প্রকৃতি
আজ কোনো প্রহরী নেই, ভারী হয়েছে আকাশ
শহরে বর্ষণ হবে।
কাকনীল পোষাক পরেছে নারী, যোগী,
বর্ষণের আকাঙ্ক্ষা তারও
শরীর ভেঙে আজ বর্ষণ হবে,
বাইবেলের পৃষ্ঠাগুলি নেচে বেড়াবে ভয়ঙ্কর..
রাজপথ যানজটলা কেটে কেটে
শ্বেতসন্ন্যাসী ফ্যাকাসে এবং
ঝড়ের শেষে… বৃষ্টি।
জীবন ও গান
যে যেখানে থাকো
তোমাদের উপর বর্ষণ হোক
আলার, অমৃতের, আনন্দের, জীবনের,
কেননা তুমি আমি অন্য পৃথিবী, অন্য মানুষ।
শুনি শীতঝরা পাতাদের দীর্ঘশ্বাস, বাঁধি
দেবতার কণ্ঠস্বর টানি অর্জুনের ধনুক ছিলা।
নগ্নতা, পরচর্চা, আজ আমরও প্রণাম নাও
গাও বৃষ্টির সুর, দাও বেদনার অগ্নিদাহ,
নাও পোড়াও এই প্রাণবাটি
জ্বালো প্রেরণার ধুপকাঠি।
রঙ ঢেলে দাও উপুড় করে
চরণ ফেলো আপন মনে একবার
যে বেড়াল তোমায় বার্তা পাঠায়
আজ তার সঙ্কট তীব্র অতি।
দূর আরও বহুদূরে শেয়ালেরা সভায় বসেছে
যন্তর মন্তর ছো, একটান, দুইটান—
‘খাড়ান ভাইসব
এক পা ও নড়বেন না, গলা দিয়া রক্ত উটবো।’
তিনটান। কালো কাপড় আবৃত।
চকচকে ছুরি ধড় বরাবর
দেহটি নড়েচড়ে শেষ চিৎকার—
’দ্যাখেন ভাইসব, দুইচক্ষু খুইল্ল্যা দ্যাখেন
গলাখান আলগা হয়া গ্যাছে,
এইবার আমার কেরামতি।’
আবরণ উন্মোচিত, বালকের হাসি।
’ যে যেহানে আছেন সিকিখান ফেলাইয়া যান।’
জীবনের গান, অন্ধকার বেদনার
অন্ধকার বিদায়ের, অন্ধকার প্রেরণার।
অলুক্ষণে পেঁচা
দুঃখ আর অমানিশা থেকে সেরে ওঠা গেল না আজও
তোমাদের আত্বীয়তা নিয়ে সন্দেহ হয়।
এক জীবনে কত আর পিঁপড়ের সারিতে সার বাধা যায়
কিংবা কোনো বাতাস-তাড়িত শব্দ জলযোগ বিচ্ছিন্নতা
ধারণ করা যায়!
তুমি উড়ো চিঠির ভয়ে সিঁধিয়ে থাকো
অথবা আটকে থাকো দমবন্ধ গুমট অন্ধকারে
বাদুড় হয়ে লটকে থাকো
লেখো যত দূর্নিবার হয়ে ওঠার গল্প।
ময়দানের হাওয়া
ময়দানের হাওয়া থেকে জেনেছি তারা আসলে নারীভুক, হিংসাতুর
তাদের মুখের দিকে মুখ করে বলেছি,’আমার চোখের দিকে চোখ
রেখে দেখো কতটা অসুখী আমি!’
তোমদের আনন্দ হয় খুব, উল্লোসিত হয়ে ওঠো যখন মৃত্যুকালীন
সময়ে জীবনের দিকে হাত বাড়াই, তোমরা লিখো যত
নারকীয় পুরনো এথিকস। মুষড়ে পড়ি আমিও।
সেবার ধর্মশালায় ঠাকুরকে জেগে উঠতে দেখলাম
অসম্ভব রাগী ক্ষয়াটে মুখ, মেট্রাতে চড়ে
দেখেছি তোমদের বাড়ি ফেরার ক্লান্তি।
প্ল্যানেটোরিয়ামের আকাশে তার জেগে ওঠা ক্লান্তিকর
বিসমিল্লাহর সানাই কানে বাজে,
শান্তিনিকেতনে একদিন খুব ভোরে কোপাইয়ের ধার ঘেষে
যেয়ে দেখেছি মানুষ অনন্ত জেগে থাকে ছবি ছবি মুখ করে।
ঝিনুক ঝিনুক ঝিনুক
আমার মৃত্যুদিনে চেয়েছিলাম
এক আজলা ভরা জল আর মুঠোভর্তি
ঝিনুক ঝিনুক ঝিনুক…
ঝিনুক আমায় সমন পাঠায়,
কোনো এক দরবেশে এসে
আমার কপালে রাখে হাত,
বলে, ’এখানে এক অজানা
কুহকের দেশ আছে, জন্ম
মৃত্যু যেখানে এক
সুতোয় বাঁধা।’
দরবেশের হাতে তখন
জাদুর বাটি গলায় ঝোলানো
মৃতদের খুলি, চোখ তার
রাঙতার রঙে রাঙা।
দরবেশের বেশে সে ছিল মৃত্যুর দূত,
আমার আত্মাকে খাঁচাবন্দি করে
নিয়ে গেছে অনেক দূরের পথে,
ধুলো উড়িয়ে সে চলে
সাথে নিয়ে চলে এই আমারি হাড়খুলি,
কত মৃত্যু কত শোক কত অভিশাপ
এগিয়ে আসে,
কত ধূলিকনা, সুরের পথ মাড়িয়ে এসেছি
খাঁ খাঁ মরুভুমে…
কোথাও কোনো বর্ষাদিনে কারো ঘুমে—
জেগে উঠেছিল যে সবুজ প্রাণ,
তারে বলি,
’ও রকম মুগ্ধ বর্ষায়
কেন তুমি জেগেছিলে
সবুজ পাতার নিঝুম মর্মরে!’
তুমি তবে গাছ হও, হও মরুভুমি
কিংবা মৃত্যুময় ঘুমের নদী,
লাল কোড়াপাখি।
থেরীগাথা
আমি যেদিন আমার ক্ষতসমেত বুদ্ধের সন্মুখে এসে
দাঁড়ালাম তিনি তার অর্ধনিমিলিত চোখ তুলে তাকালেন
আমার দিকে। অন্ধ আমার দু’চোখ দৃষ্টি পেল ফিরে।
আমার ক্ষত শুকিয়ে সেখানে জন্ম নিলো তারাজ্ঞান
মহাজীবন আর রুদ্র জীবনের মাঝে সৃষ্টি হলো এক
যোগসূত্র । উত্তরের হাওয়া এসে ঝরাপাতাদের
উড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে গেল। মৃতগাছে জন্ম নিল
সবুজ পাতা। আমার হাহাকারের জীবনে পেলাম
দিব্যজ্ঞান। বুদ্ধ বললেন, ’জীবন-মৃত্যুর মাঝে
যে জীবন সে জীবন তোমাকে দিলাম।
আমি শূন্যের মাঝে যেমন ছিলাম তেমনি
মিলিয়ে গেলাম। যেখানে কোলাহল গেছে থেমে
নগরবাসী তাদের অমারাত্রির স্বপ্ন বুকে নিয়ে
থাকে ঘুমিয়ে, জেগে উঠবে বলে কোনো
রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে।
পৃথিবীর সব দুঃখ লীণ হবে কি হবে না
থেমে থাকে না থেরীগাথা,
হাজার বছর ধরে তা বয়ে চলে।
খঞ্জনা হাতে বৈষ্ণবী কাহ্নপা মীরার দেশে জন্ম নেয়া এক কবি আমি,
অশীতিপর বৃদ্ধাকে শুধাই ‘তুমি কেন কম্বল না নিয়ে শীতে জুবুথুবু!
বৃদ্ধা তার ছানিপড়া চোখে উঁচুনিচু পথ হাঁটতে হাঁটতে জানায়,
‘গেল শীত আমার এভাবেই কেটেছে, আজ না হয় উষ্ণতার দিকে হাত বাড়ালাম না। দেখি শীত আমায় মৃত্যু এনে দেয় কিনা!’
যুদ্ধ
ক’টা বুনো শুওর আর একটা লেজঝোলা পাখি চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে, বলছে দিবো নাক ভোতা করে। কেন শুধু শুধু নিজেকে টেনে বেড়াচ্ছো! বেরিয়ে পড়ো, বেরিয়ে পড়ো বলে চেচাচ্ছে একটা বুনোহাঁস, ওর ডানায় বুনো গন্ধ, ওর আকাশে নীল মেঘের আনাগোনা। বুনোহাঁহাসের দিকে তাকিয়ে বলছি দেখো আমার আকাশ এই তোমার চোখের মতো। বুনোহাঁস গান গায়, দলের সাথে তাল মিলিয়ে তার চলা। সে ভেসে চলে হয়ে যায় বিন্দু বিন্দু ছোট ছোট হাঁস। এতো দীন দরিদ্র মানুষ দেখে নিজেই দরিদ্র বেশে তোমাদের দিকে তাকানো ভুলে গেছি, ভুলে গেছি জীবনে কিছু গান আছে। একটা নিমগাছ কেমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অচেনা রোগের সাথে তার দীর্ঘ লড়াই। আমারও এক ঘোর লড়াই যুদ্ধময়, পুরো পৃথিবীর মতো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা নাকি জীবন। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শেষে জীবনটাকে নিয়ে ভেসে যাব মেঘ হয়ে, বৃষ্টি হয়ে। পৃথিবীর জিভ কেটে ফেলেছে কেউ, তার ঘাড় মটকে দিয়ে খুব উল্লাস চলছে, দাউদাউ করে ভস্ম থেকে ভস্ম হয়ে পৃথিবীতে এক ধিক ধিক করা আগুন, ছড়িয়ে পড়েছে রাজপথে।
মেপল লীফ
একটা ঝড় বইছে একটা চাপা আতঙ্ক এ শহরে ভাইরাসের মতো
ছড়িয়ে পড়েছে যার নাম মৃত্যু। মৃত্যু যেকোন সময় তোমর ঘাড়
মটকাতে পারে তুমি জানবেও না। শুধু ভাবো মৃত্যুটা সহজ হবে
নাকি বিভৎস!
মৃত যারা তারা এসে যদি বলতো, কতটা সহনীয় ছিল
মৃত্যকালীন সময়টা। সেই চাপা আতঙ্ক নিয়ে ঘুরে বেড়াও, কাশফুল
দেখো, দেখো শরতের আকাশ কতটা নীল।
দেবীর আগমনী, বুদ্ধের অহিংস বাণী, জেসাসের করুণ মূর্তি
আমাদের আশ্বস্ত করতে পারছে না,
ভাবো বেরিয়ে পড়বে এই মৃত্যু আতঙ্ক থেকে রেহাই পেতে।
কোথায় যাবে, সবখানে ওৎ পেতে আছে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্ধ!
তুমি মেপল লীফ দেখে মুগ্ধ হয়ে মেপল লীফ, মেপল লীফ
গান করো ’জানো না বরফ পড়বে আর কিছুদিন পরেই,
শীতের চাবুকের নীচে ঢাকা পড়বে ওর সব সৌন্দর্য।
পাখিদের পাঠশালা
সামাজিক একটা আবর্তে ডুবে গেছি
সেখানে বাজছে কত সুরহীন অর্থহীন
প্রলাপের মতো রক, জ্যাজ মিউজিক।
জীবনটা ঢুকে গেছে রক মিউজিকে
আউলা ঝাউলা চুলে ব্যান্ড
বাজাচ্ছে পাড়ার সেই খুদে উঠতি মাস্তান।
তাতে সায় দিচ্ছে সদ্য ভার্সিটি পড়ুয়া
কোন তরুণ, আমার জীবন সেখানে
কোলাহলময় এক অরণ্য ভাসছে
চাঁদের আলোয় অন্ধকার গেছে উবে।
সে অরণ্যে গাছেরা নিজেরা কথা বলে
ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে।
এখানে মৃতেরা গান গায়
জীবতরা তাতে কর্ণপাত করে নাই,
আমি তখনো বধির শোরগোলে
গাছেরা কি বলে বুঝতে চাইলে শুনি
টুং টাং পাখিদের স্বর বিলাপের মতো।
পাখিদের বলি চলো ঢেউ দেখি
জল কেমন আছড়ে পড়ে বালুতটে!
ওরা উড়তে উড়তে পাতা হয়ে যায়
পাতাগুলো একদিন মরে যায় আর
সেখানে জন্মায় সজীব নতুন পাতা।
জন্ম-জন্মান্তরের ভেতর দিয়ে আমি
পার হই এক পুলসিরাত যেখানে
ফুটন্ত লাভার গনগনে আঁচ গায়ে
এসে লাগে, আমার দখিন জানালায়
এক মায়া পাখি গেয়ে চলে অবিরাম।
মৃত্যু
যখন অসুস্থ তুমি, ভাবো
মরেই হয়তো যাবে—
ভালোবাসো, পৃথিবীকে।
ভালোবাসো, গলির মোড়ের শিশুটিকে
বৃদ্ধকে আস্থার হাত দাও
বাড়িয়ে, গোলাপ ভালোবাসো,
দেখো কেমন রঙিন পৃথিবীটা!
আজকের চাঁদ কালকের অমাবস্যা
আজকের রোদ কালকের বৃষ্টি।
অন্ধ হয়ো না, না হও কালা
কান পেতে শোন কান্না পাখিদের, ওরা
কোথাও মৃতের জন্য করে নাকি শোক!
উড়তে চেয়েছে চাঁদের আলোয় মুক্ত
যে পাখি উড়তে তাকে দাও,
ভোরে পাবে তাকে মৃত।
ডানামুড়ে চোখবন্ধ করে
পড়ে আছে ছাতিমের তলে,
শুনবে না তুমি তার স্বর
দেখবে না তার পুচ্ছ তুলে
নিঝুম মল্লার।
নব্বই দশকের কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, এম.এড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জন্ম ঢাকায়, পেশা শিক্ষকতা। আয়শা ঝর্নার কবিতা বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক পরিসরে ইংরেজিতেও ছাপা হচ্ছে। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : ‘আাঁধার যান’ (কবিতা, ১৯৯৬), ‘মাত্রমানুষ’ (কবিতা, ২০০৩), ‘উনুনের গান’ (কবিতা, ২০০৫), ‘আয়না রক্ত হল্লা’ (কবিতা, ২০০৭), ‘বাতাস তাড়িত শব্দ’ (কবিতা, ২০১০), ‘শূন্য ও পৃথিবী’ (কবিতা, ২০১৭), ‘গোলাপের নাম মৃত্যু’ (কবিতা, ২০২১), ‘সিলভিয়া প্লাথের এরিয়েল’ (অনুবাদ, ২০১০), ‘নারীস্বর’ (বিশ্বের নারী কবিদের কবিতার অনুবাদ, ২০১৪), ‘কাভাফি’র কবিতা’ (অনুবাদ, ২০১৮), ‘চারকোল’ (গল্প, ২০০৮), ‘শিল্প ও নারীসত্তা’ (প্রবন্ধ, ২০১৩)।