শুক্রবার, নভেম্বর ৭

ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রগুলোর সংগ্রাম আজও প্রাসঙ্গিক…

0
Rittik-Ghatak-5

ঋত্বিক ঘটক


ঋত্বিক ঘটকের নারী চরিত্রগুলো ছিল তাঁর চলচ্চিত্রিক দর্শনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের মাধ্যমে তিনি দেশভাগের যন্ত্রণা, সামাজিক অবক্ষয় এবং মানবিক অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলোকে তুলে ধরেছেন।

ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রগুলো কেবল পার্শ্বচরিত্র ছিল না, বরং তাদের ছিল এক উল্লেখযোগ্য এবং কেন্দ্রীয় ভূমিকা। তাঁর নারী চরিত্রগুলো সমাজের বাস্তবতার দর্পণ, যারা দেশভাগ, দারিদ্র্য এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপ মোকাবিলা করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করে। ঋত্বিক এই চরিত্রগুলোর মাধ্যমে শুধু বাংলার নারীর সংগ্রামই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির টিকে থাকার অদম্য স্পৃহাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর চলচ্চিত্রে নারীরা কেবল পারিবারিক বা প্রেমের চরিত্র নয়, বরং তারা যুদ্ধ, দেশভাগ, দারিদ্র্য ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের প্রতীকী ও সক্রিয় সাক্ষী।

 

আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতীক

ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রগুলো প্রায়শই আত্মত্যাগ ও অদম্য সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সুখ, স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে আগলে রাখে।


Photo_3

‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রের নীতা চরিত্রে সুপ্রিয়া চৌধুরী


নীতা: সুপ্রিয়া চৌধুরী (‘মেঘে ঢাকা তারা’-১৯৬০): ঋত্বিকের নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে নীতা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে পরিচিত এবং শক্তিশালী। দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হওয়া একটি পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে নীতাকে তার অসুস্থ বাবা, বেকার ভাই এবং বিবাহযোগ্যা বোনকে সামলাতে হয়। নীতা একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, যে দেশভাগ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট ও পারিবারিক দায়িত্বের বোঝা বহন করে। নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে, টিউশনি করে এবং অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করে সে পরিবারের হাল ধরে। নীতার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং শেষ পর্যন্ত কঠিন রোগের কাছে হেরে যাওয়া বাঙালি নারীর চিরাচরিত বলিদানের এক মর্মস্পর্শী চিত্র। তার ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই!’ আর্তনাদ কেবল তার ব্যক্তিগত নয়, হাজারো নীতার অব্যক্ত কষ্টের প্রতিধ্বনি।

মা: গীতা গহাই (‘মেঘে ঢাকা তারা’-১৯৬০): নীতার মা ঐতিহ্যবাহী নারী চরিত্রের প্রতিনিধি, যিনি পরিবারের সংকটে নীতাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হোন, যা নারীর ওপর পারিবারিক ও সামাজিক চাপকে ফুটিয়ে তোলে।


Sita_1

পতিতালয়ে নিজের ঘরে তার ভাইকে দেখার পর সীতার চোখের বিগ ক্লোজাআপ শট


সীতা: মাধবী মুখোপাধ্যায় (‘সুবর্ণরেখা’-১৯৬১): এই চলচ্চিত্রে সীতার চরিত্রটি দেশভাগের ফলে সৃষ্ট নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হওয়া নারীর প্রতীক। শৈশবে ভাই ঈশ্বরের সঙ্গে এক নতুন জীবন শুরুর স্বপ্ন দেখলেও, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সে পতিতাবৃত্তির শিকার হয়। ঋত্বিক দেখান কীভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ নারীকে তার নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত করতে বাধ্য করে। সীতার ট্র্যাজেডি কেবল তার ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং একটি ভেঙে যাওয়া সমাজের পতনকেও নির্দেশ করে। সীতা চরিত্রে নারী শরীরে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত ও সামাজিক নিষ্পেষণের চিহ্ন ফুটে ওঠে।

 

নয়ন: অপর্ণা দাসগুপ্ত (‘সুবর্ণরেখা’-১৯৬১): নয়নের চরিত্রে নারীর যৌনতা ও শোষণের বিষয়টি উঠে আসে, যা ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে নারীর দুর্বলতা ও শক্তির দ্বৈতভাবকে প্রকাশ করে।

 

মানবিকতা ও সংবেদনশীলতার ধারক

ঋত্বিকের নারী চরিত্রগুলো পুরুষ চরিত্রদের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক এবং সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। তারা সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখে, অন্যদের প্রতি সহানুভূতি দেখায় এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালোবাসার ক্ষমতা বজায় রাখে।

অনসূয়া: সুপ্রিয়া চৌধুরী (‘কোমল গান্ধার’-১৯৬১): অনসূয়া চরিত্রটি একসময় নাট্যদলের অংশ ছিল এবং দেশভাগের যন্ত্রণা তাকেও বিচলিত করে। তার মধ্যে পুরোনো দিনের স্মৃতি এবং শিল্পকলার প্রতি ভালোবাসা প্রবল। সে অতীতের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে এবং বিভেদের মধ্যেও ভালোবাসার সেতু তৈরি করতে চায়। তার চরিত্রে নারীর আত্মানুসন্ধান এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ফুটে ওঠে।

সাবিত্রী: ছায়া দেবী (‘কোমল গান্ধার’-১৯৬১): অনসূয়ার মা, যিনি ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সংকটে আক্রান্ত হোন। তাঁর চরিত্রে নারী হিসেবে ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘাত দেখা যায়।


Basonti

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে বাসন্তী চরিত্রে রোজী সামাদ


প্রকৃতি ও মাতৃভূমির সাথে সংযোগ

অনেক সময় ঋত্বিকের নারী চরিত্রগুলো প্রকৃতির সঙ্গে বা মাতৃভূমির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে। তাদের সংগ্রাম যেন সেই ভূমি, নদী বা প্রকৃতির সংগ্রামেরই অংশ।

বাসন্তী: রোজি সামাদ (‘তিতাস একটি নদীর নাম’-১৯৭৩): এই চলচ্চিত্রে বাসন্তী নামের এক তরুণী তিতাস নদীর সঙ্গে জেলেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের প্রতীক। তার জীবন, ভালোবাসা এবং ট্র্যাজেডি যেন নদীর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তিতাস যেমন জেলেদের জীবনধারণের উৎস, তেমনি বাসন্তী সেই সমাজের প্রাণের স্পন্দন। নদীর ক্ষয় যেমন সমাজের ক্ষয়কে নির্দেশ করে, তেমনি বাসন্তীর জীবনের বিয়োগান্তক পরিণতি এক হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার বেদনার্ত ছবি। বাসন্তী নিম্নবর্গের নারী, যে নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম। তার চরিত্রে নারীর প্রাকৃতিক সত্তা এবং সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই দেখা যায়।

রাজার ঝি: কবরী সরওয়ার (‘তিতাস একটি নদীর নাম’-১৯৭৩): এই চরিত্রটি নারীর ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংঘাতকে প্রতিফলিত করে।

 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমালোচক

ঋত্বিক তাঁর চলচ্চিত্রে পরোক্ষভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সীমাবদ্ধতা ও চাপকে তুলে ধরেছেন, যা নারীদের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। নীতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবার তাকে অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহার করে, কিন্তু তার ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়াকে গুরুত্ব দেয় না। পুরুষ চরিত্রগুলো যখন আদর্শের দ্বন্দ্বে বা বেকারত্বের কারণে হতাশায় ভোগে, তখন নারী চরিত্রগুলোই পরিবারকে টেনে নিয়ে যায়। এটি এক প্রকার নীরব প্রতিবাদ, যেখানে নারী চরিত্রগুলোর শক্তি এবং পুরুষ চরিত্রগুলোর দুর্বলতা বিপরীতভাবে চিত্রিত হয়।

 

নিপীড়ন ও প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা

যদিও ঋত্বিকের নারী চরিত্রগুলো প্রায়শই চরম নিপীড়নের শিকার হয়, তবুও তাদের মধ্যে বাঁচার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিরোধের একটি নীরব স্পৃহা থাকে। নীতার শেষ মুহূর্তের চিৎকার ‘আমি বাঁচতে চাই’-এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তারা কেবল পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকে না, বরং নিজেদের মতো করে হলেও সংগ্রাম চালিয়ে যায়।

ঋত্বিক ঘটকের নারী চরিত্রগুলো ছিল তাঁর চলচ্চিত্রিক দর্শনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের মাধ্যমে তিনি দেশভাগের যন্ত্রণা, সামাজিক অবক্ষয় এবং মানবিক অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলোকে তুলে ধরেছেন। তিনি নারীদের মাধ্যমে দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, শ্রেণিসংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে ব্যক্ত করেন। নারী চরিত্রগুলি প্রায়ই বিপর্যয়ের শিকার, কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয় ভিক্টিম নয়; তারা সংগ্রামী, স্বপ্নদ্রষ্টা ও সমাজের পরিবর্তনের সাক্ষী। তাঁর নারী চরিত্রগুলি মাতৃভূমি ও নস্টালজিয়ার রূপক হিসেবেও কাজ করে। এই চরিত্রগুলো কেবল কাহিনির অংশ ছিল না, তারা ছিল বাঙালি জাতির এক চলমান ইতিহাস, যাদের সংগ্রাম আজও প্রাসঙ্গিক।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

চলচ্চিত্র নির্মাতা

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।