শনিবার, জুলাই ২৭

আমি ছাড়া কেউ নাই আমার দুখের পরিজন : সেজুল হোসেন

0

আমি যখন এই লেখাটি লিখব বলে উদ্যোগী হয়েছি ঠিক তখন নিচতলা থেকে একটা গানের সুর দেয়াল বেয়ে উপরে উঠছে। আমি গানটা ধরার চেষ্টা করছি। পারছি না। জানালা খুলে দিলাম। একটু শীত শীত আরাম বাতাসের সঙ্গে গানটা প্রবেশ করল ঘরে, মনে, মগজে। ‘জিন্দেগি অর কুচবি নেহি তেরি মেরি কাহানি হে’। সন্তোষ আনন্দ’র লেখা গান। ক’দিন আগেও একটা রিয়েলিটি শো তে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছিলেন— ‘তোমার দুঃখ দিয়ে একটা গান বানাও।’ আমি গানটা শুনছি আর বালিশের পাশে রাখা একটা বই ছুঁয়ে দেখছি। মিলান কুন্ডেরার ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’। কয়েক বছর আগে একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। অনূদিত সেই সাক্ষাৎকারে মিলান কুন্ডেরা বলেছিলেন— ‘আমার কাছে ‍উপন্যাস হচ্ছে পৃথিবীর ফাঁদে পড়া মানুষের জীবন নিয়ে তদন্ত।’ নির্ঘুম মনের ভিতর যখন এই অবস্থা তখন রাত চারটা বাজে। আমার ঘুম দরকার কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। এক ধরনের অস্বস্তি যাচ্ছে বেশ কিছুদিন। মনে হচ্ছে একটা পাথর বুকের মধ্যে কেউ চাপা দিয়ে রেখেছে। আমি সেই পাথর সরিয়ে বড়ো করে শ্বাস নিতে চাই, পারছি না। এই না পারাটাই কি কবিতায় বলতে চেয়েছি বছরের পর বছর।

বেশ কয়েক বছর আগে টেংরাটিলা গ্যাসকূপে কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো আগুন লাগাল, সেদিন গ্রামের উপর দিয়ে গরম হাওয়ার উৎপাত দেখে গ্রামবাসী অস্থির হয়ে উঠেছিল তখন। এদিক ওদিক অস্থির ছুটছিল সবাই ৷ কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না কেউ। এই না পারাটা আমি লিখতে চেয়েছিলাম, গানে। পারিনি।

যারা ঘরে ফেরে না তারা পিঠ সোজা করে, নদীর উপর চাঁদের আলোকে লক্ষ্য করে গান গায়, ‘জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারি কারণে, আমারেনি আছে তোমার মনে।’ গাইতে গাইতে কেঁদেও ফেলে কেউ। সহজ মানুষের এই কান্নাটাই আমি লিখতে চিয়েছিলাম, গানে কবিতায়। পারিনি।

আমাদের গ্রামের সহজ সরল মানুষ প্যান্ট শার্ট পরা নতুন মানুষ দেখলে এখনো অবাক চোখে তাকায়। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যার পর নদীর পারে চা দোকানে বসে গল্প করে সবাই। একে অন্যের কাছে দুঃখ আর স্বপ্ন শেয়ার করে। মাঝরাতে দুয়েকজন বাদে সবাই বাড়ি চলে যায়। যারা ঘরে ফেরে না তারা পিঠ সোজা করে, নদীর উপর চাঁদের আলোকে লক্ষ্য করে গান গায়, ‘জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারি কারণে, আমারেনি আছে তোমার মনে।’ গাইতে গাইতে কেঁদেও ফেলে কেউ। সহজ মানুষের এই কান্নাটাই আমি লিখতে চিয়েছিলাম, গানে কবিতায়। পারিনি।

শৈশবে নদীপথে লঞ্চে করে ছাতক উপজেলা সদরে যেতাম। ৪ ঘণ্টা সময় লাগত। মাঝপথে একজন অন্ধ ভিখিরি উঠত। গান গেয়ে টাকার জন্য হাত বাড়াত— এর সামনে ওর সামনে, কখনো শূন্যে। দুটি গান আমার মুখস্ত হয়েছিল শুনতে শুনতে। একটা গান শাহ আবদুল করিমের— ‘ভব সাগরের নাইয়া/মিছা গৌরব করো রে পরার ধন লইয়া। অন্যটি তাঁর নিজের লেখা— ‘ওগো এলাহি, কেন তুমি দুটি নয়ন দিলায় না’। প্রায় দেড় যুগ পর অন্ধের সেই গানের প্রতিধ্বণিই হয়তো আমি লিখেছিলাম— ‘না জানি কোন অপরাধে দিলা এমন জীবন, আমারে পোড়াইতে তোমার এত আয়োজন’।

প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। একবার পাশের বাড়ির এক জেলেকে দেখলাম কাঁধে করে একটি মাছ ভর্তি বোঝা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দূরে কোনো হাটবাজারে। অনেক ভারি ছিল সেই বোঝা আর সে খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ, গোঙানি হয়ে আমার কানে ঢোল পেটাচ্ছিল। দরিদ্র জেলের সেই কষ্ট মধ্যরাতে মনে পড়েছিল হঠাৎ আর ঘুম ভেঙে আমি খুঁজেছিলাম স্কুলের রোল দেয়া খাতা। আঁকতে চেয়েছিলাম একটা দুর্বিষহ জীবন যন্ত্রণার ছবি।

ফয়েজ উল্লাহকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম— কেন গান লিখেন? পেশায় রাজমিস্ত্রী ফয়েজ উল্লাহ দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে দুই হাতে ইটের পর ইট সাজাতে সাজাতে বলেছিলেন ‘মাথার ভিত্রে অনেক কথা। অনেক দুঃখ, অনেক জ্বালা যন্ত্রনা। কাউরে বলা যায় না। এই যন্ত্রনাগুলো মাথায় লইয়া কাজ করি। ঘুরে বেড়াই। একটা সময় মাথা আর বুক ধইরা রাখতে পারে না আমার জ্বালা যন্ত্রনাগুলাকে। গান হয়ে বাহির হইয়া আসে।’

সুরমার পারের বাউল ফয়েজ উল্লাহ। বালক বয়সের বন্ধু। বয়সে দ্বিগুন এই বাউলকে আমি ভালোবাসতাম। শুনতাম তার রচিত গান ‘বিশ্বাস করে যারে দিলাম মন, সে যে কেন ফাঁকি দিল আমারে শত্রু বানাইলো, তার লাগিয়া হয় না কেউ আপন।’ ফয়েজ উল্লাহকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম— কেন গান লিখেন? পেশায় রাজমিস্ত্রী ফয়েজ উল্লাহ দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে দুই হাতে ইটের পর ইট সাজাতে সাজাতে বলেছিলেন ‘মাথার ভিত্রে অনেক কথা। অনেক দুঃখ, অনেক জ্বালা যন্ত্রনা। কাউরে বলা যায় না। এই যন্ত্রনাগুলো মাথায় লইয়া কাজ করি। ঘুরে বেড়াই। একটা সময় মাথা আর বুক ধইরা রাখতে পারে না আমার জ্বালা যন্ত্রনাগুলাকে। গান হয়ে বাহির হইয়া আসে।’

আমি ফয়েজু্ল্লাহ হয়ে লিখতে চেয়েছিলাম সেইসব জ্বালা-যন্ত্রণাগুলোও। পারিনি।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর আমার কান জেগে উঠত। হৃদয়ের কান। কেউ একজন বাঁশি বাজাচ্ছে, পাশের জমিতে। কিংবা স্কুলঘরের বারান্দায় পা ছড়িয়ে গেয়ে উঠছে গান— ‘তুমি যদি কান্দাওরে বন্ধু, সেতো আমার সুখ, কার কাছে দেখাইবো বলো আমার পোড়া মুখ।’ ভোর হলে সেই বাউলকে খুঁজে বের করতাম। জানতে চাইতাম এই তুমিটা কে? সে তখন হাসতো। বলতো এ কথা জানলে তো আর গানের দরকার পড়ত না। তখনই বুঝি গানের এই তুমি আসলে অচেনা কেউ। অধরা কেউ। যাকে ধরে ফেলার জন্য গ্রামে গ্রামে গভীর রাতে বেজে উঠে করুণ এক বাঁশি। যে বাঁশির ফাঁসিতে আমি ঝুলে আছি একজীবন। ঝুলতে ঝুলতে লিখি— সুখে থাকার স্বপ্ন দিলা সুখ তো দিলায় না, কত সুখে আছি বেঁচে খবর নিলায়না/আমি ছাড়া কেউ নাই আমার দুখের পরিজন/আমারে ডুবাইতে তোমার এত আয়োজন।

কৈশোরে এক নিকটাত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। সকালে ঘুম ভাঙল একজনের গালির শব্দে। কে কাকে গালি দিচ্ছে বুঝতে সময় লাগল। জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি বাড়ির কর্তা, মুরব্বী। আকাশের দিকে তাকিয়ে গালি দিচ্ছেন সৃষ্টিকর্তাকে। কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ করে বলছেন ‘আমারে কেন এই বিপদে ফেলছিস তুই, কী অপরাধে?’ খুব মন খারাপ হলো দৃশ্যটি দেখে। জানতে পারি দেনার দায় তাকে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত করে তুলেছে।

এইভাবেই দিনের পর দিন, বছরে পর বছর গ্রাম, হাওরের আলো বাতাস— বিপন্ন মানুষের হায়-হুতাশ, জীবন-ফাঁদ, সংসার-ফাঁদ দেখতে দেখতে নিজের ভিতরে গোপনে রচিত হয়েছে এই গান— ‘মায়া ঘেরা ভবের জালে আমায় কইরা বন্দী, জানি না কি করছো উদ্দেশ, কিবা করছো ফন্দি”।

জীবনভর গান কবিতা কিংবা ডাইরির পাতায় কিছু একটা টুকে রাখতে এসে আমি হয়তো আমার বেঁচে থাকাটাকেই লিখতে চেয়েছি। লিখতে পারিনি কিংবা সব মুহূর্ত শব্দে ধরাও যায় না। তখন নৈঃশব্দ রচনা করি। নৈঃশব্দের শব্দ দিয়ে রচনা করি অলৌকিক কোনো কোলাহল।

পাঠ্য বইয়ের বাইরে প্রথম যা পড়েছি, তা ছিল কবিতা। যা লিখেছি, তাও কবিতা। কবিতায় যেদিন নিজের করুণ মুখ দেখতে পেয়েছিলাম, সেদিনই মনে হয়েছিল— এরচেয়ে দুখী মানুষ, পৃথিবীতে হয় না।

নিজের কোনো পরিচয়কে এগিয়ে রাখার সাহস নাই। বরং পিছিয়ে রাখার দুঃসাহস আছে। এমন কোনো শব্দ কিংবা বাক্য আজো লিখে উঠতে পারিনি, যা লিখলে পরে নিজের পরিচয়কে সামনে এগিয়ে রাখা যায়। পাঠ্য বইয়ের বাইরে প্রথম যা পড়েছি, তা ছিল কবিতা। যা লিখেছি, তাও কবিতা। কবিতায় যেদিন নিজের করুণ মুখ দেখতে পেয়েছিলাম, সেদিনই মনে হয়েছিল— এরচেয়ে দুখী মানুষ, পৃথিবীতে হয় না। আমি তাই খুঁজতে শুরু করেছিলাম নিজের দুঃখটাকেই। যা জানি না আজো।

গান ভালো লাগে। গান আমার আশ্রয় লাগে। প্রেমিকা লাগে। জীবনটাকে মনে হয় গান শেখার আনন্দ। সুযোগ পেলেই গাই, একটু দূর থেকে শুনলে মনে হবে— শীতার্ত গরীব, রিলিফের কম্বল না পেয়ে দুঃখে আটোসাঁটো হয়ে কাঁদছে। গান গাওয়ার অজুহাতে আমি কেঁদে ফেলি জমানো সব কান্না। প্রকাশ্যে কান্না মনে হলেও গোপনে গান আমার কাছে বিলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। চান্স পেলেই গানের বিলাপে রচনা করি বর্তমান আর ভবিষ্যত। শুধু কাগজে কলমে আর কান্নায় নয়, শ্বাসে প্রশ্বাসেও।

গতবছর মগবাজার রেল ক্রসিংয়ে হঠাৎ একটা মানুষের কাটা পা ফেলে গেল চলন্ত ট্রেন। কিশোরের পা। শরীরের বাকি অংশ নাকি রয়ে গেছে কয়েক টুকরা হয়ে। এই কিশোরের গল্পটাও খুব করুণ, বাবা মারা গেছেন তিনদিন আগে। সেই শোকে ছেলেটা অন্যমনস্ক হাঁটছিল রেল লাইন ধরে। আর একটা নিরুপায় ট্রেন তার উপর দিয়ে চলে গেল কী এক নিদারুণ দুঃখ রচনা করে। আমার জীবনটা এরকম, নিদারুণ দুঃখের তল্পিবাহক হয়ে অচেনা সব স্টেশনে গান খুঁজে ফেরে। যে স্টেশনে কোনোদিন সুখের ট্রেন থামে না।

কবিতার আয়নায় নিজের দুঃখিত মুখের উৎস খুঁজে না পেলেও গানে এসে জেনেছি— জীবনটাই গান। বেতাল সুরের গান। তাকে তালে আনতে কতো নদীকে জোর করে সমুদ্রের কাছে বন্ধক রাখতে হয়, সে হিসেব কেউ যদি লিখে রাখত, হায়! গান আমাকে স্পর্শে পেল সেইদিন, পৃথিবী আমাকে যেদিন পেল। জন্ম আমাকে যেদিন পেল।

অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কাছ থেকে জীবনের পোস্টার ধার করে একটা গানের আশায় বের হয়েছিলাম পথে। জানি না কবে ফুরাবে এই পথ, আমার মৃত্যু হবে গানের ভিতর, এটাই শপথ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক, গীতিকার, লেখক ও পরিচালক। তিনি শ্রেষ্ঠ গীতিকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৭ লাভ করেন। তিনি স্বপ্নসিঁড়ি অডিও ভিজুয়ালের প্রধান নির্বাহী। জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার নুরপুর গ্রামে। ২০০০ সালে লেখালেখি শুরু করেন। প্রকাশিত বইসমূহের মধ্যে আছে ‘ফুলপাখির জন্মমৃত্যু’, ২০১০; ‘স্মৃতিমেঘ, স্বপ্নজালরেখা’, ২০১৩; ‘দখিন দুয়ারের হাওয়া’, ২০১৪; ‘ও জীবন ও মায়া’ ২০১৬ ইত্যাদি। তার পরিচালিত প্রথম টিভি নাটক ‘ফাঁদ’। তিনি নাটকটির গল্পও লিখেছেন। সেজুল হোসেন গান লেখা শুরু করেন২০০৬ সালে। তিনি শতাধিক গান লিখেছেন। ‘সত্তা’ চলচ্চিত্রের ‘না জানি কোন অপরাধে’ গান রচনার জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৭ লাভ করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।