প্রবুদ্ধ কথা রাখেনি। আগরতলার অন্যতম শক্তিশালী কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর। প্রবুদ্ধ আমার বন্ধু। পল্লব ভট্টাচার্য, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, অশোক দেব, আকবর আহমেদ—ওরা ত্রিপুরার কবি, বাংলা ভাষার কবি। এর মধ্যে প্রবুদ্ধর সঙ্গে আমার যোগাযোগটা বেশি ছিল। ও ঢাকায় এসেছে যখন, আমাদের দেখা হয়েছে। আমার একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘রোম অ্যাজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে’ প্রকাশের পর দেখি, প্রবুদ্ধ একটি কবিতা লিখেছে। কবিতার নাম ‘টোকন ঠাকুর একদিনে তৈরি হয়নি।’ আমার এরকম কথা ছিল প্রবুদ্ধের সঙ্গে যে, ‘জীবনের কোনো এক সময়ে আমি আগরতলায় যাব, ওখানে কোনো এক রাস্তার ধারে কমলালেবুর দোকান দেবো আমি। সেই দোকানের পেছনেই থাকবে আমার বসবাসের ঘর। কমলালেবু বিক্রেতার সঙ্গে কি কোনো বালিকা থাকতে রাজি হবে? প্রবুদ্ধ বলল, ‘আগে কাঁটা শেষ করো। তারপর চইলা আসো।’ ফেসবুকে যোগাযোগ ছিল বেশি আমাদের। প্রবুদ্ধ গতবছর মারা গেছে। আমার ত্রিপুরা পৌঁছনোর আগেই প্রবুদ্ধ চলে গেল? প্রবুদ্ধর জন্য আমার মনখারাপ হয়। কাঁটা দেখার আগেই প্রবুদ্ধ কেন চলে গেল! কলকাতায়, একবার দেখা, কথা হচ্ছিল বিভাসের সঙ্গে। বিভাস রায়চৌধুরী। আমার বন্ধু, কবি। বিভাস থাকে বনগাঁয়। বনগাঁ থেকে ট্রেনে যাওয়া-আসা করে কলকাতায়। আদিতে বিভাসরা হয়তো ঝিনেদা অঞ্চলের মানুষ ছিল বা থাকতে পারত। একদা ওর বাবা-মা হয়তো শরণার্থী বা ‘সংখ্যালঘুজনিত’ দখল-বাস্তবতায় এদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিল ঋত্বিকের সুবর্ণরেখার সেই নতুন বাড়ির সন্ধানে।
বিভাসের সঙ্গেও কথা হতো আমার, প্রবুদ্ধকে নিয়ে। কিন্তু প্রবুদ্ধ আকস্মিক নেই হয়ে গেল! আগরতলা কেন, পৃথিবীর কোথাও আর কোনো দিন প্রবুদ্ধকে দেখা যাবে না। আমার কমলালেবু জীবিকাও প্রতিষ্ঠা পাবে না। কিন্তু প্রবুদ্ধসুন্দর করের কবিতাগুলো থেকে গেছে বাংলা ভাষার পাঠকের জন্য। প্রবুদ্ধ ওর অসুস্থ মায়ের কী সেবাটাই না করেছে! ওর মা মরে গেছে। ওর মেয়ে বিহু প্রয়াত কবি-বাবার জন্য চিরকাল রাতে ঘুমের আগে বালিশের তুলোতে কান্না লুকিয়ে রাখবে জানি। যেমন, অতীন অভিক আমার বন্ধু। ‘অপ্রকাশ্য বোধ’ ওর এখন পর্যন্ত প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ। ঝিনেদায় বন্ধু দিলিপ ঘোষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাংলা কবিতার ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে। বর্তমান নিয়েও। দিলিপের একটি মুদি দোকান আছে, ও সারাদিন সেই দোকানেই আটকা পড়ে থাকে। কিন্তু অতীন অভিক কোনো দোকান চালায় না। চাকরি করে না। সংসার করে শুধু কবিতার সঙ্গে, আড্ডার সঙ্গে। কাঁটা নিয়ে প্রশ্ন করে দিলিপ, ‘কবে রিলিজ হবে ছবি?’ বললাম, ‘এ বছরেই।’ ‘সে তো শুধু শুনেই যাচ্ছি—’ খেদ পাড়ে দিলিপ। খেদের উত্তর আমি দেওয়ার আগেই উত্তর দেয় কবি অতীন অভিক, বলে, ‘কাঁটা গল্পটা তো ইতিহাসের তিনটা সময় উল্লেখ করে। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে গল্পটা শুরু হয় এবং শেষ হয় পরের বছর ৯০ সালের ৩০ অক্টোবরে গিয়ে। অর্থাৎ ২২ মাস সময় এই গল্পে চিত্রায়িত। অবশ্য এই ২২ মাসের মধ্যে দু-দুটি ফ্ল্যাশব্যাক আছে। এক ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যাবে ১৯৭১ সালের বাস্তবতা, আরেক ফ্ল্যাশব্যাকে আমাদের নিয়ে যাবে ১৯৬৪ সালে। আলটিমেটলি কাঁটাকে ১৯৯০ সালের গল্প বলেও কেউ ভাবতে পারে, কেউ ভাবতে পারে ১৯৭১ সালের গল্প।
কেউ ভাবতে পারে ১৯৬৪ সালের গল্প। তাই এতটা সহজ ছিল না কাঁটা নির্মাণযজ্ঞ দ্রুত শেষ করা। এখন তো শেষের পথে।’ আমি দোকানি দিলিপ ঘোষ ও কবি অতীন অভিককে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। কাঁটা নিয়ে ওরা এত খোঁজখবর রাখছে, এটা আমাকে আরও দায়বদ্ধ করে তোলে। ঢাকা তো বটেই, ঢাকার বাইরে চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, সিলেট বা দেশের নানান শহরে থাকা আমার বন্ধুরাও খোঁজখবর রাখছে। প্রবুদ্ধ বলেছিল, কাঁটা শেষ করেই তুমি আগরতলায় আসবা। এবং এক অবাক করা কাণ্ডে, ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর রাত ৯ টার পর থেকে কাঁটার খোঁজখবর দেশ বিদেশের অসংখ্য বাঙালি, যারা কিনা সচরাচর হয়তো সিনেমার অনেক খবরই রাখে না—তারাও জানে। কাঁটা সিনেমার নির্মাতার খবর প্রচার করেছে দেশের সব গণমাধ্যম। সে খবরে মামলা, পুলিশ, থানা-হাজত ও আদালত প্রাঙ্গণ চলে এসেছে। সে সব কথা জার্নি অব কাঁটার আরও পরের এক পর্বে হয়তো ধরা পড়বে। অর্থাৎ মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে ছিলাম যখন, তখনও আমার জানা ছিল না, এরপর কী ঘটবে?
ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা আমরা জানি না বর্তমানে। কেউই জানে না তার ভবিষ্যৎ। আমরা মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প ছেড়ে নারিন্দায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি। পাশাপাশি চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুযায়ী চরিত্র মেলাতে থাকি। মিলে গেলে রিহার্সেল শুরু হয়ে যায়। কো-আর্টিস্টদের সঙ্গে রিহার্সেল চলতে থাকে। চরিত্রের ব্যাবহারিক প্রপস ও কস্টিউম মেলাতে থাকে সহকারিরা। যেমন, কাঁটাতে একজন সিনিয়র আর্মি অফিসারের চরিত্র আছে। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তানের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে একটি চরিত্র আছে ছবিতে। কাকে নিতে পারি সেই চরিত্রে? একদিন পাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সৈয়দ মুখলেসুর রহমানকে। সৈয়দ মুখলেসুর রহমান সেনাবাহিনীর লোক হলেও তিনি কবি, কবিতা লেখেন পলক রহমান নামে। গান করেন পলক ভাই। কবিতা আবৃত্তি করেন। অনেক আগে থেকেই আমি পলক ভাইকে চিনি। অভিনয়ের প্রস্তাব পলক ভাই সানন্দেই গ্রহণ করেন। আমি বলেছি, একজন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারের চরিত্র করতে হবে আপনাকে। পলক ভাই নিজ দায়িত্বে কাঁটাকে ভালোবেসে ব্রিগেডিয়ারের পদক ও অন্যান্য নির্ধারিত অলংকারসহ ব্যয়বহুল কস্টিউমটি করে নিয়েছেন। এবং উর্দু ভালো জানা থাকায় এই চরিত্রটি করতে খুব সুবিধা হয়েছে যেমন পলক ভাইয়ের, আমারও। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন তিনি, তাই এরপরের কোনো প্রোমোশন তাঁর হয়নি। কাঁটা শুটিং শেষে পলক ভাই বললেন, ‘আমার ডিপার্টমেন্ট আমাকে মেজর হিসেবে অবসরে পাঠালেও, আপনার ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে হলেও আমি ব্রিগেডিয়ার হয়েছি। এই পদোন্নতি আমাকে কাঁটা সিনেমা দিয়েছে। তাই স্যালুট জানাচ্ছি আপনাকে।’ শিল্পকলার নানান দিকে কাজ করা মানুষ পলক ভাই কাঁটাতে তাঁর উর্দু সংলাপে খুব ভালো অভিনয় করেছেন। নানাভাবেই আমি কৃতজ্ঞ এই শিল্পী মানুষটির প্রতি। এই সেনা কর্মকর্তার প্রতি। তাঁকে কাঁটা ছবিতে অভিনয়ে পাওয়াটা আমার জন্য ভালো হয়েছে। একজন সামরিক অফিসারের ভাবভঙ্গি তো আমি তাঁকে শেখাতে পারতাম না, যা তিনি নিজেই জানেন।
কাঁটাতে এমন কিছু দুর্দান্ত অভিনেতা আছেন, যারা থিয়েটারে দক্ষ অভিনেতা হিসেবে নিজেদের যোগ্যতার নজির রেখেছেন। হ্যাঁ, কাঁটা অডিশনের মাধ্যমে যতজন আমাদের সঙ্গে আছেন, তাদের একটা বড়ো অংশ থিয়েটার থেকে আগত, এ কথা সত্য; এবং আগে থেকেই তাদের ব্যাপারে একটা বোঝাপড়া আমার ছিল। সেটা কাঁটার কাস্টিং করতে সুবিধা হয়েছে আমার বা কাঁটা টিমের। অবশ্য তাদেরও একটা রিহার্সেল পর্ব গেছে মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে। নরসংদীর বাঁধনহারা থিয়েটারের নিয়মিত নির্দেশক অভিনেতা কামরুজ্জামান তাপু। বাঁধনহারার বাইরে ঢাকায় এসে এসে মাঝেমধ্যেই কোনো কোনো প্রোডাকশনে কাজ করে যান কামরুজ্জামান তাপু। অভিনয় নিয়ে অভিনিবেশী থাকেন তাপু, এ তাঁর গুণ। কাঁটাতে একজন গুরুত্বপূর্ণ মহল্লাবাসির চরিত্র করেছেন তিনি। সময়কাল ১৯৭১। ২৫ শে মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর ঢাকাসহ সারা দেশ থমথমে। ২৬ শে মার্চ কাটল গোলাগুলির ভয় আতংকে। ২৭ শে মার্চ ভোর থেকে সামরিক প্রশাসন কারফিউ শিথিল করে অর্ধবেলা পর্যন্ত। সেই সুযোগে, ভয়ে-আতংকে জান বাঁচানোর তাগিদে ভূতের গলি মহল্লবাসিরা অনেকেই ঢাকা ছেড়ে পালাতে চায়। তারা হয়তো পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলি পার হয়ে, নদী পার হয়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে চায়। সেই দলে যে-সব মহল্লবাসি বউ-বাচ্চা-ঘটিবাটি-পুটলি বা টিনের ট্রাঙ্ক মাথায় করে পালাতে চায়, কামরুজ্জামান তাপুও সেই দলে আছেন। তিনি কাঁটাতে আছেন আরও নানান দৃশ্যে, সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে তাপু কাঁটাতে যুক্ত থেকেছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি তার কাঁটায়; যেমন, কাজী ফয়সল আছে কাঁটায়। ১৯৭১ সালেরই একটা চরিত্র করেছে কাজী ফয়সল। ফয়সল থিয়েটারের নিবেদিত প্রাণ, তাপুর মতোই। রাজাকার জব্বার কমান্ডারের চরিত্রে অভিনয় করেছে ফয়সল। মজার চরিত্র। ভূতের গলির শান্তি কমিটির নেতা মওলানা আবুবকরের অত্যন্ত অনুগত রাজাকার কমান্ডার জব্বার হিসেবে সে যেমন নৃশংস, আবার তরুণী কুলসুমকে তার ভালো লেগেছে। মোদ্দা কথা, বাকি তিন রাজাকারকে নেতৃত্ব দিয়ে সে পুরো ভূতের গলি দাপিয়ে বেড়ায়। মুক্তি বাহিনীর খোঁজ নিতে ফন্দি আঁটে। যদিও ছাগল বা ভোঁদাই হিসেবে পরিগণিত হয় তারা, ভূতের গলির রাজাকাররা। কাজী ফয়সলকে কাঁটার এই কঠিন চরিত্রটি করাতে পেরে আমিও আনন্দ পেয়েছি। খুব প্রয়োজন অনুসারে পরিমিতির সঙ্গে ফয়সল জব্বার কমান্ডারের চরিত্রটি করেছে।
নির্দেশক রেজা আরিফের নির্দেশনায় শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ মঞ্চে নেমেছিল ঢাকায়। আমি পাঁচটা শো দেখেছি। ঢাকার মঞ্চে একটা ভালো প্রোডাকশন, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছেন শহীদুল জহিরের সঙ্গে, রেজা আরিফের সঙ্গে। অভিনেতা হিসেবে ফাহিম মালেক ইভানকে সেই আমার প্রথম দেখা। প্রতিটি শো শেষে দর্শকের আসন থেকে রেজা আরিফ দু-একজনকে ডেকে নিতেন মঞ্চে, তারপর সেই দু-একজন তাদের প্রতিক্রিয়া বলতেন দর্শকের সামনে। একটি শো শেষে রেজা আরিফ ডাকলেন দর্শক তারিক আনাম খান ও দর্শক আমাকে। সামগ্রিক ভাবেই যে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ একটা দারুণ প্রোডাকশন, সে কথা বলেছি। রেজা আরিফকে বললাম, সেই কান্না করে দেওয়া দুলারির পিতার সঙ্গে আমাকে একটু আলাপ করায়ে দেন। আমি যতবার দেখি ওই জায়গায় কেঁদে ফেলি। অভিনেতার ক্ষমতা সেইখানে লুক্কায়িত। সেভাবেই ফাহিম মালেক ইভানকে একদিন কাঁটায় যুক্ত করে নিতে পারি। মাত্র কয়েকটি দৃশ্যের উপস্থিতি দিয়েই ইভান প্রমাণ করেছেন, অভিনয় কেবলই অভিনয় নয়। সামান্য একটি ক্ষণমুহূর্তকে ইভান ব্যবহার করেন দারুণ দক্ষতায়।
কাঁটার সিনেমাটোগ্রাফার তাইজুল ইসলাম রোমান ও আর্ট ডিরেক্টর মাহমুদুর রহমান দীপনসহ সহকারিদের একটি টিম নিয়ে তখন রাতদিন একাকার আমাদের। সে এক সময় এসেছিল আমাদের জীবনে। বাঁধনহারা থিয়েটার থেকে কিছু টিনের ট্র্যাঙ্ক ও অন্যান্য প্রপস আমরা পেয়েছি কাঁটায় যুক্ত হওয়া শিক্ষানবিশ সহকারী তুরার সৌজন্যে। যেগুলো ১৯৭১ সালে ভূতের গলি মহল্লা থেকে পলায়নপর মহল্লাসীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অনিমেষ আইচও এক বস্তা পুরাতন পোশাক পাঠিয়েছিল মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে। যদিও সেই বস্তার পোশাক খুব একটা কাজে লাগানো যায়নি কাঁটাতে। তবে অন্যান্য প্রপস ও কস্টিউম এসেছে নানান জায়গা থেকে। সেই লিস্ট লিখব কোনো এক পর্বে। সবার প্রতিই কৃতজ্ঞ কাঁটা টিম, টিমের প্রতিও কৃতজ্ঞ কাঁটা।
বুঝতে পারি, মগবাজারে কাঁটা টিম আর বেশি দিন নেই, নারিন্দায় যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। নারিন্দায় গেলেও শুটিং শুরু হতে কিছুটা সময় লাগবে, কারণ, আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি হিসেবে যে বাড়ি পেয়েছি, সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দিনের বাড়ি, সে বাড়ির কিছুটা পুনর্বিন্যাস লাগবে কাঁটার জন্য। বাড়িটির বয়স প্রায় একশো বছরের কিছু বেশি, সে অনুযায়ী বাড়িতে একটা দেওয়াল তুলতে হবে শতবর্ষী ইমেজে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জই সিনেমা। কাঁটা তো আরেকটু বেশি কিছু। আর্ট ডিপার্টমেন্টের খেলা দেখাতে হবে। ওকে, খেলা হবে।
পিরিওডিক্যাল ছবি কাঁটা। শতশত পিরিয়ড বেইজড প্রপস ও কস্টিউম লাগবে ছবিতে, যেহেতু চরিত্রই পাঁচশোর অধিক। অনেক কস্টিউম বা প্রপস কখনও হয়তো মেলেনি সময় অনুযায়ী, তখন বাদ পড়ে যায় সেটা। আবার সংগ্রহ বা নির্মাণ চলে কাঁটা ক্যাম্পে। সেলাই মেশিন নিয়ে সারা দিন কাপড় কাটা-সেলাই চলতে থাকে। ক্যাম্পেই আনা হয় সেলাই মেশিন। যজ্ঞ শুরু হয়। যজ্ঞর নাম কাঁটা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন ছাত্র আসে কাঁটা অডিশনে। নাটক ও নাট্যতত্ত্বের ছাত্র। সোহেল তৌফিক। ওর বাড়ি ভুরুঙ্গামারি। ওকে আমার পছন্দ হয়। ওর জন্য একটা চরিত্র আমার মনের ভেতর থেকে ছুটে যায়। খুব মিষ্টি সেই চরিত্র, ওর লাশ দেখা যাবে কাঁটায়। ওর বিভাগের মাস্টারনি কাজী শুসমিন আফসানা শিমু। শিমুর সঙ্গে আমার কথা হয় ফোনে। শিমুই জানাল, ‘আমার এক ছাত্র গেছে না কাঁটার অডিশনে?’
‘হ্যাঁ, আসছে।’
“ও কি টিকছে?’
‘টিকছে।’
‘আমার কাছে আসছিল ছুটির জন্য, বলল, ঢাকায় যাবে অডিশন দিতে। আমি বললাম, কার কোন প্রোডাকশনে অডিশন হচ্ছে? ও বলল কাঁটার কথা। আমি বলছি, ছুটি দিতে পারি এক শর্তে। শর্তটা হচ্ছে যোগ্যতা দেখিয়ে টোকন’দার কাছ থেকে ক্যারেক্টার ছিনিয়ে আনতে হবে। পারবে?’
সোহেল তৌফিক জানিয়েছে, ‘পারব।’
ও পেরেছে। ওর লুক, ভ্রুর আচরণ দেখেই আমি ওকে একবাক্যে ১৯৬৪ সালের সুবোধচন্দ্র দাস করে দিলাম। ওর জন্য ঢাকায় আসাটা ফলপ্রসূ হোক চেয়েছি; হয়েছেও। কিন্তু স্বপ্না কে হবে এই সুবোধের? কে হবে ওর বউ, আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনের পাতকুয়ায় ডুবে মরার জন্য?
সম্পূর্ণ নতুন ছেলেমেয়েদের ট্রেইন করে নিচ্ছি। তাদের নিয়েই কাঁটা জার্নি করব। যেমন, অভিনেতাদের বেলাতেও তাই করছি। বাংলাদেশের সিনেমা দেখা মানুষের সামনে একঝাঁক পায়রা উড়িয়ে দিতে চেয়েছি। দিয়েছিও। আমিও ছোটোবেলায় পায়রা পুষতাম। কাঁটার আরেকজন অভিনেতা লালবাগের ফারুক। জিম করা শরীর। ওর মুখে বসন্তের দাগ আছে। তাই ওর নাম ছ্যাদা ফারুক। বসন্তের গুটি গুটি দাগ থেকেই ছ্যাদা নামকরণ। অবশ্য ফারুক কিছু দিন ছ্যাদা শব্দটি বলা বন্ধ করল। ছ্যাদার একটা ভালো উচ্চারণ ছিদ্র। ফারুককে কেউ হয়তো তখন নাম জিজ্ঞেস করলে ফারুক ছ্যাদা বলা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বলা শুরু করল, ‘আমার নাম ছিদ্র ফারুক।’ বসন্তের দাগকে কী নামে বলে ফারুক! মজা লাগত আমাদের। আমি একদিন বলি, ‘ফারুক, ছোটোবেলায় কী চাইছিলে, বড়ো হয়ে কী করবা?’
ফারুক বলল, ‘পাড়া পুছুম।’
‘বাহ। পায়রা পুষতে চাইছিলে?’
ফারুক হা হা করে হাসতে থাকে—’হায় আল্লা, কয় কী? এক দেছের গালি আরেক দেছের বুলি! আমি কই পাড়া পুছুম। মহল্লা দেইখা রাখমু। তাই কইছি পাড়া পুছুম। আর আপনে ভাবতাছেন কি পায়রার কথা? আমি কইতর পোছার কথা কই নাইক্কা।’
কাঁটার নব্বুই সালের একটা মারদাঙ্গা চরিত্রে অভিনয় করেছে তালিম কুমার। তার সহযোগী আতিক। তারা দুষ্টুমি করে বেড়ায় ভূতের গলির মহল্লার ভিতরে। দুর্দান্ত একটি অ্যাকশানে চলে এই দুষ্টু ছেলের দল। গলির মোড়ে বড়ো সাউন্ডবক্স লাগিয়ে তারা গান গায়, ‘হাওয়া হাওয়া, ও হাওয়া, উস্কু লোটা দে…। এমন কি তারা একদিন সম্পূর্ণ পাবলিক মব তৈরি করে মহল্লায় একজোড়া মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। তখন হয়তো গলির মোড়ে কোনো বিল্ডিংয়ের বারান্দায় নোংরা কাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকে পোয়াতি পাগলি। পাগলির কিছু বলার নেই। পাগলি চুপচাপ। পাগলি হাসে। পাগলির পেটে বাচ্চা দিলো কে? কাঁটাতে দেখা যাবে পাগলিকে। পোয়াতি পাগলিকে কি আপনি আপনার বাসার কাছাকাছি দেখেননি?’ পাগলির বাচ্চা হয় ফুটপাতে, দেখেননি? আমি দেখেছি। আমরা জানি, যুবতী পাগলির পেটে বাচ্চা হয়। সেই বাচ্চার বাবাকে কেউ কোনো দিন চিনতে পারে না। কেন? কেউ স্বীকারও করে না, পাগলির পেটের বাচ্চা কার ঔরসজাত? ডিএনএন পরীক্ষা করা হবে না তার। তবে কি শহরের মোড়ে থাকা প্রতিটি যুবতী পাগলির নাম মরিয়ম? তার জরায়ুতে কি ঈশ্বরের ভ্রূণ? পাগলিদের বাচ্চার বাবা কি আমি? রাস্তার যেকোনো পাগলির বাচ্চার সঙ্গে কি আমার ডিএনএ পরীক্ষা করা যায়? রাস্তার যুবতী পাগলির পেট উঁচু দেখলেই আমার নিজেকে সন্দেহ হয়। আমিই কি দায়ী নই যুবতী পাগলি রাস্তার ধারে পোয়াতি হয়ে গেলে? ফুটপাতে বাচ্চা বিয়োলে?
তাই কাঁটায় যুবতী পাগলিকে দেখা যাবে। কাঁটায় অনেক কিছুই দেখা যাবে। শোনাও যাবে।
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।