অলংকরণ : রাজীব দত্ত দৃশ্যশিল্প ও অন্যান্য দরিশনদারি : তিন আলোকচিত্রীর শিল্পান্বেষণ 0 ✍ জাহেদ আহমদ প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ আলোকচিত্র অনেক অনেক কাল আগে, ২০১৪-র দিকটায়, ‘ঢাকাগ্রাম’ নামে একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ধারাবাহিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। গোটা-দুই উন্মুক্ত প্রদর্শনী হয়েছিল বোধহয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় এর একটা ফলোআপ রেখেছিলাম তখন। নানা কারণেই জিনিশটা আগ্রহের পারদ বাড়িয়ে দিয়েছিল, অনেকটা আন্দোলিত করলেও ম্যুভমেন্ট বলতে যা বোঝায় তা হতে-হতেও পরে আর কন্টিনিউ করে নাই উদ্যোগটা। আজকে এতকাল পরে সেই ইনিশিয়েটিভটার স্মৃতি ইয়াদ হচ্ছে একাধারে তিন-তিনজন আলোকচিত্রীর কাজ দেখতে দেখতে। এই নিবন্ধে ঢাকাগ্রাম নামে সেই চকিত উদ্যোগটার কিছু কথাবার্তা প্রাসঙ্গিকভাবেই আসতে পারে, একটা যোগসাজশ তো রয়েছেই যা ক্রমশ ক্লিয়ার হবে আশা করি। কিন্তু সবকিছুর আগে শিল্পীত্রয় যাদের কাজ দেখতে দেখতে এত কথার বহর খুলতে চলেছি তাদের নাম উইথ ডিউ রেস্পেক্ট নিয়া রাখি। শিল্পীত্রয়ী নিত্যানন্দ শীল, প্লাবন আমিন ও রুমু আলী। প্রথমোক্ত দুইজনের দশটা করে কাজ দেখা হলো, শেষোক্তজনের সতেরোটা। কাজগুলো কোনো শো-শা ব্যতিরেকে সেলফোনফটোগ্র্যাফি। দৃশ্য ও অন্তর্নিহিত দর্শন ধরবার উপায় হিশেবে এরই মধ্যে ফটোগ্র্যাফিক জগতে ব্যাপক অ্যাডভ্যান্সমেন্ট ঘটেছে। সেলফোনফটোগ্র্যাফি শিল্পচর্চায় ক্যামেরা ব্যবহারের সনাতন কায়দা-কসরত অনেকটাই রিডিউস করে এনেছে, এর ফলে ধামাকা ছাড়া ধান্য ফলনের ধারা আরও জোরদার হয়েছে। এই কথাটার প্রমাণ মিলবে দেশের ভিতরে ফটোগ্র্যাফিচর্চায় মানুষের অংশগ্রহণ দেখে। ফেসবুকে, ইন্সটায় এবং অন্যান্য অপরবাস্তবিক মাধ্যমগুলোয় একটু চোখ রাখলেই জিনিশটা অ্যান্টেনায় ক্যাপ্চার করা যাবে। এতে একবিন্দু সন্দেহ নাই যে মানুষের দিনদুনিয়া বা যেইটাকে আমরা সভ্যতা বলি তা আজকে এর আগেকার যে-কোনো সময়ের তুলনায় দৃশ্যশাসিত। চোখ খুললেই দৃশ্য, কথাটা লালন বা তারও বহু আগের সন্ত কবীর সকলেই ঠিকঠাক বলে গেছেন। কিন্তু সম্ভবত সন্ত-দরবেশ কেউ কল্পনাও করতে পারেন নাই যে এমন একটা টাইম আসবে যখন মানুষ চোখ খুলতেই পারবে না, কারণ চব্বিশঘণ্টা তার চোখ খোলা, মাছের মতো, রক্তাভ কাপালিক অথবা নিরক্ত ফ্যাকাশে কেবল তাকায়া আছে মানুষ, আঁখি মুঞ্জিয়া রূপ নেহারিবার তার টাইম নাই। আঁখি মুঞ্জিবার মুরদটাই নাই। ঠিক এমন একটা কালে দৃশ্যধারণপূর্বক শিল্পানুসন্ধান, ধৃত দৃশ্যের অন্তরালবর্তী শিল্প উদ্ঘাটন, সহজ নয়। আলোচ্য তরুণ শিল্পীত্রয় তা-ই করতে ব্রতী হয়েছেন, কঠিনেরে ভালোবেসেছেন, সর্বাধিক জনসাধারণচর্চিত শিল্পপ্রকাশের মাধ্যম নিয়া তারা কাজনিষ্ঠ হয়েছেন। মনে পড়বে আমাদের যে এই কিছুকাল আগেও ফ্লিকারে ফটোগ্র্যাফি বিহার করবার একটা আমল অনেকেরই হয়েছিল, পরে ফ্লিকার এত জঞ্জালভারী হয়ে ওঠে যে এর সাবস্ক্রাইবাররা হাল ছেড়ে দেয় বীতশ্রদ্ধ হয়া। পাশাপাশি ফেসবুকে তখন ফটোগ্র্যাফি/ইমেইজ আপ্লোডের সুবন্দোবস্ত হওয়ায় দৃষ্টিপীড়ক একটা টাইম কাটাবার অভিজ্ঞতা আমাদের অলরেডি হয়ে গেছে। এখন এমনকি স্থির-ইমেইজই আর কেউ আপ্লোড করে না সেভাবে, সেলফোনে মুহুর্মুহু ধৃত ভিডিয়ো আর লাইভ সচল দৃশ্যস্তূপের একটা ভাগাড় হয়ে গেছে গোটা দুনিয়া। আজকাল আমরা বরং দুইয়েকটা আলোকচিত্রের স্থির স্ফূর্ততা তালাশ করে বেড়াই, পেলে প্রীত হই। ফ্লিকার ছাড়াও দুনিয়ায় আরও ফটোগ্র্যাফির শোকেইসিং সাইট আছে, বলা বাহুল্য। তবে আমাদের দেশে এইটা পপুলার হয়েছিল বলেই ইন্সট্যান্স হিশেবে নিলাম। ইন্সটায় এখন শৌখিন/ননপ্রোফেশন্যাল ফটোগ্র্যাফিশিল্পীদের হাজিরা পাওয়া যায়। কিন্তু উকুন বাছতে যেয়ে চুল সাফা হবার কারবার হয় ইন্সটায় ব্যক্তিকতার বাইরে একটা আর্টপ্রবণ ছবি বিছড়াইতে বিছড়াইতে। যে-কথাটা বলবার তা এ-ই যে, দেশে এখনও ন্যূনতম কিউরেইট-করা আর্টসাইট গরহাজির। প্রাতিষ্ঠানিক দুইয়েকটা আছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানে তো প্রাতিষ্ঠানিকতা হয়, প্রতিষ্ঠানে আর্ট পাওয়া যায় কালেভদ্রে ঝড় এসে বক মেরে রেখে গেলে পরে। যে-কথাটা ‘ঢাকাগ্রাম’ প্রসঙ্গে একটু আগে বলতেসিলাম যে এইটা আর্ট-রিলেটেড একটা আন্দোলন হতে যেয়েও হতে পারে নাই নিছক উদ্যমের অভাবে। “ঢাকার অলিগলি-রাজপথ-চিলেকোঠার নিত্যনৈমিত্তিক দিনের ফটোগ্রাফিক জর্নালের নাম ঢাকাগ্রাম। স্মার্টফোন ও ইন্সটাগ্রাম অ্যাপ্স ব্যবহার করে তোলা সব আলোকচিত্র নিয়ে” একদল ফোটোগ্র্যাফিশিল্পী নীল আকাশের নিচে তথা গ্লাসডোর-গ্যালারির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন পথচলতি মানুষের নিত্যমহোৎসবে, এইটা আর্টকালচারাকীর্ণা আড়ম্বরের এই দেশে এবং এই মৃত্যুপুরী নিস্তরঙ্গতায় ক্যালেন্ডারে দাগায়া রাখার মতো ঘটনা ছিল বটে। সেই সময়টায় এরা, ঢাকাগ্রামগোষ্ঠী, রাজধানীর ধানমণ্ডি সরণিতে একটা এবং জাহাঙ্গীরনগর য়্যুনিভার্সিটিক্যাম্পাসের ঘেসো ময়দানে একটা— মোটমাট দুইটা ওপেনঅ্যায়ার এক্সিবিশন অর্গ্যানাইজ করেছেন, অনলাইন ডেইলি নিউজপোর্ট্যালগুলোতে বেশ ভালো প্রচারও পেয়েছিল ঘটনাটি, বেশকিছু ছবি দেখার মওকা মিলেছিল সেই প্রচারসুবাদে, লেগেছিল বেশ-খানিকটা আলোকচিত্রবিচ্ছুরিত উত্তাপ ও দুন্দুভিবাদ্য সরেজমিনে-শামিল-না-হওয়া আমাদের মতো দূরবর্তীরও দেহে। যেটুকু মনে করেছিলাম যে ঢাকাগ্রাম প্রদর্শনীসিরিজ সহসা ব্যাহত হবে না, আরও প্রদর্শনী হবে এইভাবে আগলখোলা রাস্তাপার্শ্বে, মেঘরৌদ্রোচ্ছ্বলা মাঠে আর ময়দানে — সেইটা আর হয়ে ওঠে নাই। কিন্তু যদি হতো, তবে এমন ঘটনা আমাদের এই নিস্তরঙ্গ পুকুরহন্তা সাহিত্যশিল্পের দেশে একবাক্যে স্বাগত জ্ঞাপনের যোগ্য হতো। প্রথার প্রাকার-প্রাচীরসীমার বাইরের আয়োজনগুলো সর্বত্র ও সর্বদা সাফল্যমণ্ডিত হউক, এইটা আমরা সকলেই নিশ্চয় চাই, নিপাত যাউক সমস্ত হুদাকামের গতানুগতিজীর্ণ প্রদর্শনীর বায়ার-হাইকমিশনার-অ্যাম্বাস্যাডার পটানোর কায়কারবার, পঁয়তাল্লিশ হস্ত লম্বা সমস্ত ল্যান্সের পুতুপুতু ফটোগ্র্যাফিয়ার উহুউহু কলামার্কা ধাপ্পা দেখিতে দেখিতে যৈবন চলিয়া যায়, হায়! একটা কথা এইখানে বলে রাখা দরকার যে, ঢাকাগ্রাম ফটোগ্র্যাফিভিশ্যুয়াল আর্ট-ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই তাদের প্রবর্তিত ইন্টার্ভেনশনটাকে ঠিক ম্যুভমেন্ট ডিক্লেয়ার করেন নাই কোথাও, ম্যুভমেন্ট হিশেবে মেনিফেস্ট করাটাকে এত গুরুত্ববহ মনে করেন নাই নিশ্চয় এর সঙ্গে সম্পৃক্তজনেরা, যা-হোক। ব্যক্তিগতভাবে এইটা আমার ম্যুভমেন্ট ভাবতেই ভালো লাগবে। বাংলাদেশের ম্যুভমেন্টগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে, এতে এমন অবাক হবার কী আছে! ব্যর্থ হয়েছে বা ব্যাহত হয়েছে, তাতে কী! কিছু হলেও তো উস্কানি দিতে পেরেছে সেই উদ্যোগটা। আন্দোলনের তথা আন্দোলনপ্রতিম যে-কোনো উদ্যোগের শত ব্যর্থতার পরে এই এক সাফল্য ঝোলায় থেকে যায়, এইরূপ শতপ্রকারেণ উস্কানি। অ্যানিওয়ে। এর দরকার আছে। এত স্ট্যাগ্ন্যান্ট হয়া আছে তেরোশ-নদীবহুল উপকথাখ্যানের এই দেশ, একটু ম্যুভ করা আশাকরোজ্জ্বলভাবেই ঈপ্সিত মনে হয়, গোটা সময়টাকে যেভাবেই-হোক যে-কোনো উপায়ে একটা আন্দোলিতকরণ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া নিয়া-যাওয়াটা দরকার। সবসময় এই প্রক্রিয়া হাজির রাখা আর্টের, শিল্পসাহিত্যের, পোয়েট্রিসিনেমাপেইন্টিঙের প্রধানতমা কাজ। বড় দীর্ঘকাল ধরে এইটা গরহাজির এই ভেতো-শ্বেতসার আর ইক্ষু-শর্করার দেশে। গত দুইদশক ধরে এই একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেছে যে, ফটোগ্র্যাফিকে কেন্দ্র করে আর্ট-অ্যাক্টিভিটির তৎপরতা আমাদের দেশে বেড়েছে প্রচুর। ফটোগ্র্যাফি নিয়া কাজকর্ম শুরু হয়েছে জেলাশহরগুলোতে ব্যাপকভাবে, এদ্দিন যা ছিল ক্যাপিটাল-সিটিকেন্দ্রী, এবং প্রযুক্তি সুলভ হয়ে ওঠার ফলে এই শিল্পানুশীলনে তথা আলোকচিত্রচর্চায় ম্যাস-পার্টিসিপেশন অনেক বেড়েছে এইটা খালিচোখেই দৃষ্ট। মোটামুটি ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে ফটোগ্র্যাফিক সোসাইটি গড়ে উঠেছে সর্বত্র। উন্নত প্রশিক্ষণ, উন্নত অ্যাপ্রিসিয়েশন, উন্নত প্রতিষ্ঠাসুযোগ ও প্রতিষ্ঠান গড়ে-ওঠা আরম্ভ হয়েছে আলোকচিত্তির ঘিরে। এই সবকিছু অনুমেয়-উষ্ণ-অনুরাগে স্বাগত জানানোর যোগ্য। গরিমা করার মতো। ডেফিনিটলি। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার খেয়াল করা যাবে এর সঙ্গে, এত অংশগ্রহণ ও তারুণ্যঝঙ্কৃত ওই শিল্পোদ্যমের সঙ্গে যে-ব্যাপারগুলো ঠিক মেনে নেয়া যায় না। ব্যাপারটা খানিক বলার চেষ্টা করি এখানে এই তিনজন চিত্রীর কাজ একত্রে উপভোগের সুবাদে। ভ্যেরি প্রিসাইসলি বলা যাবে না আমার পক্ষে, কেননা আমি ব্যাপারটা আউটসাইডার হিশেবে একটা মার্জিনমার্কের বাইরে থেকে দেখে গেছি, এবং আমার দেখা বা আমার অবজার্ভেশন বাংলাদেশের একটি বিভাগীয় শহরগণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।এক্ষণে আমার পেটের ব্যথাটা বলি। কিন্তু অনেকদিনের ক্রনিক ব্যথা বিধায় হড়বড়িয়া ব্যক্ত করারও বিপদ রয়েছে। এদিকে যেসব ফটোগ্র্যাফার্টিস্টের কাণ্ডকারখানা দেখে দেখে এইসব ক্যারিক্যাচারাস অবজার্ভেশন গড়ে উঠেছে, এরা অনেকেই লিখনরত এই নিবন্ধকারের পরিচিত চৌহদ্দির লোক। কাজেই বিপদ এ-ও যে, এদের কেউ মনে করে বসতে পারেন আমি ফটোগ্র্যাফিলাইনে ব্যর্থ হয়া যারপরনাই ঈর্ষাদষ্ট কাউয়া হয়ে গেছি। নিশ্চয় কাউয়া আমি হয়েছি। কিন্তু যদি জিগান তো কনফেশন এ-ই যে, — ফটো-তোলা আমারও প্যাশন, লেকিন ক্যামেরায় নেভার, ক্যামেরামাস্তানি কিংবা ফটোফুটানি নৈব চ। ফটো তুলিয়া যাইতে হবে আমারে এই জীবনের উপান্ত পর্যন্ত — ইহা আমি অনেকটা মাতৃগর্ভ হইতেই জানি, ইহাই ভবিতব্য মম, কিন্তু ক্যামেরায় খিঁচানো ছবিচিত্রা আমার তরিকা নয়, ইহাও মুই বিলক্ষণ জানি। বলতে চাইছি শিল্পচর্চার শো-শা নিয়া, ক্যামেরাকার্দানি নিয়া, বলতে চাইছি একটা জেলাশহরের আলোচিত্রসমাজের লম্বা লম্বা লেন্সমাস্তানি নিয়া, প্রাইজগ্রিডি বিপুল তরুণাস্থির অপচয় নিয়া, টাকাপয়সার ধাপ্পা আর পুঁজিপাট্টার ঝনঝনানি নিয়া, আর্টকালচারের ফার্স ও ফিউটিলিটি নিয়া। প্লাবন আমিন, নিত্যানন্দ শীল আর রুমু আলীর কাজ দেখতে দেখতে এত কথাবার্তা বারায়া আসতেসে। এইবার ব্যাপারগুলারে দেখি না-হয় একটু উল্টা দিক থেকে। লেন্সমাস্তানি, ক্যামেরামাস্তানি, এমনকি কলমমাস্তানি, প্রকাশনামাস্তানি … ইত্যাদি বিচিত্রাধারা মাস্তানিটা বরাবরই থেকে যাবে; কেবল নতুন ঢেউ এসে পুরনো ঢেউগুলো সরায়ে দেবে। কেননা, শিল্পীর ক্ষিধা পায়, শীত-গরমে দেহখানা আচ্ছাদন চায়, রাতে মাথা গুঁজিবার ঠাঁইটা চায়, কাজেই তার হাতিয়ারটি ঠিকঠাক জোগাড় করতে হয়। আর এই বাজারি দুনিয়ায় পুঁজিপাট্টার ঝনঝনানি ছাড়া তা হওয়া কি সম্ভব? কথা আরও আছে। যেমন, প্রতিযোগিতা হচ্ছে এই বাজারের প্রাণবায়ু। প্রতিযোগিতায় তো স্ট্র্যাটেজিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ধাপ্পা আর মাস্তানি। নিত্যনতুন গেজেট আর বাহারি ডিএসএলআর আর ল্যান্সেস তো দরকার অবশ্যই। কিন্তু, মনে হয়, প্রযুক্তির প্রাচুর্য যতটা বাণিজ্যসহায়ক, ততটা আর্টসহায়ক নয়। আর্ট তো প্রযুক্তিতে থাকে না, আবার আর্ট তো যুক্তি-প্রযুক্তির অতটা বাইরের জিনিশও নয়। আর্ট ঘটে, এমনি-এমনি না, এইটা ঘটাইতে হয়। আর্টিস্ট ঘটায়া থাকেন আর্টের ঘটনাটা, তা তিনি কি দিয়া আর কেমন করে ঘটাবেন সেইটা আর্টিস্ট যার যার তার তার ব্যাপার। প্রযুক্তি ইত্যাদি ইভেন্টসহায়ক। ধরা যাক, ওয়েডিং ফটোগ্র্যাফি কেউ প্রফেশন্যালি করতে গেলে তার লম্বা-লম্বা ল্যান্স এবং অন্যান্য বায়নাক্কা দরকার। আর্টের জন্য অতটা আয়োজন সবসময় লাগার কথা না। এই কথাগুলো তো ঠিকই আছে। কেবল শিল্পীর ক্ষিধাটা যদি নিছক ভাতের ক্ষিধাতেই ঘুরপাক খায়, শিল্পীর শীত আর গর্মির বোধ যদি নিছক এসি-গিজারের তাপানুকূলতাই চায়, শিল্পের তাইলে কী উপায়— এইসব নিয়া ভাবতে চেয়েছিলাম। শিল্পটিল্প নিপাত যাক, ভাতকাপড়ের তোলো হাঁক— এমন প্রত্যয়ের আন্দোলনে পুঁজিস্তবকীর্তন করব আমি, নিশ্চয়। কিন্তু বক্ষ্যমাণ এই নিবন্ধের উপজীব্য ম্যুভমেন্ট মনে হয় কেবল ফটোগ্র্যাফিই নয়, শিল্পানুশীলনের অন্যান্য সর্বত্র পুঁজির দৌরাত্ম্য ও বদখত দাপট নিয়া ভাবতে একটু হইলেও প্ররোচিত করতে পেরেছে এই নিবন্ধকারকে। সেইসব বলতেই বসেছি। কথাটা এ-ই যে, বাজারের জয়গান গাওয়ার অজস্র মেশিন-ম্যাকানিজম তো ইন-বিল্ট রয়েছেই, বাজার নিজেই তার নিজের প্রোমোটর, কাজেই আমার বাজারকীর্তনী নিবন্ধের নেসেসিটি বিশেষ-একটা নাই বলেই মনে হয়। তা-ও যদি বাজার আমারে তার পিআরঅ তথা পাব্লিক রিলেশন অথর/অফিসার/অথোরিটি নিযুক্ত করত, তখন বাজারবিতানের গীত স্বতস্ফূর্তই লিখতে বইতাম। আর আমি মনে করি না হাতিয়ারে শিল্প থাকে, এইটাই ইনস্টাগ্র্যাম ইত্যাদি বিচিত্র অ্যাপ্স ব্যবহার করে নানামাত্রিক মন্ত্যাজ সম্বলিত ফটোচিত্র তুলিয়া আমাদেরে দেখায় ইনফর্ম্যাল/ননফর্ম্যাল/অনানুষ্ঠানিক কাজের ভিতর দিয়া আজকের অপেশাদার-অথচ-আর্টিস্ট স্থিরচিত্রীরা। ঢাকাগ্রাম আন্দোলন অচিরেই স্তিমিত হয়ে গেলেও প্রফেশন্যাল ফটোগ্র্যাফির বাইরে বিশালায়ত ফটোগ্র্যাফিপ্র্যাক্টিস কিউরেইট করার একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। এই তিন শিল্পীর কাজগুলো যথাযথ গোছায়া হাজির করতে পারলে লোকে ঠিকই কদর করবে। একবাক্যে যে-কেউ বুঝতে পারবে এগুলো ভিয়্যুকার্ড ফটোগ্র্যাফি নয়। এখানকার প্রত্যেকটা আর্টওয়ার্ক হিশেবে ধর্তব্য অথবা অ্যাবান্ডন্ড। শুধুই নীলাকাশের বিউটি নয়, কাশফুলের কিউটনেস নয়, ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ আর কাশের ভিতরকার অপু-দুর্গা হাতছানি দিতেসে কি না তা দিয়াই শিল্পের বিবেচনা সারতে হয়। কিছু-না-কিছু কমিউনিকেইট করাবেই শিল্পকর্ম, অথবা ভায়ব্রেইটেড হবে বিফোর ইট ইজ আন্ডার্স্টুড। প্রদর্শনীর ছবিগুলো ভোক্তারা যার যার নজরে দেখবেন, তবে এর আর্টমূল্য সন্ধান করতে করতেই দেখবেন নিশ্চয়। আর আর্ট বলতে আমি যা বুঝি আমি জানি যে সবাই তাই-ই বোঝে। তেয়াত্তর হস্ত লম্বা ল্যান্স ও অন্যান্য এক্সপেন্সিভ ফিল্টার-ট্রাইপয়েড ইত্যাদি এস্তেমাল করিয়া আমি কি পয়দাইলাম — এন্ড্ অফ দি ডে এইটাই তো দেখবে আমার-আপনার নাতনিরা। কাজেই নিজেরে সাধু সাবধান বলার গরজেও এই নিবন্ধের একটা গ্রাহ্য গ্রাউন্ড খোঁজা যায়। মাস্তানি নিয়া আর না বলি। কিন্তু, কনফেস করি, তেষট্টিকিলো মটরশুঁটির তিনছটাকি বিচি বিস্তর এক্সপেরিয়েন্স করিয়া আসছি আমরা আমাদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটাবদ্ধতায়। আবার ভাঙাচোরা নাও বাইয়া আসমুদ্রবিন্ধ্যাচল পেরোতে দেখেছি নিশ্চয়? এইসব, মনে হচ্ছিল, এই তিন শিল্পীর কাজের হাতছানি-ইশারায়। এতদসঙ্গে একটি লিঙ্ক থুয়া যাচ্ছি, ঢাকাগ্রাম ইনিশিয়েটিভের বেশকিছু শস্যের দেখা মিলবে যেখানে : ‘বিষয় : ঢাকাগ্রাম’ লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন। শেষের কথাটা না-বলেই নিবন্ধ শেষ করব এবার। কতকিছুই হয়নি তো, একটুর জন্য, আমার-আপনার-অনেকের ও সকলেরই আমাদের, সুমনের সেই গানের মতন : “একটুর জন্য কতকিছু হয়নি, ক্ষয়ে-যাওয়া আশা তবু পুরোটা ফুরোয়নি … একটুর জন্য প্রেম দিলো চম্পট, তবুও হৃদয় করে আশা নিয়ে ছটফট … একটুর জন্য পাশ-নম্বর নেই, ফেল-করা আশা তবু ফাঁকতালে থাকবেই … একটুর জন্য হাসিটাকে রাখছি, দুরাশায় হোক তবু আশাতেই থাকছি …” ইত্যাদি লাইনওয়ালা গান সেই-যে গেয়েছিলেন তিনি ‘দিবসের প্রথম সূর্য’ উদয়ের প্রহরে, এখনও এই ‘দিবসের শেষ সূর্য’-সঙ্কাশেও সমান সত্য। তবে এইটাও তো অসত্য নয় যে এন্তার অপ্রাপ্তির পরেও অনেক পাওয়াও জুটিয়াছে আমাদের ভালে। এর মধ্যে একটা হলো, সারাক্ষণ করতে চেয়েছি কিছু-একটা ভালো ও ভ্যাল্যু-অ্যাডেড সামথিং, পেরেছি কচুটাই হয়তো, তবে চেষ্টা জারি ছিল সবসময়, এখনও ছাড়িনি হাল, গুটায়ে নেই নাই পাল, এখনও অন্ধ বন্ধ করি নাই পাখা, যেখানেই ভালো কোনো উদ্যোগ, সেখানেই সমর্থন আমাদের, এ-ই তো প্রমাণ যে একটাকিছু করতে চেয়েছিলাম এবং চাইছি আজও। তবে এই কথাটাও বদ্ধমূল বিশ্বাসের মতোই দিন-কে-দিন বড় হচ্ছে ভেতরে আমার, যে, কি করতে পেরেছি তা দিয়া মুরদ তথা শক্তি মাপা যায় যেমন, তেমনি কি করতে চেয়েছি তা দিয়া মাপা যায় এমনকিছু যা মুরদের কি হিম্মতের চেয়েও প্রমাণোর্ধ্ব পরিতৃপ্তিপ্রদ। অন্তত নিজের কাছে একটা সাক্ষ্য দেয়া যায় দিনশেষে যে এ-ই বা ও-ই আমি করতে চেয়েছিনু, পারিনিকো, হয়েছি ব্যর্থ। কম নয় এই ব্যর্থতার দাম আমার কাছে, যেমন দামি দিনের আলোয় নিরুজ্জ্বল-নিষ্প্রভ জুনিপোকাটির অস্তিত্ব। মোদ্দা কথাটা হলো ওই গান, গানের ভেতর প্রবাহিত হতে পেরেছি কি না আখাম্বা যাপনের এই বীভৎস সুন্দর দিনগুলো রাতগুলো, ও-ই বিবেচ্য, ওই গীতিপ্রবাহ জীবনের, ‘আমির খানের কণ্ঠে অপার আতশবাজি’ শুনে-শুনে এ-জীবন ও এই মৃত্যুমুখর বদ্বীপে বেশ তো অনির্বচনীয় চলিয়া যাইছে আমাদের। মন্দ নয়, আদৌ মন্দ তো নয়। ‘এ-চাওয়ার রঙ’ আর এই ‘না-পাবার রঙ’ — কবীর সুমনের অন্য আরেকটা গানে এই দুই অদ্ভুত রঙের উল্লেখ রয়েছে — করতে-পারা বা করতে-না-পারা তথা কোনোকিছু হতে-পারা বা হতে-না-পারার চেয়ে কম তো মূল্যবান নয় বিবেচনা করি। শিল্পীত্রয়ের সঙ্গে একটা হাল্কা আলাপ-পরিচয় হতে পারে এবার : রুমু আলী রুমু আলী : জন্ম চট্টগ্রামে। ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। কবিতাচর্চা করেন মূলত। পাশাপাশি গদ্য লেখার চেষ্টা করেন। একজন সম্ভাবনাময় আলোকচিত্রীও। রুমু আলীর ফটোগ্রাফি দেখতে ক্লিক করুন। প্লাবন আমিন প্লাবন আমিন : প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করা তরুণ এই আলোকচিত্রী বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। তার বেশকিছু ছবি দেশবিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিয়ে বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেছেন। সম্প্রতি তার তোলা ‘করোনা মহামারির ছবিগল্প’ প্রকাশ পায় বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির ‘ফটোগ্রাফি’ নিউজলেটারে। প্লাবন আমিনের ফটোগ্রাফি দেখতে ক্লিক করুন। নিত্যানন্দ শীল নিত্যানন্দ শীল : জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বগুড়ার ধুনটে। অফিসার পাড়ায়। পড়ালেখা করেন কাজিপুর সরকারি মনসুর আলী কলেজে। ছবি তোলা শখের বশে হলেও স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতে একজন বড় আলোকচিত্রী হবার। নিত্যানন্দ শীলের ফটোগ্রাফি দেখতে ক্লিক করুন। জাহেদ আহমদকবি, গদ্যকার, অনুবাদক শেয়ার করুন Twitter Facebook Pinterest LinkedIn Tumblr Email