপহার দেয়। সিরিজটি গঠনের দিক থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকিংয়ের প্রয়াস সুস্পষ্ট যা সিনেমাটিক ট্রিটমেন্টের জায়গা থেকে শুধু মুগ্ধতাই ছড়ায়। পাশাপাশি শট ডিভিশনের নিপুণতা শাটিকাপকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

 

নেতিবাচক দিক

একজন সুশীল মানুষের গুণ আপনাকে টানলেও তার ছেঁড়া পোশাকটি কিন্তু নজর এড়ায় না। তেমনি ‘শাটিকাপ’ নির্মাণের দারুণ গল্পও আড়াল করতে পারে না এর অর্থনৈতিক সংকট আর কম বাজেটের আফসোসকে। কিছু পর্বের নির্দিষ্ট কিছু দৃশ্যকে মনে হয়েছে ততটা লম্বা না করলেও পারত নির্মাতা। আর সিরিজে খুব একটা ছিল না চরিত্রগুলোর পেছনের গল্প ও তাদের বিল্ড আপ। ফলে দর্শক মজা পাবে তবে পুরোপুরি চরিত্রগুলোর সংগ্রামের জায়গাগুলোতে কাতর হয়েও হতে পারে না। শাটিকাপের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ব্যাপার এর ভাষা। আঞ্চলিকার স্বাচ্ছন্দ্য এবং নান্দনিক প্রয়োগে ওয়েবসিরিজটি হয়েছে সম্পূর্ণ অরগানিক। তবে একটা শ্রেণীর দর্শকের কাছে বোধগম্যতায় এই ভাষাই হতে পারে একটু অস্বস্তির জায়গা। এছাড়া সিরিজটির বাদবাকি দিক অবশ্যই প্রশংসনীয়।

 

শেষকথা

‘শাটিকাপ’ চরকির প্রযোজনার কোনো সিরিজ না, নির্মাণ দেখে তারা সিরিজটি কিনে নিতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্যই নতুন নির্মাতার এই সাহসী কাজটি প্রমোট করায় তারা সাধুবাদ পাবে। তবে ‘শাটিকাপ’ নিজেই নতুন ও উদ্যমী আরও নির্মাতাদের অনুপ্রেরণার নাম হয়ে থাকবে। শাটিকাপে নিত্যদিনের সেন্সরবিহীন ধুন্ধুমার গালির ব্যবহার নিঃসন্দেহে যেকোনো দর্শককে একদম ‘র’ ফ্লেভার দিতে সক্ষম।


শাটিকাপ ৪

টিম ‘শাটিকাপ’


কোনো জায়গায় সিরিজটি মূল প্লট থেকে সরে যায়নি বা অহেতুক কোনো দৃশ্যও রাখা হয়নি। বাজেটকে মাথায় রেখে মেকআপ এবং কস্টিউমে শাটিকাপ থেকেছে সীমিত পরিসরে। সেখানে অহেতুক বাড়াবাড়ি চোখে পড়েনি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং ফলি সাউন্ডের ব্যবহারেও দুর্দান্ত বিস্ময় উপহার দিয়েছে শাটিকাপ। থ্রিলার আবহের সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে অল্প বিজিএম রেখে এসএফএক্সে অপেক্ষাকৃত বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। তাই মানের দিক থেকেও শাটিকাপ যে কোনো সময় দেখার জন্য উপযোগী কনটেন্ট। সবমিলিয়ে বলব, বাংলাদেশের সিরিজগুলোর মধ্যে শাটিকাপ একটা নতুন চ্যাপ্টার খুলে দিয়ে বলেছে— টাকা না, এখনও গল্প আর নির্মাণই আমাদের গর্বের জায়গা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

দীপ্ত টিভিতে স্ক্রিপ্টরাইটার হিসাবে কর্মরত। একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। জন্ম ময়মনসিংহে। এখন বসবাস ঢাকায়। ফিল্ম নিয়ে লেখালেখি করেন। এছাড়া ২০২১ সালে ঘাসফুল প্রকাশন থেকে ‘খেয়াবতী’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।