রবিবার, অক্টোবর ১৩

‘নাড়িসূত্র’: খোঁজ, নিখোঁজের বাইরে নিজেকে হারিয়ে ফেলা : আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

0

নিজের অস্তিত্বের সাথে একান্ত ভ্রমণের পথই বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে অসীম। সেই পথের শুরু আর শেষ নাই। বরং মোড়ে মোড়ে বাঁকবদলের বিস্ময়, কোনোদিন ফিরে না আসার গোপন, ধীর অথচ দৃঢ় গতি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা নিজে মানে তো কেবল একজন না, আত্মপরিচয়ের মোহের ভেতর অন্তত হাজার মানুষের বাস। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ‘সূত্র’ তাই প্রচণ্ড জটিল, একই সাথে অসম্ভব এবং অনিবার্য।

জিন্নাতুন জান্নাতের প্রথম একক প্রদর্শনী ‘নাড়িসূত্র’ আদতে বিচিত্র অর্থ আর ভাবের প্রকাশ। শিরোনামেই কয়েক স্তরের ঘোর লাগে। উত্তর প্রয়োজন নেই এমন সব প্রশ্নের উদ্ভব হয়। ‘নাড়িসূত্র’ কি মাটির উপরে নিচে ছড়িয়ে থাকা শেকড়ের সন্ধান? নাকি জন্ম আর জীবনের রহস্যের খোঁজ? এমনও তো হতে পারে এই ‘নাড়ি’ মূলত চারপাশের এমন সব সম্পর্কের ‘সূত্র’ যাদের কেবল অনুভব করা যায়, উচ্চারণ কষ্টসাধ্য।

‘নাড়িসূত্র’ নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে শিল্পী, শিল্প সমালোচক মোস্তফা জামান বলেন, ‘নারী চরিত্রের নির্মাণ এবং প্রতিকৃতি অঙ্কনের ক্ষেত্রে এই শিল্পী রেপ্র্রিজেনটেশনের সচরাচর ধারাকে ছাড়িয়ে গেছেন’। এর সাথে যোগ করে বলা যায় নারীবাদের প্রচলিত ধারাকে এড়িয়ে গিয়ে পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের মিশ্রনে ভিন্ন এক শক্তিমান নারীত্বের ছবি এঁকেছেন জিন্নাতুন জান্নাত। অভিযোগ, অনুযোগ, শোক, অনুতাপ ছাড়িয়ে গিয়ে নির্মোহ এক উত্থানের কাহিনি।

‘নকশিকাঁথার মাঠ’ (২০২০) ছবিটা যেমন— বিনির্মাণ করা নারীদেহ নদী, আকাশ, ঘর, বৃক্ষ ইত্যাদি ধারণ করে ফুলের মতো ফুটে আছে। শক্তি আর উদারতার গভীর এক অনুভূতি। কিন্তু এদের ভেতরকার স্পষ্ট সম্পর্কের উদঘাটন করা যায় না। কালো গাঢ় রেখার শরীর একধরণের উত্তরাধুনিক উদাসীনতার গল্পও বলে। রেঁনেসার আশাবাদ বা আধুনিকতার উদ্বেগের মধ্যেখানে এক অন্য জগত।

আবার ‘দেয়াল কথনে’ (২০২০) এসে জিন্নাতুন জান্নাত কথা বলেন সাদা চলমান রেখায়। বরবারের মতোই মুখায়বয়ব তৈরি হয় নারীর। আর এই মুখ হয়ে ওঠে খোলা জমিন, বিস্তীর্ণ দেয়াল। জীবনের একটা উজ্জ্বল প্রতীক সোনালি ডানার পাখি হয়ে ঝুলে থাকে। শূন্যতারও উদযাপন থাকে। মহাকালের মাঝে কয়েক দশকের জীবনের মতোই সে উদযাপন ক্ষুদ্র, কিন্তু গৌরবের কমতি নাই কোনো। ‘অগ্নিসিঁদুর’, ‘যাও পাখি বলো তারে’, ‘সারথি’, ‘কৃষ্ণকথা’— ২০২০ সালে আঁকা ছবিগুলোতেও দেখা মেলে শূন্যতার রং এবং বৈচিত্র্যের। হলুদ হাঁস, লাল মাছ, অথবা ধান উড়ানোর মুহূর্তগুলো জীবনের দিকে খুলে রাখা জানালার মতো, ঘরে বসে ঘরকে ভুলে থাকার সাহস জোগায়।

শিল্পী জিন্নাতুন জান্নাত তাঁর ‘নাড়িসূত্র’ সিরিজ নিয়ে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ছবিগুলোর মধ্যে দিয়ে তিনি নিজস্ব ভাবনা, অন্তরালকে যেমন প্রকাশ করেছেন; তেমনি উঠে এসেছে যেভাবে তিনি চারপাশের জগত আর ঘটনাকে যাপন করেন। ‘কাক-চরিত্র’ নামের একটা ছবিতে তিনি আত্মপ্রতিকৃতি ভেঙে আবার তৈরি করেছেন। গলে যাওয়া, জমে যাওয়া, জট লেগে যাওয়া মুখ। বামদিকে চোখের বদলে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত একটা কাক। সাদা-কালো ছবির ভেতর দিয়ে নিজের সাথে মিশে যাওয়া সময়ের আবহ এঁকেছেন। সমকাল মানুষকে এইভাবেই ছিঁড়ে ফেলে, গলিয়ে দেয়। আবার মুহূর্তেই পুণনির্মাণ করে।

‘নাড়িসূত্র’ নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে শিল্পী, শিল্প সমালোচক মোস্তফা জামান বলেন, ‘নারী চরিত্রের নির্মাণ এবং প্রতিকৃতি অঙ্কনের ক্ষেত্রে এই শিল্পী রেপ্র্রিজেনটেশনের সচরাচর ধারাকে ছাড়িয়ে গেছেন’। এর সাথে যোগ করে বলা যায় নারীবাদের প্রচলিত ধারাকে এড়িয়ে গিয়ে পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের মিশ্রনে ভিন্ন এক শক্তিমান নারীত্বের ছবি এঁকেছেন জিন্নাতুন জান্নাত। অভিযোগ, অনুযোগ, শোক, অনুতাপ ছাড়িয়ে গিয়ে নির্মোহ এক উত্থানের কাহিনি।

রঙিন অথবা সাদাকালো, চিরন্তন অথবা সাময়িক, প্রতিবাদী অথবা অসচেতন, বৈশ্বিক অথবা আঞ্চলিক, আলো নয়তো অন্ধকার— এইসব ভেদ বিভেদের চেয়ে ‘নাড়িসূত্র’ মনে হয় বেশি গুরুত্ব দিয়েছে মধ্যবর্তী অন্য কিছুকে। আমরা এই মাঝখানের অংশটার নাম জানি না, স্বয়ংসম্পূর্ণ ছবিগুলো অবশ্য বলে দেয় এই নামের খোঁজ নিস্প্রয়োজন!


জিন্নাতুন জিন্নাতের শিল্পকর্ম


১. নকশিকাঁথার মাঠ

নকশিকাঁথার মাঠ


২. কাক-চরিত্র

কাক-চরিত্র


৩. দেয়ালকথন

দেয়ালকথন


৪. অগ্নিসিঁদুর

অগ্নিসিঁদুর


৫. যাও পাখি বলো তারে

যাও পাখি বলো তারে


৬. সারথি

সারথি


৭. নবান্ন

নবান্ন


জিন্নাতুন জান্নাত

জিন্নাতুন জান্নাত

জিন্নাতুন জান্নাতের জন্ম বাগেরহাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে ২০১৪ সালে স্নাতক ও ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর চিত্রকর্মে রয়েছে বলিষ্ঠ রেখা ও রঙের ব্যবহারে বাংলার চিত্রকলার দেশজ ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণা। তরুণ এ শিল্পীর কাজে একজন নারী হিসেবে নিজের ‘সত্তা’ আর সমাজের সাপেক্ষে নিজের ‘সামাজিক সত্তার’ মধ্যকার বোঝাপড়ার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। দেশজ শিল্প ঐতিহ্যের ভাষাশৈলীর অন্বেষণে জান্নাতের এ প্রয়াস ইতিমধ্যেই শিল্পবোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘নাড়িসূত্র’ (২০২১) তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে, ১৯৯০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছোটগল্প ও কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ২০১০ সালে । এখন পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বই দুইটা, অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান  (২০১৬) ও যুদ্ধ যুদ্ধ রুদ্ধ দিন (২০২০)। প্রথম গল্প সংকলন বছরের দীর্ঘতম রাত  প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।