সোমবার, ডিসেম্বর ২

কালো ডোম ও অন্যান্য কবিতা : তুষার দাশ

0

কালো ডোম


সেই কবে থেকে কালো ডোম একটানা ডাকছে আমাকে—
চলে আয়, চলে আয়,
ভ্রূণেই তো ভালো ছিলি, কেন এলি?

এসবে আমার দায় নেই।

ছুঁতে ছুঁতে বহুবার তার হাত থেকে আমি পিছলে গেছি,
তার দিকে ফিরে না তাকাবার অভ্যেস আয়ত্ত করেছি।

বহুকাল নানাভাবে নানা সংকীর্তনে খুব মজে থেকে ব্যাপক ঠ্যাটার মতো
তাচ্ছিল্যের ভারে তাকে হতমান করে
পুনঃপুন তাকে আমি উপেক্ষা করেছি।
সে হেসেছে মৃদু।

এই সচেতন গুরুচণ্ডালির দেশে
আমি তো তেমন গুরু নই সম্মানিত,
কখনোবা মনে মনে অনাবাসী ঘৃণিত ব্রাহ্মণ নই,
চণ্ডাল জড়িয়ে ধরে, চণ্ডালের কোলে বসে তার গালে চুমু খেতে পারি!

কালো ডোম মহাসিদ্ধ, ত্রিকালজ্ঞ—
মানুষের খুলি নিয়ে চমৎকার পাশা-খেলা লোক, রক্তনেত্র চিরকাল,
এলোমেলো, সোমরসে নিজেকে জারিত করে জগতের মেদহীন সারাৎসার
হয়ে ওঠে ডোম, কালো ডোম সত্যের নির্যাস।

সামান্য বেচাল হলে কালো ডোম
পানপাত্র সারাক্ষণ হাতে থাকা হাতে ডাকে,
মাতালের অভিনয়ে মহাদক্ষ কালো ডোম দিনে রাতে ডাকে—
আয়, আয় মর্গে আয়, মর্গে আয়
স্বর্গে যদি যেতে হয়, এই তার অন্ধকার অনাবিল অন্তহীন অনন্য দরজা!
আয় আয়, আয় আয়, আয়…

 

০৯.০৯.২০২২


রাজার ডানহাত


রাজার ডান হাতের ঘরের ভেতর বসে আছে চারজন খুনি।
রাজাকে সেলাম দিতে হাত তুললেই ওরা সঙ্গে সঙ্গে
রিভলভার তাক করে আমার দিকেই।
যেন আমি কেউ নই।

বেকসুর খালাশ পাওয়া খুনি কিম্বা ধর্ষক না হলেও,
নদীখেকো ভূমিদস্যু না হলেও,
ঘুসলাল শতকোটি না হলেও,
শীর্ষপদী হাজারোকোটির চক্চকে অক্ষম মালিক না হলেও
আমি যে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ লোক এ দেশের, ওরা তা বোঝেনি।

আমি বাতাসের মতো থাকি।
ঠেলা ধাক্কা গুঁতোয় উত্তর থেকে দক্ষিণ আর
পুব থেকে অর্ধেক পশ্চিমে যাই।
আমি ভাসমান মেঘ যেন।
কিংবা নীলরঙ ফুল ফোটানো একটা কচুরিপানা।

আমি বেশি বৃষ্টি ঝরালেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে ওঠে।

সবার ডাক পড়ে।
মানবিকতার জয়গান মুখে নিয়ে
নতুনতর ভিক্ষাজীবিতার সামগানে
আকাশবাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।

রাজার লোকেরা তখন সবচেয়ে বেশি চ্যাঁচায়।
পকেট ভারী করার দলবল বেড়ে ওঠে মাঠেঘাটে কিিবলে পোকার মতো।
কী অনাবিল সবুজের মন্ত্রধ্বনি মাথার পট্টিতে।

ভাতের অভাব আর মদমোচ্ছবে রাজার চারপাশ গমগম।
আমি ভরপুকুর কচুরিপানা হয়ে গাদাগাদি পচলে চারপাশ দমবন্ধ করা
গন্ধে বিবশ হয়ে ওঠে।
ওই গন্ধে আমি অভ্যস্ত।

আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী হত্যা মৃত্যু রক্তপাত ধর্ষণ ও তার
অশ্রুসজলতা দেখে দেখে অভ্যস্ত।

আমার জ্ঞান বলে কিছু নেই।
শুধু প্রস্তরীভূততা আছে।
আমার মল্লিকাবন নেই।
বাকহীন ধাতুরাস্ত্র আছে।
যেমন কুড়াল ও বল্লম।
ট্যাটা ও চাপাতি আছে।
খড়&গ ও মশান আছে।
আলপনাভরা গিলোটিন আছে।
কুঠারের নিচে পেতে দেয়া কোটিকোটি নরমুণ্ড তৈরি আছে।
ধাবমান ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে তীর ও ধনুক হাতে
ভূমিপুত্র জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে তৈরি হয়ে আছে।

আমাকেই ভয় পেও রাজা।
তোমার ওই কসমেটিক চার খুনি ততটা দমবাজ নয়।
বামপাশে অনিকেত সীমাহীন আমার মানুষ। আসলে তোমারও।
চোখ খোলো।

 

১২.১১.২০২১


তুষার দাশ

(উৎসর্গ ড. তারেক রেজা প্রিয়বরেষু)


এ নামে মাহাত্ম্য নেই ,
শুধু এক খাসবার্তা আছে— এসো।
আলো-উজ্জ্বলতা নেই,
আকাশ-সমান এক উদার আহ্বান আছে— বসো। কথা হোক।

এ নামে পতিত-পণ, রাত্রি-জাগরণ আর বহমান হা হা হা হা হাসি আছে,
মুদ্রাদোষ আছে, শুকনো ফাটা মাঠ আছে।
আছে যুগভর সবুজ ফসল-স্বপ্ন শুধু।

এ নামের কোন গুণ ছাড়া
অদৃশ্য মিথুন-ভারে, ঘামে—
একাবলী হয়ে ওঠে অদীর্ঘ দ্বাদশী,
চৌদ্দমাত্রা পদাবলি বৈষ্ণব কবিতা হয়ে ঝরে পড়ে লালনের গানে।

এ নামের শতাব্দী বিফলে গেলে
মেধা-মুঠো তুলে আনে অমিত্র অক্ষর—
গতি পায় যুগের আকাঙ্ক্ষা-সেতু ভিন্ন বিনির্মাণে।

এরপর স্রোত বাড়ে,
নদীও সমুদ্র হয়ে ওঠে,
বাঁক-খাঁচা, ভগ্ন খরস্রোত বহুকূল ভাসিয়ে-ডুবিয়ে,
বহু পলি ফেলে সামনে এগোয়।
এই নাম এসবের মধ্যে বসে,
ভেসে ভেসে সরু চোখে বাতাসের শিস্ শোনে শুধু।

 

১৪.০৭.২০২২


ভাষাগর্বী, ভাষাপ্রেমী বন্ধুকে


তোমার ভাষার হাত ধরে হেঁটে চলেছে
হাজার হাজার ভাষা—
তার টোকা টের পাও? তার ঘামে ভেজা হাত
আর হাতের তালুর লেখা?
তোমার ভাষাও কিন্তু হেঁটে গেছে
হাজার বছর আগে অন্য কোনো
সমৃদ্ধ ভাষার হাত ধরে—
তুমি তো এখন আর মনেই করো না—
পুরোনো প্রেমিক আর ছিন্ন কাপড়ের মতো
ভুলে গেছো তোমার জন্মের দাগ,
ইতিহাস, অগ্ন্যুৎপাত, বিস্ফোরণ,
সংকট, সুধার কররেখা।

ক্ষুদ্র ভাষাদের দ্যাখো— অপরূপ কোনো কোনো ভাষা—
নিষ্পাপ ফুলের মতো, সুরের ঢেউয়ের মতো—
দশ-পাঁচজন লোক মরে গেলে
টুপ্ করে ঝরে পড়বে সেও একদিন—
পাগল ছেলের মতো অকস্মাৎ অনাদরে সেও।
হারিয়েই গেছে জলে ডুবে—মুছে ফেলে ছিন্ন বর্ণমালা—
আমার গৌরব নিয়ে যতটা সরব আমি—
অন্যদের পাশে আজ সেই সব গর্ত থেকে
বেরুনো জ্যোতির কণা নিয়ে বসি—
বলি—তোমার না বোঝা ভাষা আমি ভালোবাসি—
প্রণাম তোমাকে আর তোমার ভাষাকে—
এভাবে বলতে পারি যদি, তবে বুঝে নিতে পারব
অন্য ভাষার প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধা আছে,
ভাষার ভিখিরি সেজে অন্য প্রেম উেক দিও না।

 

০২.১০.২০২২


শিরোনামহীন


চোরেরা চমকায় চোরেরা ধমকায়
চোরেরা গুন্গুন রাত্রে গান গায়
চোরেরা নদীপারে নৌকো টপকায়।

চোরেরা সহগামী চোরেরা সমকামী
চোরেরা বাড়িঘরে দেয়াল খামচায়।
চোরেরা দল বেঁধে নীলনক্শা ফাঁদে
বন্ধু দেখে কাঁদে— যদিও চোখ জুড়ে
একটু জলও নেই। শুকনো কাঁদনের
এ অভিনয়টুকু চোরের বিস্তর
সাধনা-অর্জিত, ভীষণ মার্জিত।
কেবল রাত হলে সূর্য উঠবার
আগে ও পরে মিলে কাপড় বদলায়।

চোরের হাসিমুখ চোরের সব সুখ
চোরের দলপতি দুহাত ধরে টানে
নিটোল চোরটিকে, যাতে সে পদ পায়
আল্গা চালাকিতে। চোরের চালিয়াতি
শতেক চোরদল অবাক বিস্ময়ে
কৌতূহলে দেখে।

বললে চোর তোকে ঘামিস কেন মামু?
তবে কি তস্কর কিম্বা স্তেন খুব
তোমার পছন্দ? এখনি বলে দাও,
অনেক খাবলেছো দেহের মাংশকে,
দেশের হাড়মাস অনেক ঢুকিয়েছো
নিজের, বন্ধুর প্রীতিতে মুখরিত
কৃষ্ণ ঘরে ঘরে। এখন উৎসব,
এখন হৈ চৈ, এখন গুণীনের
চিবুক চুম্বন। পানের রোঁয়া ওঠা
মাতাল বপুদের বিপুল গুঞ্জনে
পিষ্ট দেশমাতা আকুল কাতরায়,
দস্যু সাঁতরায় আপাত নীল জলে।

 

১২-১৩.০৭.২০২১

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি-প্রাবন্ধিক-সমালোচক। গ্রামের বাড়ি সূর্য সেনের চট্টগ্রামের পটিয়ার আবদুল করিম সাহিত্য-বিশারদ আর আহমদ শরীফের কারণে বিখ্যাত সুচক্রদণ্ডী। জন্ম ওখানেই, ১৯৫৭ সালে। ১৩ নভেম্বর।

লিখছেন অনেকদিন ধরে। কখনো সক্রিয়, কখনো একেবারেই মাঠের বাইরে। আলস্যের মহান বরপুত্র। আড্ডায় অতি আগ্রহের কারণে নিগ্রহও কম জোটেনি জীবনে। তবুও আড্ডাপ্রবণ। নানা ধরনের কাজ করেছেন। কখনো পাঠাগারের বইয়ের তালিকাকারী, কখনো প্রুফ-রীডার, কখনো পত্রিকার সম্পাদনা সহকারী। গৃহশিক্ষকতার পাশাপাশি নানা কলেজ, কোচিং সেন্টারে পড়ানো, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত গবেষক থেকে হঠাৎ পরিপূর্ণ বেকার, বন্ধুর উৎসাহে বিজ্ঞাপনী সংস্থার নিয়মিত চাকরি। এরপর নিজের বিজ্ঞাপনী সংস্থা। সবই কমবেশি হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর আনন্দও হয়েছে কিছুদিন।

এখন পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা বারো। নয়টি কবিতার। দুটি প্রবন্ধের। একটি জীবনী। উল্লেখযোগ্য যে, শুরুর দিকের একটাও বাজারে পাওয়া যায় না।

গান শুনে আর ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়ে এখন পরিপূর্ণ বেকার। গোটা দশেক দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে। একাদশে ডাক পাওয়ার সম্ভাবনায় আছেন। দেশ-দেখা মানে মানুষ আর প্রকৃতিকে আরও একটু জানা, নতুন করে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।