কসাই বউ খেয়াল করল, ফ্রয়েড সাহেব তাকে গুরুতর অসুস্থ রোগী ঠাওরাচ্ছেন। আলাপের সময় হিস্টেরিয়া, ট্রমা এবং এরকম আরও কিছু কঠিন শব্দ বললেন যাতে মনে হবে তার সাংঘাতিক কোনো মানসিক রোগ হয়েছে। কিন্তু কসাই বউয়ের সেই সাক্ষাৎ ছিল সেদিনের ছিমছাম বিকালের অভিনব এক অ্যাডভেঞ্চার— নিছক একটা খেলা। কারণ উনি সব সময় বলে থাকেন, স্বপ্ন হলো ইচ্ছাপূরণ। কসাই বউয়ের তা বিশ্বাস হয় না। কারণ মানুষ যখন ভীষণ দুঃস্বপ্নে বাঘের মুখে পড়ে কিংবা মর্মান্তিকভাবে দুর্ঘটনা কবলিত হয় তখন কোন ইচ্ছাপূরণ হয়? গতরাতে সে নিজে যে স্বপ্ন দেখেছে, তাতে একটা নৈশভোজ আয়োজনের ইচ্ছা তাকে ছাড়তে হয়েছে।
মানুষ যখন ভীষণ দুঃস্বপ্নে বাঘের মুখে পড়ে কিংবা মর্মান্তিকভাবে দুর্ঘটনা কবলিত হয় তখন কোন ইচ্ছাপূরণ হয়? গতরাতে সে নিজে যে স্বপ্ন দেখেছে, তাতে একটা নৈশভোজ আয়োজনের ইচ্ছা তাকে ছাড়তে হয়েছে।
‘স্বপ্নটা বলুন।’
‘বলছি— আমি একটা নৈশভোজ আয়োজন করতে চাইছিলাম। কিন্তু ঘরে একটা স্যামন মাছ ছাড়া আর কিছু নাই। বাজারে যাব, কিন্তু দিনটা রোববার— দোকানপাট বন্ধ। দোকানিদের একজনকে ফোন করতে গিয়ে দেখলাম, ফোনটাও নষ্ট। কাজেই নৈশভোজ আয়োজনের ইচ্ছাটা বাদ দিতে হলো।’
‘বেশ। আপনি হয়তো জানেন, স্বপ্নপ্রতীকগুলোর সম্মন্ধ থাকে আগের দিনের বাস্তব কিছু ঘটনার সঙ্গে। আপনি সে রকম ঘটনাগুলোর কথা বলেন।’
‘আচ্ছা। ক্যাভিয়ার আমার খুব পছন্দ। আমার স্বামী পিটারের সঙ্গে গতকাল এ নিয়ে কথা হয়েছিল।’
‘কী কথা?’
‘আমি তাকে বিদ্রুপ করে বলেছিলাম, ইহজীবনে আমার আর ক্যাভিয়ার স্যান্ডউইচ খাওয়া হবে না। অবশ্য আমি চাই যে, সে আমাকে ক্যাভিয়ার না খাওয়াক।’
‘কেন?’
‘যাতে আমি আরও কিছুদিন এ নিয়ে তাকে খোটা দিতে পারি,’ কসাই বউ হাসে।
‘বেশ।’
ফ্রয়েড সাহেব খেয়াল করলেন, ইনি বেশ সুন্দরী এবং খুবই রসিক। ক্যাভিয়ার তার পছন্দের খাবার, কিন্তু সেটা খাওয়ার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখা কেন এতো জরুরি?
‘আপনার স্বামীর সঙ্গে আর কোনো কথা হয়েছিল যা স্বপ্নের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক?’
পিটার বলছিল, সে খুব মোটা হয়ে যাচ্ছে, নিয়মিত ব্যায়াম আর ডায়েট করবে, বিশেষ করে কোনো নৈশভোজে একেবারেই যাবে না। পরশু খাওয়ার টেবিলে এক চিত্রশিল্পী তার মাথার আকৃতি দেখে খুব প্রশংসা করছিল, বলছিল তার মাথার ছবিটা তাকে আঁকতেই হবে।
‘পিটার বলছিল, সে খুব মোটা হয়ে যাচ্ছে, নিয়মিত ব্যায়াম আর ডায়েট করবে, বিশেষ করে কোনো নৈশভোজে একেবারেই যাবে না। পরশু খাওয়ার টেবিলে এক চিত্রশিল্পী তার মাথার আকৃতি দেখে খুব প্রশংসা করছিল, বলছিল তার মাথার ছবিটা তাকে আঁকতেই হবে। শুনে পিটার বলল, এতো বাধ্যবাধকতা থাকলে সে ছবি আঁকতে দেবে না। সে রসিকতা করে বলেছিল, তার পুরো মুখ আঁকার চেয়ে কোনো সুন্দরী মেয়ের পাছার একটুখানি আঁকা তার জন্য বেশি সুখকর হবে।’
‘আপনার স্বামী সম্পর্কে বলেন।’
‘সে শুধু মজা খোঁজে।’
ফ্রয়েড সাহেব ধরে নিলেন কসাই নিজেই ‘পাছার একটা টুকরা’ কিংবা একটা পুরুষাঙ্গ। তবে কসাই বউকে সেটা বুঝতে দিলেন না। আর কসাই বউ ভাবল, খেলাটা বেশ জমে উঠেছে। কিন্তু কেউ যদি মনে করে, এটা হারজিতের খেলা— সে চাইছে, ফ্রয়েডের ইচ্ছাপূরণের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে আর ফ্রয়েড চাইছেন তার উল্টোটা, তাহলে ভুল হবে। কসাই বউয়ের ইচ্ছা ¯্রফে খেলাটা চালিয়ে যাওয়া, ফ্রয়েডের তত্ত্ব ভুল বা ঠিক যেমনই হোক। এবং খেলা জমে ওঠায় রসিক নারী আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠে।
‘নৈশভোজ নিয়ে আর কিছু?’ ফ্রয়েড অনুসন্ধান অব্যাহত রাখেন।
‘জি, আমার বান্ধবী প্যাট্রিশিয়া রসিকতা করে বলেছিল, আমি তাকে কখনো দাওয়াত করে খাওয়াই না।’
‘বেশ। কিন্তু স্বপ্নে স্যামন মাছ এলো কোথা থেকে?’ ফ্রয়েড ভ্রু কোঁচকান।
‘হ্যাঁ, ওটা প্যাট্রিশিয়ার পছন্দের ডিস।’
‘প্যাট্রিশিয়াকে নিয়ে আপনার স্বামীর মনোভাব কেমন?’
‘পিটার ওর খুব প্রশংসা করে, তবে প্যাট্রি খুব লিকলিকে আর ঢ্যাঙ্গা, আর পিটারের পছন্দ ভরাট দেহ।’
স্বপ্নটা তবে প্যাট্রিশিয়াকে নিয়েই। সে চায় আপনি তাকে নৈশভোজে দাওয়াত করে খাওয়ান, কিন্তু আপনি তা চান না। আপনি চান না, কারণ নৈশভোজ খেয়ে সে মোটা হয়ে যাবে, ঠিক যে কারণে আপনার স্বামী চাইছে নৈশভোজ এড়াতে
‘বেশ। স্বপ্নটা তবে প্যাট্রিশিয়াকে নিয়েই। সে চায় আপনি তাকে নৈশভোজে দাওয়াত করে খাওয়ান, কিন্তু আপনি তা চান না। আপনি চান না, কারণ নৈশভোজ খেয়ে সে মোটা হয়ে যাবে, ঠিক যে কারণে আপনার স্বামী চাইছে নৈশভোজ এড়াতে, কারণ তার ভয় বেশি মোটা হয়ে যাওয়ার। প্যাট্রিশিয়া আরও একটু মোটা হয়ে যাক এটা আপনি চান না, কারণ তাহলে আপনার স্বামী তার দিকে ঝুঁকে পড়বে। অন্যদিকে, প্যাট্রিশিয়া চাইছে আপনার স্বামীকে পটাতে।’
‘তাই নাকি?’ কসাই বউয়ের মুখ শুকিয়ে যায়।
‘হ্যাঁ। আর আপনি প্যাট্রিশিয়াকে ঈর্ষা করেন বলেই স্বপ্নে নৈশভোজ আয়োজনের ইচ্ছাটা নিজেই বাদ দিয়েছেন।’
কসাই বউ ঢোক গিলল। তার মনে হলো, এই বিকালে ফ্রয়েড সাহেবের কাছে না এসে কত কিছুই না করা যেতো।
‘শোনেন, আপনি তো চান আপনার স্বামী আপনাকে ক্যাভিয়ার না খাওয়াক।’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ। নিজের প্রিয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছা আপনি ত্যাগ করেছেন অন্য একটা ইচ্ছার বিনিময়ে।’
‘কী সেটা?’
‘কারণ ভেতরে ভেতরে আপনি চান প্যাট্রিশিয়াও স্যামন মাছ খাওয়ার ইচ্ছাটা বাদ দিক।’
‘মানে? আমার ইচ্ছাটা আমার নিজের ইচ্ছা নয়?’
‘আপনারই ইচ্ছা। তবে আপাতত নিজের জায়গায় আপনি প্যাট্রিশয়াকে বসিয়েছেন।’
কসাই বউ উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ। তার মনে হয়, শরীরের হাড়গোড়গুলো কেমন ঢিলেঢালা লাগছে, কেউ একটু ধাক্কা দিলেই সব খুলে পড়ে যাবে।
জন্ম ৮ মার্চ ১৯৭১, সিরাজগঞ্জ। রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ এবং সম্পদনা—সব মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরোর অধিক। ‘আগুন ও ছায়া’ উপন্যাসের জন্য ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২০’ এবং ‘বাংলার দর্শন: প্রাক-উপনিবেশ পর্ব’ বইয়ের জন্য ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-১৪২৫’ পুরস্কার পেয়েছেন।