শনিবার, জুলাই ২৭

নির্বাচিত দশ কবিতা : মোস্তাক আহমাদ দীন

0

গুপ্তভাষার স্পৃহা

পাখি কখন জানি উড়ে যায়—লালন সাঁই


দিদারে পয়মন্ত মনে ঝড়
কথার উড়ন্ত ফুল দেহমাত্রা পেতে পেতে
সুর তোলে দোতরার বুকে

এমন ব্যাকুলা মনে হ্রদের ভিতরে
শুধু কেন ছায়া উড়ে যাবে, পাখি, ওহে ছায়াপাখি?
ছায়াকৃত পাখির দিদারে শুধু কত বলো
মন ভরে আর…

একা একা স্বপ্ন খুঁড়ে দেখি
পালক স্পর্শের কথা গোপনে রয়েছে
আর
গুপ্তভাষার স্পৃহা এতটাই বৃদ্ধি পেতে থাকে
ভয়ে আমি ছোট হয়ে যাই


সর্পঈর্ষা


আমি তোর নবম সতিন, সর্প তুই
দেহ খেয়ে নে
একথা বলার পরও প্রতিঘাত সম্ভাবনাহীন

নানান আঘাতে শুনি কাঁটাগাছও কথা বলে ওঠে,
গৃহক্ষুধা নিয়ে ছুটে যায় জল
তবুও সর্পঈর্ষা আমি আজো জাগাতে পারিনি

আচমন যে মিথ্যে হয়ে গেল
তার জন্যে শিরা ফুলে ওঠে
আমারই দেহের ভারে দেহনীলে
ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে মাথা

আমি তো সাপের মেয়ে
তবু দেখো সর্পঈর্ষা জাগে তো জাগে না


দুই জন


হাওরের মুখোমুখি হয়ে মনে হলো,
এই মুখ সহনীয় নয়
দুঃখিত পাপড়ির রঙে মিলেমিশে
খুলে যাচ্ছে সমস্ত দুয়ার
মনে হলো এই চোখও বিষম দুঃসহ,
কতোয়ালের মতো দ-গভীর, কালো আর লাল, হয়ত-বা ধূসরহলুদ
যার দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে
উড়াল জালের মতো ঘিরে ধরে সমস্ত হৃদয়
যার চোখের আলোয় কখনো-কখনো
জিনকন্যার অচেনা বিস্ফার

পিঠ ফিরে বসে দুই জন
দুই হাত দুই মুখ আর এক পৃথিবীকে নিয়ে
নির্জন হাওরের পাড়ে

মুখোমুখি : বিষম দুর্বহ


মেঘলোক



শূন্যে জমছে মেঘ
ব্যথিতের রূপে বসা হবে না তোমার
কাঁধে-বয়ে-চলা নদীর উৎপাতে
তোমার নিজেরই কোমরসন্ধি ভেসে যায়

তবু নিরুদ্বিগ্নের মতো বসে
একে একে ছুড়ে দিচ্ছি গূঢ় নামাবলি
মাথার মধ্যে পরা স্বর্ণতাজটিও


এইখানে নেই কোনো বন
গাছ-নদী নেই কোনো পাখি

এখানে জ্বলন্ত ক্ষোভে আমি এক ব্যথার প্রকার


নোঙর


জাহাজ ছাড়ার পূর্বেই
তার কথা মনে পড়েছিল

দেখতে দেখতে আমার চলে গেল সহস্র বছর

মেঘে লুপ্ত হয়ে গেছে কথা, আর
তারায়-তারায় শতস্মৃতি, হাওয়া

আজ মনে পড়ে শুধু
তীর-ছেড়ে-যাওয়া নোঙরের
দশটি আঙুল

মিলনের অবিনাশ শেষ আকুলতা


ঝড়


পাতার ঝড়ের দিনে তার ডানা ভেঙে যায় দেখি
পড়ন্ত পাতার স্তূপ জর্জরিত, তবু দেখা যায়
পালকের সাঁঝ—এই সজ্জা কারও কারও কাছে তবু
মনে হয় ভাঙাচোরা—গণিকার রাংতার ভাঁজ

ভিজতে-ভিজতে যায়, জগতের ম্লান এক পাখি
মর্মে মর্মে ধুলোর জীবন, মনে মনে মরুভূর
উষ্ট্রিণীর ডিম পেলেপুষে পথের কাদায় মিলে
এমন বাদল দিনে হেঁটে যায় দূর কোনো দেশে

পাতার ঝড়ের দিনে মাথার উপর থেকে ভেঙে
উড়ে যায় বহুদূর জীবনের পালকের ছাতা…


একতারা


একটাই তার, তাও ছিঁড়ে গেছে রাত পোহাবার আগে, এখন কী রূপে তার মন যে জোগাই

ঘুণে যে ধরেছে দেহ, সেই কথা প্রচারিত হয়েছে আগেই, এই তত্ত্ব পড়শিরাও জেনে গেছে আজ, এবার কলঙ্ক-বার্তা ধীরে-ধীরে ধীরে নগরে ছড়াবে

যে-দেশে রটনা-ভয়, সেইখানে পূর্বজেরা কী কারণে পুঁতেছিল বীজ, এমন ধুলার দেশে কেনইবা ঘুরতে আসে রসের নিমাই, সে-সব বুঝি না—কেবল জেনেছি ভোর আসে না তো ছেঁড়াতার ঘুণে-ধরা দেহখানি বেয়ে

রাত্রি সুদূর হলে বে-তারেতে দেহ-মন কোনোদিনই গিয়েছে কি বাঁধা?


ফুলের মুহূর্ত


ফুলের মুহূর্ত নিয়ে ভেবে আমি তোমাকেই পাই, দেখি তুমি ফুলেরই জাতিকা, মাঝেসাঝে, অকারণে মুখে আনো পাথরের কথা, মুখে তোলো নিষ্ফুল পাহাড়ের কথা। অথচ দেখেছি আমি ফুলটুঙ্গি ঘরে বসে নরম জলের সঙ্গে মনগপ করো। ফুলের মুহূর্ত নিয়ে ভেবে আমি তোমাকেই পাই, মিছে সাজো রূঢ় শাহরিকা।


স্ফটিকচূড়ার নিচে


সুখেরও শেষ কিছু আছে, পাশে দুঃখ,
পাশে লোভ, পাশে সেই গন্দম-বাগান।
ভাঙলে ভাঙুক ঘর, ঝরে যাক ধান।
আজ রজনি না যেতে চলো দুই জন—
ধীরে ধীরে ঘাটুগানে যাই।

এই নাচে—এই মিথ্যে সাজে
তোমার সজল বুকে বেজে ওঠে ব্যথা;
এ-নাচে অনেক ভেদ :
সাকি আর রাতের ঘাটুয়া জানে,
এ-শরীরে শরীর যতটা, তারও বেশি শূন্যতোয়া ঠাঁই,
যে-ভাবে লীলার পরে গান গায় রাই :
‘সখি হামারি দুখের নাহি ওর’

আজ রজনি না-যেতে চলো দুই জন,
ধীরে ধীরে ঘাটুগানে যাই


সঙ্গী


গাছের নিবিড় সঙ্গী কোথাও কি গেছে—
কোলাহলে, পথের ভিতরে
একা একা ভিড়ে?
তা হলে তো পাঁজর অঙ্গার,
জলে জলে ভেসে যায় হাড়পোড়া কালো

শুনেছি গাছের সঙ্গী অতিসহজেই
মুখে মুখে অতলান্ত গান তুলে নেয়,
ডানায় ময়ূরপুচ্ছ বেঁধে নিতে নিতে,
মেঘে-মেঘে শুরু হয় ঘোর বরিষণ

পথে পথে রূপকের, পথে-পথে প্রতীকের পাখি উড়ে যায়

গাছের নিবিড় সঙ্গী কোথাও কি গেছে—
একা একা-কোলাহলে—নিবিড় জঙ্গলে?

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই কবিতা লেখার পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখছেন মোস্তাক আহমাদ দীন। ইতিহাসের প্রতি আগ্রহবশত অনুবাদ করেছেন সিলেটের ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থতারিখে জালালি। সম্পাদনা করেছেন ফকিরি তত্ত্বের আদিগ্রন্থ ফকির বিলাশসহ এ-অঞ্চলের বাউল-ফকিরদের গান এবং ১৯১৬ সালে প্রকাশিত জনজাতিবিষয়ক গ্রন্থ বাঙ্গালা ও বাঙ্গালার বাহিরে যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে তাহাদের সম্বন্ধে পুস্তক। সম্পাদনা করেন সমালোচনাকাগজ মুনাজেরা। ভিখিরিও রাজস্থানে যায় কাব্যগ্রন্থের জন্য এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারসহ কবিতার জন্য পেয়েছেন আরও একাধিক সাহিত্যপুরস্কার; লোকসংস্কৃতিক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য শিল্পকলা একাডেমি পদক। তাঁর মৌলিক, অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা সর্বমোট ২৭টি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মোস্তাক আহমাদ দীন ভারতের কেন্দ্রীয় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন ২০০৯ সালে। পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষক, বর্তমানে লিডিং ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগে শিক্ষকতার পাশাপাশি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।