শনিবার, নভেম্বর ৯

গোলাপ নির্মাণের গণিত : যুগ ও যন্ত্রণার সৎ প্রকাশ

0

প্রায় দুই যুগ ধরে কথাসাহিত্য রচনা করে চলেছেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম। ২০০৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী’ প্রকাশিত হয়। ‘গোলাপ নির্মাণের গণিত’ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর মোট পাঁচটা গল্পগ্রন্থ ছাপা হলো। এবাদে তিনি ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’ নামে একটা উপন্যাস লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন ‘মাহমুদুল হক রচনাবলী’। অদ্যাবধি সর্বসাকুল্যে তাঁর বই হয়েছে আটটা। খুব বেশি লিখেন না আবু হেনা মোস্তফা এনাম, বরং তিনি পাঠ করেন বেশি। এ কারণে তাঁর কথাসাহিত্য হয়ে উঠেছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার আকর। সাহিত্যে এমন পরীক্ষা-নীরিক্ষা নতুন ধারা তৈরি করবার জন্য জরুরি বলেই আমরা জানি। সেই চেষ্টাটাই করে চলেছেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম। গল্পের অসরল গঠন তিনি অনুসরণ করছেন পয়লা থেকেই—ঘটনাক্রম ধরে আগান না তিনি। আর তাঁর গল্পের ভাষাও তাঁর অসরল ঘটনাক্রমের পেছন পেছন ধাবিত হয়ে থাকে।

গোলাপ নির্মাণের গণিত

গোলাপ নির্মাণের গণিত | আবু হেনা মোস্তফা এনাম | প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা | প্রকাশক: কথাপ্রকাশ | প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪ |মুদ্রিত মূল্য ২৫০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

নামগল্প ‘গোলাপ নির্মাণের গণিত’-এর কথাটাই বলি। আমরা দেখতে পাই, গোলাপগ্রামের জিনিয়া আখতার (চাঁদবালিকা) আর আবু সাইদ (চাঁদবালক) জোছনার ম্রিয়মান আলোতে কানামাছি খেলছে। আর তখন গ্রামবাসীদের নিঃশ্বাসের ভেতর ঢুকে পড়ে গোলাপের সৌগন্ধ। তারপরই আমরা দেখি, ‘ধীর প্রবহমান নদীর উপর ভাসমান ঘন কুয়াশার ভেতর’ সে গ্রামের ভোর হারিয়ে গেছে। ধ্বংসের পরে সেখানে শস্যখেতে পড়ে আছে শুকনো খড়, আলপথে জমে আছে ধুলো আর হারিয়ে গেছে নদী। এসব ধ্বংসের কারণ হয়েছে আগন্তুকেরা। এ আগন্তুক কারা? আমরা দেখছি— ‘আগন্তকেরা, যদি বা তারা, পৃথিবীর নানান দেশের, তারা বলে আমাদের গ্রাম দ্বীপের মতো মনোরোম—সবুজ, শ্যামলিমা—বহুদূরের নক্ষত্রবীথির মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে আছে। তারা বিবিধ কোম্পানির এবং ফ্যাক্টরির মালিক, কেউ বা ম্যানেজার স্বয়ং। এবং তারা হয়তো কারো পাতালপুঞ্জে হিরার খনি, কারো বা পরমাণুবিদ্যা, কারো হয়তো যুদ্ধসরঞ্জাম, হয়তো বা সফটওয়ার বা গুগল অথবা ফেসবুক কিংবা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি; তাদের হাওয়াঘোড়া আমাদের গ্রাম দাবড়ে বেড়ায়।’ এই আগন্তুকেরা ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে গোলাপগ্রামের। তারা গ্রামবাসীদের সাথে গোলাপ বিনিময়ও করতে চায়। এভাবে ধ্বংস হয়ে যায় ঋতু, শস্য, ফল, বীজ, নারী, শিশু, বিদ্যালয়, মাঠের পর মাঠ গোলাপবাগান, এমনকি রাষ্ট্র অবধি। সেই ধ্বংসলীলার ফাঁদে পড়ে মৃত্যু হয় জিনিয়া আখতার আর আবু সাইদের। অনেকদিন পরে গ্রামবাসীরা— ‘এক আঁধার আঁধার ভোরে বিলীয়মান জ্যোৎস্না ও মেঘকুয়াশার ভেতর জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের শরীর নিঃসৃত কুয়াশার ভেতর উড়ে যাওয়া রক্তফোঁটা গোলাপের পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়তে দেখে।’

‘বিন্দুবাসিনী উদ্যান’ গল্পে বিন্দুবাসিনী তার বাবার মতো করেই সেলাইকল চালায়, একমনে। কী সেলাই করে বিন্দুবাসিনী? গ্রামের মানুষেরা দেখে— ‘… বিন্দুবাসিনী সেলাই করে চলেছে শালফুলের সুগন্ধ আর ঘুম ঘুম পাখিদের ভ্রুক্রুটি। তার সেলাইয়ের ফোঁড়ে জেগে ওঠে ছোট ছোট ফুলের জ্যোৎস্না, ঝিমঝিম সবুজ, শিশিরের গুঞ্জন আর পাখিদের গানের কম্পন।’ তখন শহরের সেলাইকরেরা গ্রামে আসে। এসব সেলাইকরদের হাতের কাজ খুব ভালো—তারা কাঁটাছেড়া মানুষের শরীর সেলাই করে, উপড়ানো বৃক্ষ সেলাই করে, হত্য করা পাখি-পতঙ্গ-ঘাসও সেলাই করতে পারে তারা। বিস্মিত হয় বিন্দুবাসিনী। তার ভয়ও করে। এদিকে বিন্দুবাসিনীর সামনে এসে দাঁড়ায় অশোক। অশোকের আগমন ব্যাকুল করে তোলে বিন্দুবাসিনীকে। অনেক অনেক দিন পরে বিন্দুবাসিনীর শরীরে নতুন চাড়া গজায়, চিরল সবুজ পাতা গজায়। আর বিন্দুবাসিনী দেখে, সোনালি শঙ্খচুরের চোখের মতো করে জ্বলছে দুপুর। তখন তার অন্ধ বাবা বোনো কোথাও থেকে কান্নার স্বরে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে— ‘পালিয়ে যা বিন্দা…পালিয়ে যা…বিন্দা!’ আবারও অশোক আসে। কিন্তু চুপ হয়ে যায় বিন্দুবাসিনী। তখন— ‘গাছের পাতারা চুপ, তাদের শরীরে শব্দময় হয়ে আছে পৃথিবীর সকল সবুজ কথা, নীল কথা, লাল কথা, হলুদ কথা।’ আবার অন্যদিকে পৃথিবীর যাবতীয় শব্দ খেলা করে শালবনে। এমন নৈঃশব্দ্য আর শব্দের কোনো শেষ নেই যেন! এদিকে হত্যাযজ্ঞেরও কোনো বিরাম নেই— হত্য হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন আকাশ, শালবন, নদী, পাখি আর মানুষ। মর্গে সেসব বিপন্নতা সেলাই করে চলেছে অশোক। তবু একদিন বনভূমিতে আগুন লেগে যায়। ভস্মীভূত হয়ে যায় ঘরবাড়ি, নদী, বৃক্ষ, ধূলো, রোদ। সেই হত্যাযজ্ঞের পরে বিন্দুবাসিনীকে আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক অনেক দিন পরে গ্রামবাসীরা দেখে, পাখির বিষ্ঠার ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে বটের চাড়া, তা পরিণত হচ্ছে বৃক্ষে। বটের ডালে চুপ করে বসে আছে নিঃসাড় একটা পাখি। আর— ‘পাখির চোখে জল’।

মর্গে সেসব বিপন্নতা সেলাই করে চলেছে অশোক। তবু একদিন বনভূমিতে আগুন লেগে যায়। ভস্মীভূত হয়ে যায় ঘরবাড়ি, নদী, বৃক্ষ, ধূলো, রোদ। সেই হত্যাযজ্ঞের পরে বিন্দুবাসিনীকে আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক অনেক দিন পরে গ্রামবাসীরা দেখে, পাখির বিষ্ঠার ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে বটের চাড়া, তা পরিণত হচ্ছে বৃক্ষে।

‘ধূলি-ওড়া সন্ধ্যার দিকে’-র রাখালবালক চটুইয়ের কথাও আমাদের মনে পড়ে। চটুইয়ের বন্ধু আবদুল তাকে বলে, মানুষ মারা গেলে পরে হরিতকী ফল হয়ে যায়! চটুই ভাবতে বসে— ‘পাতারা কেন আত্মহত্যা করে, জ্যোৎস্নায়!’ চেয়ারম্যানের গরুগুলো শহরের পার্কে চড়াতে গেলে সে দেখে, সারা শহরে ছুটে বেড়াচ্ছে গন্ধইঁদুরদের দল— ‘ধেড়ে ইঁদুর, বাচ্চা ইঁদুর, পাতি ইঁদুর, ছোকড়া ইঁদুর, মাস্তান ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর, জোলা ইঁদুর, ব্যাঙ্কার ইঁদুর, ক্যানভাসার ইঁদুর, রাজনৈতিক ইঁদুর, চ্যালা ইঁদুর, চামুণ্ডা ইঁদুর…।’ পার্কের গেটে গরু বেঁধে রেখে চটুই দেখে, পৌরসভা, পুরোনো হাসপাতাল, ফুড গোডাউন, শিক্ষ অফিস, টাউন হল, আবাসিক হোটেল, মসজিদ, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, কাঁচাবাজার, দোকানপাট—সব ছেয়ে গেছে গন্ধইঁদুর দিয়ে! চটুই দেখে, এক গন্ধইঁদুরের পিছে পিছে ছুটেছে হাজারও গন্ধইঁদুর। এভাবে মেলাদিন ধরে পার্কে গরু চড়াতে যায় চটুই। তখন পুলিশ আর ছুচোঁপার্টি এসে বকা দেয় তাকে— ‘…এইডা গরু বান্ধার জায়গা, ভাগ এখেন থেকি!’ এ দু-দল মিলে তখন গরুগুলোকে লাঠিপেটা করে। ছুটোছুটি লেগে যায় পর্কের ভেতরে— ‘ট্যুরিস্ট দৌড়াচ্ছে, গরু দৌড়াচ্ছে, ছুঁচোপার্টি দৌড়াচ্ছে, পুলিশ দৌড়াচ্ছে।’ চটুইও দৌড়াচ্ছে কোনো উপায় না দেখে। তখন হয়তো তার আকলিমার কথা মনে পড়ে যায়। তখন— ‘নদীর মৃত শরীর জুড়ে ময়ূরের খসে পড়া পালকের গৌরব নিয়ে কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলগুচ্ছ তাকে অভাবিত করে।’ কিন্তু পুলিশ আর ছুঁচোপার্টির সন্ত্রাসের কারণে চটুইয়ের ভেতরে জন্ম নেয় ভয়। আকলিমা আর চটুইয়ে যুগল-জীবনের শুরু হয় এসব ভয়ের মাঝেই। আয়নার ভেতরে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখে চটুই। আয়নাকে তার আশ্চর্য একটা মোমদানি বলে মনে হয়। সে তার বন্ধু আবদুলকে বলে, স্বপ্ন দেখা তো দোষের কিছু নয়! তবু ধ্বংস থামে না—আকলিমাকে ছিঁড়ে খায় গন্ধমূষিকেরা। চটুইয়ের খুব কান্না পায় তখন। ভেঙে যায় তার স্বপ্নবিলাস। তারপর একদিন ভোজবাজির মতো করে আয়নার ভেতরে মিলিয়ে যায় চটুই আর আকলিমা। গ্রামবাসীরা দেখে— ‘…চটুই মাথা দুলিয়ে গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছে, আকলিমার হাতে কচুরিপানার নীলচেবেগুনি ফুলের গুচ্ছ। তাদের শরীর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে নরম ঝলমল ধূলিগোধূলি কুয়াশা। আর একটা ঘুম।’

‘মৃত্যুসদনের অস্পষ্ট মিউ মিউ’ গল্পের মূল চরিত্রের মৃত্যু ঘটে। তার মাথা বরাবর গুলি ছুড়েছিল ইঁদুরেরা। মৃত্যুর পর থেকে সে বাস করে এ শহরের শাহবাগমোড়ের লাইব্রেরির অন্ধকারে। এর আগে ইঁদুরদের সাহস ও নিপুণ হত্যকৌশল তাকে সন্ত্রন্ত করে তুলেছিল। সে চোখের সামনে দেখেছিল, ইঁদুরেরা কেবল বইয়ের পাতাই খেয়ে ফেলছে না, সেই সাথে তারা খেয়ে ফেলছে পিঁপড়া, কীটপতঙ্গ, সাপ, এমনকি ধাড়ি বেড়াল পর্যন্ত। ধাড়ি বেড়ালের মতো একটা বড়ো প্রাণীকে আক্রমণ করাটা তো সহজ নয়! সে কাজাটা তারা করছে দল বেঁধে। তাই মূল চরিত্রের ভয় হচ্ছিল, যেকোনো সময়ে তাকেও খুন করে ফেলতে পারে সন্ত্রাসী ইঁদুরদের দল। তার মনে হচ্ছিল, এমন হতে পারে যে ইঁদুরেরা হয়তো পয়লাতে তার পায়ের দিকে আক্রমণটা চালাবে, অথবা মাথার দিকটায়, অথবা এমনও হতে পারে, ইঁদুরেরা আক্রমণ চালাবে তার গলাতে সরাসরি। কাজেই ইঁদুরদের খেলাধুলা দেখতে তার যতই ভালো লাগুক না কেন, মৃত্যুভয় তার ভেতরে জেঁকে বসেছিল। যাহোক, ইঁদুরদের হাতে মৃত্যুর পরে তার শরীরের রং হারিয়ে যায় এবং সে আশ্রয় নেয় শাহবাগমোড়ের লাইব্রেরিটার অন্ধকার কোণে। সে দেখতে পায়, সারা লাইব্রেরিতেও তাণ্ডব চালাচ্ছে ইঁদুরেরা— তারা কাগজ খাচ্ছে, গুলি হাগছে আর জগতের সব আলো বধ করবার জন্য গুলি ছুড়ছে তারা। ইঁদুরবাহিনীর হাতে খুন হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ বেড়াল। তারপর এক সময়ে সে দেখে— ‘…ভাঙা আয়নার টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে এক-একটি বই। ভাঙা ঘুলঘুলি দিয়ে উড়তে উড়তে বাজতে বাজতে প্রাচীন বইগুলো আমার মৃত মগজের বিড়াল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে শহরের বাতাসে।’

এ পর্যন্ত আমরা আবু হেনা মোস্তফা এনামের সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ ‘গোলাপ নির্মাণের গণিত’-এর গল্প ধরে ধরে যে আলোচনা করলাম, তা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে তাঁর গল্পের বিষয় আর ভাষা হালের কথাশিল্পের বিষয় আর ভাষার সাথে খুব একটা মিলছে না। মোটামুটিভাবে তাঁর গল্পগুলোতে তিনটা মূলসুর রয়েছে—সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্ত্রাস, হত্যযজ্ঞ আর ব্যাক্তির মৃত্যু।

‘ইঁদুর এবং বাজার বিষয়ক ট্রাভেলগ’ গল্পে আমরা দেখি, ইঁদুরেরা এবার সুশীল হয়ে উঠেছে; তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শপিংমল, রেস্তোরাঁ, মিউজিয়াম, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং স্থাপত্যকলার স্কুল। লেখক আমাদেরকে আরও জানাচ্ছেন, নানান বয়সী ইঁদুরেরা একটা নদীর দু-ধারে পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাদের সাথে মানুষের যোগাযোগ চলছে; মানুষের সাথে তৈরি হচ্ছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘর্ষ। মজার ব্যাপার হলো এই যে দিনে দিনে ভারি হচ্ছে ইঁদুরদের দল। লেখকের মনে শঙ্কা হচ্ছে যে আলবেয়ার কামুর ইঁদুরদের মতো করে না তারা আবার এ শহর ছেয়ে ফেলে! আসলে তেমন পরিণতিই তো ঘটবার কথা! নয় কি? সংখ্যাগরিষ্ঠরা যদি খুনী হয়, যদি ষড়যন্ত্রকারী হয় তবে কি শেষমেষ জিতে যায় না তারা? ইতিহাস তো সেটাই বলে!

এ পর্যন্ত আমরা আবু হেনা মোস্তফা এনামের সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ ‘গোলাপ নির্মাণের গণিত’-এর গল্প ধরে ধরে যে আলোচনা করলাম, তা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে তাঁর গল্পের বিষয় আর ভাষা হালের কথাশিল্পের বিষয় আর ভাষার সাথে খুব একটা মিলছে না। মোটামুটিভাবে তাঁর গল্পগুলোতে তিনটা মূলসুর রয়েছে—সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্ত্রাস, হত্যযজ্ঞ আর ব্যাক্তির মৃত্যু। আমাদের আশপাশে তো এসবই ঘটছে! এ নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলবার নেই। শুধু আমরা দেখি, একজন ব্যক্তি এসব সামাজিক অনাচারের প্রভাব থেকে কিছুতেই দূরে থাকতে পারে না! যদি তা পারত, তবে এ পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হতো নিঃসন্দেহে! এমন উদাহরণ আমরা পশ্চিম ইউরোপের সাহিত্যে বিস্তর দেখেছি (যেমন, আলবেয়ার কামুর ‘দ্যা আউটসাউডার’, ফ্যানৎস্ কাফকার ‘দ্যা মেটামরফোসিস’ প্রভৃতি)। বাংলাদেশে যেহেতু সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ চলছে কাজেই এখানেও আমরা আজকাল ব্যক্তির সাথে সমাজের আর রাষ্ট্রের সংঘর্ষ বেশি হতে দেখছি। এমন যুগযন্ত্রণার সৎ প্রকাশ ঘটেছে এই গ্রন্থে।

সামাজিক অন্যায়গুলোর কথা আবু হেনা মোস্তফা এনাম কিন্তু সরাসরি বলছেন না—আশ্রয় নিচ্ছেন প্রতীকের। এ কারণে এ বই জুড়ে রয়েছে প্রতীকের ছড়াছড়ি। সেগুলোর ভেতর থেকে বুঝে নিতে হয় গল্পের চলন। আবার অনেক কিছু ভেঙেও বলেন না তিনি। সেই অনির্দিষ্ট অঞ্চলে পাঠক চলছেন নিজের মতো করে। এতে কোনো আপত্তি নেই আবু হেনা মোস্তফা এনামের। দিনশেষে একটা গল্প বা উপন্যাস পাঠকের মাঝে একটা ভাবনা জাগিয়ে তোলে। তো গল্প বলার ধরন অসরল হলেও খুব আড়ালে থেকে সে কাজটাই করে চলেন এই লেখক।

দ্বিতীয়ত, আমরা দেখছি আবু হেনা মোস্তফা এনামের গদ্যভাষাও তাঁর গল্পের প্রকাশের মতোই অসরল। অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি, তিনি গল্প বলবার জন্য ভাষা তৈরি করে নিচ্ছেন—প্রচলের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন না। এমন সৃষ্টিশীল গদ্যভাষারই সন্ধান করেছিলেন কমলকুমার মজুমদার, অমীয়ভূষণ মজুমদার, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদুল জহির প্রমুখ। আবু হেনা মোস্তফা এনামের গদ্যভাষার ধরন দেখে এ কথাটাই আমাদের মনে পড়ে যায়, বাংলা কথাসাহিত্যের নয়া ভাষা নির্মাণের কাজ থেমে যায়নি তবে!

আমাদের মনে পড়বে, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের গদ্যভাষাতে খানিকটা এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যভাষাতে বহুলাংশেই আমরা কাব্যিকতার বোধন দেখেছি। এবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন পর্যায়ের গদ্যে, বিশেষ করে, ‘ছিন্নপত্র’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এবং ‘শেষের কবিতা’-য় এমন কাব্যিক গদ্যের উৎকর্ষের উদাহরণও আমরা স্মরণ করতে পারব।

এভাবে বিষয় ও অপ্রচলিত গদ্যভাষার ভারসাম্য রাখতে পারাটা বেজায় কঠিন! এ পথে যারা হেঁটেছেন তারা তা বিলক্ষণ জানেন! এমন একটা ভারসাম্য রক্ষার জন্য গল্পের ভাষা হয়ে ওঠে কাব্যিক। আবু হেনা মোস্তফা এনামের বেলাতে সেটাই ঘটেছে বলে আমরা ধারণা করি। আমাদের মনে পড়বে, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের গদ্যভাষাতে খানিকটা এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যভাষাতে বহুলাংশেই আমরা কাব্যিকতার বোধন দেখেছি। এবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন পর্যায়ের গদ্যে, বিশেষ করে, ‘ছিন্নপত্র’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এবং ‘শেষের কবিতা’-য় এমন কাব্যিক গদ্যের উৎকর্ষের উদাহরণও আমরা স্মরণ করতে পারব। এমন কাব্যিক গদ্যের অবতারণার পেছনে একজন কথাশিল্পীর প্রথম ভাবনাটা এমন হতে পারে যে অনেক সময়ে গদ্যকার তাঁর কিছু কথা সরাসরিভাবে বলতে চান না। দ্বিতীয়ত, তিনি গদ্যের সহজাত ছন্দকে ধরবার জন্য শব্দের পরে শব্দ বসিয়ে নিজের সাথেই খেলতে বসেন। এভাবে মাঝখান থেকে আমরা নতুন কাব্যিক গদ্যভাষার স্বাদ পেয়ে যাই। এখন কেউ যদি আমাদেরকে প্রশ্ন করেন, গদ্যভাষার প্রাঞ্জলতার বিধান করাটাই লেখকের মোক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তখন আমরা বলব, এই এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একজীবনে কত ধরনের গদ্যভাষারই চর্চাই না করে গেছেন—কখনও তা হয়েছে জলের মতো সহজ, কখনও তা কাব্যিক আর ফলত মেদবহুল! এ কারণেই আমরা আবু হেনা মোস্তফা এনামের কাব্যিক আর মেদবহুল গদ্যভাষার কুহকে হারিয়ে যেতে দ্বিধা বোধ করি না। তবুও সেই গদ্যভাষাকে আমাদের জলের মতোই সহজ মনে হয়! এটাকে আমরা লেখকের সংযমী উপস্থাপনাই বলব।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আবু হেনা মোস্তফা এনাম বহুত্বের সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, খুন, মানুষের অসম্মান, তাদের নিরুপায়তা আর ক্ষুব্ধতার যুগের গল্পকার। আমরা তো এসবের ভেতরেই বাস করছি দীর্ঘ দিন ধরে! আমরা আরও দেখছি, নিগৃহিত হচ্ছে সমাজের নির্বিবাদী, নির্বিরোধী ও প্রতিবাদে অপটু মানুষজন। এরাই আবু হেনা মোস্তফা এনামের গল্পের মূল চরিত্র। আর এ কারণেই আবু হেনা মোস্তফা এনামের সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও খুনবিষয়ক গল্পগুলো আমাদের মন ছুঁয়ে যায়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাশিল্পী, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে, ঢাকা শহরের সিদ্ধেশ্বরীতে। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের ভেতরে রয়েছে: ‘নক্ষত্রের ঘোড়া’, ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’, ‘আয়না’, ‘নীলক্ষেতে কেন যাই’,  ‘বখতিয়ার খানের সাইকেল’ এবং ‘ঘুমতৃষ্ণা’। উপন্যাসটির নাম–‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২২-এর সৃজনশীল শাখায় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ামস কলেজ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে তিনি স্নাতোকোত্তর।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।