রবিবার, অক্টোবর ১৩

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : ১ম পর্ব

0

Motif-01শহীদুল জহিরের সঙ্গে যেদিন আমি দেখা করতে যাই, সেটি ২০০১ সাল। ঈদের রাত। ঢাকা শহর অনেকটাই ফাঁকা ফাঁকা। কী করি বা কোথায় যাই মনোভাব থেকেই নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে রিকশায় চেপে বেইলি রোডে যাই। তদানীন্তন এক আমলা ও নাট্যকার গোলাম শফিকের বাসায় গিয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়াপর্ব শেষ করেই আমি শফিক ভাইকে আমার মনের কথাটি বলি, ‘আচ্ছা শফিক ভাই, বেইলি রোডে শহীদুল জহির কোথায় থাকেন?’ সে রাতে আমার সঙ্গে ছিল বন্ধু হুমায়ুন, হুমায়ুন তখন ঢাকার বাইরের কোনো থানার পুলিশ, এখন যেমন মিন্টো রোডে, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে। অবশ্য ২০০১ সালের প্রায় দশ বছর আগেই আমি শহীদুল জহিরকে চিনতাম। চিনতাম শুধু তাঁর গল্প-উপন্যাসের পাঠক হিসেবে। একদা, খুলনা আর্ট কলেজের ছাত্র হিসেবে আমি খুলনায় ছিলাম প্রায় ৩ বছর। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত। ঝিনেদা-খুলনা যাওয়া আসা ছিল সে সময়। অবশ্য খুলনায় আমি সাহিত্যের তুরীয়-তুমুল উন্মাদনায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই, যখন ঝিনাইদহে বড়ো হয়ে উঠছিলাম, তখনকার সেই সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন, ঢাকায় দু-একবার গেছি। সেই যাওয়া কবিতার জন্যে যাওয়া, সেই যাওয়া সাহিত্যের জন্যে যাওয়া। বই কিনতে ঢাকায় যাওয়া, বইমেলায় ঢাকায় যাওয়া, কবি আবুল হাসানের জন্মদিন উৎসব দেখতে ঢাকায় যাওয়া বা একবার কবি নজরুল সরকারি কলেজে ভর্তি হতেও যাওয়া ছিল আমার। কিন্তু সে বছর বন্যাজনিত কারণে ঝিনাইদহে ফিরে গিয়ে আর ঢাকায় যেতে পারলাম না, ভর্তি হয়ে গেলাম সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজে, আমাদের লোকাল শহরে।

হাসান স্যারকে টাকা পাঠাতে পারলাম না, টাকা চলে গেল চা-পুরি-সিগারেটে। হাসান স্যারকে রাজশাহীতে চিঠি লিখলাম এসব কথা জানিয়ে। স্যার লিখলেন ফিরতি চিঠি, ‘ঠিক আছে, টাকা পাঠানোর দরকার নেই। তুমি আমাকে দুই পার্টে বের হওয়া “স্পার্টাকাস” ছবির ভিসিপি কিনে দিও।’

ঝিনাইদহে থাকতেই ঢাকার পত্রপত্রিকায় ডাকযোগে পাঠানো আমার দু-একটি কবিতা ছাপা হচ্ছিল। খুলনায় যাওয়ার পর খুলনা থেকে ঢাকায় যেমন গেছি, রাজশাহীতেও গেছি। আমাদের খুলনা আর্ট কলেজ তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করত, কারণ, খুলনায় তখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলা কথাসাহিত্যের এক বড়ো রূপকার হাসান আজিজুল হক মাঝেমধ্যেই খুলনায় আসতেন। ফুলতলায় তাঁদের বাড়ি, যদিও দেশ ভাগ না হলে তিনি পরিচিত হতেন পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় বাংলার মানুষ হিসেবে। খুলনা হাদিস পার্ক বা উমেশচন্দ্র লাইব্রেরিতে দু-এক পশলা আড্ডা হতো হাসান স্যারের সঙ্গে। তিনি যে আমাদের নামে নামেই চিনতেন তখন, এইটা আমাদের ভালো লাগত। একদিন হাসান আজিজুল হক স্যার কথায় কথায় বললেন, ‘“প্রাকৃত” নামে কথাসাহিত্যের একটা কাগজ প্রকাশ করব। খুলনায় চালানো যাবে ১০ কপি?’ হাসান স্যার রাজশাহী ফিরে যাওয়ার পর আমার তখনকার ঝিনাইদহের ঠিকানায় ১০ কপি ‘প্রাকৃত’ এলো একদিন। আমি ঝিনাইদহে ২ বা ৩ কপি, যশোরে ৩ কপি ও খুলনায় ৪ কপি ‘প্রাকৃত’ বিক্রি করে ফেললাম দুই সপ্তাহের ভেতরেই। ৩৫ টাকা করে মূল্য প্রতি কপি ‘প্রাকৃত’। কিন্তু ৩৫০ টাকা একবারে আমার হাতে আসেনি, কেউ আজ টাকা দেয় তো কেউ পরের সপ্তাহে দেবে বলেও তারপরের সপ্তাহে প্রথমে দিল হয়তো বিশ টাকা, তার ছয় দিন পরে হয়তো দিল বাকি ১৫ টাকা। ফলত, হাসান স্যারকে টাকা পাঠাতে পারলাম না, টাকা চলে গেল চা-পুরি-সিগারেটে। হাসান স্যারকে রাজশাহীতে চিঠি লিখলাম এসব কথা জানিয়ে। স্যার লিখলেন ফিরতি চিঠি, ‘ঠিক আছে, টাকা পাঠানোর দরকার নেই। তুমি আমাকে দুই পার্টে বের হওয়া “স্পার্টাকাস” ছবির ভিসিপি কিনে দিও।’

১৯৯২ সালে ‘প্রাকৃত’ হাসান আজিজুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত নিরীক্ষাধর্মী ছোটোকাগজ। সেই প্রথম সংখ্যা ‘প্রাকৃত’র মধ্যেই আমি প্রথম পেলাম শহীদুল জহিরকে, যেখানে একটি ছোটোগল্প ছিল, ‘ডুমুরখেকো মানুষ’। পড়ে, শহীদুল জহিরকে কি পুরোপুরি ধরতে পারলাম? না বোধ হয়। কিন্তু ভীষণ ঔৎসুক্য এসে গেল। সম্ভবত ১৯৯৪ সালের প্রথম দিকে আমি খুলনা আর্ট কলেজ থেকে মাইগ্রেট করে চলে আসি ঢাকায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন খুলনা আর্ট কলেজে প্রাক ব্যাচেলর অফ ফাইন আর্ট কোর্সে ভর্তি হই ১৯৯০-৯১ সেশনে। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাক বি এফ এ-র কাগজপত্র তুলে মাইগ্রেট করে চলে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন চারুকলা ইন্সটিটিউট বা অধুনা যার নাম চারুকলা অনুষদে; চারুকলার ’৯০-৯১ ব্যাচের সংগেই যুক্ত হই। সেই ১৯৯৪ থেকেই আমি ঢাকাতে পার্মানেন্ট হয়ে যাই। তারপর একদিন হাতে পাই ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’। একদিন হাতে পাই ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’র পরে হাতে পাই ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’।

তো সেই ২০০১ সালের ঈদরাতে কোনো প্রকার ফোন বা নোটিস না করেই আমি পৌঁছই বেইলি রোডের এমন এক ছয়তলা বিশিষ্ট সরকারি কোয়ার্টারের সামনে, যেখানে একজন দারোয়ান ছিলেন এবং আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এই বিল্ডিংয়ে কি শহীদুল জহির থাকেন?’ দারোয়ান আমাকে কিছুটা বিস্মিত করে জানতে চান, ‘অকৃতদার শহীদুল জহির?’ ছয়তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন শহীদুল জহির, একা। প্রায় ৩ ঘণ্টা আমি তাঁর সঙ্গে নানান গল্প করে সে রাতে বিদায় নিই। পরে আবার যাব যাব করেও কিন্তু আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এরপর জহিরের ‘মুখের দিকে দেখি’ ‘প্রথম বয়ান’ বেরুল। ২০০৮ সালে জনাব জহির আকস্মিক মারা গেলেন।


টোকন ঠাকুর

টোকন ঠাকুরের চলচ্চিত্র (আনরিলিজড) ‘ব্ল্যাকআউট’-এর পোস্টার। ডিজাইন করেছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা।


২০০৬ সালে আমি ‘ব্ল্যাকআউট’ বানালাম, আমার প্রথম ছবি। ‘ব্ল্যাকআউট’ হচ্ছে এ টেল অব টু পালস অব এ মিস্টিফাইং নাইট—অমীমাংসিত রাতে দুই বন্ধুর গল্প। এরপর টেলিভিশনকেন্দ্রিক কিছু ড্রামা-ফিকশন বানাই কিন্তু টেলিভিশন মাধ্যম আমার পছন্দের নয়। কাজেই টিভিতে আমার ভালো লাগেনি। বন্ধ করে দিই টিভির জন্যে কাজ বানানো। কিন্তু ছয়টা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানানোর জন্য প্রস্তুতি নিই, যা মূলত ছয় ঋতুকে ঘিরেই আবর্তিত ছিল। গ্রীষ্মের ছবি ‘তরমুজ’, আষাঢ়ের ছবি ‘শালিক দিবস’, শরতের ‘দ্য গ্রেট অস্কার’ হেমন্তের ‘শুধু শুধু’ শীতের ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’ ও বসন্তের ‘স্পিরিং উইদাউট স্ক্রিপ্ট’। এক বছর ধরে সংশ্লিষ্ট ঋতুতে শুটিং করেছি। এক দিন করে শুটিং। কিন্তু সম্পাদনা পর্বে এসে আর সমাপ্ত করতে পারিনি। মনে মনে এখনো মায়া লাগে সেই ফুটেজের জন্য। কিন্তু মায়াই তো সব নয় জীবনে। মায়ার কোনো কায়া নেই। কায়া না থাকলে তো আমরাও থাকি না।


টোকন ঠাকুর-২

ব্ল্যাকআউট-এর দৃশ্যে রাহুল আনন্দ ও প্রয়াত তানভীর হাসান


blackout 4

ব্ল্যাকআউট-এর দৃশ্যে প্রয়াত তানভীর হাসান ও তিনা


blackout 3

ব্ল্যাকআউট-এর দৃশ্যে রাহুল আনন্দ


এবং শহীদুল জহির মারা যাওয়ারও কয়েক বছর পর ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’গ্রন্থ থেকে ‘কাঁটা’ গল্পটি ভিজ্যুয়ালাইজ করার চিন্তা মাথায় ঘন হতে থাকে। চিত্রনাট্য করতে উৎসাহী হই। ‘কাঁটা’কে ছবি হিসেবে দেখতে চাই এবং মানুষকে দেখাতে চাই। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। রবীন্দ্রনাথের শিশুকিশোর গল্প থেকে চিত্রনাট্য করার প্রজ্ঞাপন দেখার পর আমার মাথায় আসে অমলের কথা, ‘ডাকঘর’-এর কথা। কিন্তু ‘ডাকঘর’ তো যে কেউই জমা দেবে, এই ভেবে আমি পুনরায় ‘কৈশোরক’-এ চোখ রাখি। রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সময় ‘কৈশোরক’ প্রকাশিত হয়—অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বেশ কিছু পরে ‘সন্দেশ’ সম্পাদক লীলা মজুমদার কবির শিশু-কিশোর উপযোগী লেখার একটা সামগ্রিক সংকলন প্রকাশ করেন, সেই সংকলনের নামই ‘কৈশোরক’। এর মধ্যে ‘সুকুমার’ গল্পটিকে আমার পছন্দ হলো। ‘সুকুমার’ আদতে রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের দিকে আত্মজৈবনিক লেখা ‘সে’ গ্রন্থের একটি অংশ। সেই ‘সে’ বা ‘সুকুমার’ থেকেই আমি চিত্রনাট্য করি, নাম, ‘রাজপুত্তুর’। কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথের পালিতা কন্যা পুপেদি ও পুপেদির জন্যে কল্পিত নায়ক কিশোর সুকুমারকেই ‘রাজপুত্তুর’ নামে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘রাজপুত্তুর’ ৪৯ মিনিটের একটি শিশুকিশোর ফিকশন। ‘রাজপুত্তুর’ ছাড়াও আরও ১৩ জন শিশু সেই কাজে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু প্রযোজনা সংশ্লিষ্টদের বিশেষ কিছু অসহযোগিতার কারণে কাজটি আমার ইচ্ছে অনুযায়ী শেষ হয়নি। মনের খুঁতখুঁতানি যায়নি। ‘রাজপুত্তুর’ শেষ করি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে।


rajputtur

rajputtur 3

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে টোকন ঠাকুরের সিনেমা রাজপুত্তুর-এর পোস্টার। ডিজাইন করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ।


কিন্তু এর আগেই ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে শহীদুল জহিরের ‘কাঁটা’ গল্পটিকে চিত্রনাট্য করি প্রতিযোগিতার জন্যে। এবং চিত্রনাট্য উত্তীর্ণ হয়। ‘রাজপুত্তুর’ জমা দিয়ে আমি ২০১৬ সালে মনোযোগ দিই ‘কাঁটা’ যাত্রায়। মন্ত্রণালয়ে উত্তীর্ণ হওয়া চিত্রনাট্য ‘কাঁটা’কে আরও ডেভেলপ করতে উৎসাহ পাই। পিরিওডিক্যাল স্টোরি ‘কাঁটা’তে তিনটি সময় উপস্থিত, যার দুইটা সময় আমি নিজের চোখে দেখিনি। অতএব ইতিহাসের সঠিক গবেষণা ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব নয়। কেননা, ১৯৭১ সাল ও ১৯৬৪ সাল আমি নিজের চোখে দেখিনি, কিন্তু সেই সময়কে উপস্থিত রেখে ‘কাঁটা’ নির্মাণ করতে হবে। এর সঙ্গে উপস্থিত থাকবে ১৯৮৯-৯০ সাল।

স্বপ্না যদি ঘরের কাজ সামলায় তো সুবোধ চাকরি করে বাইরে। যেহেতু মূল গল্পে কোনো উৎস নেই, তাহলে কী ধরনের চাকরি পেতে পারে সুবোধ? কত টাকা বেতন হতে পারে তার? ঋষিপাড়ার ছেলে সুবোধরা লেখাপড়াই বা করেছে কতটুকু? পর্যাপ্ত গবেষণার পাশাপাশি কাঁটার চারজন সুবোধকে আমি চাকরি দিয়েছি চিত্রনাট্যে।

’৮৯-৯০ সাল অবশ্য আমি নিজে দেখেছি। কলেজে পড়তাম তখন। গল্পের বাস্তবতায় শহীদুল জহির যা লিখেছেন, চিত্রনাট্যের বাস্তবতায় তা আরও ডিটেইল জরুরি। গল্পের পাঠক গল্পকারকে যতটা ধরবেন, সিনেমার দর্শক নির্মাতাকে ধরবেন অনেক বেশি। যেমন, গল্পে সুবোধ নামে একটি চরিত্র আছে, যে তার বউ স্বপ্নাকে নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। সেই হিন্দু দম্পতি ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছিল ৩৬ নম্বর ভূতের গলির আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে। বাড়ির উঠোনে একটি পাতকুয়া আছে এবং একদিন স্বামী-স্ত্রী মরেও যায় সেই কুয়ার মধ্যে। মূলগল্পে কিন্তু কোথাও নেই যে ঢাকায় তাদের পেশা কী ছিল? সুবোধ কী কাজ করত? তার বউ স্বপ্নাই বা কী করত? পেশা না থাকায় তারা কোন ধরনের বাসা ভাড়া নিতে পেরেছিল, তাদের অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস কী—কোনো ধারণাও নেই ‘কাঁটা’ গল্পে। পেশা নির্ণয় না থাকায় তাদের ঘরের আসবাবপত্র কেমন হবে, সেটিও পরিষ্কার নয়। তাদের পোশাক-আশাক কী—এক কথায় সুবোধ-স্বপ্নার জীবনমানের ধারণা নেই গল্পে। এই গল্পের মোচড় এমনই যে, পাঠকের মনে তাদের অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস নিয়ে হয়তো কোনো প্রশ্ন আসবে না; কিন্তু ছবিতে তো অর্থনৈতিক জীবনমান সাপেক্ষে তা নির্ণয় করতেই হবে। তাদের পোশাক-আশাক কোন মানের, কত টাকা মূল্যের, বাড়ি ভাড়া কোন মানের, ঘরের আসবাবপত্র কোন মানের, সেই অনুযায়ী সুবোধ বা স্বপ্নার অর্থনীতির উৎস দেখাতেই হবে। আর ‘কাঁটা’ গল্পে সুবোধ বা স্বপ্না তো তিন-চার জোড়া। একাধিক সুবোধ, একাধিক স্বপ্না। সবার বেলাতেই অর্থনৈতিক উৎস দেখাতে হবে। অর্থাৎ সুবোধদের কোনো না কোনো চাকরি করা দেখানো জরুরি। স্বপ্না যদি ঘরের কাজ সামলায় তো সুবোধ চাকরি করে বাইরে। যেহেতু মূল গল্পে কোনো উৎস নেই, তাহলে কী ধরনের চাকরি পেতে পারে সুবোধ? কত টাকা বেতন হতে পারে তার? ঋষিপাড়ার ছেলে সুবোধরা লেখাপড়াই বা করেছে কতটুকু? পর্যাপ্ত গবেষণার পাশাপাশি কাঁটার চারজন সুবোধকে আমি চাকরি দিয়েছি চিত্রনাট্যে।


rajputtur 2

টোকন ঠাকুরের সঙ্গে রাজপুত্তুর চরিত্রে অভিনয় করা শিশুশিল্পী বিস্ময় সরকার মুগ্ধ।


পুরান ঢাকার ভূতের গলিতে শহীদুল জহিরের জন্ম, এবং কাঁটা গল্পের লোকেশনও পুরান ঢাকার ভূতের গলি। তাই চিত্রনাট্যে প্রথমে সুবোধদের আমি চাকরি দিলাম বাংলাবাজারে, ছাপাখানায়। চিত্রনাট্য বিস্তৃত হয়ে চলল। একদিন মনে হলো, না, ছাপাখানায় হবে না, ওদের চাকরি দেবো সিনেমা হলে। গল্পে চারজন সুবোধ আসবে ইতিহাসের আলাদা আলাদা চারটা সময়ে। চাকরি ওই একই। সিনেমা হলে। একজন ৩৫ মি. মি. সিনেমা প্রোজেক্ট করে, অর্থাৎ সে প্রোজেক্টর মেশিন চালায়। সেই অনুযায়ী সে বেতন পায় এবং তার সুন্দরী বউ স্বপ্নাকে নিয়ে বসবাস করে পুরান ঢাকায়। আরেকজন সুবোধ হল কাউন্টারে সিনেমার টিকিট বিক্রি করে। আরেকজন হলের গেটম্যান। আরেক সুবোধ সিনেমা হলের টিকিট চেকার। তাদের বউ স্বপ্নারা ঘরে পুজো করে, রান্না ঘরে রান্না করে, উঠোনের কুয়া থেকে বালতিতে করে কলসি ভরে জল ওঠায়, উঠোনের কোণে পাতাবাহারের ছত্রছায়ায় একটি তুলসী গাছ লাগায়। ‘কাঁটা’ চিত্রনাট্যের বিস্তৃতি চলল একবছর। চিত্রনাট্য একটার পর একটা ভার্সন বেরুতে লাগল। অনেক ভার্সন করেছি চিত্রনাট্যের, ২১তম ভার্সনে শুটিংয়ে গেছি। এই ছবির লোকেশন কি পুরান ঢাকাতেই হবে? এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি চলল। মুন্সিগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর গেলাম ছোট্ট টিম নিয়ে। নড়াইল যাওয়ার কথাও উঠল। কেউ কেউ জানাল, চাহিদা অনুযায়ী কুষ্টিয়া বা নাটোরের পুঠিয়াতে গেলে লোকেশন পাব। রাজশাহীতেও গেলাম। চট্টগ্রামে গেছি এবং ফাইনালি পুরান ঢাকার গল্প আমাকে পুরান ঢাকাতেই ফিরে তাকাতে বলল। ভাবলাম, আমার ছোটোবেলা কেটেছে ঝিনাইদহে, যশোরে, খুলনায়। আর শহীদুল জহিরের ছোটোবেলা ছিল পুরান ঢাকায়। আমি ঢাকায় থাকি বটে এবং পুরান ঢাকাতেও যাওয়া আসা করি, কিন্তু পুরান ঢাকায় তো বসবাস করিনি কখনো। তাহলে পুরান ঢাকার মহল্লাবাসীদের আমি ক্যারেক্টারাইজেশন করব কীভাবে? আমিই তো থাকি বা থেকেছি নতুন ঢাকায়। ভালো হয় না, যদি আমি পুরান ঢাকাতেই চলে যাই বসবাসের জন্যে এবং যেহেতু ‘কাঁটা’র লোকেশনে আছে পুরান ঢাকার প্রায় আশিটা পুরানো বাড়ি, যে বাড়িগুলোর বয়স দুইশ-তিনশ বছর। সবচেয়ে কম বয়েসি যে বাড়ি, তার বয়সও একশ বছরের বেশি। এবং পুরান ঢাকার গলি আছে গল্পে প্রায় ৩০ টার মতো। গলির দুই ধারের বাড়ি বা বিল্ডিংয়ের বয়সও ওরকম পুরোনো।

 

‘কাঁটা’ নির্মাণপর্বের যাত্রা হলো শুরু…

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।