নাফ নদীর অর্ধেক বাংলাদেশের, অর্ধেক মিয়ানমারের। কী আশ্চর্য, একই নদীর জল ভৌগলিকভাবে ভাগ হয়ে যায়! প্রকৃতি এক রকমের, মানুষের রাজনীতি-অর্থনীতি-সার্বভৌমত্ব-ধর্ম-সংস্কৃতি আরেক রকম। পাহাড়ি উপত্যকা থেকে নেমে আসা নাফ, এই সমুদ্রগামী নদীতে রক্ত ভেসে যায়। মানুষের শিশু ভেসে যায়। জীবন মরে যায়। পুরো পৃথিবী তাকিয়ে দ্যাখে। পৃথিবীর কি কিছুই করার নেই রোহিঙ্গাদের জন্য? রোহিঙ্গারা কি মানুষ নয়? রোহিঙ্গা শিশুরাও মানব শিশুই, কেবল মুসলিম তো নয়! হ্যাঁ, গোটা মিয়ানমারের সার্বিক জনগোষ্ঠীর নিরিখে মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘু বটে, সেজন্য সংখ্যালঘুদের নিজের ভিটেবাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য উচ্ছেদের শিকার হতে হবে? সহায়-সম্পদ ফেলে অন্য কোথাও কোনো অজানা উদ্বাস্তু শিবিরে জীবন পার করতে হবে? দাউদাউ করে জ্বলবে সংখ্যালঘুদের গ্রাম? অদ্ভুত একটা চরিত্র মানুষের, সে প্রায়শই, প্রকাশ্যে, খুব গোপনেও, নিজের গোত্রের বাইরের কাউকে সহ্য করতে চায় না, পারে না। এই আদিম ট্যাবু থেকে বেরোতে পারেনি যে মানুষ, সেই মানুষই আবার অতি গর্ব করে বলে বা বই লিখে, সভা সমিতি করে জানান দেয়, তারা অনেক এগিয়েছে! হয়তো এগিয়েছে, এগুচ্ছে, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ যেমন গোডাউনে আগুন লাগে আর সেই দিনই দেখা যায় কিছু মানুষ আলুপোড়া খাচ্ছে। তারা আলুপোড়া খেতেই এসেছে। বড়ো একটা কারণ কী এই যে, সব মানুষ একই সময়ে একই রকম পাটাতনের নয়, একই অর্থনৈতিক মানদণ্ডে দাঁড়ানো নয় সব মানুষ; একই সময়ে, একই রকম, অর্থাৎ সব মানুষের জন্য সুবিধা সমান সমান নয়? ব্যাপকতর শ্রেণিতে তা বিভাজিত? তাই একটি সমাজের সব মানুষ একই মূল্যবোধের গাছের ছায়ায় বেড়ে ওঠে না, উঠতে পারে না। যেভাবে, গুজরাটের কোনো মুসলিম পরিবারে যখন উৎকণ্ঠার উত্তেজনা বাড়ে, সেটি হয়তো সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠরা অনুধাবন করতে পারে না। অনুধাবন করবে কীভাবে? এক গোত্র আরেক গোত্রের উপর চেপে বসেতে চায়। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠরা যেভাবে চায়, সেভাবেই হয়। বাহুবলই শ্রেষ্ঠ বিচার—এই আদিমতা থেকে বেরুতে পারিনি আমরা; আমরা মানুষ। তাই মানুষ দ্বারাই মানুষ হত্যা হয়, নারী ধর্ষণ হয়, দুর্বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবল। এই বাস্তবতা আমাদের আদিমতা থেকে বেরিয়ে আসার অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পশ্চিমের শাদারা কালোর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালে বোঝা যায়, ওদিকে এশিয়ান-আফ্রিকানরা সংখ্যালঘু। এই সংখ্যালঘু বিভাজন শুধু বিভাজনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, কারণ, সংখ্যালঘু সংখ্যাগরিষ্ঠের দখল ও লালসার শিকার হয়, হবেই। কেন না, এই আদিম ট্যাবু থেকে মানুষ এখনো নিজের মুক্তি ঘটাতে পারেনি! সংখ্যালঘুরা কেমন আছে, কেমন থাকে, এই প্রশ্নের উত্তর দেয় সংখ্যাগরিষ্ঠরাই। কী হাস্যকর, কী নির্মম! শ্রেষ্ঠত্বের শ্লাঘায় অবস্থা এমন এক স্তরে পৌঁছয় বা পৌঁছে আছে, যারা শিকার, তারা তাদের কথা বলবে না, বলতে পারবে না, বললেও কোথাও পৌঁছবে না নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা বা থাকা সেই অনিরাপত্তাবোধ; যা পিতা থেকে পুত্রতে সঞ্চারিত হয়, দেশে দেশে।
মানুষ দ্বারাই মানুষ হত্যা হয়, নারী ধর্ষণ হয়, দুর্বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবল। এই বাস্তবতা আমাদের আদিমতা থেকে বেরিয়ে আসার অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পশ্চিমের শাদারা কালোর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালে বোঝা যায়, ওদিকে এশিয়ান-আফ্রিকানরা সংখ্যালঘু।
‘দেশ’ই তো একটা বিরাট ট্যাবু। পাখিদের কোনো দেশ আছে? প্রজাপতিদের কোনো পাসপোর্ট আছে? শীতপাখিদের কোনো ভিসা থাকে? মানুষই নিজেদের বলতে থাকে শ্রেষ্ঠ, তাহলে আপন প্রজাতি এত বিভাজিত কেন? হানাহানিই কি তাহলে বড়ো কিছু? এ-ই মানতে হবে? আমিই সেরা, আমিই শ্রেষ্ঠ, আমরা সেরা আমরাই শ্রেষ্ঠ— এই বোধই তো মানুষকে নির্বোধ বানিয়ে ফেলে! তাই সংঘর্ষ হয়, মানুষ মরে, দাঙ্গা হয়, গোত্রে গোত্রে। সেই দাঙ্গা কে বা কারা শুরু করে আর কারা কারা তার শিকার হয়, সে হিসেব সবিস্তারে আর কোনোদিনও উঠে আসে না। আমরা অনলাইনে ছবি দেখেছি, গোবিন্দগঞ্জে খড়বিচালি দিয়ে ছাওয়া সারিসারি বাঁশখুঁটির ঘর, সাঁওতালদের ঘর, এক পোশাকি বাহিনী সারিবদ্ধভাবে সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে সাঁওতালদের গ্রাম। আচ্ছা, এই সাঁওতাল কারা? কোত্থেকে এসেছে? কবে থেকে আছে এই জনপদে? ওদের অপরাধ কি এই যে, ওরা এই জনপদের প্রাচীন জনগোষ্ঠী? যারা পুড়িয়ে দিল ঘর, তারা কারা? কে কাকে উৎখাত করে? রেড ইন্ডিয়ান বলে ট্যাগ লাগানো আদিবাসীদের উৎখাত করা হলো। যারা বেঁচে রইল কিছু, তারা নিজভূমে পরবাসী হলো। ‘নিজভূম’ হয়তো তর্কসাপেক্ষ, ‘জন্মভূমি-মাতৃভূমি?’ আবার, জন্মভূমি-মাতৃভূমিও হয়তো ট্যাবু ধারণা থেকে মুক্ত নয়!
এক ভাষণে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, ‘পিজারোর মন যত না বাইবেলের দিকে, তার চেয়ে বেশি সোনার খনির দিকে।’ তাই আমরা দেখলাম, সমুদ্রপারের জাহাজ ভর্তি সৈন্যরা যে এলো, এসে সব দখল করে নিল! দখলও কি অনুমোদনযোগ্য? যদিও, দুর্ভাগ্যজনক সত্য, পৃথিবী দখল হয়ে গেছে। কিছু মানুষের কাছে বাকি অগণন মানুষ বন্দি হয়ে গেছে। এভাবেই বয়ে চলা একটি সমাজে আমরা থাকি। সবাই আমরা নৈতিকতার কথাই বলব বা বলছি কিন্তু একই সঙ্গে সবাই জানে, নৈতিকতা ছুরিকাঘাতে মরে পড়ে আছে তিন রাস্তার মোড়ে। কাজেই দখলবাজকে দখলবাজও বলা যাবে না। দখলবাজই উদ্ধারকর্তা, সেই রকম মানতে হবে। কর্তৃত্বের নানারকম চাল থাকে। সাধারণ মানুষ আমরা, আমরা সেই চালের শিকার। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির দ্বন্দ্বে তো আর কম মানুষ মারা পড়ল না উপমহাদেশে! যারা মারা পড়ল, তাদের প্রত্যেকের পরিবার ক্ষতির শিকার হয়ে গেছে আজীবনের জন্য। তারাই সাধারণ মানুষ। সমাজে সাধারণ মানুষই বেশি। ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি কান্না দিয়েই তাদের জীবন এগিয়ে চলে। সমাজের বড়ো কোনো ঘটনার নেপথ্যে সাধারণভাবেই তারা জড়িত থাকে না কিন্তু বড়ো ঘটনা ঘটলে তার খারাপ কিছুর শিকার সেই সাধারণ মানুষকেই হতে হয়। রাজনীতির এই নিষ্ঠুর খেলার বলি হলো ইতিহাসে কত জন? অন্তত ভারতবর্ষে বা বাংলাদেশেই? আর ইতিহাসের বাইরেই বা বলি হলো কত জন? রেষারেষির তো কোনো ইতিহাস লেখা হয় না, হিংসাহিংসীও তো গণমাধ্যমে খবর হয় না; ঘটনা বড়ো পর্যায় পর্যন্ত না পৌঁছুলে নিউজ ভ্যালু আসে না। কাজেই লিখিত ইতিহাস যা ধারণ করে, মানুষের মুখে মুখে ফেরা অলিখিত ইতিহাস ধারণ করে আরও বেশি কিছু। হয়তো অলিখিত ইতিহাস সংরক্ষিত হয় না। কিন্তু সামাজিক ইতিহাসের অলিখিত উপাদানগুলো কোথাও কখনো আড্ডায় কিংবা গল্পচ্ছলে সামনে চলে আসে। মানে কেউ কেউ সেগুলো সামনে নিয়ে আসে।
আর সেলুনের সামনে রাখা বেঞ্চে বসা মহল্লার কয়েকজন বয়স্ক লোক পুরোনো দিনের গল্প শোনাচ্ছিল। হুম। শহীদুল জহিরের সঙ্গে বা তাঁর রচনার চরিত্রদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তো আমার ছিলই, ‘কাঁটা’র সঙ্গে বোঝাপড়াটা আরেকটা লেভেলে পৌঁছুল। ‘কাঁটা’র চরিত্রদের সঙ্গে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট নিয়ে বোঝাপড়া শুরু হলো। মনে হলো, ছবি বানাব ‘কাঁটা’ নিয়ে।
একদিন সে রকম কিছু আড্ডাবাজের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। তারা চৌরাস্তার মোড়ের সেলুন ঘরের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। সেলুন ঘরের বিহারি নাপিত তার মতো করে চুল দাঁড়ি কামানোর কাজ করে যাচ্ছিল। আর সেলুনের সামনে রাখা বেঞ্চে বসা মহল্লার কয়েকজন বয়স্ক লোক পুরোনো দিনের গল্প শোনাচ্ছিল। হুম। শহীদুল জহিরের সঙ্গে বা তাঁর রচনার চরিত্রদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তো আমার ছিলই, ‘কাঁটা’র সঙ্গে বোঝাপড়াটা আরেকটা লেভেলে পৌঁছুল। ‘কাঁটা’র চরিত্রদের সঙ্গে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট নিয়ে বোঝাপড়া শুরু হলো। মনে হলো, ছবি বানাব ‘কাঁটা’ নিয়ে। তাহলে চিত্রনাট্য করা যায়। কিন্তু এই গল্পের চিত্রনাট্য করা তো মোটেও সহজ কিছু নয়, যারা কাঁটার পাঠক, বিশ্বাস করি স্বীকার করে নেবেন। যদিও আমার নিজের প্রতি দারুণ এক আত্মবিশ্বাসই আমাকে চালিত করে। এই চলাটাই আমার চলা। এবং আমারও কিছু আছে বলার। কথক শহীদুল জহির গল্পটিতে যা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন, আমি সেই বলার মধ্যে আমার নিজের বলা বা বলতে চাওয়ার গোত্রগত মিল খুঁজে পেয়েছি। যে দায় নিয়ে এই গল্পটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে পৃথিবীতে, বাংলা ভাষায়, শহীদুল জহিরের হাতে, সেই দায় আমাকে টেনেছে। আবিষ্ট করেছে। ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। চিত্রনাট্য করতে গিয়ে আমি ‘কাঁটা’র মধ্যে ডুব দিয়েছি। গল্পের পাঠক বর্ণমালায় রচিত অক্ষরের শব্দ-বাক্য পড়তে পড়তে এগিয়ে যায়, কিন্তু ছবির দর্শক চোখ দিয়ে দ্যাখে, কান দিয়ে শোনে। শহীদুল জহির পড়ে আনন্দ পেতে উঁচু স্তরের পাঠক হতে হয়, তা হয়তো ঠিক, কিন্তু ছবির দর্শক একজন নিরক্ষর মানুষও হতে পারে। শুধু তার চোখ ও কান থাকলেই চলে। কাঁটা চিত্রনাট্য করার সময় এ সব কথা আমি বারবার ভেবেছি। কাঁটা-ছেড়া করেছি। কাঁটা-কুটি করেছি। কাঁটা মাথায় ঢুকেছে আমার। কাঁটার নাম, মনোজগতের কাঁটা। অসহায়ত্ব, আত্মগ্লানি ও বিভ্রান্তির চক্র কাঁটা।
খুবই জটিল ধরনের গল্প কাঁটা। কিন্তু ম্যাজিক আছে। মজা আছে। এটি একটি পিরিওডিক্যাল পটভূমি। এই পটভূমির মধ্যে বাংলাদেশ তো আছেই, আছে কিছুটা ভারত, কিছুটা পাকিস্তান। কিন্তু আলটিমেটলি কাঁটা ভূতের গলির গল্প। শহরের পুরানো এলাকার একটি মহল্লার নাম ভূতের গলি। ভূতের গলির সারি সারি বাড়িগুলি শত বছর আগের বা তারও আগের সময়ের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন গলিগুলো ধরে মানুষ হাঁটাচলা করছে। চিত্রনাট্য লেখার প্রস্তুতি হিসেবে গল্পে উপস্থিত তিনটি সময়কে গবেষণার মধ্যে নিয়েছি। ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দ্বিতীয় এক নিঃসন্তান ও রংবাজ জেনারেলের শাসনামলের শেষ দিকে…’ জনাব জহিরের এরকম ন্যারেশন থেকে ধরা যায়, ১৯৮৯ ও ৯০ সাল, যখন ভারতের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অর্থাৎ ১৯৮৯ সাল। আবার বাবরি মসজিদে ‘রাম মন্দির’-এর শিলান্যাসকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা, সেটি ১৯৯০ সালের অক্টোবরের ঘটনা। ভারতে রাজীব গান্ধি—আধভানির ভোটের লড়াই চলছে। এদিকে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচণ্ড চাপে থাকা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মাওলানা আবদুল মান্নানের দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় অতিরঞ্জিত ও উদ্যেশ্য প্রণোদিত সাম্প্রদায়িক উস্কানির খবর ছাপানোয়, তখন বাংলাদেশে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি হলে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই উপমহাদেশে দুটি বড়ো সম্প্রদায় মুসলমান ও হিন্দু। বাংলাদেশে যারা সংখ্যালঘু, ভারতে তারা সংখ্যাগুরু। যেমন, বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু, ভারতে সংখ্যালঘু। তো কাঁটার চিত্রনাট্যে ঢুকে পড়ল ১৯৮৯-৯০ সালের তদানীন্তন ঘটনাসমূহের সচিত্র ধারাবিবরণী। অবশ্য এই সময়টাতেই আমি কলেজে উঠেছি। নিজের চোখেই দেখেছি বাংলাদেশ, পরিপার্শ্ব।
পুরান ঢাকার ভূতের গলিতে ১৯৮৯ সালের বাস্তবতায় কাঁটা গল্পটি শুরু হবে। গল্প তো ক্রমশ সামনের দিকে আগায়, কিন্তু কাঁটা গল্পটি আদতে আগাবে না, পেছাবে।
পুরান ঢাকার ভূতের গলিতে ১৯৮৯ সালের বাস্তবতায় কাঁটা গল্পটি শুরু হবে। গল্প তো ক্রমশ সামনের দিকে আগায়, কিন্তু কাঁটা গল্পটি আদতে আগাবে না, পেছাবে। ১৯৮৯-৯০ সালে শুরু হয়ে গল্পটি ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাবে ১৯৭১ সালে। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েকমাস আমরা কাঁটা গল্পের সঙ্গে থাকব ভূতের গলিতে। আমরা রাজাকার, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানি আর্মির হম্বিতম্বি ও ভয়াবহতার মুখে পড়ে যাব। এবং ১৯৭১ সাল থেকেও আমরা আবার দ্বিতীয় ফ্ল্যাশব্যাকে যাব ১৯৬৪ সালে। সে সময়ের একটি ঘটনার দুর্বিপাকে পড়ে আমরা ভূতের গলিতে একদিন-একরাত থাকব এবং পুনরায় ফিরে আসব ১৯৯০ সালে। অর্থাৎ কাঁটা ১৯৮৯-৯০ সালেরই গল্প, ভেতরে দুটি ফ্ল্যাশব্যাক, এক, ৭১ সাল, দুই, ৬৪ সাল। লিখিত গল্প কাঁটা পাঠকদের সামনে আছে সম্ভবত ১৯৯৫ সাল থেকে; আর পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে দর্শকের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এ বছরেই, ২০২৩ সালে। অতীত, বর্তমানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতে প্রবিষ্ট হয়, কাঁটাতে ভবিষ্যৎ, বর্তমানের ভেতর দিয়ে অতীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়; বা হবে। খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা মিশন। চিত্রনাট্য করতে বসে শহীদুল জহিরের এই সময় নিয়ে খেলাটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছি। মনে রেখেছি, ১৯৭১ ও ১৯৬৪ সাল আমি দেখিনি, সেই না দেখা সময়ের চিত্রনাট্য করছি। ইতিহাস গবেষণা করেছি, বিভিন্ন বই ও নানাসময়ের গণমাধ্যম থেকে তথ্য নিয়েছি। বাংলাদেশে পিরিওডিক্যাল ছবি প্রায় হয় না বললেই চলে, সেখানে ‘কাঁটা’—একই ছবির মধ্যে তিন সময়ের উপস্থিতি ঘটানো একটি গল্প পছন্দ করে নিয়েছি, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাতেই নিয়েছি।
এমন কি মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি অনুদানপ্রাপ্তির পরেই কাঁটা চিত্রনাট্য একটু একটু করে পরিমার্জন-সংযোজন শুরু হলো এমনভাবে, ৫০ পৃষ্ঠার চিত্রনাট্য ধীরে ধীরে ১৬১ পৃষ্ঠায় গিয়ে ঠেকল। ডিটেইল করতে করতে বড়ো হয়ে গেল। ডিটেইলিংয়ের নেশায় পেয়ে বসল। শহীদুল জহিরেই থাকলাম, শহীদুল জহিরে থেকেই কোথাও খানিকটা বেরিয়ে যেতে চাইলাম। এটা একটা খেলা। এই খেলা শহীদুল জহিরের সঙ্গে এবং কাঁটার চরিত্রদের সঙ্গে আমার। চরিত্রও তো কম নয়, পাঁচশোর অধিক। যদিও কাঁটাতে সময় ও ঘটনাই প্রধান প্রতিপাদ্য ইস্যু। কাঁটার চিত্রনাট্যে আমি নিজেকে ক্রমাগত সংযোজিত করেছি। যেন-বা প্রয়াত কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরকে পড়াতে চেয়েছি আমার চিত্রনাট্য। কিন্তু চিত্রনাট্যই তো আর শেষ কথা নয়, বাজেট করতে হবে, টাকা জোগাড় করতে হবে, প্রি-প্রডাকশন শুরু করতে হবে, সেট ও লোকেশন কনফার্ম করতে হবে, প্রপস এবং কস্টিউম সংগ্রহ করতে হবে, তারপরেই তো প্রডাকশনে যাওয়া সম্ভব, তাই না? অবশ্য চিত্রনাট্য নিজেও একটা আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। আমারও আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। কিন্তু তখনো আমার হাতে এককালীন বড়ো কোনো অর্থ আসেনি। মন্ত্রণালয়ের এক কিস্তির টাকা তো অতি সামান্যই। মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী তিন ধাপে শুটিং করতে হবে, অর্থও পাওয়া যাবে তিন ধাপে।
কিন্তু কাঁটা তিন ধাপে শুটিং করা যাবে না, কারণ, প্রায় আশিটা পুরনো শতবর্ষী বাড়ি কাঁটার লোকেশন, শুটিং এক ধাপেই সব করতে হবে। এক ধাপের শুটিং শেষ করে মন্ত্রণালয়ের পরের ধাপের টাকা পেয়ে শুটিংয়ে গিয়ে দেখব, কিছু বাড়ি নেই, ডেভেলপারদের কাছে চলে গেছে, বাড়ি ভেঙে ফেলবে, তখন কন্টিনিউটি রাখতে পারব না, ছবি শেষই হবে না।
কিন্তু কাঁটা তিন ধাপে শুটিং করা যাবে না, কারণ, প্রায় আশিটা পুরনো শতবর্ষী বাড়ি কাঁটার লোকেশন, শুটিং এক ধাপেই সব করতে হবে। এক ধাপের শুটিং শেষ করে মন্ত্রণালয়ের পরের ধাপের টাকা পেয়ে শুটিংয়ে গিয়ে দেখব, কিছু বাড়ি নেই, ডেভেলপারদের কাছে চলে গেছে, বাড়ি ভেঙে ফেলবে, তখন কন্টিনিউটি রাখতে পারব না, ছবি শেষই হবে না। তাই শুটিং একটানাই করতে হবে। এবং প্রায় এক কোটি টাকা লাগবে। একই লোকেশনে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ধরেছি। নয় মাস ছিলাম আমরা লোকেশনে। কাকতালীয় তথ্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধও হয়েছিল নয় মাস ধরে।
চিত্রনাট্যকে আরও শহীদুল জহির কিংবা ভূতের গলি মহল্লাবাসিদের কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছি। তাই অনেক বছর ঢাকায় থাকলেও পুরান ঢাকায় কখনো আবাসিক থাকিনি, কাঁটার জন্য চলে গেলাম সূত্রাপুর থানার পাশেই, বিহারী লাল জিউ মন্দির থেকে আর কয়েকটি বাড়ি পর বসন্ত কুমার দাস রোডে, সাড়ে ছয় মাস ভাড়াটিয়া হয়ে গেলাম। অপুদের বাড়ি। ওটা ফরাসগঞ্জ। ওখানকার বাড়িগুলোর কোনো কোনোটার বয়স দুইশ বা তিনশ বছর। সেখানেই প্রায় পরিত্যাক্ত এক বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিলাম। আমাকে রান্না করে দেওয়ার জন্য সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হলো সনৎ কুমার শিকদার, ওরফে গজেন্দ্রগমন। ঠিক বুড়িগঙ্গার পাড়েই ছিল ফরাসগঞ্জের সেই বাসা। যেখানে থেকে খাঁটি পুরান ঢাকাকে ধরতে চেয়েছি, ধরে চিত্রনাট্যে গেঁথে দিয়েছি। অর্থাৎ আমি প্রথমবারের মতো পুরান ঢাকার বাসিন্দা হয়ে গেলাম। কাঁটা চিত্রনাট্য কালারফুল হয়ে উঠল। ধ্রুব এষকে পড়তে দিলাম। তিনি বললেন, দুই কোটি টাকার নিচে এ প্রোডাকশন নামবে না। শিবুকে পড়তে দিলাম। শিবুর নাম শিবু কুমার শীল। নারিন্দার বাসিন্দা। শিবু জানাল, ‘খুবই আপনার মতো হইছে স্ক্রিপ্ট, ভালো হইছে।’
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।