শনিবার, জুলাই ২৭

‘প্রকাশনায় প্রফেশনালিজম সেই অর্থে আমাদের এখানে গড়ে ওঠেনি’ : আলী আফজাল খান

0

Ali Afzal Khanলিটল ম্যাগাজিনের জগতে প্রায় ২২ বছর ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন কবি, সম্পাদক ও গবেষক আলী আফজাল খান। ২০০১ সালে তার সম্পাদনায় যাত্রা শুরু করে ‘ভিন্নচোখ’। এ দীর্ঘপথ খুব সহজ-সরল ছিল না। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান নির্মাণ করেছে পত্রিকাটি। ভিন্নচোখের বিষয় বৈচিত্র্যে বরাবরই থাকে ভিন্নতার ছোঁয়া। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাবিশ্ব কবিতা সংখ্যা–মার্চ ২০২১’। ভিন্নচোখের এই সংখ্যায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ১০০ কবির সৃষ্টিকর্ম স্থান পেয়েছে। একহাতে পুরো সম্পাদনার দায়ভার সামলেছেন আলী আফজাল খান। ভিন্নচোখের গড়ে উঠার ইতিহাস, কর্মপদ্ধতি, সমসাময়িক সাহিত্যচর্চাসহবিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লাবণী মণ্ডল


প্রশ্ন : ভিন্নচোখ কখন, কীভাবে শুরু হয়–এর আদি ইতিহাসটা জানতে চাই।

আলী আফজাল খান : আমার সম্পাদনায় ক্রিয়েটিভ লিটলম্যাগ ভিন্নচোখের প্রথম সংখ্যা বের হয় ২০০১ সালে। আমাদের বন্ধু এবং পরিচিতদের একটা সার্কেলের মতো ছিল যারা লেখালেখি করতাম টুকটাক, কেউ কেউ ছবি আঁকতো, কেউ আবার চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত। মাঝে মাঝে গ্রুপ স্টাডিও করতাম আমরা নানান বিষয়ে, নানান জায়গার পাঠচক্রেও যাইতাম। আমাদের একটা সময় মনে হয় যে আমরা একটু ভিন্নভাবে ভাবি, ঠিক সবার মতো না আমরা। তো আমরা নিজেদের লেখালেখি এবং চিন্তা প্রকাশের একটা প্লাটফর্ম তৈরির ভাবনা থেকেই আসলে ভিন্নচোখ প্রথম প্রকাশ করি। নিজেদের লেখার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত পরিচিত এবং আমাদের মতো যারা চিন্তা করে তাদের লেখাও জোগাড় করতাম প্রকাশের জন্য।

বাংলাদেশের কবিতা সংখ্যা

বাংলাদেশের কবিতা সংখ্যা কভার, শিল্পী এস এম সুলতান

প্রথম সংখ্যা ট্যাবলয়েড আকারে ছিল, নিউজপ্রিন্টে। তখন আমি এবং টিম ভিন্নচোখের সবাই স্টুডেন্ট। এখনকার মতো এত পরিকল্পিত সংখ্যা ছিল না সেটা, তবে নতুন চিন্তার ছাপ ঠিকই ছিল বলে মনে হয়। সব ধরনের লেখাই ছাপা হচ্ছিল তখন ভিন্নচোখে, তবে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন এবং সমসাময়িক বিষয়গুলো আমরা শুরু থেকেই রাখতাম। পোস্টমডার্ন ভাবুকদের প্রচুর অনুবাদ তখন ছাপা হয়েছে ভিন্নচোখে, নতুন লেখকদের প্রচুর লেখাও। আর বোধনের পর থেকেই ভিন্নচোখের সাথে শিল্পীদের একটা নিবিড় সম্পর্ক বরাবর। খুব অল্প সংখ্যক বিজ্ঞাপন আর বন্ধুদের চাঁদা দিয়েই মূলত: সংখ্যা বের করতাম তখন। এখনও কারও কারও কাছে এসব পুরনো সংখ্যা আছে, মাঝে মাঝে ফোন পাই বা ইনবক্স করেন কেউ কেউ। জানতে চান এই ভিন্নচোখ সেই ভিন্নচোখ কি না। প্রথম সংখ্যার পর থেকেই ভিন্নচোখ ম্যাগাজিন সাইজে বের হচ্ছে।

২০০৪ সাল পর্যন্ত নিউজপ্রিন্টেই প্রকাশ হয়েছে, তারপর তো ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভিন্নচোখের কার্যক্রম বন্ধই ছিল, দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ২০১৩ সালে, ’১৪ সালে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের কবিতা সংখ্যা। শুরুতে যারা কাজ করতো তাদের অধিকাংশ এখন আর নাই, দেবাশীষ সিকদার দেবু আর নকিব বিয়াই এখনও আছে। বাকিদের কেউ কেউ মানসিকভাবে থাকলেও সময় দিতে পারে না আগের মতো।

শুরুর কথা বললে আরও একটু যোগ করা দরকার। ভিন্নচোখ আসলে একটা নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন, কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান না। লিটলম্যাগ ছাড়াও ভিন্নচোখের আরও কয়েকটা উইংস আছে। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতা বহু আগে থেকে ছিল আমাদের, বলছি একটু আগে, ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে ভিন্নচোখ সিনে সার্কেল, ২০১৫ সালে প্রকাশনা শুরু করে ভিন্নচোখ, বাংলাদেশ এবং ভারতের শিল্পীদের চিত্রপ্রদর্শনী দিয়ে ২০১৮তে প্রথম ইভেন্টস।

 

প্রশ্ন : আমরা অনেকেই জানি, ভিন্নচোখ শুরুর পর চিন্তাশীল মহলে বেশ সাড়া পড়েছিল; কিন্তু একটা বড়ো সময় এর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এমন চিন্তাশীল উদ্যোগগুলো হাঁটতে চলা শুরু করলেই হোঁচট খেতে দেখা যায়। এর কারণ কী?

আলী আফজাল খান : বলা হয় যে লিটলম্যাগের জন্মই হয় মরার জন্য। সুনির্দিষ্ট কারণ এভাবে বলা কঠিন, নানান সময়ে নানান কারণে এটা হয়। সাধারণত দেখা যায় লিটলম্যাগগুলার সম্পাদকই থাকেন কাণ্ডারি, তার মৃত্যু বা অনীহা বা ব্যস্ততা ম্যাগটির পথ চলা থামিয়ে দেয়, আবার প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো আর্থিক এবং অন্যান্য সক্ষমতাও থাকে না বলে টাকা পয়সার অভাবে বন্ধ হওয়াও কম বড়ো কারণ নয়। এছাড়া নির্দিষ্ট গ্রুপকেন্দ্রিক লিটলম্যাগগুলো অনেক সময় নিজেদের অন্তর্কলহেও ভেঙে যায়। ভিন্নচোখ বন্ধ ছিল আমার ব্যক্তিগত কারণে, এই সময়টায় আমি সাহিত্য জগত থেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলাম।

 

প্রশ্ন : পুনরায় প্রকাশনা শুরু করতে ও টিকিয়ে রাখতে কোন কোন সীমাবদ্ধতা বা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে?

আলী আফজাল খান : ভিন্নচোখের সেকেন্ড ফেজ যখন শুরু করি তখন আমি একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সিইও এবং প্রায় ৭/৮ বছর সাহিত্য জগতের সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, পুরান বন্ধু বা পরিচিত যারা ছিল তাদের সাথেও ততটা যোগাযোগ নাই আর। আর এমন একটা সংখ্যার কাজে হাত দিলাম যেটা কাজ হিসেবে অনেক বড়ো, বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে এত বড়ো কাজ আমি দেখি নাই। কাজেই বাধা তো কিছু ছিলই, প্রধান বাধা হিসেবে দাঁড়াইলো আমার সাহিত্যিক বন্ধুরাই যাদের আমি লিস্টে নেই নাই, তারা সিন্ডিকেট তৈরি করল যেন আমি সংখ্যাটা প্রকাশ করতে না পারি।


বাংলাবিশ্ব কবিতা সংখ্যা

আলী আফজাল খান সম্পাদিত বাংলাবিশ্ব কবিতা সংখ্যা


সিনিয়রদের বলছে যেন লেখা না দেয়, আবার আমার লিস্টে যারা ছিল তাদের অনেককে তাদের গ্রুপে ভিড়াইছে, লেখা দিতে চেয়ে পরে তারা লেখা দেয় নাই, কেউ কেউ তাদের কর্মস্থলের প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছে এই সংখ্যা প্রতিরোধে, কেউ গল্প লিখছে আমি না কি বাঘডাশ, ঢাকার শিল্প সাহিত্যজগত প্রায় দুইভাগ, খুবই আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা সেটা। এসবের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ ছিল এত বড়ো একটা কাজের টাকা ম্যানেজ করা, শিল্পীদের কাছ থেকে ছবি পাওয়া এসব নানান বিষয। টিম ভিন্নচোখের সবাই এবং বন্ধু-সুহৃদ ছাড়াও বিশেষভাবে শিল্পী উত্তম ঘোষ, শিল্পী চারু পিন্টু, শিল্পী বিকাশ আনন্দ সেতু এবং আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ভাইয়ের এই সময়ের আন্তরিক সহযোগিতা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

 

প্রশ্ন : ভিন্নচোখের বর্তমান সংখ্যাটি ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’, যা ভিন্নচোখের ২০ বছর পূর্তি সংখ্যা। এখানে ১০০ কবির কর্মযজ্ঞ স্থান পেয়েছে। এ বিশাল কাজের চিন্তাটা কোত্থেকে এলো। এত বড়ো পরিসরের একটি কাজ কী করে সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করলেন?

আলী আফজাল খান : বাংলাদেশের ৪০ জন প্রতিনিধিত্বশীল জীবিত কবি নিয়ে ২০১৪ সালের বইমেলায় ভিন্নচোখ প্রকাশ করে ‘বাংলাদেশের কবিতাসংখ্যা’। তখন থেকেই পরিকল্পনা ছিল ভারত ও বাংলাদেশের কবিদের নিয়ে ইংরেজি অনুবাদসহ আরেকটা সংখ্যা করার। ২০১৪ সালের বইমেলার পর ভারতের কবি প্রবাল কুমার বসুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। প্রবালদা বাংলাদেশের কবিতাসংখ্যা দেখে চমকে ওঠেন। দুই বাংলা মিলিয়ে একটা সংখ্যা করার প্রস্তাব দেন। কেন তিনি সংখ্যাটা দেখে চমকে উঠেছিলেন, তা বুঝতে পারি ২০১৮ সালে যখন আমি কলকাতায় তাঁর যাপনচিত্র অফিসে যাই, আর তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘Signposts’ সংকলনটি দেন। কৌতূহলী পাঠকও সহজে বুঝবেন, দুটি সংকলন হাতে নিলে দুই ভূগোলে দুই পরস্পরবিচ্ছিন্ন সম্পাদক কতটা চিন্তার কাছাকাছি। প্রবালদাকে প্রস্তাব দিই প্রজেক্ট শুরু করার। ২০১৯ সাল থেকে আসলে ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’র কাজ শুরু হয়।

এই সংখ্যা ভিন্নচোখের ২০ বছর পূর্তি সংখ্যা। বাংলা ভাষার জীবিত প্রতিনিধিত্বশীল কবি যাঁদের আছে বাংলা কবিতায় নিজস্ব কণ্ঠস্বর ও স্বাক্ষর, তাঁদের মধ্যে ১০০ জন কবির জীবনী, কবিতাভাবনা ও একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’। এ সংকলনের কালসীমা আমরা নির্ধারণ করছি শূন্য দশক পর্যন্ত। কারণ, এর পরবর্তী সময়ের কবিতা এখনো আকার পাওয়ার পথে। যুগলবন্দিতে কবিদের পোর্ট্রেট আঁকছেন ৬টি দেশের বরেণ্য ৭৫ জন চিত্রশিল্পী। অধিকাংশ কবিই তাঁদের স্বনির্বাচিত সেরা/পছন্দের কবিতাগুলো দিয়েছেন, অগ্রজদের কেউ কেউ সময় দিতে পারেননি, অনুমতিক্রমে তাঁদের কবিতাসমগ্র বা শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে কবিতা বেছে নেওয়া হয়েছে। অনেকে সময়ের অভাবে, আবার কেউ কেউ মনে করেন, তাঁদের কবিতাই কবিতাভাবনা, তাঁরা কবিতাভাবনা পাঠাননি।

তিন বছর প্রায় ৫০০ মানুষের সঙ্গে এই সংখ্যা করতে গিয়ে যোগাযোগ করতে হইছে। ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’দেখছেন বলে বা ভিন্নচোখ সম্পর্কে জানেন বলে বাংলাদেশের কবিদের লেখা সংগ্রহ ততটা জটিল ছিল না। তার মধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল, যেমন অসীম কুমার দাস, উনি এখন সমস্ত যোগাযোগের বাইরে। ফলে তার লেখা সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট করতে হইছে, কবি সরকার মাসুদ ভাই এবং বেঞ্জামিন নিয়াজী ভাই হেল্প করছেন তার অনুমতি নেওয়া এবং লেখা সংগ্রহে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে তাকে আমি কখনও দেখি নাই বা তার সঙ্গে কথাও বলি নাই কখনও। আর ভারতের কবিদের লেখা সংগ্রহ আসলে সম্ভব হইছে কিছু মানুষের সহযোগিতা আর ইন্টারনেটের কারণে। তারা তো আর ভিন্নচোখ দেখে নাই বা ভিন্নচোখ সম্পর্কে জানেও না, ফলে মূল কষ্টটা হইছে এইসব লেখা সংগ্রহ করতে। আর বলা যায় না এমন নানান বিষয় তো থাকেই। আমি হয়তো সর্বাংশে নিখুঁত হইতে পারি নাই, তবে চেষ্টা করছি সর্বোচ্চ, সৎ ছিলাম নিজের কাছে। খাঁদ ছাড়া কিন্তু গয়না হয় না, বাস্তবে কাজটা শেষ করতে চাইলে আসলে খাঁদ কিছু থাকে। এই সংখ্যায় অনেক কবি আছেন যারা মেইনস্ট্রিমের না, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ছিল না, অনেক ক্ষেত্রে তিন চার ধাপ অনুসরণ করতে হইছে। দেবদাস আচার্যের বাসায় নিজে গিয়ে লেখা নিয়া আসছেন কবি ও সম্পাদক রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সেই লেখা মোবাইলে ছবি তুলে আমাকে পাঠাইছেন। আবার নির্মল হালদার শুধু হোয়াটস আপ নাম্বার ব্যবহার করেন, কবি মৃন্ময় ভৌমিক ওখানকার ডিরেক্টরি থেকে তার নাম্বার সংগ্রহ করে আমাকে দিছে, আমি তার সাথে যোগাযোগ করছি। একেকটা যোগাযোগ একেকটা কাহিনী আসলে, দুই একটা বললাম বুঝার জন্য।

এতগুলা পোট্রের্ট করা ছিল এই সংখ্যার প্রধান একটা চ্যালেঞ্জ। প্রথম যখন ভিন্নচোখের শিল্প সম্পাদক সেতুকে বলি এই সংখ্যার শিল্প পরিকল্পনা, একশ পোর্ট্রেট শিল্পীদের দিয়ে করানো সেতুর কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে। সখী অনন্যা তখন পাশে না দাঁড়ালে এই প্রজেক্ট আলোর মুখ দেখত কি না আমার ঘোর সন্দেহ ছিল। অনন্যা সাহস দিয়েছে, সে একাই সব পোর্ট্রেট করে দেবে, বেশ কিছু পোর্ট্রেট সে একের পর এক করে ফেলার পর আমার আর সেতুর মনে উদ্যম ও সাহস আসে সম্ভব। শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি, তাদের আন্তরিক সহযোগিতা এবং ভালোবাসায় একশ কবিরই পোর্ট্রেট শেষ করতে পারি আমরা। কলকাতার কবিদের সঙ্গে প্রথম দিকের যোগাযোগেও অনন্যা হেল্প করেছে। কবি প্রবাল কুমার বসু সিনিয়র কবিদের অনেকের লেখা নিজে সংগ্রহ করে পাঠাইছেন, যখনই যেটা সাহায্য চাইছি আন্তরিকভাবে সেগুলা করছেন। এক কথায় বলি, এত বড়ো একটা কাজ আসলে বহু মানুষের ভালোবাসার যৌথ খামার।

 

প্রশ্ন : এখানে যে কবিদের নাম রয়েছে, তা নির্ধারণ করলেন কীভাবে। এর কোনো মানদণ্ড ছিল কি না, অথবা এ নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে কি না?

আলী আফজাল খান : বাংলা ভাষার জীবিত প্রতিনিধিত্বশীল কবি যাদের আছে বাংলা কবিতায় নিজস্ব কন্ঠস্বর ও স্বাক্ষর তাদের মধ্যে থেকে বাংলাদেশের ৫০জন এবং ভারতের ৫০জন নিয়ে এই বাংলাবিশ্ব কবিতা সংখ্যা। উপদেষ্টা সম্পাদক, সহসম্পাদক এবং অগ্রজ কবিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন পরামর্শ দিছেন, তবে চূড়ান্ত অর্থে সম্পাদক হিসেবে এর দায় আমারই। মৃত কোনো কবি এই সংকলনে নাই এবং শূন্য দশকের পর যারা লিখতে আসছে তাদের এই নির্বাচনে বিবেচনা করা হয়নি।

জগতের কোনো সংকলনই নিখুঁত বা সবার মন অনুয়ায়ী হয় না, কাজেই বিতর্ক তো থাকবেই। তালিকা সমালোচনা করে অনেকে ফেসবুকে স্টাটাস দিছেন, কেউ গল্প লিখছেন আবার কেউ লিখছেন কবিতা। কেউ প্রকাশ্য সমালোচনা করছেন আবার কেউ গোপনে। এখানকার মূল সমস্যা আমার মনে হয় পরশ্রীকাতরতা। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী সুন্দর করে বাঙালিকে ব্যাখ্যা করছেন, আমরা হইতেছি কচ্ছপের জাতি, কেউ উপরে উঠতেছে দেখলে পেছন থেকে সবাই তারে টেনে ফেলে দেই, ভালো কাজের প্রশংসা করতে জানি না, এত গরিব আমরা।

 

প্রশ্ন : এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের পর বিভিন্ন মহল থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?

আলী আফজাল খান : যত বড়ো কাজ প্রতিক্রিয়া আসলে সে অর্থে পাই নাই। বইমেলা চলাকালীন সময়েই বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, আর মেলা চলাকালীন শয়ে শয়ে মিডিয়া থাকে সেখানে, হাজার হাজার মিডিয়া কনটেন্ট উৎপাদন করে তারা, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার পর বাংলা কবিতার সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ভিন্নচোখের ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’, সেটা নিয়ে কোথাও কোনো আওয়াজ নাই।

দৈনিক সংবাদ আর জনকন্ঠ দুইটা রিভিউ করছে, সাম্প্রতিক দেশকাল আমার একটা ইন্টারভিউ ছাপছে, বাংলা নিউজ ২৪ ডট কম নিউজ এক্সক্লসিভ ইন্টারভিউ আর নিউজ করছে আর কিছু অনলাইন ম্যাগাজিন-এই তো। পাশাপাশি ফেসবুকে বা ইনবক্সে অনেকে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাইছেন।


আলী আফজাল খান

ভিন্নচোখের অফিসে লেখক-পাঠকের সঙ্গে আড্ডারত আলী আফজাল খান


প্রশ্ন : ভিন্নচোখ ও আপনার সম্পাদকীয় নীতি সম্পর্কে জানতে চাই।

আলী আফজাল খান : সেই অর্থে কোনো বিশেষ মতকে সমর্থন করে না ভিন্নচোখ, তবে টিম ভিন্নচোখের আমরা সবাই স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া জেনারেশন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী কোনো কিছুকে আমরা সমর্থন করি না এবং যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী তাদের কাছ থেকেও দূরে থাকতে চাই। যেমন ধরেন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের ৪০জন জীবিত কবিকে নিয়ে ভিন্নচোখ প্রকাশকরে ‘বাংলাদেশের কবিতাসংখ্যা’, তখন আল মাহমুদ জীবিত, কিন্তু এই সংখ্যায় ভিন্নচোখ আল মাহমুদকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। এছাড়া মত বা পথ তো আসলে সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল, সেসবে স্থির ঈমান রাখা মুশকিল।

লেখা আহ্বান করলাম, সবাই গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ পাঠাইলো আর সেগুলো কম্পাইল করে, সাথে দু’একজন সিনিয়রের লেখা জোগাড় করে একটা পত্রিকা প্রকাশ করে ফেললাম, ভিন্নচোখের যে কোনো সংখ্যা দেখলেই বুঝবেন এসব থেকে একদম আলাদা ভিন্নচোখ। প্রতিটি সংখ্যার লেখা আমন্ত্রিত, সংখ্যার প্রয়োজনে লেখকদের দিয়ে লেখা তৈরি করাও। ভাষা সংখ্যার লিড আর্টিক্যাল লিখেছিলেন সলিমুল্লাহ খান, তো এই লেখার জন্য টানা ছয় মাস উনার পেছনে লেগে থাকতে হয়েছে আমাকে, সাক্ষাৎকার সংখ্যায় প্রকাশিত গায়ত্রী স্পিভাকের সাক্ষাৎকার অনুবাদের জন্য কবি জুয়েল মাজহারকে টানা ৪ মাস জ্বালাইছি রাত-দিন। বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা টানা তিন বছর কাজ করে শেষ করলাম, প্রায় ২০০ কন্ট্রিবিউটর ছাড়াও এই সংখ্যা করতে গিয়ে প্রায় ৫০০ মানুষের সাথে আমার কাজ করতে হয়েছে। অপরিসীম প্রেম এবং ধৈর্য না থাকলে এগুলো আসলে অসম্ভব, আর মাথাটাও-তো ভিন্নই, সেকেন্ড কপি পাবেন না।

 

প্রশ্ন : ভিন্নচোখকে অনলাইনে আনার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

আলী আফজাল খান : আছে। সম্পূরক হিসেবে প্রিন্ট মিডিয়ার। প্রতিস্থাপন করে নয়। কারণ ভিন্নচোখ ইতিহাস প্রকাশ করে সংবাদ নয়। একটা ওয়েব সাইট আপনি লম্বা সময়ের জন্য কিনতে পারবেন না, এটা অনলাইনের সীমাবদ্ধতা। আমি না থাকলেও প্রিন্ট মিডিয়ার কাজ থেকে যাবে, কিন্তু অনলাইনে সেটা সম্ভব না, বছর বছর সাইট রিনিউ করতে হয়।

 

প্রশ্ন : সাহিত্যচর্চায় ভিন্নচোখের ভূমিকাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আলী আফজাল খান: সাম্প্রতিককালে ভিন্নচোখ হয়ে উঠছে বাংলা ভাষায় একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের পত্রিকা, একই কাতারে দাঁড়াতে পারবে এমন আর একটা পত্রিকাও আপনি দেখাতে পারবেন না। ফলে অনুসরণকারী বলেন আর অনুকরণকারী বলেন এসব তো কিছু তৈরি হয়েছেই। কেউ কেউ ভিন্নচোখের মতোই সংখ্যা করার চেষ্টা করছেন। প্রজন্মের কবিতাসংখ্যা যখন করি বেশ কয়েকটি লিটলম্যাগ একইভাবে তরুণদের নিয়ে সংখ্যা করেছে, বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যার মতো একশ কবি নিয়ে কেউ কেউ কাজ করছে, ভাষা সংখ্যা আরও অনেকেই করছে। তারা এগুলো ঈর্ষায় করুক আর প্রতিযোগিতা করে করুক বা আইডিয়া চুরি কইরা করুক, সে যাইহোক, এগুলো পজিটিভ ইমপ্যাক্ট বা প্রতিচর্চা বলতে পারেন।

সাহিত্য চর্চায় ভিন্নচোখ কী ভূমিকা রাখছে সেটা আসলে সময় বলবে; তবে দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি আমি। উন্নয়ন, উন্নয়ন বলে এখন আপনারা অনেক চিৎকার, চিল্লাচিল্লি শুনেন। এটা শুরু হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর, মানে ২০০৯ সালের পরের ঘটনা। অথচ ভিন্নচোখ ২০০৪ সালে যে সংখ্যা করছে সেটা ছিল ‘উন্নয়ন ও রাজনীতির সংলাপ’নিয়ে। সংখ্যাটা পড়লেই আপনি বুঝবেন এইসব আলাপ আরও ২০/৩০ বছর প্রাসঙ্গিক থাকবে। ২০১৭ সালে অনুর্ধ্ব ৩০ বছরের ৫০ জন প্রতিশ্রুতিশীল কবিকে নিয়ে হয়েছে ‘প্রজন্মের কবিতাসংখ্যা’। ধারণা করি বাংলাদেশের কবিতাজগৎ আগামী সময়ে এরাই দাপিয়ে বেড়াবে। আর বর্তমান ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’তো আগামী একশ বছর কবিতাপ্রেমীদের আশ্রয় হয়ে থাকবে বলে আমি মনে করি।

 

প্রশ্ন : ইদানীং অনেকেই প্রশ্ন তোলেন–অনলাইনের কারণে না কি সাহিত্যচর্চা ব্যাহত হচ্ছে। অনেকে ফেসবুকের পোস্ট থেকে বই ছাপাচ্ছেন। মানহীন বইয়ে সয়লাব প্রকাশনাসংস্থাগুলো। এ বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখেন?

আলী আফজাল খান : আমার মতে অনলাইনের কারণে বরং সাহিত্যচর্চা গতি লাভ করছে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি, ব্যাহত হচ্ছে বলে আমি মনে করি না। এই যে ভিন্নচোখ বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা করলো এটা এই অনলাইনের কারণে অনেকখানি সহজ হয়েছে, বিভিন্ন ভূগোলে বসবাসকারী মানুষকে নিয়ে এই কাজ তিন বছরে শেষ করতে পারছি, অনলাইনে সাহিত্যচর্চা না হলে আমি এক যুগেও শেষ করতে পারতাম কি না সন্দেহ আছে। ইন্টারনেটের কারণে সীমান্তের কাঁটা তো তুচ্ছ মনে হয়েছে, কবি নির্বাচনের প্রচলিত ছাঁচ ও চাক ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারছি ফেসবুকের কল্যাণে, আর নানান দেশে থাকা কবি এবং শিল্পীদের সঙ্গে সংযোগ অসম্ভব ছিল ইন্টারনেট ছাড়া।

আমার মনে হয় বাংলা ভাষায় আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষকে লেখালেখি করতে দেখি, অন্য কোনোভাবেই সেটা সম্ভব ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলো আগে যেখানে প্রান্তবর্তী তরুণ লেখকদের জিম্মি করে রাখতো সেটা এখন আর পারে না, প্রতিভা থাকলে সে ঠিকই পাঠক পেয়ে যাচ্ছে। এখন আপনি যেটা বললেন ফেসবুক পোস্ট থেকে বই ছাপছেন, কথা সত্য। মানুষ আর আগের মতো কাগজে লিখছে না, সময়ের সঙ্গে এসব পরিবর্তন আসবেই। আগে তো মানুষ কাগজেও লিখতো না, এমন একটা সময়ও তো ছিল। আর আপনি মানের কথা যদি বলেন, সেটা আস্তে আস্তে তৈরি হবে। প্রকাশনা যখন শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে এদেশে, পেশাদারিত্বের খাতিরে বা ভালো করতে হলে তাকে সেটা করতেই হবে এক সময়। গাঁদ কখনও টিকে থাকে না, ভালো বই, ভালো প্রকাশকরাই টিকে থাকবে।

 

প্রশ্ন : সম্প্রতি স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকেও সম্পাদনা ছাড়া, আবার কোনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রুফ দেখা ছাড়াই বই প্রকাশিত হচ্ছে। একজন সম্পাদক, লেখক, কবি হিসেবে বই সম্পাদনার গুরুত্ব কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আলী আফজাল খান : প্রকাশনায় প্রফেশনালিজম সেই অর্থে আমাদের এখানে গড়ে উঠেনি। এটার মূল কারণ আসলে পুঁজি। ইন্ড্রাস্ট্রি হিসেবে প্রকাশনা দাঁড়ালে তখন এসব আর থাকতো না, তবে বড়ো প্রকাশনীগুলো যাদের বড়ো ইনভেস্টমেন্ট আছে তারা সম্পাদনা বা প্রুফ দেখা ছাড়া মানহীন বই করছে একথা সত্য না, এমনকি ছোটো ছোটো প্রকাশনীগুলোও যারা সিরিয়াস কাজ করছে বা দীর্ঘদিন প্রকাশনায় থাকতে চায় তারাও না। বলতে পারেন কিছু ভুঁইফোড় প্রকাশনী এমন করতেছে, এগুলো সব যুগেই থাকে আবার হারিয়েও যায়।

 

প্রশ্ন : এ সময়ে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখছি–সাহিত্যের নামে এক রকম তোষণ চলে, পদক-পুরস্কার-সম্মাননা বিক্রি হয়ে যায়, অথবা আটকে যায় আমলাতন্ত্রে। ৯০-পরবর্তী সময়কালে সাহিত্য আন্দোলন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, যার প্রভাব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভয়াবহভাবে প্রত্যক্ষ করছি। সামগ্রিকভাবে এ সময়টাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আলী আফজাল খান : শেয়ালের কুমির ছানা দেখানোর মতো কিছু নির্দিষ্ট চেনামুখই আমরা পুরস্কারের মঞ্চে দেখতেছি, এরা নিজেরাই একটা সিন্ডিকেট কইরা নিছে একথা সত্য। আবার দেখতেছি মৌলবাদী ভাবাপন্ন কিছু সাহিত্যিক ভারত থেকে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি বেশি সম্মানিত হইতেছেন, যোগাযোগ আর টাকা পয়সা ছাড়া এসব হইতেছে এ কথা বলা যাবে না। তবে ৯০-পরবর্তী সময়কালে সাহিত্য আন্দোলন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, যার প্রভাব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভয়াবহভাবে প্রত্যক্ষ করছি–আপনার একথার সাথে আমি একমত না।

গত দুই দশকে যে পরিবর্তনগুলো ঘটেছে তা গত দুইশ বছরেও ঘটেনি আসলে, আমি বলছি সাম্প্রতিক সময়ে পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। বন্ধুদের আমি প্রায়ই বলি, আসলে আমরা একটা ট্রানজিশন জেনারেশন, এনালগ থেকে ডিজিটালের ট্রানজিশন পিরিয়ডটার সাহিত্যিক আমরা।আমরা সাহিত্যচর্চা শুরু করছিলাম পাঠচক্র দিয়ে, নিয়মিত আজিজে যেতাম তখন, নানা পাঠচক্রের তৎপরতা ছিল নতুনকে জানার, অনেক হিউম্যান ইন্টার্যা্কশন ছিল তখন। এগুলো এখন ফেসবুক গ্রুপে পরিণত হয়েছে, ইন্টার্যা্কশনগুলো ইমোতে পরিণত হয়েছে। সবকিছুই এখন খুব ভোলাটাইল, ভাসা ভাসা, গভীরেগেলে কিছু পাবেন না আপনি, আমি বলি কাগুজে বাঘ। সোশ্যাল মিডিয়ার বিশাল বাঘটারে বাস্তবে দেখলে বুঝবেন সেটা আসলে একটা মেনী বিলাই। কাজ না করেই কথার বাহাদুরি, পরিচিতি সিন্ডিকেট এসব দিয়ে মিডিয়াতে নিজেকে ফুলায়া এমন বড়ো করে যেন অলঙ্ঘ্য পাহাড় মনে হয়। এগুলো আসলে বেলুন, কাজের সুঁচ পড়লেই ফাইটা আকাশে উড়াল দেয়। কথা বেশি বলা আমার স্বভাবেই নাই, নিজের কাজ দিয়েই পরিচয় দিতে পছন্দ করি, বন্ধুরা এজন্য নাম দিছে আমারে ‘সাইলেন্ট কিলার’। সোনার খনি থেকে মানুষ সোনা আহরণ করতে কিন্তু ৩ হাজার ফুট মাটির গভীরেও চলে যায়, কাজেই যেগুলো কালের ধোঁয়া সেগুলো এমনিতেই সময়ের বাতাসে মিলিয়ে যাবে। আবার এত এত মিডিয়া হয়ে গেছে যে আসলেই কে শুনে বা দেখে কার কথা? আমি বলি একালে মহানায়ক হবে না, এটা পাতি নায়কদের কাল।

সৎ, মেরুদণ্ডী এবং ব্যক্তিত্ববান সাহিত্যিকের জন্য সাহিত্যচর্চা সব সময়ই জটিল। জেমস জয়েস, লিও টলস্টয়, আন্তন চেখভ কিংবা বোর্হেসের মতন সাহিত্যিকরা নোবেল পাননি। জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথও কিন্তু তাদের সময়ে এখানে অনেক প্রতিকূলতা, বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে এটাই কিন্তু পরিণতি, পুঁজি সব সময়ই সর্বগ্রাসী, খাইতে খাইতে কিছু না পাইলে শেষ পর্যন্ত সে নিজেরেও খায়। আগেও বলছি আমি এটা মহানায়কদের সময়কাল না, এটা পাতি নায়কদের কাল। দুর্বৃত্তায়নও চাটুকারিতা সব সময়ই ছিল, আছে, থাকবে। তবে ভাঁড়ামোকে বিশেষ মর্যাদা দান এই সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, হিরো আলম, টিকটক অপু বা মোটিভেশনাল সাজিদ-এদের প্রত্যাখ্যান না করে বরং আমাদের সময়টাকে বোঝার আছে। আমি মনে করি সমাজে বিদ্যমান অসাম্য এবং অবিচারের প্রতি এসব বিশেষ বার্তা। স্ল্যাং ব্যবহার করে বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করে কেউ কেউ কেন জনপ্রিয় তার সমালোচনার আগে এই সমাজ এবং পাঠক সাইকোলজি বোঝা দরকার। যে বিষফোঁড়া সমাজ দেহে লালন করে চলতেছিলাম আমরা সেগুলো ফাইটা যাইতেছে, শ্লেষ-বিদ্রুপ রূপে ছড়াইতেছে। কেন একজন এলএসডি বিক্রেতার উপর তরুণীরা ক্রাস খাচ্ছে সেটা না বুঝে এড়িয়ে বা প্রত্যাখ্যান করে গেলে বিষ থেকেই যাবে। এমন একটা সময় এখন যখন খল নায়কই নায়ক। আগে তো চুরি হতো, এখন হয় ডাকাতি। একজন অসৎ মানুষ আগে চোরের মতো পলায়া থাকতো, এখন দেখেন তারা বুক ফুলায়া হাটে, মঞ্চে ওঠে। সবাই হাত তালি দিচ্ছে। যে মানুষটা সৎ, মেরুদন্ডী এবং ব্যক্তিত্ববান, সে-ই এই সময়ের অযোগ্য।

 

প্রশ্ন : বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যাটি তো আসলে হাতে ধরে পড়া যায় না, পড়ুয়া বয়স্ক ব্যক্তিরা এটা ধরে পড়তেও পারবেন না; এ ক্ষেত্রে কি এটিকে খণ্ড আকারে প্রকাশ করা যেত না? এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

আলী আফজাল খান : যে অসুবিধার কথা বললেন সেটা সত্য, তবে পড়তেই পারবেন না এমন না, বলেন যে হাল্কা মেজাজে পড়ার সমস্যা, নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়। সিরিয়াস হয়ে বসতে হবে এই সংখ্যা পড়তে, যেখানে সেখানে পড়তে পারবেন না। প্রতিষ্ঠানগুলার যে সক্ষমতা থাকে, লিটলম্যাগের তা থাকে না।ভিন্নচোখের প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো সেই পরিমাণ আর্থিক বা সাংগঠনিক ক্ষমতা নাই যে এই বিপুল আয়োজন বার বার করতে পারবে। এটা একটা কারণ, আবার খণ্ডখণ্ড প্রকাশ করার সুবিধা অসুবিধা দুই’ই কিন্তু আছে।

 

প্রশ্ন : এ ধরনের আরও কাজ করার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই রয়েছে। আপনার ভাষ্যমতে, এ সংখ্যায় তেমন সাড়া পাননি কিংবা মূলধারার মিডিয়াগুলো নজর দেয়নি; এর কারণ কী? সে ক্ষেত্রে আবারও এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে কি?

আলী আফজাল খান : মিডিয়া তো সব সময়ই চাইবে তার পারপাস সার্ভ করতে, কেন সাড়া দেয়নি কম বেশি আপনি আমি সবাই জানি। তাদের মুনাফার কাছে গু আর গোলাপের কোনো পার্থক্য নাই। অথচ এই প্রোডাকশন আজকে প্রথম আলো করলে মিডিয়ার ঢোলের আওয়াজে আপনার কান ফাইটা যাইতো।

সংখ্যার সম্পাদকীয়তেই ভিন্নচোখের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দেয়া আছে, ইংরেজি অনুবাদে বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যার আন্তর্জাতিক সংস্করণ করতে চাই।

 

প্রশ্ন : এত বড়ো একটি কর্মযজ্ঞ করতে আর্থিক ঝুঁকিও তো নিতে হয়েছে। এ সম্পর্কে জানতে চাই।

আলী আফজাল খান : ভিন্নচোখ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না, ফলে বিনিয়োগ করে মুনাফার বিষয় থাকলে সেখানে ঝুঁকির প্রশ্ন। ২০১৫ সাল কবি হেলাল হাফিজ ভিন্নচোখের আগের কাজ বাংলাদেশের কবিতাসংখ্যা দেখে আমারে বলছিল আমি জানি না এই কাজ তুমি জমি বিক্রি করে না বউয়ের গয়না বিক্রি করে করছো, তবে এটা বুঝতে পারছি ভিন্নচোখ তোমার প্রেমিকা। জীবনটাই যেখানে দিয়ে রাখছি টাকা পয়সা তো সেখানে তুচ্ছ। আপনার কি মনে হয় এই সংখ্যা বিক্রি করে যে টাকা খরচ হইছে তা উঠে আসবে কোনোদিন বা কোনোদিন লিটলম্যাগ বিক্রি করে কেউ তা করতে পারছে? কিছু মানুষ থাকবেই যারা এসব করে যাবে। এই সংখ্যার প্রেসের বিল এখনও দু লাখ টাকা বাকি আছে, প্রেস মালিকের ফোনে ঘুম ভাঙে প্রায়ই।এসব কে বুঝবে? কার এত বুঝার ঠেকা পড়ছে?

 

প্রশ্ন : এ সময়ে তরুণদের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে আপনার পরামর্শ কী?

আলী আফজাল খান : কোনো পরামর্শ নাই। আপনি আমি পরামর্শ দিব আর তারা সেটা মাইনা চলবে এমন ভাবার কোনো কারণ নাই। যে যার মতো পথ করে নেয়। এখনকার সময়ই এমন যে কোনো কিছুর গভীরে কেউ যায় না, সব ভাসা ভাসা, শিকড় খুব নাজুক। লেখা প্রকাশের যে বাধাগুলা ছিল এখন তো আর সেসব নাই, এখন বরং পড়ার মানুষ, পাঠকই কম। বই পড়ে না মানুষ, ডিজিটাল মিডিয়া বইয়ের জায়গা দখল কইরা নিছে।

 

প্রশ্ন : এ সংখ্যায় কবিদের পোর্ট্রেট এঁকেছেন ছয়টি দেশের বরেণ্য ৭৩ জন চিত্রশিল্পী। এ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

আলী আফজাল খান : চেকোস্লোভাকিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া এবং গ্রীসের শিল্পীরা এই সংখ্যায় কাজ করছেন। বিখ্যাতশিল্পীদের পাশাপাশি অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণেরও কাজ আছে। ফলে পাঠক পোর্ট্রেট পেইন্টিংয়ের সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেনএইকাজগুলো দেখে।

 

প্রশ্ন : ভিন্নচোখ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ভিন্নচোখ কতটা অবদান রাখতে পেরেছে, পারছে?

আলী আফজাল খান : বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যার আন্তর্জাতিক সংস্করণ ইংরেজি ভাষায় করতে চাই সেটা আগেই বলছি। প্রকাশনা থেকে ভালো কিছু বই আগেও করছি এবং সামনেও সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সিনে সার্কেল এবং ইভেন্টস নিয়ে সেই অর্থে এখনও কোনো প্ল্যান নাই। শুধু বই নিয়ে একটা লিটলম্যাগ শুরু করছিলাম-পোস্টমর্টেম, সেটাও থেমে আছে।

তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ভিন্নচোখ কতটা অবদান রাখতে পেরেছে, পারছে তা তো আর আমি বলতে পারবো না, সময়ই বলবে। ভিন্নচোখ একদম আনকোড়া পাঠকের না আসলে, একটা লেভেল পার করার পর আপনি ভিন্নচোখের পাঠক। ভিন্নচোখের কাজ ঠিক সারফেস লেভেলে না, আপনি বলতে পারেন পলিসি মেকিং এর জায়গায়। আজকাল চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আর ইন্ট্রা ইকোনমি কথা বলা হচ্ছে, উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, অথচ এসব নিয়ে ভিন্নচোখ কাজ করছে ২০০৩/০৪-এ, উন্নয়ন ও রাজনীতির সংলাপ সংখ্যায়। এক্সক্লুসিভলি তরুণদের নিয়ে ভিন্নচোখ সংখ্যা করছে ২০১৭ সালে-প্রজন্মের কবিতাসংখ্যা, বয়স যাদের ৩০-এর নিচে তাদের নিয়ে। লিড আর্টিকেলে বাংলা কবিতার গোড়া থেকে একদম সমসাময়িক সময় পর্যন্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে, নতুন নিরীক্ষা ভিজ্যুয়াল পোয়েট্রিও ছাপা হয়েছে। একটা সময় পার না হলে এ ধরনের কাজের অবদান মূল্যায়ন করা যায় না, আমাদের কাজ করার দরকার করে রেখে যাচ্ছি, এটুকু বলতে পারি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

তাঁর জন্ম টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। সবুজের মাঝে বেড়ে ওঠা এই লেখক ভালোবাসেন প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের গল্প বলতে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রকাশনাশিল্পে। তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে সাহিত্য ও বই আলোচনা এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে থাকেন। ইতিমধ্যে যৌথ সম্পাদনায় তাঁর পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।