শনিবার, জুলাই ২৭

কেমন ছিল ১৯৮৬-র ম্যারাডোনা : ইলিয়াস কমল

0

বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তদের আতুরঘর বলা যায় আশির দশকের ফুটবল বিশ্বকাপ। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ে দিয়েগো ম্যারাডোনার অতিমানবীয় পারফর্মেন্স বোধকরি বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার এই বিপুল ফুটবল সমর্থক গোষ্ঠী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা মনে করার চেষ্টা করেছিলেন ৮৬-র বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সেই অতিমানবীয় পারফর্মেন্সকে স্মরণ করার। তাঁদের স্মৃতির গল্পই আমরা জানব আজ।


Maradona 4

ম্যারাডোনা— ফুটবলের এক আশ্চর্য জাদুকর


৮৬-র বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ এলেই যে বিষয়টি সবার আগে মানুষের মনে আসে তা হলো ম্যারডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’। এক বিখ্যাত ও কুখ্যাত ফুটবল অধ্যায়। বিশ্বজুড়ে তাবৎ মানুষের সেই সমালোচনার সূত্রপাত হ্যান্ড অব গড। তবে একই সাথে স্মরণকালের সেরা গোলগুলোর একটিও সেই বিশ্বকাপেই। একই ম্যাচে কুখ্যাত ও বিখ্যাত ম্যারাডোনার গল্পই তো বারবারই শোনা যায়। এমন পরিস্থিতিও আর দ্বিতীয়টি নেই ফুটবল ইতিহাসে।

 

প্রেক্ষাপট
গ্রুপ পর্বের ম্যাচ শেষে শীর্ষস্থানে ছিল আর্জেন্টিনা। সেইসাথে ছিল শিরোপার দাবিদারও। গ্রুপ পর্বে ইতালির সাথে ড্র করলেও দক্ষিণ কোরিয়া ও বুলগেরিয়াকে পরাজিত করে। ইল্যান্ড অবশ্য ততটা ভালো করতে পারেনি। পর্তুগালের বিপক্ষে পরাজয় দিয়ে শুরু করেছিল গ্রুপ পর্ব। পরবর্তীতে মরক্কোর সাথে ড্র। শুধু পোল্যান্ডের সাথে ৩-০ গোলের জয় দিয়ে নকআউট পর্বে ওঠে ইংল্যান্ড। ইংলিশদের নকআউটে প্রতিপক্ষ ছিল প্যারাগুয়ে। যাদের ৩-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে পায়। তার আগে আর্জেন্টিনা আরেক লাতিন আমেরিকান উরুগুয়েকে হারায় ১-০ গোলে। এবারে কোয়ার্টার ফাইনাল। আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড মুখোমুখি। ফকল্যান্ড যুদ্ধের ৭৪ দিন পর। আবারও দুই দেশ ফুটবল যুদ্ধের মাঠে। ম্যাচের আগে অবশ্য ম্যারাডোনাই বলেছিলেন, ফুটবল আর রাজনীতি একসাথে থাকার বিষয় নয়। কিন্তু এটা ছিল একটা ডাহা মিথ্যা। আর্জেন্টাইনদের বুকের ভেতর ফকল্যান্ড যুদ্ধে পরাজয়ের ক্ষত তখন দগদগে ঘা। ম্যাচটা যেকোনো উপায়েই জিততে চেয়েছিল আর্জেন্টাইনরা। পরে তা স্বীকারও করেছে খেলোয়াড়েরা।

 

খেলা কি আসলেই মনে রাখার মতো ছিল?
মাঠের খেলাতেই তার উত্তর আছে। আর্জেন্টাইনদের স্বচ্ছ পাস, চোখ ধাঁধানো সব ড্রিবলিংয়ের সাথে কিছুটা উচ্ছ্বাস ও নাটকীয়তাও। সেই নাটকীয়তার প্রথম পর্ব আসে দ্বিতীয়ার্ধের কিছুক্ষণ পর। ডান কোনা থেকে কর্নার কিক নিতে গেলেন ম্যারাডোনা। তাকে দেখেই বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফার গেলেন ইংলিশ পোস্টের দিকে। কর্নারের ফ্ল্যাগটি উঠে গিয়েছিল। ম্যারাডোনা তা তুলে দেখান লাইনম্যানকে। কোস্টারিকান লাইনম্যান কিছু করতে অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি নিজেই কর্নারের ফ্ল্যাগের স্ট্যান্ডটি লাগান। ম্যাচ জুড়ে ম্যারাডোনার উপস্থিতিই ছিল এমন; দর্শকের মনে রাখার মতো।

ম্যাচের সব জায়গাতেই ছিলেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনা দলে টেক্যানিক্যালি যে সকল দুর্বল খেলোয়াড় ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে শর্ট পাসে বল সংগ্রহ করে আক্রমণভাগেও যোগান দিতেন ম্যারাডোনা। তবে সার্জিও বাতিস্তার কাছে বল থাকলে তিনি নিজেই এগিয়ে যেতেন আক্রমণভাগে। দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বাতিস্তার প্রতিই সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখতেন ম্যারাডোনা। কারণ, তাঁর থেকেই একমাত্র অপজিশন থার্ডে বল পেতেন এই ফুটবল জাদুকর। বাতিস্তার কাছে বল দিয়ে বেশিরভাগ সময়ই উইং ধরে এগিয়ে যেতেন, ফাঁকা জায়গা দেখে বা নিজের জন্য জায়গা বের করে নিতেন। ক্রমাগত নিজেদের খেলোয়াড়দের সাথে ওয়ান-টু ওয়ান খেলতেন, মাঝে মাঝে খেলতেন ব্যাক ফ্লিকও। তাঁকে আটকানো রীতিমত দুঃসাধ্য ছিল।


Hand Of God

যুগ যুগ ধরে আলোচিত সমালোচিত ম্যারাডোনার সেই ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের একটি মুহূর্ত


সেই কুখ্যাত-বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড-এর আগে মাঝ মাঠ থেকে ডান প্রান্তে বারুচাগাকে বল বাড়ান বাতিস্তা। ম্যারাডোনা তখন মাঝমাঠ থেকে উপরের দিকে উঠে আসছেন। বারুচাগা বল দেন ম্যারাডোনাকে। বল নিয়েই ইংল্যান্ডের বক্সের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন ফুটবল জাদুকর। বক্সের ভেতর ঠিক গোলপোস্ট বরাবর তখন তিনজন ডিফেন্ডার। ম্যারাডোনা বল বাড়িয়ে দিলেন ভালদানোকে। দিয়েই পোস্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন ক্ষুদে জাদুকর। ভালদানো ইংলিশ ডিফেন্ডারদের মাথার উপর দিয়ে বল বাড়িয়ে দিতে দিতে ম্যারাডোনাও ছোটো বক্সের সামনে হাজির। ততক্ষণে এসে হাজির ইংলিশ গোলরক্ষকও। শূন্যে ভেসে উঠলেন ম্যারাডোনা, মাথা দিয়ে ছুঁতে না পারলেও ‘ঈশ্বরের হাত’ তো ছিলই। সেটাই এগিয়ে দিল আর্জেন্টিনাকে। সঙ্গে সঙ্গে ইংলিশ ফুটবলাররা দৌড়ে গেলেন রেফারির দিকে। কিন্তু হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। এ কথার মতেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল সেই ‘হ্যান্ড অব গড’-এর গোল। ভালদানো একই ধরনের বল চারবার দিয়েছেন ম্যারাডোনাকে। কিন্তু গোল ওই একটাই।

 

পৃথিবীর সেরা সেই গোল
এই গোল ভুলতে পারবে না কেউই। পৃথিবীতে যতদিন ফুটবল থাকবে ততদিন মানুষের কাছে সেরা গোল হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজটেকায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা ম্যারাডোনার সেই দ্বিতীয় গোলটি। যার বর্ণনা করতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই, যারা মাঠে বসে স্বচোক্ষে সেই কীর্তি দেখেছেন, তাঁদের চোখ ছলছল করে ওঠে। তারপরও যেন বর্ণনার কমতি থেকে যায়। প্রথম গোলের ৪ মিনিট পরেই সেই অবিস্মরণীয় গোলটি করেন ম্যারাডোনা।


Second Goal 1

৮৬-র বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা প্রায় একক প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় যে গোলটি করেন তা পৃথিবীর তাবৎ ক্রীড়ামোদীর কাছে ফুটবল-নন্দনের অন্যতম উদাহরণ হয়ে আছে


ম্যারাডোনার মুখে আমরা গোলটির বর্ণনা পাই এভাবে-‘আমি মাঝমাঠে বল পেয়ে কাউবয়ের মতো দৌড় শুরু করি। ইংলিশ মিডফিল্ডার পিটার রেইড খুব কাছে থেকেও আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। আমি দেখলাম এটাই সুযোগ। ঘোড়ার মতো ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। টেরি বুচারকে এক ডজে বোকা বানালাম। আমি দেখলাম বুরুচাগা, ভালদানো এবং ইংলিশ ডিফেন্ডার ফেনউইক তাকিয়ে দেখছে আমি কিভাবে গোল করছি। টেরি বুচারকে বোকা বানালেও সে শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে লেগে ছিল। আর বক্সে ঢোকার আগ মুহূর্তে ফেনউইক হাত দিয়ে আমাকে ধাক্কাও মেরেছিল। তখন আমার মনে হয়েছে, আমার মধ্যে বুলডোজারের মতো শক্তি ভর করেছে। ওই সময় ওই ধাক্কা আমার গায়ে লাগলেও টেরই পাইনি। সবার শেষে ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিয়ে উদযাপন শুরু করে দিলাম।’

২০০২ সালে ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে এই গোলটি ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হিসেবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে বিতর্কিত হয়ে আছে ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বরের হাত’ গোলটি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এই গোল—যা কখনোই ভোলার মতো নয়। আর ম্যারাডোনা? নিজেকে অবিস্মরণীয় করে গেছেন এই দুই গোল দিয়েই নয়, ৮৬-র বিশ্বকাপে নিজের সামগ্রিক খেলা দিয়েই। যে কারণে ফুটবল ভক্তরা ভালোবেসে তাঁকে এখনও জাদুকর বলে ডাকেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৮৪; ময়মনসিংহ। শিক্ষা : স্নাতকোত্তর। পেশা : সাংবাদিকতা।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।