নাম
সিঁড়ি বেয়ে স্বপ্নে উঠে গেল নষ্ট সকাল।
রণাঙ্গনে ইস্তফা দেওয়া মার্জিত শাড়ির কুঁচি
রাস্তা ছেড়ে সোফাতে শয্যা নিল,
আর বুড়ো পায়রা দম নেওয়ার আগে শাপান্ত করে গেল সভ্যতাকে।
চুপচাপ বারান্দায় বসে এসব হজম করে গেলে,
টক গন্ধে ছেয়ে যায় শিউলি গাছের পাতা।
চোখবুজে আরাম করতে পারব ভেবে,
ভবিষ্যৎ কে লাস্যময় মনে হয়,
অথচ হয়তো ওৎ পেতে আছে অসুখের সমস্ত নাম।
‘তোমার নাম কী?’
বলব না। সেইটা আমার নিজের নয়।
চিৎকার করে উঠলে ধাইমার হাতের তালুতে,
শোরগোল করে নাম রেখে ফেলল তারা।
নাম ধরে বলল শব্দ থামাতে।
যারা নাম রাখল আমার জীবন কি তাদের হয়ে গেল?
সবুজ পাহাড়েও চিৎকার ছিল রাতজুড়ে,
প্রগাঢ় ঢের শব্দ!
এবার যদি আমি ভোরে উঠে তার নাম রেখে ফেলি বিনা অনুমতিতে,
আর ঘোষনা দিই গম্ভীর স্বরে,
থামাও এসব শব্দের মেনিফেস্টো!
সে কি ঠিক কথা মেনে মাথা নুইয়ে বলবে
জ্বী আচ্ছা!
তার জীবন কি এবার আমার হবে?
‘সব পাহাড়ের নামই মানুষের রাখা’
নিঃশ্বাস ফেলে বললাম জানি আমি!
শিউলি পাতায় টক গন্ধ,
বারান্দায় আবেদনময় ভবিষ্যৎ রোদে তা দিচ্ছে,
ঠিক ঘরপোষা বেড়ালের মতো।
‘লক্ষ্মী মেয়ে এবার আর কোন মেনিফেস্টো নয়?’
জ্বী আচ্ছা!
নাম-২
ময়ূর এবং মাছেরা পাখা মেলে নেচে যাচ্ছিল মাদলের তালে,
বহ্নুৎসব পুড়ছিল ফেলে দেয়া স্বপ্নেরা,
কাঁচা ছাই এবং আগুনের ফুলকিতে লেগে ছিল অগ্রহায়ণের ঘ্রাণ,
নতুন ধানের মুখ ফোঁটেনি তখনও,
তখনও রাত ঢের বাকি,
তখনও আশা ছিল ভোর হবে দুয়ার খোলা আশ্বাসে।
সেইসবই বিগত দিনের কথা।
এখন রাত কেটে যায় বিস্মৃতির মতো,
এখন স্বজনরা আঁক কষে পণ্ডিতমশাইয়ের মতো,
এখন দ্রোহ আসে কেবল বিজ্ঞাপনে,
আর ভালোবাসা বাইসাইকেল বেল এর টুং শব্দ ভুলেই গেছে।
ব্যক্তিগত বুড়িগঙ্গারও এখন দর্শক লাগে,
অথচ ঘোরদুপুরে বুড়িগঙ্গা স্নান করতো নিজের মতো,
বিজ্ঞাপন এবং বিলাসীতা বিহীন।
অথচ রাত তখন অনেক বাকি থেকে যেতো,
ভোরের আগে চোখ মটকে বলে যেত, ‘টু বি কনটিনিউড!’
সমস্ত ফুরিয়ে যায় এখন।
কেবল লাশ ছাড়া।
এইসময় জীবিত এবং মৃত লাশদের।
নামে ভরে উঠে ক্রমশ হাতের আঙুল, জমিনের ফুল।
খোলা ডাস্টবিনের মতো ভূভাগ সড়িয়ে দুহাতে,
বেড়ে ওঠে নামেরা।
সুঠাম এবং সাবলীল।
নামে ভরে ওঠে ক্রমশ প্রেমিকের গাল, রেড সিগন্যাল,
দুপুরের ভাত, সলীল স্বঘাত।
বাতাসের শ্বাস, কনিষ্ঠ মাস।
নামে ভরে ওঠে
বোকাদের গান, রুটিন স্লোগান।
লোভ
অসুন্দরে বিচ্ছিরি করে আল্পনা এঁকে
সেই মনঃকষ্টে পথ ভুলে গেল তারাদের দল ঘোর বর্ষাতে।
তখনও সবুজ ঢের গাঢ় হওয়া বাকি,
তখনও পথিকের ঢের সমুদ্র পরে মাঠে,
অত ঢেউ তারাশূন্য দেশে হেঁটে ফিরতে পারে না কেউ।
তারারা পথ ভুলে গেল।
স্বাতী দূরাশার মতো নিভে গেল আলো মুছে।
শুধু লুব্ধক তখন আকাশে।
মুখ তুলে পথিক তীব্র করে বলল,
আমিও লোভী, আমারও চোখ চকচক করে সবথেকে বেশি।
লুব্ধক পাল্টা কি বলল নিচু করে মুখ,
শুনতে পাওয়ার আগেই ভেসে গেল সব।
তখন দুষ্মন্তের মতো রোদ্দুর ভরা এলাচ গাছে অসমাপ্ত ক্রোধ।
অনেক আগে শুরু হওয়া লাভ-ক্ষতি হিসাবে মুখ নিচু মানুষের।
পথিক শুধু কাতর বিষে বলল,
আমিও লোভী!
আমারও পেতে ইচ্ছে করে অমলতাস সকাল,
আর গাঢ়-নীল-জামের মতো সন্ধ্যা!
বাসুকী লতার মতো ভালোবাসা,
আর কৃষ্ণের মতো বন্ধু!
বাদলপোঁকা
দিগন্তু ছুঁতে না পারার মতো কষ্ট নিয়ে বাদলপোঁকা মাথা ঘামাতোনা।
যেবছর বৃষ্টি হলো হাতে গোনা সুখের মতো,
সেইবছরই প্রথম দিগন্ত আছে বলে খেয়াল হলো তার।
ধরেবেঁধে দেয়া সীমান্ত স্বর্গের নিচে।
অথচ এতোকাল ধরে সে জানতো আকাশ সত্যি স্বাধীন!
‘যেন উচ্ছন্নে না যায় তাই বেঁধে দেওয়া,’
—গুবরে পোঁকা বলেছিল চশমা ঠেলে।
লক্ষীপেঁচা একুশ শতাব্দী থেকে কথা বলছে না।
আর কাঁচপোঁকা সহস্র স্বপ্নভঙ্গে এখন চাঁদ আর অমাবস্যায় ফাঁক ধরতে পারে না।
‘বিদ্যা আমি চাইনি!
অথচ এখন বর্ষায় স্বর্গ ডুবে গেলেও,
অশনি সংকেতের মতো প্রাচীর দেখতে পাই আমি!
অথচ আমার বোকার মতো স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে।
অথচ অত বিদ্যা আমি চাইনি!’
চোখ
তারাবাতির মতো ফুলকি ছোটে তখন ব্রহ্মপুত্রে।
যখন গাঢ় তৃষ্ণায় চাঁদ নেমে আসে কাশফুলের খুব কাছে,
মেঘের ভেতর ডুবে যাওয়ার মতো করে জোছনা ঢুকে যায় সেখানে,
গাঢ় রাতে।
যখন শহর ঝিমায়ে যায় ওপারে,
যখন অতৃপ্ত আত্মার মতো শহর ঢুলতে থাকে ওপারে,
যখন নষ্ট স্বপ্নের মতো শহর ভুল বকে ওপারে,
যখন বখে যাওয়া সন্তানের মতো শহর ভনিতা করে ওপারে,
যখন ছিপি খুলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় শহর ওপারে,
যখন জানালা আটকে কাঁদে শহর ওপারে,
যখন ছাদ খুলে সময় কত হলো দেখে শহর ওপারে,
যখন কাউকে ভালোবেসে না, এমনি কাছে পেতে চায় শহর ওপারে।
ও অন্ধ।
ও চোখের বিনিময়ে মাণিক্য পেয়েছে কুড়িয়ে।
তখন।
নিশিতে পায় যখন দূর্বাঘাসদের,
নিশিতে পায় যখন ঠান্ডা মাটিতে মাথা পেতে থাকা রূপকথাদের,
যখন ঋষির মতো নদ, বুক পেতে জুড়িয়ে দিতে থাকে দিবসের গ্লানি,
তখন।
ও সমস্ত শরীরে চোখ এঁকে নিয়েছে।
এখন ছুয়েঁ দিলে আঙুলই শুধু,
ও বলে দিতে পারে কি তরাসে ঘর খুঁজছে যাযাবর পাখি,
কি তরাসে থেমে যায়,
শহরের কথা।
![Sumaya Mashrufa Pro](https://www.sree-bd.com/wp-content/uploads/2021/12/Sumaya-Mashrufa-Pro.jpg)
ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশান সম্পন্ন করে এখন অনেক কিছু করতে চাওয়ার চেষ্টায় থাকা শুধু। আর নষ্ট হয়ে যাওয়া বিস্তর সময়ের শোক ভুলে এখনও সুন্দর কিছু করতে পারা যাবে নিজেকে ঐরকম আশ্বাস দেওয়া কেবল। আর কিছুই না।