শুক্রবার, অক্টোবর ৪

আমিনুল ইসলামের দীর্ঘ কবিতা : মধুমতীর সঙ্গে

0

আজ এই বাদামি বিকেলে তোমার শরীরে মেশালাম
আমার পঞ্চাশোর্ধ্ব শরীর; বেঁকে উঠে আসা
তোমার কোমর বিড়ম্বিত করেনি আমাকে
কারণ তোমার ঔষধি প্রাঙ্গণের খোলা হাওয়া
ফিরিয়ে এনেছে মহানন্দা প্রযোজিত
যৌবনের বীর্যসচ্ছল দিন যা করতে অসমর্থ—
নায়াগ্রা আমাজন থেকে কিনে আনা ভায়াগ্রাও
আচ্ছা মধুমতী, তোমার বয়স কত?
বলবে না?
তুমি কি বাংলার নারী যে বয়সের কথা তুললে
এড়িয়ে যেতে চাও
দুচোখে এনে ঝিকমিক ঢেউয়ের পলক?

আমি জানি, তুমি এক অনন্ত প্রেমিকা;
গয়া বেদের সাথে তোমার কি সম্পর্ক ছিল,
সেও আমি জানি;
গয়া তোমাকে তার চম্পাবতীর সখি বলে
জানাতো সবাইকে, তাই না মধুমতী?
পদ্মার স্রোতে নাও ভাসিয়ে তারা চলে এসেছে
তোমার চাঁদনীমাখা প্রাঙ্গণে—
পাটগাতী ঘাটে: ‘বাবু সেলাম বারে বার,
আমার নামটি গয়া বাইদা বাবু বাড়ি পদ্মার পার!’

জসীমউদদীনের সাথে তোমার প্রেম ছিল ওপেন সিক্রেট,
কুমার নদে পা দিয়েও সে চলে আসতো
তোমার উঠোনে; ধানসিঁড়ির জীবনানন্দ,
দৃষ্টি ছুঁয়ে থাকা হৃদয়হীনতায়,
হাঁপিয়ে ওঠা এক প্রাণ
চোরা পায়ে গিয়েছিল
উত্তরের বনলতা সেনের কাছে,
সেও তো তোমার জলের আঙিনা দিয়েই;
দুদণ্ড শান্তি নিয়ে মুঠোয় ফিরে আসবার পথে
তোমার কানে মুখ ভিড়িয়ে
সে কি বলেছিল তার কথা
যার পরিচয় উদ্ধারে ঘুম হারাম করে চলেছেন—
গুহ-সৈয়দ-খানের দল
যেভাবে ব্রাহ্মী লিপির উৎস নিয়ে
আজও ঝরে চলেছে বিতর্কের ঘাম;
হায় অন্ধকারের উৎস,
একটার পর একটা টর্চলাইট
কিন্তু শেষ হয় না কালো পর্দার সারি!

আমি জেনেছি, টঙ্গীপাড়ার সেদিনের সেই দামাল কিশোর
কতবার সাঁতার কেটেছে তোমার জলে!
কতবার তার সুঠাম পেশী ধুয়ে দিতে দিতে
গাঙপাখি আর মাছদের আসরে
ত্রিকালদর্শী অভিজ্ঞানে তুমি বলে উঠেছো,
দেখো, এই কিশোর বড় হয়ে একদিন মুক্ত করবে
বাংলার—
সবখানি আসমান
সবগুলো নদী
সবকটি সুর
যে কিসিমে বর্ষা এসে মুক্ত করে দেয়
শাপলাবিলের ঘনলাল সৌন্দর্য।

আচ্ছা মধুমতী, তুমি যখন গোপন আড়ালে আশ্রয় দিতে
হেমায়েত বাহিনীকে,
ধুয়ে দিতে তাদের ক্ষুধা ও অনিদ্রার জ্বলন্ত শরীর,
আর নবায়িত তেজস্বিতায় তারা ফুটো করে দিতো
হানাদার বাহিনীর দখলদারিত্ব—ঠাস্ ঠাস ঠাস্,
তখন কি তুমি সাবাস বলে চাপড়ে দিতে
তাদের উত্তপ্ত পিঠ?
আশালতা দিদিকে প্রশ্ন করি, তিনি কোনো কথা না বলে
দুচোখে রচে রাখেন
অজানা অভিমানের আলো
যা টর্চলাইটের মতো
রাঙিয়ে দেয় পেছনে ফেলে আসা দিন ও রাত;

এ পাড়ে ও পাড়ে আজ কত বাড়ি! কত অট্টালিকা!
আড়াল হয়ে আসে মিঠুর ঘুড্ডি ওড়ানো আকাশ
জলের উঠোন ছুঁয়ে কোনো এক মহাবাড়ি
তার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কলের গান
সেই বাড়ির এক দুরন্ত কন্যা
যার গান শুনে মুগ্ধ আজ
সমস্ত দুনিয়া,
বালিকা বিকেলে আসতো সে সৈকতবিহারে,
ঢেউয়ের আঁচল বাড়িয়ে
ধুয়ে দিতে দিতে দুটি রাজহংসী পা,
তুমি কি তার উচ্ছল কণ্ঠে তুলে দিতে
জোয়ারের শব্দ
পাতাঝরার বেদনা
আর
নৈঃসঙ্গের কুলকুলানি?
তাই বুঝি তার কণ্ঠে—
শ্রাবণের সবখানি সুর
সবটুকু অশ্রু:
‘বঁধু, আমি ছিনু বুঝি বৃন্দাবনের রাধিকার আঁখিজলে…’

আহা! রাতদিন তোমার জলে বেজে চলেছে
মহাকালের এইচএমভি
তানসেনের মাহফিলের উপমায় কান পেতে আছে
স্বাতী অরুন্ধতী আদম সুরুত,
মুগ্ধ মৃত্তিকার মন
মুগ্ধ এ আমিও;
তুমি তো জানো, কমলা ঝরিয়া-উম্মে কুলসুম—
বেগম আখতার আর লতা-রুনার গান শুনে
বড় হয়েছি আজকের এ আমি,
তাদের কণ্ঠ না না শুনলে আজো কাটে না
আমার উল্টা দিন পাল্টা রাত
আজকের এই যে তুমি তাদের চেয়ে কত বড়
কিন্তু তোমার কণ্ঠ এতটুকুও বুড়ো হয়নি আজও
তুমি ধারণ করে রেখেছো—
অনার্য দিনের সকালের ভৈরবী,
বিকালের বৃন্দাবনী সারং
আর সন্ধ্যার পূরবী,
তীরধনুক হাতে তীরে বসে থাকা
যুবক-যুবতীর খালি গলার ডুয়েট;
সওদাগরী জাহাজ থেকে ভেসে আসে
ঘুঙুরের শব্দ,
তবলার বোল
উচ্ছল নৃত্যের শব্দে ঢেউ জাগে
তোমার স্রোতেলা বুকে;

আহা, তোমার মিঠাপানি ঘেঁষে দগ্ধবুকের অকূল
আকাশ ফাটানো কান্না—
আগুনের লেলিহান শব্দ আর কূটিল মন্ত্রধ্বনির সাথে
উড়ে যায়—
প্রভুহীন আকাশের পানে!
মধুমতী, তুমি প্রাণ ও প্রেম বিলিয়ে এসেছো
শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুধু পারোনিকো জোয়ারের আঁচল বাড়িয়ে
মুছে ফেলে দিতে
কতিপয় লোভী নরের হীনলোভ উৎসারিত
সেদিনের সেই আগুনের অন্যায় উৎস
যেভাবে প্লাইওসিন দিনে করতোয়া নেমে এসে
মুছে দিয়েছিল দগ্ধতার অভিশাপ আর
পুণ্ড্রবর্ধন হয়ে উঠেছিল
সবুজে শ্যামলে সচ্ছল ও স্বনির্ভরা।

মধুমতী, আমি বয়সে তোমার অনেক অনেক ছোটো
তোমার স্রোতেলা হাঁটুর সমানও নই,
কিন্তু সবটুকু প্রাপ্তবয়স্ক
তোমার শরীরে যে-যৌবনের জোয়ার,
তাতে মিশে আছে আমার শরীরের ঘাম আর রতিবাসনা
আমি পদ্মার উঠোন থেকে স্রোত-পথ ধরে
হাঁটতে হাঁটতে
এসে গেছি
তোমার উঠোনে
তোমার শরীরেও পদ্মার শরীরের গন্ধ পাই
এমন কি একবার রূপাসক্ত হয়ে আমি
করতোয়ার কুটির থেকে থেকে গিয়েছিলাম
নীলনদের বাড়ি হয়ে গুয়াদালকিমির
তোমার কপোলে মধুমালার চন্দনপঙ্ক,
তাদের নাভিতে ক্লিওপেট্রার কিফি
কিন্তু তোমাদের সকলেরই আত্মার গন্ধ এক;

দ্যাখো, আজ আমার সাথে এসেছে
লীনা, খেনচান আর মুমু
তাদের কোমরে দোল খায়
পদ্মা, পায়রা, আত্রাই;
আর তাদের সকলেরই প্রাণের গন্ধ একইরকম
যা মিলে যায় তোমার জলের খোশবুর সাথে;
ওদের নৌকায় পেয়ে বৈঠাহাতে উচ্ছল
তোমার নিবিড় সন্তান প্রেমকুমার
আধভেজা কাপড়ে চেয়ে তৃপ্ত তার বাসন্তী।

মধুমতী, আরেকটি কথা বলে রাখি শোনো,
চিররজঃস্বলা এই বাংলাকে ভালোবাসি আমিও,
বাসি অনেক অনেক বেশি,
কিন্তু জীবনানন্দের মতো আমি বসে থাকিনিকো
মুখ দেখে বাংলার
যাযাবর নয়,
ইবনে বতুতার মন নিয়ে ঘুরে এসেছি—
মহাদেশ থেকে মহাদেশ
ডজন ডজন নদী,
যে-নদীরই তীরে দাঁড়িয়েছি, তারই জলে বেজে উঠেছে
‘এখানে রমণীগুলো নদীর মতো,
নদীও নারীর মতো কথা কয়’
আজ আমার সাথে এসেছে যারা—
আসাদ নোমান রনি রুবেল ও সা’দ,
তাদের সকলেরই কণ্ঠে এই গান,
আজ থেকে আমাদের সাথে গাইতে পারো তুমিও
‘এই মধুমতী ধানসিঁড়ি নদীর তীরে
নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে
এক নীল ঢেউ কবিতার প্রচ্ছদ পটে…’

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও গবেষক। জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩। প্রকাশিত গ্রন্থ : ২৫টি। কবিতার বই : ২০টি; ছড়ার বই ৩টি; প্রবন্ধের বই ১টি; এবং গবেষণা গ্রন্থ: ১টি। কয়েকটি উল্লখযোগ্য বই : ‘মহানন্দা এক সোনালি নদী নাম’, ‘কুয়াশার বর্ণমালা’, ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’, ‘জোছনার রাত বেদনার বেহালা’, ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’, ‘হিজলের সার্বিকট হাউস’, ‘নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।