রবিবার, অক্টোবর ১৩

জীবন-জগৎ-মানবপ্রেম ও নিসর্গের কবি : প্রগতি খীসা

0

নিসর্গের কবি তিনি, প্রকৃতির সৌন্দর্য সন্ধানী। জীবন, জগৎ, মানবিক প্রেম ও ভালোবাসাকে খুঁজেছেন এবং বিতরণ করেছেন সমতল-গিরিকন্দরের মানুষের হৃদয়ে। কবিতাকে উপজীব্য করে তুলেছেন মানুষের চিন্তার খোরাক হিসেবে এবং জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন মানবসেবা ও মানুষে মানুষে সংবাহন বিন্দু সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য দহনে। জোনাকির জ্বলজ্বল আলো, সান্ধ্যাকালের ব্যাঙের সমস্বরের ডাক, পাখির কলবর, ঝিরি-ঝর্ণার কলকল শব্দ, পাহাড়ের সর্পিল ছন্দের বুনোপথ কিংবা সমতলীয় ধানের জমি আইল দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা। তাঁর কবিতাগুলো পাঠকের মন উপোল করা অনবদ্য শিল্পসম্ভারে ভরা। ব্যক্তি জীবনে ঢাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে ব্যাবসা করলেও তাঁর মন কোনোদিনই ব্যাবসা করে টাকা অথবা ধন-দৌলত অর্জন করার লিপ্সায় পেয়ে বসেনি। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই কন্যাকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত পড়ালেখা শেখানোর পর এক সময় ব্যাবসা-বাণিজ্য ছেড়ে কবিতায় সমর্পণ করেন নিজেকে। ঘুরে বেড়িয়েছেন পাহাড়-প্রান্তর থেকে শুরু করে জৈন্তাহিল, গারো পাহাড়, মধুরপুরসহ খুলনার সুন্দরবন এলাকায়। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি ও সংস্কৃতির কথা, নদীর কথা, হাওড়-বাওড়ের জনজীবনের সুখ দুঃখের কথা ফুটে উঠেছে সরলভাবে।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই কন্যাকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত পড়ালেখা শেখানোর পর এক সময় ব্যাবসা-বাণিজ্য ছেড়ে কবিতায় সমর্পণ করেন নিজেকে। ঘুরে বেড়িয়েছেন পাহাড়-প্রান্তর থেকে শুরু করে জৈন্তাহিল, গারো পাহাড়, মধুরপুরসহ খুলনার সুন্দরবন এলাকায়।

তাঁকে এদেশের কবিতাবাদী মানুষ মনে রাখবেন বহুকাল। পার্বত্য শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহায়ক ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট ও রাঙামাটি কালচারাল ইনস্টিটিউশন কবি মাহমুদুল হাসান মাছুমকে ‘নিসর্গ কবি’ উপাধিযুক্ত পদকসহ সম্মাননা প্রদান করে ২০১৯ সালে।

দেশজ সংস্কৃতিজাত মননশীলতা সর্বোপরি তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেশব্যাপী শিল্পসংস্কৃতি সংগঠন ‘আর্টিস্টট্রি’ এবং এ সংগঠনের মূখপত্র ‘প্রতিধ্বনি’ কবিকে পৌঁছে দেয় উচ্চতর চূড়ায়। কবির আকস্মিক মৃত্যুর খবরে বাকরূদ্ধ হয় দেশের সাহিত্য শিল্পবোদ্ধা মানুষ। নওগাঁয় সবুজ মাঠে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর বাবার পাশে আর মায়ের বুকে মহাশয়নে শায়িত মাছুম ভাইয়ের উদ্দেশ্য বলব, তুমি হেসে হেসে চলে গেছ তোমার জোনাকির বংশদ্ভূত শহরে। কবিতার পাঠক, সাহিত্যকুল বন্ধুবান্ধবরা তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তোমার সৃষ্টি আর কবিতা-সম্ভারের ঐশ্বর্যতায়। কবি তোমার মৃত্যু নেই।

কবি পকেটের টাকা খরচ করে পাহাড়ে আসতেন। আসতেন প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও স্থানীয় রূপরসের উপাদানের সন্ধানে। কবির অপ্রকাশিত কবিতার যে পাণ্ডুলিপি তা সবই পাহাড়-সংস্কৃতি নিয়ে লেখা কবিতা।

কবির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে রাঙ্গামাটিতে, আমারই বাড়িতে। ২০১৮ সালে এক শরৎ-সন্ধ্যায়। কবি এসেছিলেন তখন রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব দেখতে। ঢাকায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কয়েকজন পাহাড়ের ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে। কবিকে গাইড করা ছাত্র-ছাত্রীরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে কবিকে নিয়ে আসে আমার বাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন আরেক ভদ্রলোক। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা তিনি। কৃষি কর্মকর্তার নাম পল্লব। সে বছরই আমার প্রথম সন্তান প্রমী ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর দ্বিতীয় সন্তান অতিন্দ্রীয় খীসা পড়ত ঢাকার একটি স্কুলে। এ কারণেই নানা সময়ে অসময়ে যেতে হতো ঢাকায়। কখনো একা, আর কখনো স্বপরিবারে। ঢাকায় গেলে দেখা হতো কবির সাথে। ঘুরে বেড়াতাম টিএসসি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গণগ্রন্থাগারসহ নানা জায়গায়। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে কবি বললেন, এই যে দাদা দেখুন কবিতার শক্তি। কবিতার শক্তিতে জ্বলে উঠে তিনি আজ আমাদের জাতীয় কবি। আমরা কেউ এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকব না কিন্তু এই ধরিত্রীর বুকে মানবজাতি তথা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যতোদিন বেঁচে থাকবেন ততোদিন কবি কাজী নজরুল থাকবেন আমাদের জাতীয় কবি হয়ে। কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম এভাবে জীবন ও জগতের সাথে কিংবা মানবিক সত্তায় একাকার হয়ে ভাবতেন কবিতা নিয়ে। কবির সাথে যতোবার দেখা হয়েছে ততোবারই মুগ্ধ হয়েছি আমি। এভাবে কবির সাথে আমার সম্পর্কটা হয়ে যায় বড়ো ভাই আর ছোটো ভাইয়ের মতো।

কবির পরামর্শ মতো খাগড়াছড়ির ভাইবোন ছড়া নিবাসী এবং আমার হাতেগড়া পার্বত্য শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহায়ক ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরসন চাকমা আমাকে কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম। রাঙ্গামাটিতে আমার চিকিৎসার খরচ যোগান দিতে নাট্যকার সুশীল দাদা মঞ্চত্ব করলেন নাটক। বরেণ্য কবি মৃত্তিকা চাকমা ও কবি শিশির চাকমার নেতৃত্বে পাহাড়ের সকল কবি, লেখকগণ এলেন এগিয়ে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানে। আমেরিকা প্রবাসী সুনীতি দাদা পাঠিয়ে দিলেন মাদ্রাজ মেডিকেল মিশন সেন্টারে নিউক্লিয়ার মেডিনিন আয়োডিন থেরাপি নেওয়ার সমস্ত খরচ।

একদিন পাশে রাখা মোবাইলের টিংটিং শব্দে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে কলব্যাক করি। ফোন করতেই বললেন দাদা পাহাড়ে আসতে মন এগিয়ে গেছে বহুদূর। আপনার কোথাও কোনো প্রোগ্রাম আছে কি না? এপাড় থেকে জানালাম আপাতত আমার ব্যক্তিগত কোনো প্রোগ্রাম নেই আপনি চাইলে আসতে পারেন। আমি বিষয়টি সুশীল দাদার সাথে শেয়ার করি। এদিকে উল্টাপাড়ার চিক্কোমণি তালুকদার পরের দিন ফোন দিল আমাকে। চিক্কোমণি বাবু ফোনে বলল মাছুম দাদা পাহাড়ে আসছেন। এবার যেন তিনি আসেন উল্টাপাড়ায়।

সুশীল দাদা আর মাছুম দাদাসহ ঠিক হলো তাঁরা ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি পৌঁছবেন শুক্রবার সকালে। অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে। আর সেদিনই দুপুরে খেয়ে দেয়ে আমরা চলে যাব বাবু চিক্কোমণি তালুকদারদের বাড়িতে। কথামতো তাঁরা পৌঁছলেন রাঙ্গামাটি। দুপুরে আমার বাড়িতে খাওয়ার কথা বললে তিনি বললেন না দাদা খাব না। আমরা রেস্ট করব। তারপর সেখান থেকে চলে যাব কাউখালী উল্টাপাড়ায়।

রাতটি কাটালাম তালুকদার বাড়িতে। অর্থাৎ চিক্কো তালুকদারের বাড়িতে। শনিবার সকালে নাস্তা, ভাত, মিষ্টি, চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে অপরাজিতা চাকমাদের বাড়িতে।

খানাপিনা হয় সুশীল দাদার আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে বাড়ির উঠানে বসে জোনাকির আনাগোনা, ব্যাঙের সমস্বরে ডাকে মিটিমিটি চাঁদের আলোর নিচে সৌর বিদ্যুতের আলোতে চলে কবিকন্ঠে কবিতা পাঠ। আমার সহধর্মিণী বনিতা খীসা স্কুল-কলেজে পড়ার সময় জড়িত ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। বনিতা দু’টো গান গেয়ে শোনাল সেদিন। কবি মাছুম দাদা তাঁর লেখা ও কাব্যিক পলাশের সুর করা একটি গান মোবাইল থেকে বাজিয়ে শোনালেন আর নিজেও গাইলেন কন্ঠ মিলিয়ে। কবির লেখা গানটি শুনে আমার বুক চিনচিন করে উঠল। বার বার মনে হচ্ছিল গানের ভেতর কী একটা বার্তা দিতে চাইছেন কবি। গানের ভেতর নিষ্প্রভতার ছোয়া কিন্তু নিষ্প্রভ নন কবি। আমরা উৎসবই করলাম সে রাতে। রাতটি কাটালাম তালুকদার বাড়িতে। অর্থাৎ চিক্কো তালুকদারের বাড়িতে। শনিবার সকালে নাস্তা, ভাত, মিষ্টি, চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে অপরাজিতা চাকমাদের বাড়িতে। বলাবাহুল্য যে, অপরাজিতার মা শ্যামলী চাকমা সদ্য অসুখ ছেড়ে উঠেছেন তাই শ্যামলীকে দেখতে যাবেন কবি। আর অপরাজিতার মেঝো কাকাবাবু কবির সম্মানে আয়োজন করেছেন শনিবারের দুপুরের খাবার।

রবিবার অফিস খোলা হবার কারণে সময় দিতে পারিনি কবিকে সেদিন। যাবার আগে কবি বলে গেলেন উল্টাপাড়াতে একটি পাঠাগার হবে। পাঠাগারের নাম হবে ‘মৈত্রী পাঠাগার’।

চিক্কোমণি তালুকদারদের বাড়ি থেকে অপরাজিতা চাকমাদের বাড়ি পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে কবি নিজ হাতে ছবি তোলেন আমার। সবাই মিলে একসাথে তুললাম ছবি। অপরাজিতার মাকে কিছু টাকাও দিলেন কবি সেদিন। আশেপাশে ৪-৫ ঘর বেড়ালাম একসাথে। সব বাড়িতেই ছিল পাকা কলা, পেঁপে আর বিন্নি চাউলের গুঁড়া দিয়ে বানানো পিঠা। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে পরিবারের দুইজনকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলাম রাঙ্গামাটিতে। তাঁরা থাকলেন সুশীল দাদাসহ। কারণ শনিবারের রাতে ভোজের দাওয়াত দিয়েছেন উল্টাপাড়ার গ্রাম-প্রধান (সমতলে মাতুব্বর) বাবু অমৃতলাল কারবারি। রবিবার সকাল ১০ টার দিকে আবারও রাঙামাটি ফিরে এলেন কবি ও তাঁর দল। কবির সাথে চা খেয়ে তাদের বিদায় জানাই। উল্লেখ্য, রবিবার অফিস খোলা হবার কারণে সময় দিতে পারিনি কবিকে সেদিন। যাবার আগে কবি বলে গেলেন উল্টাপাড়াতে একটি পাঠাগার হবে। পাঠাগারের নাম হবে ‘মৈত্রী পাঠাগার’। আগামী শীত মৌসুমে চলে আসবেন কবি পাঠাগারটি উদ্বোধন করতে। সঙ্গে নিয়ে আসবেন বই–এই বলে তাঁরা পাহাড়িকা বাস যোগে রাঙ্গামাটি থেকে চলে গেলেন চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়। রবিবার রাতে অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর কবির সাথে সামান্য কথা হয় আমার। ৫ সেপ্টেম্বর অফিসের কাজে আর সেদিন রাতে বাড়িতে মেহমান আসায় কোনো কথা হয়নি কবির সাথে। সেদিন ফেসবুকে লগইন করারও সময় হয়নি আমার। ৬ তারিখ সকালে যখন অফিসে বসে খবর পাই কবির হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফোন দিলাম মাছুম দাদার নস্বরে। ফোন রিসিভ করলেন কবি তনয়া। কিছুক্ষণ পর কবি তনয়া দিলেন পোস্ট, কবি আর আমাদের মাঝে নেই। হতবাক হলাম এ সংবাদে। মুহূর্তে খসে পড়ল হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি।

জানি না কবির মতো আমিও কোনোদিন না থাকলে কয়জন স্মরণ করবে? হয়তো শূন্যের ঘরে বন্দি হবে সে আশা। কারণ ঢাকার সংস্কৃতি আর মফস্বলের সংস্কৃতি তো এক নয়। অতএব, ঢাকার কবি বন্ধুরাই ভরসাস্থল। উর্দ্ধলোকে চাঁদের আলোতে মিশে থাকুন কবিবর মাহমুদুল হাসান মাছুম। আমরা আপনাকে ভুলব না। কারণ এই পাহাড় আর পাহাড়ের মানুষকে ভালোবেসেছেন জীবনের প্রতিটি ভোরে অথবা জীবনের প্রতিটি ক্ষণে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

সদস্য-সচিব, পার্বত্য কবি পরিষদ আহবায়ক কমিটি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।