শনিবার, জুলাই ২৭

কেউ চুম্বন করেনি : কবীর রানা

0

Eid Motifএ নগরীতে চাঁদ প্রবেশ না করতে পারলে, সে কথা বলা দরকার, সে কথা শোনা দরকার। এর অনেক রাত পর, নগরীর কেউ কেউ জানালা খুলে মনে করার চেষ্টা করে, জানালা খুলে তারা কী কী দেখতে পেত, কী কী দেখতে চাইত, জানালা দিয়ে গৃহে কী কী প্রবেশ করত, কী কী প্রবেশ করতে চাইত। রাতের শরীরে অনেক রাত জমা হলে কিংবা তাদের শরীরে অনেক রাত জমা হলে তারা ঠিক মতো স্মরণ করতে পারে না সে সব কিছু। জানালার দুদিকেই রাত অবস্থান করলে তারা আরোহন করে ঘুমের অশ্বে। পিপাসা মুখে ঘুমের অশ্ব যায় অজানা নদীর দিকে, অজানা নগরীর দিকে।

প্রতিটি নগরীর প্রতিষ্ঠাতা থাকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠাতা তো কাঠুরে। যার থাকে কুঠার। সব কাঠুরে ও তার কুঠারের গন্তব্য নগরমুখী ও মুদ্রামুখী হলে সে কাঠুরে বনের গাছ কেটে প্রতিষ্ঠা করে নগরী, রাজনীতি ও রাজধানী। বনের গাছগুলোকে বনমানুষ মনে হলে বলি বনমানুষ কেটে প্রতিষ্ঠিত হয় নগরী, রাজনীতি ও রাজধানী।

প্রতিটি নগরীর প্রতিষ্ঠাতা থাকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠাতা তো কাঠুরে। যার থাকে কুঠার। সব কাঠুরে ও তার কুঠারের গন্তব্য নগরমুখী ও মুদ্রামুখী হলে সে কাঠুরে বনের গাছ কেটে প্রতিষ্ঠা করে নগরী, রাজনীতি ও রাজধানী। বনের গাছগুলোকে বনমানুষ মনে হলে বলি বনমানুষ কেটে প্রতিষ্ঠিত হয় নগরী, রাজনীতি ও রাজধানী। তারপর বনের গাছের কোটর থেকে অন্ধকার এনে নির্মাণ করে বাড়ি, রাস্তা, সন্তান, চাঁদ, সূর্য। তারপর বাড়ি বড়ো হয়, রাস্তা বড়ো হয়, সন্তান বড়ো হয়, বড়ো হয় চাঁদ, সূর্য এবং এ সবের অন্ধকার— নগরী, রাজনীতি ও রাজধানী।

সালমান রহমান এ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা নয় তবুও এখন এ নগরীর প্রায় সকল কিছুর সকল গল্পে আছে তার প্রভাব। কারণ এটা এ রকম যে সে সারাজীবন এ নগরীর গল্পগুলো দখল করতে চেয়েছে। গল্প দখল করার চেয়ে নিজেকে, নিজের নামকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার ভালো উপায় আর কী-ই বা হতে পারে। সে দখল করেছে ভূমির গল্প, ভূমিতে অবস্থিত প্রাণী ও অপ্রাণীর গল্প। জলের গল্প, জলে অবস্থিত প্রাণী ও অপ্রাণীর গল্প। আকাশের গল্প, আকাশে অবস্থিত প্রাণী ও অপ্রাণীর গল্প।

সালমান রহমানের দৃশ্যমান সংসারের দিকে তাকালে দেখি তার একজন তরুণী কন্যা আছে। হতে পারে এ কন্যা তার চেনা স্ত্রীর, অচেনা স্ত্রীর। একটা সংসারের কতোটুকুই বা জানা যায়, যদি এই কথা কেউ কখনও বলে থাকে, তবে তাকে বলি যতটুকু সংসারের ছিদ্র দিয়ে সংসার দেখা যায় ঠিক ততটুকু। এ কন্যা জন্ম নিয়েছে জলে, জলের গর্ভে; স্থলে, স্থলের গর্ভে; আকাশে, আকাশের গর্ভে। তবে কেউ সেটা নিশ্চিত করে বলতে না পারলে তার একজন স্ত্রী আছে যার শরীরে জল, স্থল, আকাশ আছে। তার স্ত্রীর চেয়ে তার মেয়ের প্রতি সালমান রহমান ও নগরীর নাগরিকদের আগ্রহ বেশি হলে তার নাম শুনি। তার নাম শোনা হয় নগরীর সকল দোকান থেকে। যখন তার মেয়ে নগরীর সকল দোকানে যায় তার বাবার সকল গল্প দেখাশোনা করার জন্য। তার নাম ইলা। যে বলে এ নগরীর সব কিছুই দোকান। বাবা দোকান, মা দোকান, ভাই দোকান, বোন দোকান।

ইলার প্রিয় শখ গল্প। যে সব গল্পে তার বাবা আছে সে সব গল্প। সে তার বাবাকে নিয়ে বলা, লেখা সকল গল্প দেখতে চায়, শুনতে চায়, পড়তে চায়। দোকানদারেরা তার বাবার গল্প বলে, লেখে। সে শোনে, পড়ে। এ নগরীতে দোকানের শেষ কোথায়। ইলা দোকানের পর দোকান পার হলেও শেষ হয় না দোকান। যেভাবে রাতের পর রাত চলে গেলেও শেষ হয় না রাতের গল্প। এক সময় তার মনে হয় এ নগরীর অভিধানের সকল শব্দও দোকান ও দোকানদার। এ নগরীর ভাষাকেও মনে হয় দোকানদারের ভাষা। ভাষার জন্ম হয়েছে কেনা-বেচা করার জন্য। আর দোকানদারেরা এ নগরীর সবচেয়ে ভালো গল্পকার, যখন বিজ্ঞাপনকে ভাবা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো গল্প।

একদিন সন্ধ্যা। ইলা আসে নাটকের দোকানে। সে তিন ঘন্টার নাটকের গল্পে তার বাবাকে খুঁজে পায় না। নাটকটির নাম কেউ চুম্বন করেনি। সে নাটকের দোকান থেকে বাইরে আসে। রাস্তায় আলো নাই। আলোর দোকান বন্ধ। আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের দোকান খোলা। আকাশে চাঁদ। একদিনের চাঁদ কিংবা দুদিনের চাঁদ কিংবা তিনদিনের চাঁদ। চাঁদ দেখতে চুম্বনের মতো। সে জানে না এ নগরীতে চাঁদের দোকান আছে কি না, চুম্বনের দোকান আছে কি না। তার ইচ্ছে হয় সে যাবে চাঁদের দোকানে, চুম্বনের দোকানে। সে সব দোকানের চাঁদের গল্পে, চুম্বনের গল্পে তার বাবা আছে কি না সে তা দেখতে চায়।

 

২.
সালমান রহমান বিস্মিত হয় এই কথা শুনে যে চাঁদ ও চুম্বনের গল্প থেকে সে বাদ পড়ে গেছে। সে তো কিনেছিল চাঁদের পাথর, চুম্বনের পাথর। কবে তবে ঝরে গেছে তার সে সকল পাথর চাঁদ ও চুম্বন থেকে। ইলা পাশে ছিল। সে তার বাবাকে বলে চাঁদ ও চুম্বনের গল্পে তার বাবার পুনরায় অন্তর্ভুক্তি দরকার। ইলা উত্তরাধিকার নিয়মে জানে, সিংহাসনের নিয়মে জানে তার বাবার মৃত্যুর পর এ নগরীর সকল গল্পের সিংহাসনে তার নাম থাকবে। আর এখন যখন তার বয়স বিশ বছর, যখন তার প্রিয় বিষয় চাঁদ ও চুম্বন, আর চাঁদ আর চুম্বনের গল্পে যদি তার বাবাকে খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে সেও থাকবে না চাঁদ ও চুম্বনের গল্পে।

সালমান রহমান ও তার মেয়ে ইলা সিদ্ধান্ত নেয় তারা নিজেরা চাঁদ ও চুম্বনের গল্প তৈরি করে নাটকের দোকানে তা সরবরাহ করবে। চাঁদ ও চুম্বনকে তারা রাতের বিষয় জ্ঞান করে সন্ধ্যার পর পরই তারা তাদের বাড়ির ছাদে আসে গল্প তৈরি করার জন্য।

টুপটাপ করে চাঁদ ঝরে পড়ছে, চুম্বন ঝরে পড়ছে। ঝরে পড়া চাঁদের ও চুম্বনের গল্পে সালমান রহমান নিজের নাম যুক্ত করতে চায়। সে সময় কোলাহল। বাজারের কোলাহল। কতো বাজার সে দখল করেছে।

টুপটাপ করে চাঁদ ঝরে পড়ছে, চুম্বন ঝরে পড়ছে। ঝরে পড়া চাঁদের ও চুম্বনের গল্পে সালমান রহমান নিজের নাম যুক্ত করতে চায়। সে সময় কোলাহল। বাজারের কোলাহল। কতো বাজার সে দখল করেছে। কতো ঐতিহাসিক সে সব বাজারের গল্পে তার নাম লিপিবদ্ধ করেছে। দৈনিক পত্রিকার ঐতিহাসিক, ইলেকট্রনিক পত্রিকার ঐতিহাসিক, অনলাইন পত্রিকার ঐতিহাসিক সবাই তার ছবি তুলে, সাক্ষাৎকার নিয়ে বাজারের সকল গল্পে তাকে যুক্ত করেছে। এখন সালমান রহমানের মনে হচ্ছে, তার মেয়ের সংগে কথা বলার পর, বাজারের সকল গল্প অস্থায়ী। এ সব গল্পের চরিত্রগুলোর নাম বদলে যায় সময়ের দূরত্বে গিয়ে। এসব গল্প একদিন পর শোনে না কেউ, মানে না কেউ। বাজার মানে না বাজারকে, বাজার বিক্রি হয়ে যায়। ইতিহাস মানে না ইতিহাসকে, ইতিহাস বিক্রি হয়ে যায়। তার মেয়ে ইলা, যে তার শরীর থেকে, শরীরের বাজার থেকে বেরিয়ে এসেছে, যাকে সে সকল বাজার তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে, সে জেনেছে, জানছে গল্পের জানালার নিকটে গিয়ে, কোন গল্প স্থায়ী, কোন গল্প অস্থায়ী, কোন গল্পে তার নাম আছে, কোন গল্পে তার নাম নাই। এ নগরীর প্রাচীনতম গল্প নাটক হলে, তার মেয়ে ইলা সেখানে গিয়ে দেখেছে, নাটকের গল্পে সে নাই।

নাটক বিষয়ে সালমান রহমান কতোটুকু জানে। তার মনে পড়ে গ্রীসের কথা। কিংবা তারও আগের আপেল নগরীর কথা। কেউ লেখে না নাটক। নাটক নিজেকে নিজেই লেখে। মানুষের সেখানে থাকে না কোনো বাজার বিদ্যার ক্ষমতা। বাজার বিদ্যার গল্পে সে প্রবেশ করেছে নানারূপ বাজার দখল করে। আজ রাতে তার শরীরে, মনে বাজার দখলের ক্লান্তি। এই ক্লান্তি অসংখ্য বিছানার অসংখ্য শয়ন, অসংখ্য বিশ্রাম দূর করতে পারছে না। এতোটুকু শরীরে এতো এতো ক্লান্তি তাকে বিস্মিত করে। তার মেয়ে ইলা, যার বয়স কেবল বিশ, সেও জানায় তার শরীর ও মনে ক্লান্তি জমা হচ্ছে। ক্লান্তিকে তার পাহাড় মনে হয়। নিজেকে মাঝে মাঝে তার ক্লান্তির পাহাড় মনে হয়। বাজারের এ সকল গল্পও ক্লান্তিকর। এতো ক্লান্তিকর গল্প তারা কী করবে। তারা এখন চাচ্ছে ক্লান্তিহীন গল্প, ক্লান্তিহরণের গল্প। ক্লান্তিহরণের গল্পে তাদের নাম থাক।

অফুরন্ত রাত, অফুরন্ত চাঁদ, অফুরন্ত চুম্বন ঝরে পড়ছে। ছাদে না, ছাদের বাইরে যে দীঘি, সেখানে। সালমান রহমান ও তার মেয়ে ইলা ছাদ থেকে নেমে দীঘির পাড়ে আসে। স্থান বদলালেও তারা তৈরি করতে পারে না চাঁদ ও চুম্বনের গল্প। তারা অনুধাবন করে কৌশল জানলেও সব গল্প তৈরি করা যায় না, সব গল্প নিকটে থাকে না।

ইলা এখনও ছাত্রী থাকলেও সে তার বাবাকে জানায় তার বাবা তাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খুলুক একটা নতুন বিভাগ। যে বিভাগের নাম হবে চাঁদ ও চুম্বন বিভাগ। এ বিভাগে পড়ানো হবে চাঁদ ও চুম্বন বিষয়ক সকল কিছু। সালমান রহমান তার মেয়ের এ চিন্তায় খুশি হয় এবং ভাবে তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে হবে তার যোগ্য উত্তরসূরী।

চাঁদের কাছে এক টুকরো মেঘ জমা থাকলে তা এখন বৃষ্টি হয়। সামান্য বৃষ্টি সামান্যই ভেজাতে পারে সালমান রহমান ও ইলাকে।

 

৩.
কতো আয়তনের আয়নার সামনে দাঁড়ালে একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি দেখতে পায়। মানুষের আয়তন মানুষ পুরোপুরি জানতে না পারলে সে তৈরি করে নানারূপ বই। বইকে সে আয়না ভাবে। বইয়ের পাতায় পাতায় নিজের অলীক ছবি আঁকে। সে সব ছবিকে বিশ্বাস করার জন্য, করানোর জন্য বিদ্যালয় করে, বিশ্ববিদ্যালয় করে। সরকারি বিদ্যা, সরকারি বিদ্যালয়; বেসরকারি বিদ্যা, বেসরকারি বিদ্যালয়; কবি ও গল্পকারদের বিদ্যালয়।

এই দুপুরে, যে দুপুরে পাখিরা আকাশ ত্যাগ করে, বই লিখতে লিখতে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের মনে আসে আয়নার কথা, নিজের আয়তনের কথা। বাংলা ও দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করে সে শিক্ষক হয়েছিল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক বই ‘কেউ চুম্বন করেনি’ বাজারে প্রবেশ করলে এ নগরীর সবাই চমকে যায়। সবাই বিস্মিত হয় এই ভেবে যে, কীভাবে একটা নন্দনতত্ত্বের বই এতো জনপ্রিয় হয় এবং বাজার দখল করে। বাজার দখল শব্দবন্ধটির দিকে তাকিয়ে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের নিজেকে হঠাৎ করে মস্তান মনে হয়। এরপর সে শুধু বাজার শব্দটির দিকে তাকায়। শব্দটিকে তার অনন্ত খনি মনে হয়। যার তল নাই। কতোকিছু ধারণ করতে পারে এই খনি। এই খনিতে প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি জমা হয়েছে কতোকিছু। জমা হবে অন্তহীন ভবিষ্যতেও কতোকিছু। তার বইও তাহলে জমা হয়ে গেছে বাজার খনিতে।

সে সেই আয়নার সামনে প্রতিদিন দাঁড়ায় নিজের আয়তন জানার জন্য, বোঝার জন্য। বই নানারকম হলে আয়নাও তবে নানারকম। নানারকম আয়নার সামনে নানা আয়তনের জয়নাল আবেদীন। সে বিভ্রান্ত নিজের নানা আয়তন দেখে। কখনও একটা মৌমাছি, তার আয়তন; কখনও একটা ভল্লুক, তার আয়তন; কখনও একটা খরগোশ, তার আয়তন; খুঁজছে ঝোপ।

ক্লাস নিতে নিতে একদা, হয়তো হঠাৎ, সে বলেছিল তার কাছে বই পৃথিবীর সেরা আয়না। সে সেই আয়নার সামনে প্রতিদিন দাঁড়ায় নিজের আয়তন জানার জন্য, বোঝার জন্য। বই নানারকম হলে আয়নাও তবে নানারকম। নানারকম আয়নার সামনে নানা আয়তনের জয়নাল আবেদীন। সে বিভ্রান্ত নিজের নানা আয়তন দেখে। কখনও একটা মৌমাছি, তার আয়তন; কখনও একটা ভল্লুক, তার আয়তন; কখনও একটা খরগোশ, তার আয়তন; খুঁজছে ঝোপ। সে তার আয়তন না জানতে পারলে বিয়ের দিকে যায় না, সংসারের দিকে যায় না। একটা বছর আরেকটা বছরের পাশে দাঁড়ালে তা হয় কয়েদীর পাশে দাঁড়ানো আরেক কয়েদী, শিকলের সংগে যোগ হওয়া আরেক শিকল। তারপর সে সব বছর মিলে মিলে পঁয়ষট্টি বছর হলে সে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসরে যায়।

বই লিখতে লিখতে সে থামে। আজকাল সে তার নানারূপ স্মৃতিকে ডাকে, যেভাবে সন্ধ্যায় দূর গ্রামের গৃহিণীরা তাদের হাঁসগুলোকে ডাকে। যে হাঁসগুলো সারাদিন আহার খুঁজতে ভেসেছিল পুকুরের জলের জঙ্গলে। জয়নাল আবেদীনের মনে হয় তার স্মৃতিগুলো সে সকল হাঁসের মতো। কতোদিন কতো বছর সে হাঁসেদের মতো পুকুরের জলে, পুকুরের জলের জঙ্গলে খাবার খুঁজেছে, খাবার খেয়েছে, তবে কেউ তাকে ডাকেনি বলে ফেরেনি সে সন্ধ্যার গৃহে, সন্ধ্যার শাড়ির কাছে, সন্ধ্যার প্রদীপের কাছে।

এখন এই অবসরে, এই দুপুরে, তার মনে হচ্ছে ‘কেউ চুম্বন করেনি’ তার লিখিত এই বইটি আসলে নন্দনতত্ত্বের নয়, এটি নাটক, তার আত্মজীবনীমূলক নাটক। পৃথিবীর সকল বই শেষ পর্যন্ত নাটক। আর সকল নাটক মানুষের জীবনী।

পঁয়ষট্টি বছর পার করার পর, যখন চাঁদ দূরে চলে যায় তার চুম্বন নিয়ে, সে সময় তবু, সে সময় দুপুরে চাঁদের কথা, চুম্বনের কথা তার মনে আসে, মনে ভাসে।

‘কেউ চুম্বন করেনি’ নন্দনতত্ত্বের এই বইটিকে তার একবার আত্মজীবনীমূলক নাটকের বই মনে হলে সে সেখানে তার নিজস্ব চুম্বন খোঁজ করে। বইটি সে আবারও পড়ে। চুম্বনের ইতিহাস এ বইয়ের একটা অংশ হলেও সে তার নিজস্ব চুম্বন এখানে খুঁজে পায় না। আসলে তার চুম্বনের ইতিহাস কী, কতোটুকু? একটা চড়ুই পাখির ঠোঁটে একটা খড়। উড়ে যায় চড়ুই পাখিটি। ঐ একটা খড় হয়তো চড়ুই পাখিটির চুম্বনের সংকেত। সে তার ঠোঁটের দিকে তাকায় আয়নার মাধ্যমে। তার ঠোঁটে খড় কোথায়। চড়ুইয়ের কাছে, একটা খড়ের নীড় নির্মাণের কাছে তবে তার ঠোঁট পরাভূত।

তারপর এই সত্য, কয়েকজন নারীর সংগে বিয়ের বাইরে কিছুকাল, কয়েকবার কিংবা অনেকবার চুম্বনের নন্দনতত্ত্বে অংশগ্রহণ হয়েছিল। সে সকল চুম্বনে মুদ্রিত ছিল না অন্তর্গত নিস্তব্ধতা। অথবা সে সকল চুম্বন জলের ঢেউ হলে কোথায় সে সকল ঢেউ। কোথাও সে চুম্বন-ঢেউ স্থায়িত্ব না পেলেও লিখেছে সে চুম্বনের নন্দনতাত্ত্বিক বই— ‘কেউ চুম্বন করেনি’। আর এই বই বাজার দখল করলে সবাই ধরে নেয় এ নগরে তার চেয়ে চুম্বন বিষয়ক নন্দনতত্ত্ব জানে না কেউ।

খ্যাতি বাজার ও বিজ্ঞাপন নির্ভর হলে তার বই বাজারে যায়, বিজ্ঞাপনে যায়। জয়নাল আবেদীন বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দেয় চুম্বন বিষয়ে। আর আজ সকালে এ নগরীর সবচেয়ে বিখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার কাছে অনুরোধ আসে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য। তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নন্দনতত্ত্বের একটা নতুন বিভাগ খুলতে চায়। যার নাম হবে ‘চাঁদ ও চুম্বন বিভাগ’। তাকে সে বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তাকে আমৃত্যু এ বিভাগে চাকুরি করার কথা বলা হয়েছে।

 

৪.
বাজারে ‘চাঁদ ও চুম্বন’ বিভাগের এমন চাহিদা ছিল তা জানতো না সালমান রহমান, ইলা কিংবা এ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন। তারা তিনজন এ আলোচনায় যায়, বাজার আবিষ্কার করার চাইতে বড়ো আবিষ্কার আর কী-ই বা হতে পারে। মানব বিদ্যার আরও কতো কতো বিদ্যা এখনও আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে তা তারা অনুভব করে।

হাঁটতে হাঁটতে আসছে সবাই। বাজার থেকে, কেনা থেকে, বেচা থেকে— আসছে সবাই অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের ক্লাসে। তারা ছাত্র, তারা ছাত্রী; তারা জানবে চাঁদ ও চুম্বন বিষয়ক নন্দনতত্ত্বের কথা, নন্দনতত্ত্বের বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা।

‘চাঁদ ও চুম্বনের’ ক্লাস দিনে নয়, রাতে হয়। এটা খুব প্রাথমিক ও মৌলিক কথা চাঁদ ও চুম্বনের সন্ধানে যেতে হয় রাতে। চাঁদ ও চুম্বন আবিষ্কার দিনে সম্ভব নয়।

চারটা লণ্ঠন শ্রেণিকক্ষের স্তব্ধতাটাকে প্রকাশ করছে। চল্লিশজন ছাত্র-ছাত্রী বসে আছে। তাদের সামনে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন। জয়নাল আবেদীনের পায়ের কাছে একটা সাদা বিড়াল। তার পোষা বিড়াল। এ বিড়ালটা সব সময় তার বক্তৃতার সঙ্গী। বিড়ালটা তার অনুপ্রেরণা। ‘কেউ চুম্বন করেনি’ বইটা লিখবার সময় এ বিড়ালটা তার অনুপ্রেরণার কাজ করেছে।

অনেক বড়ো একটা শ্রেণিকক্ষ। শ্রেণিকক্ষের চারপাশে চারটা লণ্ঠন। চারটা লণ্ঠন শ্রেণিকক্ষের স্তব্ধতাটাকে প্রকাশ করছে। চল্লিশজন ছাত্র-ছাত্রী বসে আছে। তাদের সামনে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন। জয়নাল আবেদীনের পায়ের কাছে একটা সাদা বিড়াল। তার পোষা বিড়াল। এ বিড়ালটা সব সময় তার বক্তৃতার সঙ্গী। বিড়ালটা তার অনুপ্রেরণা। ‘কেউ চুম্বন করেনি’ বইটা লিখবার সময় এ বিড়ালটা তার অনুপ্রেরণার কাজ করেছে। এ বিড়ালের সে নাম দিয়েছে নন্দন। নন্দনের বিড়াল। তার মনে হয়েছে মানুষের নন্দনতাত্তিক বোধের কাছাকাছি প্রাণী বিড়াল। সাদা বিড়াল। সাদা বিড়াল ধারণ করে সাদা বরফের নীরবতা, সাদা বরফের সরবতা।

জয়নাল আবেদীনের বক্তৃতা আসে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে। বক্তৃতা আসে সাদা বরফের গীতিপথ বেয়ে। ছাত্র-ছাত্রীরা ভেবেছিল তাদের অধ্যাপক বক্তৃতার সংগে নিয়ে আসবে চাঁদ, নিয়ে আসবে চুম্বন। কিন্তু সেটি হয় না, শুধু বক্তৃতা। জয়নাল আবেদীনের কথা আসতে থাকে তার মুখ থেকে, তার বই থেকে, তার নোট থেকে। রাতের সকল আলো অনুসরণ করে চাঁদকে, রাতের সকল সম্পর্ক অপেক্ষা করে চাঁদের আগমনের জন্য। আর চুম্বন, যার জ্যামিতিক আকার চাঁদের মতো, থাকে চাঁদের শরীরে। তার বক্তৃতা চলতে থাকে বিড়ালের পায়চারির মতো। তার বক্তৃতা শুনে ছাত্র-ছাত্রীরা অনুধাবন করে তারা আসলে কখনও জানেনি চাঁদ কী, চুম্বন কী। তবে তাদের একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে জয়নাল আবেদীনকে জানায় সে চাঁদ ও চুম্বন দেখেছিল একবার তার মা’র সংগে বাজারে যেতে যেতে। সে বলে সে সময় একটা প্রজাপতি তার মা’র শাড়ি থেকে বের হয়ে উড়ে গিয়েছিল গোরস্থানের দিকে। তারপর আর সে প্রজাপতিটাকে দেখেনি। তার এই কথা সবার কাছে অর্থহীন। সবচেয়ে বেশি অর্থহীন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের কাছে।

লণ্ঠনের আলো কমতে থাকলে কারো কারো গোরস্থানের কথা মনে আসে। জয়নাল আবেদীন তখন ক্লাস নেওয়া থামিয়ে দেয়। ক্লাসের বাইরে আকাশে সে সময় চাঁদ। একটা অথবা অনেকগুলো। আর কী বিস্ময় দেখো চাঁদের নিচে চুম্বন নয়, নগরীর অনেক গোরস্থানের একটা।

রাতে লণ্ঠন জ্বালিয়ে এভাবে চুম্বন ও চাঁদ বিষয়ে অনেকগুলো ক্লাস নেওয়া হয়। অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন এবং তার ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝতে পারে তারা আসলে চুম্বন ও চাঁদের কোটরে প্রবেশ করতে পারছে না। ভাঙা পথ। দূরে যাওয়া যায় না। চাঁদ ও চুম্বন যত দূরে থাকে তত দূরে তাদের বিদ্যা পৌঁছুতে পারে না। চাঁদ ও চুম্বনের গল্পে তারা হতাশ হয়। হতাশ হয় নগরীর আরও অনেকে। যারা বাজারে ছিল তাদের হতাশা আরও বেশি হয়। কারণ তারা ভেবেছিল তারা এ বিদ্যা আরও বেশি বাজারজাত করতে পারবে।

একবার একটা গাছ ফল না দিলে দ্বিতীয় গাছের নিকটে যাওয়া যায় ফল ভিক্ষার জন্য। ফলের কাছে সবাই তো ভিখারী। ভিখারীর হাত সব সময় অন্ধ হলে, অন্ধ ভিখারী বলি। জয়নাল আবেদীন অন্তত এ সময় হয় অন্ধ ভিখারী। সে যায় দ্বিতীয় গাছের কাছে। দ্বিতীয় পন্থার কাছে। সে তার লণ্ঠন পদ্ধতি পরিত্যাগ করে যায় জল পদ্ধতির কাছে। সকল ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে সে যায় এক নদীর কাছে, যার কাছে আছে এ নগরীর প্রথম জল। প্রাচীন এ স্রোতস্বিনীর নাম যদি বুড়িগঙ্গা তবে তারা এসেছে তার কাছে চুম্বন ও চাঁদ বিষয়ে শিক্ষা চর্চা করতে। অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন এই প্রথম স্রোতস্বিনীর সাহায্যে শিখতে চায়, শেখাতে চায় চাঁদ ও চুম্বন বিদ্যা।

বুড়ি চাঁদ আসে বুড়িগঙ্গার শরীরে। জলের চাইতে অধিক আলিঙ্গন, অধিক চুম্বন, অধিক আনন্দ আর কে-বা জানে। যে জানে সে হয়তো মরে গেছে কবে। জল ও চাঁদের আলিঙ্গন তারা পর্যবেক্ষণ করে। কতোকাল পরিভ্রমণ করে এসেছে এ চাঁদ, কতোকাল পরিভ্রমণ করে এসেছে এ জল। তারা নগরীর সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে যুক্ত হতে চায় কেবল এই দৃশ্যের সংগে।

মাঝরাতে নদীতে চাঁদ আসে। বুড়ি চাঁদ আসে বুড়িগঙ্গার শরীরে। জলের চাইতে অধিক আলিঙ্গন, অধিক চুম্বন, অধিক আনন্দ আর কে-বা জানে। যে জানে সে হয়তো মরে গেছে কবে। জল ও চাঁদের আলিঙ্গন তারা পর্যবেক্ষণ করে। কতোকাল পরিভ্রমণ করে এসেছে এ চাঁদ, কতোকাল পরিভ্রমণ করে এসেছে এ জল। তারা নগরীর সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে যুক্ত হতে চায় কেবল এই দৃশ্যের সংগে। জয়নাল আবেদীন ও তার ছাত্র-ছাত্রীরা মনে করে তারা বোধহয় বুঝে ফেলেছে, পেয়ে গেছে চাঁদ ও চুম্বনের অতলান্ত গল্প। এ গল্প তারা বাজারে বেচতে পারবে সকল ভবিষ্যতে। যে গল্পে থাকবে সালমান রহমান আর ইলা। তাদের বিনিয়োগ, তাদের বাজার বিষয়ক ভাবনা হারাবে না।

রাত আরেকটু বড়ো হলে, রাত চাঁদ ও চুম্বনের সংগে দ্বন্দ্বে গেলে, ক্লাসের সেই ছেলেটির মনে পড়ে প্রজাপতি ও গোরস্থানের কথা, যে ছেলেটি মায়ের সংগে যেতে যেতে দেখেছিল কীভাবে একটা প্রজাপতি উড়ে গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল গোরস্থানের ভেতর। আর এখন কী কথা, বুড়িগঙ্গার জলে লাশ ভেসে আসে। এ সকল লাশ কোথা থেকে আসে, কোন কাল থেকে আসে। অনন্ত লাশ ভেসে যাচ্ছে চাঁদ আর চুম্বনের ভেতর দিয়ে। যেন লাশের কারখানা আছে নদীর পাশে। সে কারখানা থেকে উৎপাদিত লাশ নেমে আসছে বুড়িগঙ্গার জলে। লাশ কী রপ্তানি করা যায়। জানে না তারা। এ সব অপ্রত্যাশিত স্রোত, অপ্রত্যাশিত লাশ জানত না তারা, ভাবত না তারা। জয়নাল আবেদীন এবং তার ছাত্র-ছাত্রীরা বোঝার চেষ্টা করে কোথা থেকে আসে এ লাশ। একজন ছাত্রী, যার প্রতিবেশী একজন শ্রমিক ছিল, গতকাল যার লাশ বুড়িগঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল সমুদ্রে পাঠাবার জন্য, সে বলে এ লাশ সম্ভবত শ্রমিকদের। তখন সবার স্মরণ হয় বুড়িগঙ্গার দু’পাড়ের অজস্র কারখানার কথা, কারখানার অজস্র শ্রমিকদের কথা। হতে পারে এ সব লাশ কারখানার শ্রমিকদের। যারা মারা গেছে গতকাল কিংবা অনেক না খেয়াল থাকা গতকালে। একজন ছাত্রী জানায় এ সকল কারখানার মালিক সালমান রহমান যে কিনা তাদের বন্ধু ইলার বাবা। একজনের মনে হয় এসব কারখানায় তবে লাশ উৎপাদিত হয়।

বুড়িগঙ্গার পাড়ে এ সময় কুকুরের ঘেউ ঘেউ। তারা বুড়িগঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। জয়নাল আবেদীন ও তার ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝতে পারে না কুকুরগুলো কেন ঘেউ ঘেউ করছে। যদি তাদের ঘেউ ঘেউ ক্ষুধার হয়, রাত্রির ক্ষুধার, তবে তারা কি ঘেউ ঘেউ করছে রাত্রির লাশ পাবার জন্য, চাঁদ পাবার জন্য, চুম্বন পাবার জন্য। ঘেউ ঘেউ এর ভাষা চিরকাল ঘুম ভাঙ্গানিয়া হলে তারা ঘুম থেকে জেগে উঠবে কি। কিন্তু তারা তো জেগে আছে। জেগে আছে তাদের বাজার নিয়ে, যেখানে তারা চাঁদ ও চুম্বন নিয়ে যাবে এ নগরীর প্রথম জল বুড়িগঙ্গার স্রোত থেকে।

 

৫.
কেউ চুম্বন করেনি। শুয়ে আছে সে, জয়নাল আবেদীন। তার শরীরের পাশে তার লিখিত বাজার দখল করা বই ‘কেউ চুম্বন করেনি।’ দিনের বেলা বাজারের কে-বা ভাবে চাঁদ ও চুম্বন বিষয়ক কথা। জয়নাল আবেদীনের শরীরের পাশে এখন যারা তারা তো জানে না সমাধিস্থ করার পদ্ধতি। পিঁপড়ারা সমাধিতে বিশ্বাসী নয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৬৮, কুষ্টিয়ায়। বর্তমানে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। লেখেন বিভিন্ন লিটলম্যাগে। সম্পাদিত লিটলম্যাগ : নিজকল্পা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : জল আসে মানুষের দীঘিতে, মানচিত্রকর, আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে, বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা, কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম এবং মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ।  উপন্যাস : কেউ মরছে না

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।