সোমবার, ডিসেম্বর ২

‘পুরো দেশটাই এক উম্মুক্ত জাদুঘর’ —মকবুল ফিদা হুসেন

0

আধুনিক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চিত্রায়ণই ছিল শিল্পী এম. এফ. হুসেনের অণুপ্রেরণা। ভারতের বর্ণিল ঐতিহ্যকে তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর চিত্রকর্মের ভাষা হিসেবে। একারণেই হয়তো তাঁর ক্যানভাসে পৃথিবী ধরা পড়েছিল এক সত্য, অলীক ও প্রতীকি রূপে৷ মকবুল ফিদা হুসেনের শিল্পদর্শন নিয়ে বিভিন্ন রচনা থেকে এই লেখাটি তৈরি করেছেন আলী রেজা পিয়াল

মকবুল ফিদা হুসেনের নিজের জীবন ছিল বেশ বর্ণময়। জন্মেছিলেন ১৯১৫ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের পাধারপুরে। সেখান থেকে মুম্বাই এসে কর্মজীবনের শুরুতে এঁকেছেন সিনেমার পোস্টার। এরপরে করা শুরু করলেন বাচ্চাদের নার্সারি স্কুলের আসবাবপত্রের কারুকাজ। এসবের মধ্যে আবার ১৯৪৭ সালে জড়িয়ে পড়লেন প্রগতিশীল শিল্পী দলের সাথে।


Mother Teresa

মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা মাদার তেরেসা


আশেপাশের পৃথিবী, দৈনন্দিন জীবন, নানা ধরণের মানুষ এসবই ছিল হুসেনের চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু। আশেপাশের মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর শিল্পে। হুসেনের জীবনে তাঁর দাদা আবদুল হোসেনের খুব প্রভাব ছিল। সে প্রভাবের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর আঁকা ল্যাম্প, পুরনো ছাতা এসবে। নিজে মাতৃস্নেহের সান্নিধ্য তেমন না পাওয়ায় মাতৃস্নেহের শান্তি তিনি ধারণ করেছিলেন মাদার তেরেসার ছবি এঁকে। কারণ মাদার তেরেসা ছিলেন তাঁর কাছে মাতৃত্বের প্রতীক।

১৯৪০ এ যখন ফ্যান্টাসি ফার্নিচার শপে কাজ করছিলেন তখন তিনি বেশ কিছু খেলনা বানিয়েছিলেন। সেই খেলনাগুলোর কয়েকটিকে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর পরবর্তী জীবনে আঁকা (মৃদংগ) চিত্রকর্মগুলোতে।

২০০৪ এ বানিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘মিনাক্ষী: এ টেইল অফ থ্রি সিটিজ’। তাঁর আর একটি সিনেমা ‘থ্রু দ্যা আইস অফ এ পেইন্টার’ ১৯৬৭ সালে বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জিতে নেয় ‘দ্যা গোল্ডেন বিয়ার’।

সিনেমা নিয়ে তার মুগ্ধতা ছিল আজীবন। সেই মুগ্ধতা থেকে ২০০৪ এ বানিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘মিনাক্ষী: এ টেইল অফ থ্রি সিটিজ’। তাঁর আর একটি সিনেমা ‘থ্রু দ্যা আইস অফ এ পেইন্টার’ ১৯৬৭ সালে বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জিতে নেয় ‘দ্যা গোল্ডেন বিয়ার’।

১৯৪০-৫০ এর দিকে তিনি ভারতীয় ক্ষুদ্রশিল্প, চীনা ক্যালিগ্রাফি এবং অনেক পাশ্চাত্য শিল্পীদের সংস্পর্শে আসেন। এই সময়ের আঁকা ‘ম্যান এন্ড জমিন’ এ তিনি মানুষের সাথে মাটির ও সংস্কৃতির সম্পর্ক তুলে ধরেন। ১৯৪৭ সালে আঁকেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘প্যাসেজ অফ টাইম’। চাইনিজ কালজয়ী শিল্পী চি পাই শিহ এর অণুপ্রেরণায় ভারতবর্ষে প্রথম ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন ঘোড়ার আদল।


Passage of Time

ফিদা হুসেনের আঁকা ‘প্যাসেজ অব টাইম’


ভারতের সাধারণ মানুষকে বুঝতে ও তাদের সাথে মিশতে হুসেন রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্য আঁকা শুরু করেন। তাঁর রামায়ণ সিরিজটি ১৯৬৮ সালে সমগ্র ভারতবর্ষে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। গ্যালারিতে গিয়ে চিত্রকর্ম দেখার সুযোগ যারা কখনো পায় না তাদের জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭১ এ তিনি মহাভারত আঁকা শুরু করেন। বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে তিনি মহাভারতের ঐতিহাসিক পটভূমিকে গতিময়ভাবে তুলে ধরেন।

১৯৬৭ সালে তিনি কেরালার নাম্বুথিরি ব্রাহ্মণদের নিয়ে আঁকেন তাঁর কেরালা সিরিজ। মানুষকে ভেতর থেকে বোঝার যে আপ্রাণ চেষ্টা তিনি আজীবন করেছেন তারই এক অংশ ছিল এই কেরালা সিরিজ।


Kerala

তাঁর ‘কেরালা সিরিজ’-এর একটি পেইন্টিং


হুসেনের মিশর ভ্রমণের কারণে এই সময়ে তাঁর ছবিতে ফুটে ওঠে দিমাত্রিক মিশরীয় শিল্প। তারই ফলাফল হিসেবে বিশ্ব পায় হুসেনের বিখ্যাত ‘বিটউইন দ্যা স্পাইডার এন্ড ল্যাম্প সিরিজ’। যেহেতু তিনি তাঁর ভ্রমণ থেকে অনেককিছুই শিখতেন, বিভিন্ন ছবিতে নিজের নামও লিখতেন হিন্দি, মারাঠি, বাংলা, মালায়লাম এসব ভাষায়।

১৯৬০ সালে তিনি রামকুমারের সাথে ভ্রমণ করেন ঐতিহ্যের শহর বেনারসে। তাঁরা দুজনেই বেনারসের সৌন্দর্য্য, লোকভর্তি ঘাটগুলো দেখে অণুপ্রাণিত হন যা পরবর্তীতে প্রতিফলিত হয় দুজনের শিল্পকর্মে। বেনারসে গিয়েই হুসেন সিদ্বান্ত নেন তিনি লোকের কথায় আর কান দেবেন না। নিজের যা পছন্দ তাই আঁকবেন এখন থেকে। সমালোচনায় ভরপুর এক বছরে এমনই এক সিদ্বান্ত নেওয়ার দরকার ছিল তাঁর। ‘চিত্রকর হিসেবে হুসেনের দিন শেষ’, ‘জমিন’ এর অধিকাংশই বাইরের চিত্রকর্ম থেকে ধার করা’, ‘এসব বিদেশী ম্যগাজিন থেকে দেখে আঁকা’ গণমাধ্যমে এমন কথাই চলছিল তাকে নিয়ে।


Mahabharata 2

এম এফ হুসেনের আঁকা বিখ্যাত ‘মহাভারত সিরিজে’র একটি পেইন্টিং


হুসেন রাজনীতি বিমুখ ছিলেন এমন কথাও তাকে নিয়ে বলা যায় না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ইন্দিরা গান্ধীর পোর্ট্রেট অথবা গালফ ওয়ার নিয়ে করা স্কেচ দেখে। ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে দেশে বিদেশে মন্তব্য করতে তিনি কখনোই পিছপা হননি। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ নিয়ে তাঁর মতামত স্থান পেয়েছে ইন্সটলেশন পিস ‘থিয়েটার অফ দ্যা এবসার্ড’-এ। রাজনীতির মতো, প্রাকৃতিক দূর্যোগও যে তাঁর ভাবনার জগতকে আন্দোলিত করত তারও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৭ এ অন্ধ্র প্রদেশের সাইক্লোন দেখে আঁকা ‘সাইক্লোনিক সাইলেন্সে’।

তাঁর ইন্দিরা গান্ধীর পোর্ট্রেট অথবা গালফ ওয়ার নিয়ে করা স্কেচ দেখে। ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে দেশে বিদেশে মন্তব্য করতে তিনি কখনোই পিছপা হননি। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ নিয়ে তাঁর মতামত স্থান পেয়েছে ইন্সটলেশন পিস ‘থিয়েটার অফ দ্যা এবসার্ড’-এ।

বেঁচে থাকা অবস্থাতেই হুসেন পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ। ২০১১ সালের ৯ জুন লন্ডনে মারা যাওয়ার আগে প্রায় পাঁচ বছর তাকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটাতে হয় হিন্দু আতংকবাদীদের রোষানলে পড়ে। দেশে ফেরার অনেক ইচ্ছা থাকলেও দেশে আর তাঁর ফেরা হয়নি।

আজীবন হুসেন তাঁর চিত্রে শুধু ভারতের ঐতিহ্যই নয় তুলে ধরেছেন ভারতের মানুষকে। হোক সে কৃষক, গায়ক, নৃত্যকার, দার্শনিক, সকলেই স্থান পেয়েছে তাঁর চিত্রকর্মে। তাই হয়তো ইব্রাহিম আলকাজি ২০১১ সালে বলেন ‘গত ৬০ বছর ধরে হুসেন ভারতের ঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন এবং এমনভাবে তা নিজের চিত্রে তুলে ধরেছেন যাতে মানুষকে তাঁর শিল্প ভাবিয়ে তোলে’।

আজীবন হুসেন এমনভাবে ভারতের মানুষ ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এই পুরো দেশটাই এক উম্মুক্ত জাদুঘর।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু আগ্রহ এবং প্যাশন সিনেমাকে কেন্দ্র করে। সিনেমা নির্মাতা হবার উদ্দেশ্যে সে একাধিক শর্টফিল্ম তৈরি করেছে। সিনেমা নির্মানের পাশাপাশি লেখালেখিতে আগ্রহী। প্রকাশিত অনুবাদের বই রিচার্ড ফাইনম্যানের লেখা ‘সিক্স ইজি পিসেস’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।