পর্ব-প্রারম্ভিকে প্রশ্ন তোলা যায়, ‘জার্নি অব কাঁটা’ কতদূর যাবে? ধারণা করি, সপ্তাহান্তে প্রকাশিত এই জার্নি উনিশ-কুড়ি মাইল যাবে, যদি এক পর্ব সমান এক মাইল ধরি আমরা। অবশ্য এখন আর মাইল-কালচার নেই, কিলোমিটার এসে গেছে। এই জার্নি নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে বেরিয়ে শংকর হয়ে এখন অবধি ফরাসগঞ্জে এসে ঠেকেছে। ফরাসগঞ্জ থেকে আমরা গেছি মগবাজারে, ওখানে কাঁটা ক্যাম্প হবে। কাঁটা ক্যাম্প থেকে আমরা যাব নারিন্দায়, শরৎগুপ্ত রোডে, হলুদ মসজিদের পাশে। একপাশে বসু বাজার, অনতিদূরে শক্তি ঔষধালয়, দয়াগঞ্জ; কিন্তু আমাদের গন্তব্য ভজহরি সাহা স্ট্রিট বা সেই ভূতের গলি। ভূতের গলি তো গলিই বটে তবে ভূতের গলি একটি মহল্লা, শহরের পুরনো একটি আবাসিক এলাকার নামই ভূতের গলি। তাই ভূতের গলিতে একটি গলি নয়, আছে একাধিক গলি, উপগলি। পুরান ঢাকা বলতেই তো আমরা জানি বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি! কিন্তু আমাদের গন্তব্য ভূতের গলির আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি। চৌরাস্তার মোড়ের বিহারি নাপিতের কর্মক্ষেত্র—’ইয়োর চয়েস সেলুন’। বা, আমরা গিয়ে গলির মাথায় ছোট্ট হোটেলে বসে গরম গরম ডালপুরি-চা খাব আর ভাবতে থাকব, কোথায় প্রবেশ করেছি আমরা? ভূতের গলি! আর কে না জানে, পরিপার্শ্বের সকল রাস্তাই ভূতের গলির সঙ্গে কানেক্টেড! খুব সঙ্গত কারণেই এই জার্নি এক কথায় ভূতের গলির জার্নি। ঘোস্ট লেন জার্নি। কী কী আসবে এই জার্নিতে? কী কী আসবে না? আসবে অনেক কিছুই, আসবে সময়। ‘সময় সবুজ ডাইনি’—কবি রণজিৎ দাশ লিখেছেন এবং একদিন কীভাবে যেন সেই ডাইনির সঙ্গে দেখা হলো। ডাইনি আমার জীবনকেও খপ করে ধরে ফেলল। ছোটো থেকে ক্রমশ বড়ো হতে হতে বড়ো হতে চেয়ে আমি সময়ের সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে পড়লাম গোলাকার অন্ধকারের ভেতর। সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, কোথায় যাচ্ছি? শুধু জানি, যাচ্ছি। এই যাওয়া আমন্ত্রিত অতিথির মতো যাওয়া। এই আমন্ত্রণ ঠিক আমন্ত্রণও নয়, ডাক। আমাকে ডেকেছে কেউ, যাব না? যেভাবে পাহাড় ডাকে বলেই না আমরা বান্দরবানে যাই, সমুদ্র ডাকে বলেই না আমরা ইনানি বিচে যাই। যাই, খোলা ম্যানহোলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহর-প্রান্তর ছাড়িয়ে। যেতে যেতে দেখা হয় আপনার সঙ্গে, আলাপ হয়, ভালো লাগে। যেতে যেতে দেখা হয় তোমার সঙ্গেও, ভালো লাগে। এই যে আমি যাচ্ছি, আমার এ রকম জার্নির ছাপছোপ আবছায়াভাবে উঁকি দিতে থাকবে কাঁটা জার্নিতে। আমার পরিপার্শ্ব, আমার চেনাপরিচিত জগতের বাসিন্দা ও বান্ধুবান্ধব অনেকেই ক্রমশ ঢুকে পড়বে এ লেখায়, এই জার্নিতে। নানান ঘটনা ও ঘটনা-তরঙ্গের কম্পনটুকু ছড়ানোর চেষ্টা তো থাকবেই লেখার মধ্যে। ‘জার্নি অব কাঁটা’য় পরবর্তীতে এমন কিছু ঘটনাপ্রবাহও চলে আসবে, যা হয়তো কেউ বা আমি এ পর্যায়ে কল্পনাও করিনি। সেসব কণ্টকাকীর্ণ ও একইসঙ্গে মজাদার ঘটনাপ্রবাহকে সেকালে আমাদের বাড়িতে যে জাঁতাটা ছিল, সেই জাঁতায় পিষে, খেজুরের গুড়ের পায়েস বানিয়ে পরিবেশন করা হবে জার্নি অব কাঁটায়। …আর কী কী আসবে না এই লেখায়? শুধুমাত্র কাঁটা ছবিতে দৃশ্যমান গল্পের পরম্পরাটা আসবে না এই জার্নিতে। ছবির গল্পটা শুধু ছবির দর্শকের জন্য। ওই গল্পটা বলব বলেই তো এত শ্রম, এত স্বপ্ন, গলদঘর্ম হয়ে মোহময় সুড়ঙ্গে গমনাগমন! এত মাথা কুটে মরা! এবার প্রশ্ন—দর্শক কবে দেখতে পাবে কাঁটা, তাই তো? এই প্রশ্নেরও যথাযথ উত্তর জানা যাবে কোনো এক পর্বের লেখাতেই। কারণ, সব অপেক্ষারই অবসান হয় একদিন, যেদিন পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়। ‘শ্রী’র পাঠক পড়বেন জার্নির লিখিত রূপ, লেখার ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়ে দেওয়া হবে প্রোডাকশন স্টিলস। আরেকটি প্রশ্নেরও মুখোমুখি আছি, দেশের প্রধান প্রধান কাগজ বা সাময়িকীতে তো আমি প্রায় নিয়মিতই লিখছি, তাও প্রায় আড়াই দশকের অধিক সময় ধরেই লিখে আসছি, তাহলে ‘শ্রী’র মতো এমন তুলনামূলক নবীন পোর্টালে লিখছি কেন? যা প্রিন্টও নয়! এমন কি রয়্যালিটি ছাড়া যখন আর কোথাও দুই লাইনও লিখি না, তখন এরকম একটা পরিশ্রমী ধারাবাহিক কেন ‘শ্রী’তে উপস্থাপন করছি?
আরেকটি প্রশ্নেরও মুখোমুখি আছি, দেশের প্রধান প্রধান কাগজ বা সাময়িকীতে তো আমি প্রায় নিয়মিতই লিখছি, তাও প্রায় আড়াই দশকের অধিক সময় ধরেই লিখে আসছি, তাহলে ‘শ্রী’র মতো এমন তুলনামূলক নবীন পোর্টালে লিখছি কেন? যা প্রিন্টও নয়! এমন কি রয়্যালিটি ছাড়া যখন আর কোথাও দুই লাইনও লিখি না, তখন এরকম একটা পরিশ্রমী ধারাবাহিক কেন ‘শ্রী’তে উপস্থাপন করছি?
লিখছি ভালোবাসার জন্য। ভালোবাসার জন্য জীবনটাই তো তুড়ি দিয়ে উড়ায়ে দিলাম। ভালোবাসা অনুভব করি যেখানে, সে রাস্তা দিয়ে যেমন অকারণ হাঁটাহাঁটি করি, হাঁটতে চাই, ভালো লাগে; সেরকমই। বিধানের সঙ্গেও তাই। বিধান সাহা কবি। বিধান এই ‘শ্রী’র কারিগর। সমসময়ে যা দেখি, তার মধ্যে ‘শ্রী’র আয়োজনগুলো খুব সুন্দর। একদা বড়ো সাময়িকী সম্পাদনার সঙ্গে আমিও চাকরিসূত্রে জড়িত ছিলাম। তাই ভালো ট্রিটমেন্ট একটা লেখাকে পাঠকের সামনে কীভাবে হাজির করতে পারে, আমি জানি। দেখি, সেই গুণ বিধান রপ্ত করে উঠছে। ভালো লেখাসমূহ নিয়ে নিয়মিত সংখ্যার বাইরে উৎসব আয়োজন করে ‘শ্রী’। প্রেজেন্টেশন কালারফুল। ভালো লাগে। টের পাই, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে ‘শ্রী’। ক্রমশ পাঠক বাড়ছে। ‘শ্রী’-ও একটা জার্নি করছে। কাঁটাও একটা জার্নিতে আছে। পাঠক, দর্শক বা যেকোনো মানুষ, প্রত্যেকেরই একটা জার্নি আছে। জার্নির গল্প আছে। সেই গল্পে স্বপ্ন আছে, আনন্দ আছে, ব্যথা আছে, এবং স্বপ্নভঙ্গও আছে। সেই অর্থে পাঠক-দর্শক ও আমি খুব দূরের কেউ নই। আমরা প্রতিবেশী। আমি প্রতিবেশীদের কথা বলছি মানে আমি আমদেরই কথা বলছি। আমি আমাদের জার্নির কথাই বলছি। লেখার ভেতর দিয়ে পাঠক ও দর্শক নিজেও এই জার্নিতে জার্নিম্যান, সেটি পরিষ্কার হবে ধীরে ধীরে, পর্বে পর্বে। পরবে পরবে। পর্ব তো অধ্যায়, পরব হচ্ছে পার্বণ—উৎসব। গত ঈদের উৎসব সংখ্যা দিয়েই ‘শ্রী’তে কাঁটা জার্নি গদ্যাকারে শুরু, প্রতি শুক্রবার ধারাবিকভাবে জার্নি অব কাঁটার নতুন আরেকটি পর্ব উন্মোচিত হবে। বিচ্ছিন্ন যেকোনো পর্ব যেমন যে কেউ পাঠ করতে করতে এই জার্নিতে অবলীলায় ঢুকে পড়তে পারবেন, যদিও জার্নির ধারাবাহিকতার স্বাদ আরেকটু বেশিই পাবেন যদি প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব করে করে পড়ে যান। ‘শ্রী’র সিনেমা বিভাগে তো কাঁটা জার্নি লেখাটা সিরিয়ালি থাকছেই, থাকছে ‘শ্রী’র হোম পেইজেও। পড়তে পড়তে ভালো লাগলে লেখার লিংক শেয়ার দিয়ে নিজের প্রিয় বন্ধুদের পড়তে দেবেন, আদান-প্রদানের এইটুকু পারস্পরিক সম্পর্ক অনুভব করছি আমি আপনার সঙ্গে, তোমার সঙ্গেও। অনলাইন যুগে একটি স্বপ্নের লিংক দিচ্ছি আমি আপনাকে, লিংক দিচ্ছি তোমাকে। ‘প্রিয়জনকে বই উপহার দিন’—তা তো দেবেনই, সে স্লোগান শাশ্বত। হাল-জামানার সাউন্ড হয়তো-বা—প্রিয়জনকে লিংক উপহার দিন। লিংক বলতে বোঝাচ্ছি শ্রী-তে প্রকাশিত ‘জার্নি অব কাঁটা’ লেখাটার ওয়েব লিংক। কারণ, জার্নি দলগতই আনন্দ দেয় অধিক। অনেকে মিলে একটি লেখা পড়ে নিজেদের মধ্যে শেয়ার করার যে মজা—তা তো একা একা হবে না। একা একা তো ডিসকোর্স করা যায় না, ডিসকাস করা যায় না। তাই—
ভালোবাসা আপনাকে, তোমাকেও। এবার পর্বে ঢুকে পড়া যাক, ঠিক আছে?
কাঁটা বড়ো আয়োজনের ছবি। কাঁটা এমন একটি গল্প, যার মধ্যে ওত পেতে আছে আলাদা তিনটি গল্প। এ ছবিতে পাঁচশোর অধিক পাত্রপাত্রী অনস্ক্রিন যুক্ত আছে। শতভাগ পিরিওডিক্যাল লোকেশন। ১৯৮৯-৯০ সালের বাস্তবতা দেখা যাবে ছবিতে। দেখা যাবে ১৯৭১ সালের বাস্তবতা এবং দেখা যাবে ১৯৬৪ সালের বাস্তবতা। শহীদুল জহিরের মনোজগত থেকে যখন চিত্রনাট্য শুরু করি, তখন কাঁটা গল্পের একটি করে লাইন পড়তাম আর অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে থাকতাম, কী করা যায়? হাতে লিখেছি কাঁটা’র স্ক্রিপ্ট, যা প্রথম কম্পোজ হয় কাঁটাবনে, পুনশ্চ-র রিয়াজের অফিসে। এরপর কাকরাইল-মালিবাগ। আর চিত্রনাট্য সংশোধন চলে গাওসুল আজম-নীলক্ষেতে কিছু দিন। এরপর যাই পুরানা পল্টনে, বাবু ও সবুজের ধুপছায়াতে। অতঃপর একটি প্রিন্টার মেশিন কিনে ফেলি। পরবর্তীতে মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প ও নারিন্দায় কাঁটার সেন্ট্রাল শুটিং লোকেশনেও স্ক্রিপ্ট কারেকশন ও প্রিন্ট চলতেই থাকে নিয়মিত। এবং প্রাগুক্ত তথ্য, ছোটো ছোটো সংযোজন-পরিমার্জন করেই নতুন করে প্রিন্ট করতাম কাঁটা’র চিত্রনাট্য। সেই ছোটো ছোটো কারেকশন সাপেক্ষে ২১ তম ভার্সনে আমরা কাঁটার শুটিংয়ে যাই।
![](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2023/05/মনে-নেই-.jpeg)
মনে নেই, বিস্মরণ, ব্ল্যাকআউট। টোকন ঠাকুরের হ্যান্ড ফন্ট
‘তিতাস নদীটা হচ্ছে নায়ক, মালোপাড়া গ্রামই আমার ন্যায়িকা’—এ কথা অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস থেকে বানানো ছবির নির্মাতা বলেন, যিনি ঘটক পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান! শুধু বলেনইনি তিনি, প্রতিষ্ঠা করেছেন, দর্শক মেনেছেন। তবু সেখানে স্টার কাস্ট আছে। কবরী, রোজী, প্রবীর মিত্র—কে নয় তখন তারকা? যদিও ঋত্বিক ছাড় পেতে পারেন সে ছিল ১৯৭৩ সাল বলে, গত শতাব্দী বলে। এখন তো ক্যারেক্টারাইজেশন সেই ধারণা বদলেছে দেশে দেশে। স্টার ডাস্ট হয়ে গেছে পৃথিবীর ভালো ভালো কত না ছবিতে! আমিও ভেবেছি, কাঁটার নায়ক কে? নায়িকা কে? কাঁটা পটভূমিতে সুবোধচন্দ্র দাস কি নায়ক? স্বপ্নারানী দাস কি নায়িকা? অথবা বাড়িওয়ালা আবদুল আজিজ ব্যাপারী কি নায়ক হতে পারে না, কাঁটার? বা ড্যামকেয়ার যুবতী কাজের মেয়ে কুলসুম, সেই কি নায়িকা হতে পারে না? আচ্ছা, তা যদি না হয়, ভূতের গলির মহল্লার মানুষই কি কাঁটার নায়ক, যাদের আমরা দেখতে পাব নানান সময়ে, বিভিন্ন ঘটনার ভেতর দিয়ে! নাকি সময়ই নায়ক, কাঁটার? ঘটনাগুলো নায়িকা? স্ক্রিনে সময় থাকবে, ঘটনা থাকবে, মহল্লার মানুষ থাকবে। তাই ছবিতে নায়ক-নায়িকা অনুসন্ধান আমার কাজ না। নায়ক-নায়িকা কনসেপ্টই তো একুশ শতক আসার আগেই সেকেলে বলে বাতিল হয়ে গেছে। আমি নিজে যে সমাজে বাস করি, সেখানে কোনো নায়ক বা নায়িকা দেখলাম না আর উপন্যাস বা সিনেমাতে নায়ক-নায়িকা দেখে যেতে হবে বা দেখাতে হবে—এ কোন ধরনের কৈশোরক চেতনা? বাংলা ছবি কি সাবালক হবে না? সমাজে সব ছেলেই নিজের কাছে নিজেই উত্তমকুমার বা শাহরুখ খান, সব মেয়েই নিজের কাছে নিজে সুচিত্রা সেন বা দীপিকা পাড়ুকোন। বস্তির মধ্যেও কেউ রাজ্জাক, কেউ শাবানা। কাঁটায় আমার দরকার পাত্রপাত্রী, ঠিক; যদিও বাঙালি দর্শকের একটা বিরাট অংশ সিনেমার কথা শুনলেই প্রথম প্রশ্ন করে, ‘তা কে কে আছে?’ আমি অন্তত কয়েকজনের এরকম প্রশ্ন যেই শুনেছি, ‘কাঁটাতে কে কে আছেন?’—বলেছি, ‘আপনিই আছেন?’ ভ্যাবাচেকা খায় তারা, আবার সামলে উঠে জানতে চায়, ‘না মানে কে কে অভিনয় করেছে কাঁটাতে? নায়ক-নায়িকা কারা?’ বলেছি, ‘একটি মহল্লার প্রায় সব্বাই অভিনয় করেছে কাঁটাতে। অনেক মানুষ, পাঁচশোজনেরও বেশি হতে পারে। আদতে আমার তো চরিত্র করবার ক্ষমতা সম্পন্ন অভিনেতা বা অভিনেত্রী দরকার, স্টার দরকার না। তাই চিত্রনাট্যে বর্ণিত ক্যারেক্টার খুঁজে পেতেই আনন্দ বেশি। মুখস্ত মুখ দিয়ে ক্যারেক্টার করানোতেই আমার নীতিগত বিরোধ আছে। মুখস্ত মুখ বা স্টারের আলোয় ঝলমলো করে ছবিকে দর্শকের কাছে পৌঁছতে হবে, এ আমি চাইনি কাঁটা প্রজেক্টে। বরং চিত্রনাট্যে বর্ণিত ক্যারেক্টারকে একেকটি নতুন মুখের ওপরে পেস্ট করেছি। যখন ‘ব্ল্যাকআউট’ করি, ২০০৬ সালে, কারা ছিল সেখানে? ছিল সুমন। সুমন জাবিতে নাটক ও নাট্যতত্ত্বের ছাত্র ছিল। আমরা একই নাটকের দল ‘নাট্যকেন্দ্র’রও সদস্য ছিলাম। ওর বাসা আগারগাঁও তালতলায়, আমার বাসা ছিল তখন কাজীপাড়া ও পরে এলিফ্যান্ট রোডে। আমার বাসার আড্ডায় সুমন আসত। ব্যক্তিগত বোঝাপড়া ছিলই। মিষ্টি একটা লুক ছিল ওর। সুমন হচ্ছে তানভীর হাসান। পরে বিজ্ঞাপনচিত্র বানাত। আরও কিছু দিন পরে ও আত্মহত্যা করেছে। সেই আত্মহত্যার পরে এক বিষণ্ণ বিকেলে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে যাই। দেখি, মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মর্গবন্ধু, যাদের সঙ্গেও তানভীর কাজ করেছে বা ও তাদের বন্ধু ছিল। আমাদের বন্ধু নুরুল আলম আতিক, আকরাম খান, রেজা আরিফ, সামির আহমেদ, ইকবাল কবির জুয়েল, জুনায়েদ হালিম—আর কে কে ছিল মর্গের সামনে সেই অবসন্ন সন্ধ্যার আলোয় দাঁড়িয়ে, এখন আর মনে আসছে না। মনে না আসা বা মনে না পড়া বা বিস্মরণকে আমি আগেই বলেছি, ব্ল্যাকআউট। ব্ল্যাকআউট হচ্ছে, মনে নেই। ‘ব্ল্যাকআউট’ এর প্রধান দুই চরিত্রের একজন তানভীর, আরেকজন রাহুল। রাহুল আনন্দ।
সেই আত্মহত্যার পরে এক বিষণ্ণ বিকেলে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে যাই। দেখি, মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মর্গবন্ধু, যাদের সঙ্গেও তানভীর কাজ করেছে বা ও তাদের বন্ধু ছিল। আমাদের বন্ধু নুরুল আলম আতিক, আকরাম খান, রেজা আরিফ, সামির আহমেদ, ইকবাল কবির জুয়েল, জুনায়েদ হালিম—আর কে কে ছিল মর্গের সামনে সেই অবসন্ন সন্ধ্যার আলোয় দাঁড়িয়ে, এখন আর মনে আসছে না।
চারুকলার ছাত্র। আমার ঘরের লোক। রাহুল প্রাচ্যনাট-এ যুক্ত। অবশ্য ‘জলের গান’ তখনো হয়নি। আর কারা ব্ল্যাকআউট-এ অভিনয়ে ছিল? একদমই নতুন মেয়ে তিনা, গায়ক কফিল আহমেদ, শিল্পী ধ্রুব এষ, বিমল বাউল, চারুকলার মডেল দাদু, আমার ভাগ্নি বর্ষা বিভাবরী বা মিতুল, বাপ্পি আশরাফ, আবদুল হালিম চঞ্চল, কিশোর বেলায়েত হোসেন, রাজীব আশরাফ—এরকম। কিন্তু কাঁটার অভিনয়ে থাকবে যে পাঁচশোজন, সেই পাঁচশোজন কারা? এখানে তো লাগবে আবাল-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর-কিশোরী বা এককথায় ইতিহাসের তিন সময়ে উপস্থিত তিন দল মহল্লাবাসী, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের দল, মন্দিরের ভক্তকুল, বিয়ে বাড়ির জমায়েত—এমন কি একটি উত্তেজিত পাবলিক মব এবং জ্যোৎস্নারাতে বাঁশিওয়ালার পেছনে মধ্যরাতে হারিয়ে যাওয়া আরও একদল নারীপুরুষ, সেখানেও শ’খানেক মানুষ; এত এত মানুষ আমি পাব কোথায়? এই মানুষেরা তিনটি সময়ে স্ক্রিনে থাকবে কাঁটায়। সেই তিন সময় অনুযায়ী কস্টিউম, প্রপস, সেট-লোকেশন ইত্যাদি একটা ফ্যাক্টর। ষাট-সত্তরটা পুরনো বাড়ি ও প্রায় বিশটা গলি আছে ছবিতে। এক ছবিতেই তিন ছবির ধাক্কা কাঁটা। যারা কাঁটা গল্পটি পড়েছেন, তাদের যে-কারো সঙ্গে দেখা হলে বা পরিচয় হলে আমিই উল্টো প্রশ্ন করে থাকি, এখনো করি, ‘আপনি কয়বার পড়ার পরে কাঁটা গল্পটি আপনার কোনো বন্ধুকে মুখে মুখে শোনাতে পারেন বা পারবেন? পুরো গল্প নয়, গল্পের সংক্ষিপ্তায়ন শোনাতে পারেন বা পারবেন?’ আজও এমন কাউকে পাইনি, যে কিনা কমপক্ষে তিনবার না পড়ে কাঁটা অন্য কাউকে ডেলিভারি দিতে পারে মুখে মুখে! গল্পটি জনাব জহির এমন ভঙ্গিতে লিখেছেন, পড়তে গেলেই সময়ের জট লেগে যাবে। কিন্তু সেই জটেই ঢুকতে ভাল্লাগবে। মানুষ যেমন গোলকধাঁধায় স্বেচ্ছায় ঢুকে পড়ে, কাঁটা একটি গোলকধাঁধার নাম, বাংলা ছোটোগল্পে। ছবি কতখানি গোলকধাঁধার হচ্ছে, সেই মতামত দর্শক দেবে।
একবারও যে চেষ্টা করিনি, এমন নয় কিন্তু। এফডিসির ছবি করিয়েদের ভেতর থেকে পছন্দ মতো যোগাযোগ করেছি অভিনেতা রিয়াজ আহমেদের সঙ্গে। বিয়ে হওয়ার আগে রিয়াজের স্ত্রী তিনা কাজ করেছিল ‘ব্ল্যাকআউট’এ। একদিন ফোনে ফোনেই কথা হয় রিয়াজের সঙ্গে, কথা প্রসঙ্গে তিনা ও ব্ল্যাকআউট এর কথাও ওঠে। কিন্তু সব মিলিয়ে রিয়াজের সঙ্গে সমন্বয় হয়নি তখন। সেইভাবেই, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়ে উঠল না একজন পরিচিত অভিনেত্রীর সঙ্গে। একদিন প্রায় ঘণ্টাখানেক মুখোমুখি বসে কথা হয় অভিনেতা মোশাররফ করিমের সঙ্গে। মোশাররফ করিম কাঁটাতে অভিনয় করেছেন বেশ আগেই, অনিমেষ আইচ নির্মিত সেই কাঁটা ছিল টেলিভিশন প্রোডাকশন। মোশাররফ করিম বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিভাবান ও জনপ্রিয় একজন অভিনেতা। একদা নাটকের দল ‘নাট্যকেন্দ্র’র সদস্য ছিলাম আমি, মোশাররফও নাট্যকেন্র্ দলের সদস্য। অর্থাৎ একদা আমরা একই দলের লোক, যখন সেগুনবাগিচা শিল্পকলা একাডেমি নয়, বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তন ও গাইড হাউস মিলনায়তন প্রচণ্ড অ্যাক্টিভ ছিল মঞ্চনাট্যে। তো ভীষণ শিডিউল-ব্যস্ততার অভিনেতা মোশাররফ করিমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, বললেন, ‘কাঁটা তো আমি একবার করছি। সুবোধ তো? সুবোধচন্দ্র দাস?’
বললাম, ‘আমাদের কাঁটা চিত্রনাট্যে সুবোধ একজন না, কয়েকজন। শহীদুল জহিরের গল্প কাঁটা থেকেই তো চিত্রনাট্য করা, স্কেলিটন এক, হয়তো ফিগার যার যার মতো। আপনাকে একজন সুবোধ ভেবে কথা বলতে এলাম।’ যেমন, নুরুল আলম আতিকও একবার চিত্রনাট্য করে জমা দিয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। যাই হোক, আমার চিত্রনাট্যের প্রস্তাবিত সেই একজন সুবোধের অংশটুকু ছিল আমার কাছে। কাঁটায় যুক্ত হলে আমাদের বেশ কিছু দিন রিহার্সেল করতে হবে এবং সেই রিহার্সেল হবে মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প অফিসে। কিন্তু এমন ব্যস্ত একজন অভিনেতার পক্ষে কি সেই সময় বের করা সম্ভব? ঘণ্টাখানেকের আড্ডায় ৪/৫টি সিগারেট পুড়ে শেষ হয়ে এলো আমাদের এবং এটা সত্যি যে, এই ব্যস্ত অভিনেতাকে কাঁটাতে পাওয়া সম্ভব নয়, সেই বাস্তবতা নেই। তাই গল্প করা, নাট্যকেন্দ্রের মিডনাইনটিজের কিছু কথা অটোমেটিক উঠে এলো আমাদের আড্ডায়। আলোচনা প্রায় শেষ। হঠাৎ এলো মোস্তফা সরয়ার ফারুকী প্রসঙ্গ, মোশাররফই তুললেন। সরয়ারের সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন মোশাররফ, বললেন, ‘আচ্ছা, ফারুকীর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা—’
![কাঁটা ৫_ছবি ৩](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2023/05/৫ম-১-1.jpeg)
আড়াইহাজার থানার প্রভাকর্দি গ্রামে, ভোরবেলা মনিটরের সামনে টোকন ঠাকুর। ব্ল্যাকআউট-এর সেটে | ছবি : রিচার্ড রোজারিও
মোশাররফের এই ‘সম্পর্কটা’ বলার পরে একটুখানি প্রশ্নসাপেক্ষ পজ তৈরি হলো এবং এরপর প্রশ্ন-বাক্য কোন দিকে মোড় নিতে পারে? সেটি ভেবে আমি বললাম—
‘অবৈধ সম্পর্ক। হা হা হা।’
‘না মানে আপনাদের মেলামেশাটা ঠিক কোন সময়ে? নাট্যকেন্দ্রের ওই সময়টার আগে না না পরে?’
‘পরে।’
‘শাহবাগে?’
‘শাহবাগেই, তবে একটা পত্রিকা অফিসে ছিলাম আমি, মুক্তকণ্ঠে, তখন সরয়ারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় কিংবা হয়তো হয় চারুকলায়।’ তখনকার দিনে আমি ও সরয়ার টই টই করে ঘুরে বেড়াতাম শহর ঢাকা। নারীহীন জীবনে নারীদের কথা ভাবতাম। গাছপাতা খাইতাম। কত কি করতাম! সেসব অন্যরকম দিন। উদ্যান থেকে রাস্তা, রাস্তা থেকে অলিগলি তামা তামা করে ফেরা দিন।
যাই হোক, মোশাররফকে কাঁটাতে পাচ্ছি না। কাঁটার ১৯৮৯-৯০ সালের সুবোধের জন্য আলাদা করে প্রিন্ট করা চিত্রনাট্য প্রসঙ্গে অভিনেতা মোশাররফ বললেন, ‘কাজটা হয়তো সময় বাস্তবতা বা সব মিলিয়ে করা কঠিন আমার জন্য, কিন্তু আপনার স্ক্রিপ্টটা তো আমি পড়ব, পত্রিকায় তো কবিতা পড়িই। তাছাড়া অনিমেষের কাঁটা আর আপনার কাঁটা দুইটা দুই রকম হবে, এ-ও আমি জানি।’
এই যে একজন প্রতিভাবান অভিনেতাকে পেলাম না। এর জন্য তখন আমার কী মনে হয়? অবশ্যই আমাকে এটা মেনে নিতে হবে যে, বাজার অনেক বড়ো সত্য। বাজারই বড়ো বাস্তবতা। পুঁজিবাজার একজন মানুষের স্কিলনেসকে বেইজ করে তার একটা মূল্য নির্ধারণ করে দিতে থাকে, তার নিজের সময় তখন বাজারই কিনে নেয়। মোশাররফ করিমের সময় বাজার কিনে নেয় চড়া মূল্যে, আগত সময় আসবার আগেই সেই সময় বিক্রি হয়ে যায়। এতে অভিনেতার নিজেরও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ প্রায় নেইও। কেননা, তিনি তার সময় তো বিক্রিই করে দিয়েছেন অর্থের বিনিময়ে অর্থের কোনো মালিকের কাছে। আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অর্থই।
![কাঁটা ৫_ছবি ৪](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2023/05/chonchol-199x300.jpeg)
টোকন ঠাকুর ও চঞ্চল চৌধুরী, পনেরো বছর আগে | ছবি : রিচার্ড রোজারিও
বাংলাদেশের আরেকজন প্রতিভাবান ও জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। চঞ্চলও চারুকলার ছাত্র। রাহুল ও চঞ্চল মনে হয় একই ব্যাচের। আমার দুই-তিন ব্যাচ জুনিয়র ওরা। চঞ্চলের সঙ্গে সেই চারুকলার ছাত্রজীবন থেকেই বোঝাপড়া আছে। ছাত্রজীবন মনে এলেই একটা স্মৃতি উস্কে ওঠে মনে; সে ছিল ১৯৯৫ সাল। চঞ্চলদের ব্যাচের ছাত্র গ্রাফিক ডিজাইনের সিরাজুল হাসান মান্না হঠাৎ জন্ডিসে মারা গেল। মান্নার লাশ নিয়ে আমরা ৭/৮ জনের এক টিম যাচ্ছি নড়াইল, পহরডাঙায়, মধুমতী নদীর পাড়ে। মান্না কবিতা লিখত। আমরা যে দিন ২৩ বছরের মান্নার লাশ ঢাকা থেকে নিয়ে যাই, পহরডাঙায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে গভীর রাত হয়ে যায়। তখন কুসুম সেভেনে পড়ত, কুসম একদিন কথায় কথায় বলছিল আমাকে। মান্নার মেজো কাকার মেয়ে আজকের অভিনেত্রী কুসুম শিকদার। তো মান্নার লাশ আমরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে সড়কপথ শেষে নৌকায় ওঠাই। নৌকা ভেসে চলে মধুমতী নদীতে। সেই শ্রাবণের রাতে আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল না, ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। আমরা কজন বসে আছি নৌকায়। নৌকায় চারুকলার ছাত্র ও একজন তরুণ কবির লাশ। সেই মধ্যরাতের নদী-চরাচর ভেদ করে চঞ্চলের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো একটি গান। কোথাও কিছু হারিয়ে ফেলে, প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার হাহাকারের গান। আমরা আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠি সেই গানে। অনেক পরে একদিন, তখন চঞ্চল টেলিভিশনে নিজের একটা জায়গা তৈরি করে নিজেকে প্রমাণ করেছে। সেই সময় চঞ্চল একদিন এলো আমার বাসায়, বিষয় হচ্ছে, ‘প্রথম আলো’র ‘ছুটির দিনে’ ম্যাগাজিন উঠতি ১০ জন তরুণের ওপরে একটি সংখ্যা প্রকাশ করবে। সেই ১০ জনের একজন যেমন কুসুম শিকদার, একজন চঞ্চল চৌধুরী, একজন যেমন ছিল অর্ণব। এদের একেকজনের ওপরে লিখবেনও একেকজন, মানে ১০ জন। প্রথম আলো আমাকে লেখার দায়িত্ব দিলো চঞ্চলের ওপরে। লেখার প্রস্তুতির জন্যই বাসায় বসে লেখার আগে একসন্ধ্যা আড্ডা দেওয়া। যদিও, ব্যক্তি চঞ্চলকে আমি যতটা জানি, ততটা তো আর ওর অভিনয় করা নিয়ে ওর নিজের ভাবনা আমার জানা ছিল না।
একদিন চঞ্চলকে ফোন করি, বলি, কাঁটা। কাঁটার চরিত্র সুবোধকে মাথায় রেখেই চঞ্চলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পুনরায় বুঝি, যেভাবে সময় বিক্রি হয়ে যায় মোশাররফের, চঞ্চলেরও সেই একই রিয়েলিটি। জনপ্রিয়তাই বাজারশিল্প। বাজার পুঁজি নিশ্চিত করে। পুঁজি জীবনকে স্মুথ করে। আনন্দ-ঘোর ব্যস্ততা দেয়। চঞ্চলকেও পাওয়া যাবে না কাঁটাতে। তাছাড়া আমি হয়তো নিয়মিত নই, এখনো যেমন; নির্মাণের ভালোমন্দের প্রমাণও তো দিতে পারিনি।
সেই জানার জন্যই আড্ডা ছিল আমাদের। চর্চা, একাগ্রতা ও পরিশ্রম অভিনয়ে ওকে একটা অন্য মাত্রায় উন্নীত করেছে। একদিন চঞ্চলকে ফোন করি, বলি, কাঁটা। কাঁটার চরিত্র সুবোধকে মাথায় রেখেই চঞ্চলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পুনরায় বুঝি, যেভাবে সময় বিক্রি হয়ে যায় মোশাররফের, চঞ্চলেরও সেই একই রিয়েলিটি। জনপ্রিয়তাই বাজারশিল্প। বাজার পুঁজি নিশ্চিত করে। পুঁজি জীবনকে স্মুথ করে। আনন্দ-ঘোর ব্যস্ততা দেয়। চঞ্চলকেও পাওয়া যাবে না কাঁটাতে। তাছাড়া আমি হয়তো নিয়মিত নই, এখনো যেমন; নির্মাণের ভালোমন্দের প্রমাণও তো দিতে পারিনি। নিজেকে প্রমাণ করতে পারাটা আবশ্যিক, নইলে আস্থায় পৌঁছানোর রাস্তা কোথায়? চঞ্চল অভিনয়ে নিজেকে বারবার নিজের সিগনেচার রেখে চলেছে। আমি তো নির্মাণে ডেবু করতে যাচ্ছি, চাচ্ছি। তাছাড়া কাঁটাতে তো প্রায় পাঁচশোর অধিক পাত্রপাত্রী, আমি আর কয়জন তারকা অভিনেতা নিতে পারব? তাদের সময়-শিডিউল, রেমুনারেশন কীভাবে অ্যাডজাস্ট হবে? বাজেট কোথায় পৌঁছবে? এখন বলতে পারেন, ‘এত চরিত্র আছে ক্যান স্ক্রিপ্টে?’ এই প্রশ্নে আমি কোনো উত্তর দিতে পারব না। বরং আমার মনে পড়বে, পাঁচহাজার লোক থাকলে আরও ভালো হতে পারত! মনে পড়ল, শংকরে থাকাকালীন একবার কথা হচ্ছিল শব্দগ্রাহক বন্ধু নাহিদ মাসুদের সঙ্গে। নাহিদই কথায় কথায় একদিন বলল, ‘কাস্টিং কিছু কি ভাবছেন?’ বললাম, ‘ভাবছি। একটা কালো মেয়ে চাই, সুইট মুখ।’
নাহিদ বলল, ‘ কে সে?’
‘নন্দিতা দাশ।’
‘কথাবার্তা হইছে কিছু?’
নাহিদকে বললাম, ‘না। কীভাবে যোগাযোগ করব?’
নাহিদ বলল, ‘ইমেইল করেন।’
‘কই পাব ইমেইল আইডি?’
![কাঁটা ৫_ছবি ৪](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2023/05/সৈন্যরা-.jpeg)
কাঁটা সিনেমার সেটে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে টোকন ঠাকুর | ছবি : হোসেইন আতাহার
রাতে আমাকে ইমেইল আইডি খুঁজে বের করে সেন্ড করল বন্ধু মারজুক রাসেল। সেই ইমেইলে নন্দিতা দাশকে মেইল করি। ৩ ঘণ্টার মধ্যে নন্দিতার সহকারী খাতামির ফিরতি মেইল পাই। ১০ ঘণ্টার মধ্যে ফিরতি মেইল পাই নন্দিতা দাশের, সেই কালো ও সুইট মেয়ের। ‘ধ্রুপদী’ সম্পাদক ও বাংলাদেশে সুস্থধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ পুরুষ প্রয়াত মোহাম্মদ খসরু যাকে ছোটোবেলায় কোলেও নিয়েছেন বলে একদিন আমাকে বলেছেন রোহিতপুরে। সেই ঈদ রাতের শীতে রোহিতপুরে খসরু ভাইয়ের বাড়িতে এক চৌকিতে ঘুমাই আমরা। খসরু ভাই, আমি, জুনায়েদ হালিম ও গাজী মাহতাবউদ্দিন হাসান। অবশ্য খসরু ভাই ও খসরু ভাইয়ের ওপরে ডকু বানানো নির্মাতা হাসান এরই মধ্যে চিরতরে মাটিতে ঘুমিয়ে গেছে। খসরু ভাই কালো মেয়েদের দিকে ঝুঁকে থাকতে চাইতেন। একদা নন্দিতার বাবা আর্টিস্ট যতীন দাশ খসরু ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন। যাই হোক, নন্দিতা মেইলে জানালেন, ‘কাঁটার মেটেরিয়াল পাঠান। আমি পড়ব। কিন্তু সাদাত হাসান মান্টোকে নিয়ে আমি একটা ছবি বানাচ্ছি, তাই আপাতত ব্যস্ত থাকব আমি আমার নির্মাণাধীন মান্টো নিয়েই। কাঁটা মেটেরিয়াল পছন্দ হলে আমি কাজ করব মান্টো বানানোর পর।’ তখন অবশ্য আমিই আর এগুতে পারিনি, কারণ, কো-প্রোডিউসারের সঙ্গে বনিবনা হলো না, সে তো আগেই বলেছি। নন্দিতা দাশের সহকারী ফিরতি ইমেইল দিলেন ৩ ঘণ্টার ব্যবধানেই। নন্দিতা ফিরতি মেইল দিলেন ১০ ঘণ্টার মধ্যে। অভিজ্ঞতাসূত্রে জানি, বাংলাদেশের কোনো ব্যস্ত অভিনেতাকে ইমেইল করলে তার উত্তর দিতে হবে—সেই কার্টেসি এখনো তাদের অভ্যাসে রোপিতই হয়নি। বরং ইমেইল পাঠিয়ে ফোন করে জানাতে হয়, ‘আপনাকে একটা মেইল পাঠাইছি।’ কিংবা দেখা না করে বললে ইমেইলের ফলাফলই আসবে না। এতই লেবারি লাইফ, ইমেইল ওপেন করার সময়টাও নেই, সেই সময়টুকুও বিক্রি করে খেয়ে বাঁচতে হয়!
ফরাসগঞ্জে আমার একটা সিদ্ধান্ত স্থির হয়ে গেল যে, কাঁটা হবে স্টারলেস কাস্ট। আমি তো স্টার শো করে টাকা কামাই করব বলে ছবি বানাচ্ছি না, আমি একটি ছবি বানাচ্ছি, সাধারণ মানুষই ছবির গল্পের চরিত্র। তাই মনে হলো, সমাজের সাধারণ মানুষ থেকেই অডিশন করে পাত্রপাত্রী খুঁজে কাঁটা করব। তাছাড়া আমি যখন মাখমালবাফের ‘কান্দাহার’ বা ‘সাইক্লিস্ট’ দেখি, আমি কি ইরানি পাত্রপাত্রীদের কাউকে চিনতে পারি? যখন কিওরোস্তমির ছবি দেখি, তেহরানের মোশাররফ করিমকে কি চিনতে পারি? সিউলের কিম কি দুক দেখলে আমি বা আমরা কি কোরিয়ান চঞ্চল চৌধুরীকে চিনতে পারি? পারি না। ওসমান সেমবেনের ছবিতে সেনেগালের উৎপল দত্তকে চিনতে পারব? বা নুরি বেলজি সেলানের ছবি দেখে কি ইস্তাম্বুলের হুমায়ুন ফরিদীকে চিনে ফেলব? না, চিনব না। না চেনা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সেসব ছবি আমরা কেন দেখছি তবে? নোলানের ছবি দেখি কেন? কুরোসাওয়ার ছবির পাত্রপাত্রীদেরও আমরা চিনব না। নাক থাবা জাপানি দেখলে বাঙালিরা তো কয়েকজন মানুষকেই আলাদা করে চিনতে পারবে না! তাহলে কাঁটা যখন দেখবে নানান দেশের নানান ভাষার দর্শক, তারাও কি চিনবে বাংলাদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের? না, চিনবে না। তারা শুধু ছবিটাই দেখবে। দেখে, ছবির ভালোমন্দ বিচার করবে। তারা কাঁটার লেখক, নির্মাতা, কারিগরি কাজের ক্রু যারা, তাদের এবং সর্বোপরি অভিনেতা-অভিনেত্রী কাউকেই চিনবে না। ভালো লাগলে বলবে, বাংলাদেশের ছবিটা ভালো লেগেছে। এবং বাংলা ভাষার মানুষ বা আমার নিজের দেশের মানুষ, তারাও তো ভালো ছবি দেখতে সর্বদাই আগ্রহী; তাহলে আমার ভাবনা থাকা উচিত ছবিটা ভালো করে বানানোর দিকে আবিষ্টচিত্তে মনোযোগী থাকা। স্টার কাস্ট অন্তত এই প্রজেক্টে ভাববার অবকাশ নেই। আবার এ কথাও সত্য যে, একজন পরিচিত অভিনেতা বা অভিনেত্রীর মুখ বা মুখের হাসি কান্না বা যেকোনো অভিব্যক্তি দর্শকের কাছে খুব চেনা থাকে, মুখস্ত হয়ে যায়। প্রিয় হয়ে যায়। ধরা যাক, চঞ্চল চৌধুরী বা মোশাররফ করিমকে বানানো হলো কাঁটার সুবোধচন্দ্র দাস, দেশের দর্শক তো ঠিকই টের পাচ্ছেন যে সুবোধ এখানে মোশাররফ করিম, বা সুবোধ এখানে চঞ্চল চৌধুরী। নির্মাতার উদ্যেশ্য কি এতে সফল হলো? আর্ট কি কিছুটা অবনমনের শিকার হলো না? ব্যাবসা যেমন, ছবি তো আর্টও। সেক্ষেত্রে একটি নতুন মুখকে দর্শক চেনে না বলেই তাকে দিয়ে সুবোধচন্দ্রের চরিত্র পারফেক্টলি করাতে পারলে সেই নতুন মুখকেই সুবোধচন্দ্র ভেবে মেনে নেওয়া সহজ হতে পারে। এরকম করে ভেবেছি। কারণ, আমি তো ছবিতে এটিএম শামসুজ্জামান বা তারিক আনাম খানকে চাচ্ছি না। চাচ্ছি একজন অভিনেতার ভেতর দিয়ে আবদুল আজিজ ব্যাপারীর চরিত্রকে ধরতে, যে চরিত্র স্ক্রিপ্টে আছে, বাস্তবে নেই, নেই কিন্তু শুটিংয়ের ভেতর দিয়ে সেই চরিত্র দাঁড়াবে। সমাজের ভেতর থেকে পাঁচশো মানুষ আমাকে খুঁজে বের করতে হবে চরিত্র অনুযায়ী, এরকম নির্মাণ-ভাবনা পাকা হয়ে গেল আমার মস্তিষ্কে।
সেক্ষেত্রে একটি নতুন মুখকে দর্শক চেনে না বলেই তাকে দিয়ে সুবোধচন্দ্রের চরিত্র পারফেক্টলি করাতে পারলে সেই নতুন মুখকেই সুবোধচন্দ্র ভেবে মেনে নেওয়া সহজ হতে পারে। এরকম করে ভেবেছি। কারণ, আমি তো ছবিতে এটিএম শামসুজ্জামান বা তারিক আনাম খানকে চাচ্ছি না। চাচ্ছি একজন অভিনেতার ভেতর দিয়ে আবদুল আজিজ ব্যাপারীর চরিত্রকে ধরতে, যে চরিত্র স্ক্রিপ্টে আছে, বাস্তবে নেই
শংকরে থাকাকালীন মাহফুজ জুয়েলকে শেয়ার করেছি কাঁটার কথা। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সময় কেটেছে জুয়েলের সঙ্গে। জুয়েল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে গেছে নিজ বাড়িতে। জুয়েল যেমন কাঁটার শুভাকাঙ্ক্ষি, বন্ধু আমার। আবার বন্ধু হলেও সাপোর্ট পাওয়ার নামে ধাপ্পার শিকারও যে হইনি কারো দ্বারা, তা তো নয়। তবে প্রতারকদের নাম নেব না এই লেখায়। যারা ঠকাতে চেষ্টা করেছে, ধাপ্পা দিয়েছে সহযোগিতার নামে, তাদের কথা নিতে পারি না এই আত্ম-উদ্গীরণের কনফেসে। জীবন চলার বাঁকে নানারকম প্রাণীদের সঙ্গেই তো আমাদের দেখা হয়, হবেও, কী করা যাবে! প্রতারিত হয়েছি, খারাপ লেগেছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। ভেঙে পড়লে তো চলবে না। সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই মানুষের। বিটিভির মহাপরিচালক ছিলেন কবি আসাদ মান্নান। একদিন তিনি তাঁর সরকারি অফিসেই মিটিং ডাকলেন। সেখানে এলেন বিটিভির দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কাঁটার জন্য কোনো স্পন্সর এনে দেওয়া যায় কি না, সেই লক্ষ্যে কবি আসাদ মান্নান সেই দুজনকে বলেছেন। স্পন্সর না পেলেও আমি কবি আসাদ মান্নায়ের কাছে ঋণী থাকব আজীবন। যদিও আসাদ মান্নান অবসরে গেলেন তার কিছু দিনের মধ্যেই। বিটিভির নিউজ রুমের একজন আমার সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক প্রতারণা করেছে ঠিক তখন। ফরাসগঞ্জে থাকাকালীন মাঝেমধ্যেই বিউটি বোর্ডিংয়ে গেছি। একবার তো ভাবছিলাম, বিউটি বোর্ডিংয়ের ভেতরের দিকেই কাঁটা সেট ফেলা যায় কি না! ওখানে গেলেই লোটন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। লোটন ভাই রাজনীতিবিদ ও প্রকাশক। কাঁটার জন্য অনেক বড়ো সাপোর্ট দিয়েছেন তিনি। লোটন ভাইয়ের ঋণ মনে রাখবে কাঁটা টিম। একদিন বিউটি বোর্ডিংয়ে পেলাম অভিনেতা ও শৌখিন আলোকচিত্রী শংকর সাওজালকে। শংকর’দার সঙ্গে কাঁটা নিয়ে শেয়ার করেছি সেই পুরান ঢাকায় বসেই।
![কাঁটা ৫_ছবি ৫](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2023/05/tttttt-.jpeg)
ইয়োর চয়েস সেলুন, ভূতের গলি, নারিন্দা | ছবি : হোসেইন আতাহার
কাঁটাতে ব্যবহার করা হবে, এমন একটি গানের ব্যাপারে একদিন খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। কোথাকার গান, গীতিকার-সুরকার কে—এসব ধরতে না পেরে ফোন করি বিপ্লব বালাকে। বিপ্লব’দা বলেন, ‘এই গান ছোটোবেলায় শুনেছি, এটা কি মানিকগঞ্জ অঞ্চলের গান? —এখন মনে করতে পারছি না।’ ফোন করি কামালউদ্দিন কবিরকে। কবির ভাই বলেন, ‘এখন তো আমি ক্লাস নিচ্ছি, পরে রাতে যদি ফোন দেন, কথা বলা যেতে পারে।’ তখন দুপুর। আমার মনে হচ্ছিল, বিকেলের মধ্যেই এটা বের করতে হবে। সবসময় একটা পিনিকে আছি। ডাকসু ভবনে গেলাম। একদা সাংবাদিক ও অধুনা ‘প্রাচীন ঢাকার শিলালিপি গবেষক’ বন্ধু তরুণ সরকারকে বলি, এবং লিরিকের এক জায়গায় আছে ‘পইড়া’—শুনেই তরুণ বলল, ‘এটা ধামালি গীত। হাওড়ের গান। পইড়া বুঝলে না, পালক।’
কাঁটার একটি প্রধান চরিত্র করবে এক স্ত্রী বিড়াল, যে কিনা গর্ভবতী থাকবে। সেই বিড়াল কোথায় পাব? বিড়াল কি কথা শুনবে আমার? ডাকপিয়নের মতো খাকি পোশাকে অ্যালান পো আছে কাঁটাতে। সে আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির বিড়ালকে ধরে বস্তাবন্দি করে নদীর ওপারে ফেলে দিয়ে আসবে। কাঁটা ছবিতে আছে একঝাঁক কবুতর। একজোড়া ঘুঘু। একটি টিয়া। একটি ময়না। কোথায় পাব এসব? ফরাসগঞ্জে আমি কতদিন থাকব আর? কো-প্রোডিউসিং বাদ, কাঁটার জন্য বড়ো একটা স্পন্সর কবে কোথায় পাব—এইসব ভাবনায় নির্ঘুম রাত যায় আমার, পুরান ঢাকায়। ফরাসগঞ্জের উল্টিনগঞ্জ ঘাট আমাকে গভীর রাতে বসিয়ে রেখে ক্লান্ত বুড়িগঙ্গাকে বলে, ‘যাও বয়ে যাও…’
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
![Tokon Thaakoor](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2021/09/Tokon-Thaakoor.jpg)
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।