শুক্রবার, জুলাই ২৬

‘একমাত্র বাংলাদেশেই ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে রক্ষণশীলতা দেখা যায়’ ─উম্মে ফারহানা

0
Umme Farhana 0

উম্মে ফারহানা

উম্মে ফারহানার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরে। লেখাপড়া করেছেন বিদ্যাময়ী স্কুল, মুমিনুন্নিসা সরকারি কলেজ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা করছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। তাঁর দুই সন্তান প্রকৃতি আনন্দময়ী ও পৃথিবী আলোকময়। লেখালেখির প্রধান ক্ষেত্র কথাসাহিত্য। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চারটি। ছোটোগল্প ‘দীপাবলি’ (২০১৬), ‘ফওজিয়ার আম্মা আর অন্যরা’ (২০২২), ‘টক টু মি’ (২০২৩) এছাড়া একটি উপন্যাস ‘রাত্রিশেষের গান’ (২০২৪)। ‘রাত্রিশেষের গান’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই সাক্ষাৎকারে নিজের লেখালেখি, নারীবাদ, বাংলা সাহিত্যের বর্তমান প্রবণতা, পাঠকের অভিমুখ, নগরজীবনের সংকট এবং মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের স্বরূপসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। শ্রী ওয়েবম্যাগের জন্য তার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সাবিরা শাওন


সাবিরা শাওন: আপনার লেখা যতটা পড়েছি সেখানে অনেক লেখায় বেশ ভিন্নতা চোখে পড়েছে। যেমন, ২০২৩ সালে প্রকাশিত আপনার ৩য় গল্পগ্রন্থ ‘টক টু মি’ এর নামগল্প ‘টক টু মি’ সহ ‘গণশাদা’, ‘সুজানা’। যদিও জানি যে ফিকশন লেখার সময় লেখক তার কল্পনাকেই বেশি প্রশ্রয় দেন। তবুও আমার জানতে ইচ্ছে করছে ২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত আপনার ‘রাত্রিশেষের গান’ উপন্যাসের রাত্রি চরিত্রটির হুইলচেয়ারে বসে একটা বিষণ্ন দিন যাপনের গল্প; আইডিয়াটা ঠিক কীভাবে এলো?

উম্মে ফারহানা: ২০২২ এর মার্চ মাসে আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম, সামান্য ব্যথা। কাটেনি, রক্ত বের হয়নি, তাই ইগনোর করেছি। কিছুদিন পর জায়গাটা বেগুনি হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন সেলুলাইটিস হয়ে গেছে, যার পরের ধাপ নাকি গ্যাংগ্রিন। ডায়বেটিস থাকাতে ব্যথা টের পাচ্ছিলাম না। সাত দিনের বেডরেস্ট দিলেন, বাথরুমে যাওয়া ছাড়া সারাক্ষণ বিছানায় থাকতে হবে। তখন এক গ্লাস পানির জন্যও অন্য কাউকে ডাকতে হয়েছে। টের পেলাম, নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে না পারলে কতটা অসহায় লাগে। এমন যদি হয় যে একজন খুব একটিভ মানুষ হঠাৎ করে এমন পরনির্ভরশীল হয়ে যায় যে তার প্রতিটি ব্যক্তিগত কাজে অন্যের সাহায্য দরকার হয়, চাইলেই সে বাইরে যেতে পারে না, শেলফ থেকে একটা বই নামাতে পারে না, এমনকি একা একা সে শাড়ি পড়তে পারে না, তাহলে তার ভেতরে কী চলতে পারে? এই ভাবনা থেকেই লেখা শুরু করেছিলাম, সে বছরই, ঈদের ছুটিতে। পরের বছর, মানে ২০২৩-এর প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় ‘গ্রাসিয়াস আ লা ভিদা’ নামে বের হয় এই আখ্যানটি।

 

সাবিরা শাওন: আগের ‘টক টু মি’-তে দেখছি কিছু হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি গানের লাইনের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার যা নিঃসন্দেহে লেখায় অন্যরকম মাত্রা যোগ করেছে। এইবার উপন্যাসে দেখলাম স্প্যানিশ ভাষায় গানের ব্যবহার। সাধারণত অনেক লেখায় আমরা রেফারেন্স হিসেবে গানের ব্যবহার দেখি। কিন্তু আপনার লেখায় পাঠক হিসেবে আমার কাছে গানগুলোকে ন্যারেটিভেরই একটা অংশ মনে হয়েছে। লেখক হিসেবে আপনি কি গানগুলোকে রেফারেন্স হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছেন? এবং লেখায় এই ভিন্নতা প্রয়োগের পিছনে কোনো গল্প আছে কি না।


Umme Farhana 2_Model Nizhum Haque

উম্মে ফারহানার গল্পগ্রন্থ ‘টক টু মি’। বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মডেল হয়েছেন নিঝুম হক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া।


উম্মে ফারহানা: আমরা একটা মনোলিঙ্গুয়াল সমাজে বাস করি। বাংলা ছাড়া আমাদের আর কোনো ভাষার ওপর দখল তো নেইই, ব্যবহার করতেও পারি না সেভাবে। এমনকি শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের ব্যাপারেও অনেকে বেশ কট্টর। শিল্পের মাধ্যম হিসাবে ভাষা কিন্তু কম জরুরি একটা ব্যপার। মনে করো, চলচ্চিত্র। কোরিয়ান ছবি আমরা দেখি, কিংবা ফরাসি। আবার আমাদের উপাসনার ভাষা আরবি। সেটা কি আমরা বুঝি? না বুঝলেও আজান আমাদের মনে যে অনুভূতি সৃষ্টি করে, কোরান তেলাওয়াত কিংবা ধরো যে হজের সময় যে লাব্বায়েক ধ্বনি কাবা প্রদক্ষিণের সময় আবৃত্তি করা হয়─ সেগুলোর প্রভাব তো আমাদের মনে পড়ে। একটা অল্প পরিচিত ভাষা, যেটি আমরা পুরোপুরি বুঝি না সেটির ধ্বনিগত মাধুর্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই বলে আমি মনে করি। আমেরিকার শিশুরাও কিন্তু একটা সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ শেখে স্কুলে, আমাদের ইংরেজি শেখার যে উদ্দেশ্য, ওদের স্প্যানিশ বা ইটালিয়ান শেখার উদ্দেশ্য কিন্তু এক নয়। এমনকি ভারতের প্রায় সব মানুষ নিজের মাতৃভাষা বাদে আরও দুই তিনটি ভাষা অল্পবিস্তর জানেন। অমিতাভ ঘোষের ‘সী অব পপিজ’ উপন্যাসে বাংলা ফরাসি ভোজপুরি হিন্দি─ ইংরেজি বাদে এই চারটি ভাষার শব্দ বাক্য এমনকি সংলাপ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে যদিও সেটি মূলত ইংরেজি বইয়ের পাঠকদের জন্য লেখা। আবার কোরিয়ান ছবি ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’-এ দেখবে শেষদিকে স্প্যানিশ গান আছে। এমন ভূরিভূরি উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। একমাত্র বাংলাদেশেই ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে রক্ষণশীলতা দেখা যায়। নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, উনার গানে ‘দিল উয়োহি মেরা ফাঁস গ্যায়ি’ কিংবা কবিতায় ‘খুন কিয়া খুনিয়া’ পাবে। তো সাংস্কৃতিকভাবে পলিগ্লট হওয়াটাকে আমি খুব পজিটিভ ব্যাপার হিসেবে দেখি। পাঠক ভিন্ন ভাষার এলিউশন পড়ে বিরক্ত হতে পারেন কি না সেটা আমলে নিই না। এটা গুগলের যুগ। কেউ কোনো রেফারেন্স না বুঝলে এক মিনিটে সেটা গুগল করে নিতে পারেন, সবার হাতে ফোন আছে। এই একই কারণে আমি কলোকুয়্যাল বা ডায়ালেক্ট ব্যবহারেরও পক্ষে।

 

সাবিরা শাওন: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি, আমরা জানি, আপনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছেন এবং এখন পড়ান। এই সাহিত্যের ছাত্রী হবার সুবাদেই কী লেখালেখিটা আরও বেশি আগ্রহের জায়গা থেকে করে যাচ্ছেন নাকি এর সাথে সংশ্লিষ্ট না হলেও আপনি এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই লিখতেন?

উম্মে ফারহানা: আমি প্রথম বই বের করেছি ২০১৬ সালে। তখন আমি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক এবং দুই সন্তানের জননী। কিন্তু আমি লিখি ২০০০ সাল থেকে, ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, যায় যায় দিন এসব পত্রিকার পাঠকের পাতায় পাঠাতাম, ছাপাও হতো। তখন ফেইসবুক ছিল না বলে বন্ধুবান্ধব অনেকেই জানত না যে আমি লিখি। বরং সাহিত্যে পড়ার সময় লেখালেখি বন্ধ ছিল। সাহিত্যে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সঙ্গে সৃজনশীল লেখার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করি। অধিকাংশ সাহিত্যের গ্র্যাজুয়েট ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত নন কিন্তু অন্য ডিসিপ্লিনের মানুষ চমৎকার কবিতা, গল্প উপন্যাস লেখেন।

 

সাবিরা শাওন: আপনি একজন নারীবাদী এবং জেন্ডার স্টাডিজ নিয়ে বিস্তর জানাশোনার পাশাপাশি আপনার অনেক লেখাও আছে। তবে আমাদের দেশের নারীর প্রাধান্যতা নিয়ে উপন্যাস খুব কমই আছে। স্পেশালি নারীকে বোল্ড কোনো চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে সেভাবে চোখে পড়েনি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনার এই উপন্যাসে এই ফিলোসফিক্যাল জায়গা থেকে কোনো অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি না?

উম্মে ফারহানা: এই ব্যাপারে একটু দ্বিমত করব। পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষার সাহিত্যে নারীপ্রধান উপন্যাস আছে। ‘আনা কারেনিনা’, ‘মাদাম বোভেরি’, ‘টেস অব ডি’আরবারভিলস’, বাংলায় আছে ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘শুভদা’, ‘রাইকমল’, হালের লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’সহ আরও অনেক উপন্যাস, আনিসুল হকের ‘আয়েশামঙ্গল’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘নূরজাহান’, হাসান আজিজুল হকের ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’, তারপর আমার অপছন্দের কিন্তু অনেকের প্রিয় পশ্চিম বাংলার সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ (না চাইলেও নামটা নিতে হলো, জনপ্রিয়তার হিসাবে)। লক্ষ্য করলে দেখবে অধিকাংশ পুরুষ লেখকের এক বা একাধিক গ্রন্থের মূল চরিত্র নারী। কিন্তু এই সকল বোল্ড কিংবা ভিক্টিম নারীদের নিয়ে যারা লিখেছেন, তাঁরা মূলত পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই লিখেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’ বলো কিংবা আনিসুল হকের ‘মা’─ নারীর অস্তিত্বের বিভিন্ন মাত্রা নিয়ে লেখা এসকল গ্রন্থের মূল চরিত্র নারী কিন্তু তাদের সৃষ্টিকর্তা পুরুষ। এইখানেই নারীবাদী আলাপ উঠতে পারে। ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স ছাড়া লেখা যাবে না এমন কোনো কথা নাই। কিন্তু পুরুষ লেখক যখন নারী চরিত্র সৃষ্টি করেন, তার আনন্দ বেদনার বয়ান বলেন, তখন তার লেখক সত্ত্বা তার লৈঙ্গিক পরিচয়কে কতটা অতিক্রম করতে পারে, কিংবা আদৌ পারে কি না সেটা একটা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।

আমার এই উপন্যাসের মূল চরিত্র নারী এবং অবিবাহিত নারী। তার স্ত্রীত্ব কিংবা মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু পঙ্গু হবার ফলে তার প্রতি মাসের ঋতুচক্র যেভাবে তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, যে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যাপারটিতে আমরা কিশোরী বয়স থেকে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাই সেটা যেভাবে রাত্রিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয় সেটা তো নারীদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার একটি অংশ। এটা জাস্ট একটা উদাহরণ দিলাম। পুরুষ লেখক নারীদের নিয়ে লিখলে তা অভিজ্ঞতালব্ধ হবে না এমন কথা কখনোই আমি মানি না। কারণ লেখকের পর্যবেক্ষণ অনেক সময়ই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তাহলে আমি কেন একজন পঙ্গু ক্রিকেটার (পুরুষ) কে উপন্যাসের মূল চরিত্র বানালাম না? রাত্রির ছোটোবেলার বন্ধু একটি চরিত্র কিন্তু ছিল, যে খোঁড়া হয়ে যাবার ফলে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়েছে, সে কেন প্রধান চরিত্র হলো না, আমার প্রোটাগনিস্টকে কেন একটি মেয়েই হতে হলো─ এই প্রশ্ন যদি করো, তাহলে আমি বলব যে আমার পড়া নারীকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর অধিকাংশকেই মনে হয়েছে পুরুষের চোখে দেখা নারীর জীবন। তাই নারীর চোখে দেখার এবং দেখাবার চেষ্টা হয়তো ছিল। তবে উপন্যাস শেষ পর্যন্ত একটি সৃষ্টিশীল কাজ, শিল্প। আমি মনে করি শিল্প কখনো তত্ত্বনির্ভর হয় না। ফেমিনিস্ট কনশাসনেস থেকে উপন্যাস লিখলে সেটি হবে প্রপাগান্ডা, শিল্প নয়। তাই নারীবাদী সাহিত্য বলে কিছু হয় না। সাহিত্যের নারীবাদী পাঠ সম্ভব কিন্তু তাত্ত্বিক আলাপ আখ্যানকে ভারাক্রান্ত করে। নারীবাদ একটি রাজনৈতিক অবস্থান। আর লেখকের পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার দায় নেই বলে আমি বিশ্বাস করি। লেখক নিজের মতন লিখবেন, পাঠক ও সমালোচকরা সেই কাজের মূল্যায়ন করবেন। সেই মূল্যায়নের সময় নারীবাদের তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক বিবেচনা আসবে। নারীবাদ একই সঙ্গে একটি দর্শন, তাই সেই দার্শনিক মূল্যায়ন পাঠকের ওপর নির্ভর করবে।

জিজ্ঞেসই যেহেতু করলে, তাই বলি, রাত্রি কিন্তু কোনো নারীবাদী চরিত্র নয়। সকল নারী চরিত্রকে নারীবাদী হবার প্রয়োজনও নেই।

 

Umme Farhana 1

উম্মে ফারহানার উপন্যাস ‘রাত্রিশেষের গান’। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।

সাবিরা শাওন: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থানকে কীভাবে দেখছেন? যেমন, একশ্রেণির মানুষ বলছে এখন লোকেরা বই পড়ে না৷ বইমেলায় গিয়ে ফটো তুলে আসে শুধু। আবার একই সাথে এবছর প্রকাশিত ‘পদ্মজা’ নামের একটি বই; যেটার দামের কলেবর বেশ বড়ো হলেও অনেক পাঠক কিনেছে এবং পড়ে রিভিউও দিচ্ছে। আপনি এটা নিয়ে আপনি ফেসবুকে স্ট্যাটাসও লিখেছেন। তো এই বিষয়টাকে কী পাঠকের রুচির বিবর্তন বলা যাবে? এমনকি লেখক হিসেবে আপনি এটাকে সাহিত্যের পট পরিবর্তনের আরেকটা ইংগিত বলে মনে করছেন কি?

উম্মে ফারহানা: শুনতে স্নবারির মতন লাগবে, কিন্তু লেট মি বি অনেস্ট, আমি বর্তমানের বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে অতটা জ্ঞান রাখি না। কেজিতে পড়ার সময় থেকে আমি গল্প উপন্যাস পড়ি, সেটা গত শতাব্দীর, গত সহস্রাব্দের কথা। ২০০০ সালের পরে প্রকাশিত হওয়া বাংলা সাহিত্য আমি খুব কম পড়েছি। আমার পড়া বাংলা উপন্যাসের লেখকেরা প্রায় সবাই মৃত কিংবা অতি বৃদ্ধ। আমার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের লেখা যা পড়েছি তা নগণ্য। মনে করো পারমিতা হিমের একটা বই, মাহবুব মোর্শেদের একটা, লুনা রুশদীর একটা, আফসানা বেগমের দুইটা, এমন আর কি। একে ঠিক সেরকম ভাবে পড়া বলা যায় না। অথচ হুমায়ূন আহমেদ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজের আশিভাগ হয়তো আমার পড়া, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তারাশঙ্কর বা মানিকের উল্লেখযোগ্য লেখাগুলি কলেজে পড়ার সময়ই পড়ে ফেলেছি। তাই বর্তমান সাহিত্য নিয়ে মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নাই।

‘এখন আসি এই প্রজন্ম বই পড়ে না’র আলাপে। এই অভিযোগের খুব বেশি গুরুত্ব আমার কাছে নাই। আমাদের মা খালারা গল্প উপন্যাস পড়তেন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে, সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য তো আনন্দই আসলে। তাঁদের কাছে টিভি ছিল না, সব বাসায় রেডিও ছিল না, তাঁরা সুবোধ ঘোষ কিংবা নীহাররঞ্জন গুপ্ত কিংবা নিমাই ভট্টাচার্যের গল্প উপন্যাস পড়ে অবসর কাটাতেন, আমরা ছোটোকালে ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়েছি। সেটা ধরো এইটিজ বা আর্লি নাইন্টিজের কথা। বিটিভি ছাড়া আমাদের কাছে কিছু ছিল না। এখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে নেটফ্লিক্স আছে। বিনোদনের জন্য তারা বইয়ের ওপর নির্ভর করবে না এটাই স্বাভাবিক। এখন কথা হচ্ছে, আগের জেনারেশনের সবাই কি বই পড়তেন? উত্তর হচ্ছে ‘না’। আমার আত্মীয়দের মধ্যে অনেককেই দেখেছি তাঁরা সিনেমা দেখতে যেতেন হলে, সিনেমার ম্যাগাজিন চিত্রালি পড়তেন, ট্যাবলয়েড ধরনের অনেক কিছু ছিল, সেগুলি পড়তেন। আখ্যানের পাঠক চিরকালই কম, কবিতার পাঠক আরও কম। যে বই যত উচ্চমানের সেই বইয়ের পাঠক তত কম। মনে করো ‘ইউলিসিস’ কিংবা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’ বা ‘টিন ড্রাম’ কতজন পড়েছে? ফর এক্সাম্পল, পাউলো কোয়েলহো কিংবা এরিখ শেগালের বই কতজন পড়েছে? ইলিয়াস কিংবা ওয়ালিউল্লাহর পাঠকের তুলনায় হুমায়ূন আহমেদ কিংবা ইমদাদুল হক মিলনের বই বেশি মানুষ পড়বে এটাই স্বাভাবিক। আমি কিন্তু জনপ্রিয় ধারার লেখাকে ছোটো করছি না। ‘পদ্মজা’র যে রিডারশিপ, চোখ কপালে উঠে যাবার মতন কাটতি, সেটি একটা শ্রেণির পাঠকের জন্য। তাঁরা ৮০০-৬০০ টাকা দিয়ে ‘পদ্মজা’ কিনে পড়ছেন, ফ্রিতে তাদেরকে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ কিংবা ‘খোয়াবনামা’ দিয়ে দেখ, তাঁরা পড়বেন না। এটা রুচির বিবর্তন নয়, রুচির পার্থক্য। ওই বাংলায়ও দেখবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিংবা সমরেশ মজুমদারের লেখার যে চাহিদা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের লেখার চাহিদা সেই তুলনায় কম। সন্দীপন সুনীলের সমসাময়িক, কিন্তু তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত এমন কতজনকে তুমি চেন? এখানে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার একটা কারসাজি আছে, আর ম্যাসপিপলের রাডারের সামর্থও একটা ফ্যাক্টর। সন্দীপনের ‘ভারতবর্ষ’ পাঠকপ্রিয় হবার মতন বই না, যেভাবে সুনীলের ‘ভালবাসা, প্রেম নয়’ খুব সহজেই পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে।

আমার ফেইসবুকের স্ট্যাটাসেও আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম, যে ‘পদ্মজা’র পাঠকদের অধিকাংশ ‘পদ্মজা’রই পাঠক। ফেইসবুক, যা নিওমিডিয়ার অংশ, এই জেনারেশনের জন্য মেইন্সট্রিম মিডিয়া এবং সেটিই এই বইয়ের জনপ্রিয়তার মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

 

সাবিরা শাওন: আবারও আপনার উপন্যাসের ফিরে আসি। এই উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে নাগরিক জীবনের যে সংকট, হতাশা থাকে তা শুরুতে অসহনীয় মনে হলেও এই চড়াই-উতরাইগুলো পার হতে গিয়ে আমরাও একসময় এই ধাপগুলোর সাথে ঠিক খাপ খাইয়ে নেই। আপনার প্রোটাগোনিস্টকেও এমন অবস্থার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে উপন্যাসের কোনো এক স্ফেসিফিক ধাপে গিয়ে কি মনে হয়েছে যে এখানে ডিপ্রেশনের টোনটা আরেকটু বাড়িয়ে দেই অথবা কমিয়ে দেই? নাকি ডিপ্রেসিং টোনের প্রয়োগটা সাবলীলভাবেই এসেছে?

উম্মে ফারহানা: আমার এই উপন্যাসের প্রাথমিক শিরোনাম ছিল ‘গ্রাসিয়াস আ লা ভিদা’, আমার মনে হয় প্রথম আলো ঈদ সংখ্যাতে তুমি নিজেও পড়েছিলে। এই বাক্য কিংবা বাক্যাংশের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘জীবনকে ধন্যবাদ’, এই স্প্যানিশ গানটিতে বারবার জীবনকে ধন্যবাদ দেওয়া হয় এবং কৃতজ্ঞতার মূল কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। গায়িকা বলছেন জীবনকে ধন্যবাদ কারণ সে আমাকে দেখার চোখ দিয়েছে, হাঁটার জন্য পা, ভালোবাসার জন্য হৃদয়, উপলব্ধি করার জন্য মস্তিষ্ক আর গান গাইবার জন্য কণ্ঠ দিয়েছে। আমার প্রোটাগনিস্ট পঙ্গু মেয়েটি এই গান থেকে বেঁচে থাকার প্রেরণা নিতে চায়। সে ভাবতে চায় যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলেও সে দেখতে পারে, শুনতে পারে, সে যথেষ্ট প্রিভিলেজড, তাকে সাহায্য করার জন্য মানুষ আছে, তার ভাই আছে বন্ধু আছে, জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ হবার মতন বহু কিছুই তাঁর আছে। এই যে পজিটিভ দৃষ্টিতে দেখে জীবনের কঠোর চ্যালেঞ্জ সে অতিক্রম করতে চায় এটাই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য। সম্ভবত আমি একথাটা সফলভাবে বোঝাতে পারিনি। তাই যখন অনেক পাঠক সাফোকেটিং বা ডিপ্রেসিং হিসেবে এই আখ্যানটিকে লেবেল করছেন তখন আমার মনে হচ্ছে আমি রচয়িতা হিসেবে পুরোপুরিই ব্যর্থ।

 

সাবিরা শাওন: তিথি; প্রোটাগোনিস্টের বন্ধু, এই উপন্যাসের আরেকটি শক্ত চরিত্র বলে মনে হয়েছে। এই যে, তিথি আর রাত্রির মাঝে সহজ সাবলীল এক বন্ধুত্ব। যেখানে কেউ কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করে না কারণ তাঁরা জানে যে, সময় হলে ঠিক সব কথা উগরে দেবে কোনো লুকোছাপা থাকবে না এবং পরস্পরের সান্নিধ্যই যাদের কাছে স্বস্তির। সমকালীন সময়ে এই বন্ধুত্বটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? বা আপনার কি মনে হয় এমন বন্ধনহীন গ্রন্থিতে বাঁধা দারুণ বন্ধুত্ব আসলে এগজিস্ট করে?

উম্মে ফারহানা: বন্ধুত্ব একটা দারুণ ব্যাপার। বন্ধুর সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্ক থাকে না, তাই রক্তের সম্পর্কের চেয়েও জোরালো হয় সেটা। তিথির সঙ্গে রাত্রির যে বন্ধুত্ব তা রাত্রির জীবনের একটি পরম আশীর্বাদ। তিথি তাকে আশার আলো দেখাতে চায়, তিথি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় এবং সেজন্য নিজের উদ্যোগে সে বহুকিছু করে। তুলনায় রাত্রির ভাইয়েরা তত কিছু করে না, তারা বোনের প্রতি দায়িত্বটুকুই পালন করতে চায় শুধু। রক্তের সম্পর্কের তুলনায় ভালোবাসার সম্পর্ক যে বেশি জরুরি সেটাই বোঝা যায় এতে।

অবশ্যই এমন অনেক বন্ধুত্ব এগজিস্ট করে। আমি রক্তের সম্পর্কের মানুষদের কাছ থেকে যতটা পেয়েছি, তাঁর চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছি বন্ধুদের কাছ থেকে। সেটা লজিক্যাল সাপোর্ট বলো, দুঃসময়ে সাহস দেওয়াতে বলো কিংবা নিঃশর্ত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রেই বলো। বন্ধুদের তো কোনো দায়িত্ব নেই, কারও কাছে তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। তবু তিথির মতন বন্ধুরা রাত্রির মতন অসহায় মানুষের পাশে থাকে, শুধু সাহায্য করার জন্য না, তাকে অসহায়ত্ব থেকে বের করে আনবার জন্য তারা জান লড়িয়ে দেয়। এটাই বন্ধুত্বের, ভালোবাসার শক্তি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বর্তমানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি প্রোগ্রামে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। একাডেমিক পড়ালেখা শেষ করেছেন হিসাববিজ্ঞানে। ছোটোবেলা থেকেই লুকিয়ে-চুরিয়ে বই পড়ার অভ্যাসটা আজো রয়ে গেছে। নিজের অনুভূতি আর আর গল্প লেখার অনুপ্রেরণা সেখান থেকেই।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।