বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২

প্রজেক্ট মেডুসা : রাবেয়া রব্বানী

0

তাদের পা ও গলা শিকল দিয়ে এভাবে বাধা যাতে তারা কেবল সামনের দৃশ্যটাই দেখতে পায়, কোনভাবেই মাথা নাড়াতে না পারে —সক্রেটিস/গুহা রূপক/প্লেটো

 

সম্মানিত ক্লায়েন্টস, কেভ সিন্ড্রোম করোনা পরবর্তী একটি মানসিক পরিস্থিতির নাম। লম্বা মহামারীর পর মানুষের এমন সমস্যা আগেও হয়েছে…

ঐ শালা চুপ।

প্রজেক্ট ম্যানেজার ভাষণ দিতে শুরু করতেই আমরা কিছু সম্ভ্রান্ত ক্লায়েন্ট তাকে গালি দিচ্ছি। আমাদের উগ্রতাকে একটা অসুস্থতা হিসাবে ধরে নিয়ে লোকটা হয়তো একটু পর পর তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমরা এখন বাসে, যাচ্ছি আসামের কাজিরঙ্গা জঙ্গলের দিকে। লম্বা ভ্রমণ, ঘামের গন্ধ, ক্যান জাতীয় খাবার আর রাত জাগা আমাদের অস্থির করে তুলেছে। বাসের ভেতর সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বলে আমরা ভয় পাচ্ছি। নানা রকম উগ্র কোরাস করছি, ‘ঐ শালা তরা বাস থামা, পেশাব করব বাস থামা, গোসল করব বাস থামা’। তবে বাস থামলেই নামতে গড়িমসি করছি। মধ্যবয়সী মহিলাটাকে বার বার বলতে শুনছি, মনু আমি বাইরে যাব না, আমার শরীর কাঁপে।

 

*
প্রজেক্টের নাম মেডুসা। টাকার বিনিময়ে এখানে তারাই নাম লিখিয়েছি যারা মহামারী চলে যাওয়ার পরও শুধু ঘুমাই, কাজে যাই কিংবা শুধু বাসায়ই থাকি, বাইরে গেলে যাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। আমাকে এখানে আসার জন্য সাত দিনের ছুটি নিতে হয়েছে। রিতুকে বাপের বাড়ি রেখে যখন রওয়ানা দিচ্ছি তখন আমার মায়ের ফোন আসে, ‘আবার একা একা কোথায় যাচ্ছিস? রিতুকে নিয়ে যাস না কেন? বাচ্চা কাচ্চার মুখ কি আমি বেঁচে থাকতে দেখব না?’

আমার মায়ের তিনটা প্রশ্নের কেবল একটাই উত্তর ছিল, ‘তুমি তো জানোই আম্মা, লম্বা লম্বা লক ডাউনে বউ আর বউ থাকে না। ’
আমি লাইন কাটার বিপ বিপ শব্দ শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, আমি আর রিতু তিন চার বছরের সংসারে শারীরিক ভাবে নতুন কাউকে আনতে না পারলেও মানসিক ভাবে যে এক মায়ের গর্ভে চলে গেছি তাই বা কম কি। পুনঃ উৎপাদন না হলেও একটা রূপান্তর তো এসেছে! সে যাক, আমার স্ত্রী যে কিনা এখন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকে, সে ফোনের ওপাশের কথাগুলো না শুনেই কেঁদে ফেলেছিল, ‘ভাইয়া আম্মা নিশ্চয়ই আবার সেই বাজে কথাগুলো বলেছে, ছি ছি ছি, এই মুখ আমি আর তোমাকে আর দেখাবো কিভাবে?’

রিতুর মুখ আমাকে আর বেশিক্ষণ দেখতে হয়নি, সে মুখ ঢেকে ভেতরে চলে গিয়েছিল।

 

*
জঙ্গলে যাওয়ার সময় যে সাথে বুট নিতে হয় আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ধার করতে এরপর আমি গিয়েছিলাম তরুণের বাসায়। তরুণ বুট জোড়া দিয়ে বলেছিল, আগেও তো কি ছাতার প্রজেক্টে গিয়েছিলি বউ নিয়ে কি ছাতার মানসিক ঝামেলায়… লাভ হয়েছিল কিছু?

অবশ্যই, আগে আশি ভাগ বোন মনে হতো এখন দুইশ ভাগ বোন মনে হয়। একটা এসপার-ওসপার তো হয়ে গেছে।

তরুণ মুখ কুচকে বলেছিল, যাই বলিস জঙ্গলে সাপের কামড়ে মরে যেতে পারিস, আর পোকা, বিছা, ভাইরাস তো আছেই। জেনে শুনে কেউ বিষ খায় তোকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

তরুণকে নতুন কিছুতে বিশ্বাস জুটিয়ে আমি আর্মি ছাপের টি-শার্ট আর ক্যাপ পরে রাস্তায় নেমে পড়েছিলাম। ব্যাক প্যাক পিঠে নিয়ে কুঁজো হয়ে বিচ্ছিরি একটা বৃষ্টিতে ভিজছিলাম আর আকাশের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম। আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না সেই বৃষ্টির উদ্দেশ্য ভালো।

 


চোখের বিভ্রান্তি দুই ধরনের আর তা হয়েও থাকে দুটো কারণে; এক, আলো থেকে অন্ধকারে এলে, দুই অন্ধকার থেকে আলোতে গেলে —সক্রেটিস/ গুহা রূপক/ প্লেটো।

অক্টোবর মাসের বিকেল, এখনও সূর্য ঢলে পড়েনি। একটা খোলা মাঠের কাছে বাস থেমেছে। জায়গাটার নাম ক্যাম্প নিকোরি, বোখাহাট, কোহারা, কাজিরঙ্গা। গ্রাম্য চেহারার বিস্তীর্ণ মাঠ, মাচানের উপর নানান রঙের তাঁবু টানানো, মাঝে মাঝে মাঝারি ঘনত্বের কিছু জঙ্গল। কোথাও কোনো কংক্রিটের ঘর নেই বলে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। ঘরে ফিরে যাওয়ার এক প্রচণ্ড নেশা মাথায় ভূতের মতো চেপে আছে। আমার মতো অনেকেই ব্যাগ থেকে মাস্ক আর রোদচশমা বের করতে চাইছে কিন্তু প্রজেক্ট ম্যানেজার কাউকে সেই সময় না দিয়ে বাইরে বের করে দিচ্ছে।

ডিম ফোটা মুরগির ছানার মতো টলমল পায়ে হাঁটছি আমরা। ক্যামেরা ছাড়া সকল ধরণের ইলেকট্রনিক যন্ত্র কেড়ে নিয়ে আমাদের হুল্লোড় করতে বলা হয়েছে। কিছু তরুণ-তরুণী সেই চেষ্টা করছেও বটে, কিন্তু ঠিক জমছে না।

মোটা মহিলাটা ভ্রাম্যমান টয়লেট থেকে বের হয়ে চিৎকার শুরু করেছে, সাপ সাপ। ভ্রাম্যমাণ টয়লেটে সাপ কিভাবে আসতে পারে তা না ভেবেই চিৎকার করছে অনেকে। প্রজেক্ট ম্যানেজার তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে। আমার ক্লান্ত লাগছে।

 

*
রাত দশটা। একটা কুটিল চেহারার চাঁদ ঝুলে আছে আকাশে। মাথার নিচে ব্যাগটা রেখে মাঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। জেগে দেখি, খিচুড়ি পরিবেশন করা হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পাট শেষ হলে প্রতি দুজনকে একটা করে তাঁবু আর চাদর বুঝিয়ে দিয়ে প্রজেক্টের লোকগুলো নিজেদের তাঁবুতে চলে গেছে।

নিকোরি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধানসিড়ি নদীটা এখন একটু বাড়াবাড়ি রকম শব্দ করছে, পেঁচা জাতীয় কিছু পাখি ডাকছে, পোকা-মাকড়, ঝিঁ-ঝিঁ আর শেয়াল তো আছেই। মনে হচ্ছে একটা আস্ত প্রাণীর উপরই আমরা তাঁবু গেড়ে বসে আছি।

 

*

দুজন টহলরত পাহারাদার মাঠের চারপাশে হাঁটছে। সন্ধ্যাটা ঘুমিয়ে থাকার কারণে আমার চোখে ঘুম নেই। একটা লোক এখনও মাঠে পায়চারি করছিল। অস্বাভাবিক লম্বা শার্ট দেখে আমি তাকে চিনতে পারলাম। বাসের সকল কোরাসের লেখক এই লোকই। লোকটার পাতলা ফিনফিনে লম্বা চুলগুলো হাল্কা বাতাসেই উড়ছে। আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমি নীল।

আমি রনি, কবি রনি।

আচ্ছা, কবি বলেই কি ঘুম নেই? আল মাহমুদের মতো একটা নাইট সাফারি দিয়ে কবিতা লিখবেন নাকি?

আরে না না। এইসব দেখার কি আছে? এই চাঁদ, একটা পাথরের টুকরা, তাও এবড়ো থেবড়ো। এই আকাশ, কিছু গ্যাস ছাড়া আর কিছুই না। পাহাড়গুলো এক জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, না আছে রং, না আছে ঢং। গাছগুলো অসভ্যের মতো এখানে ওখানে গজিয়ে ওঠে। এইসব নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক কবিরা কেন হুদাই মাতামাতি করে গেছে আমি বুঝি না। প্রকৃতি প্রসঙ্গে আমি কি লিখেছি শুনুন—

`আখ খেতে যাব কেন?
কি আছে এমন আখের খেতে,
লম্বা লম্বা সার সার লাঠি ছাড়া।
কেন দেখতে যাব আখের খেত?’

আমি তার কবিতার প্রশংসা না করে পারলাম না। কবি রনি একটু গর্বিত বোধ করে মাথা নেড়ে খাবারের তাঁবু থেকে হুইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে এসেছে। আমরা পান করছি মাঠের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। দুই পেগ পেটে পড়তেই আমার নড়তে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে কেউ পেরেক দিয়ে আমাকে পুতে দিয়েছে। নিজেকে সাহায্য করার চেয়ে অন্যকে সাহায্য করা সহজ তাই আমি কবি রনিকে জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি আর বার বার চোখ কচলে নিচ্ছি, একি! আমি তো আসলে আমাকে টানছি!

 

*
জঙ্গলে ঢোকার মুখে একটা ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় এসে বসেছি আমরা। কবি রনি বলল, আমি কিন্তু জঙ্গলে অনেকগুলো সবুজ চোখ দেখতে পাচ্ছি। আমিও দেখতে পাচ্ছি।

আমি উত্তেজিত হয়ে প্রহরীগুলোকে ডেকে চোখগুলো দেখালাম কিন্তু তারা সেগুলোকে জোনাক পোকা বলে তাঁবুতে ফিরে যেতে বলল। আমরা বার বার তাদের বোঝালাম, জ্বোনাক পোকার আলোর মাঝে কমলা বিন্দু থাকে না। ক্যামেরার মতো স্থির থাকে না, অন্তত জ্বলে নেভে। তারা বুঝতেই পারল না। অবশ্য তাতে আমরা দুজন রেগে যাইনি। গ্লাস ছাড়াই আরও কয়েক পেগ গিলে বোতলটা প্রহরীদের ধরিয়ে দিলাম, গা ছেড়ে সটান শুয়ে পড়ল কবি রনি।

একটা অসার আহ্লাদ নিয়ে আমি চারপাশ দেখলাম। তাঁবুর আলো গুলো থর থর করে কাঁপছে, চাঁদের দাগযুক্ত চেহারাটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে, ঝোপের উপর সবুজ চোখগুলো টগর ফুলের মতো মিছিমিছি পড়ে আছে।

কবি রনি ভারী কণ্ঠে বলল, চোখগুলো আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। আমাদের হাসা উচিত। উপহাস করা উচিত।

আমি একমত হয়ে হাসতে শুরু করলাম। প্রহরী দুজন আমাদের পেছনে পা ছড়িয়ে বসেই হুইস্কি গিলছিল, তারাও আমাদের সাথে শব্দ করে হাসতে লাগল। তিন হাত দূরে দূরে বসায় আমাদের চিৎকার করে কথা বলতে হলো। প্রকৃতিকে অনেকক্ষণ গালাগাল করার পর কবি রনি ইতোমধ্যে জঙ্গলকে হাতছানি দিতে শুরু করল। অনেক ডাকাডাকির পরও জঙ্গল কাছে আসতে পারল না। আমি নতুন করে আবিষ্কার করলাম, জঙ্গলের পা নেই, চাঁদের ঠোঁট নেই, আকাশ রাত হলেই আফ্রিকানদের মতো কালো হয়ে যায়। একজন প্রহরীও দুঃখ করে উঠল—

স্যার সবগুলাই ন্যাংটা। কাপড় চোপড় নাই।

আমাদের কষ্ট হলো। কবি রনি, আমি, প্রহরী দুজন, আমরা সবাই হাউমাউ করে কাঁদলাম।

 

 


মাথা নাড়াতে না দেওয়া হলে ছায়া ভিন্ন আর কিছু দেখবে কিভাবে? —প্লেটো/ গুহা রূপক/দ্য রিপাবলিক

কাজিরঙ্গার জঙ্গলগুলো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। বিশাল বড়ো এলাকা। ন্যাশনাল পার্কের জিপ সাফারির জন্য আমাদের আলাদা আলাদা জিপ নিতে হয়েছে। আমরা যাচ্ছি পার্কের সেন্ট্রাল রেঞ্জে। আমার জিপে আছে কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ের দলটা। একটা স্থানীয় দোকান থেকে ব্লাক রাইস নামক এক প্রকার ক্ষীর খাওয়ার পর থেকেই আমার ঘুম পাচ্ছে।

 

*
জিপের হাতল ধরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোনো বন্য প্রাণী দেখা হয়ে উঠেনি, ছবি তোলা হয়নি। একবার কেবল জিপে থাকা একজন গাইড আমাকে জোর করে উঠিয়ে দেখিয়েছিল গণ্ডারের মলের স্তূপ। সেই মলের স্তূপের বিশেষত্ব হচ্ছে, গণ্ডার নিয়মিত এক জায়গায় মলত্যাগ করে। তিন মাস পর এরা জায়গা বদলায় তাই আমি যেগুলো দেখেছিলাম সেগুলো শুধু একটা গণ্ডারেরই মল ছিল। সেই গণ্ডারের মলত্যাগের বিশেষ জায়গায় বমি করে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠলাম এইমাত্র, এখন দুপুর।

পার্কের ক্যান্টিনে আমিষের কোনো ব্যবস্থা নেই, বাজে কিছু নিরামিষ আর ভাজি দিয়ে ভাত খাবার পর একটা ছোটো রেস্ট রুমে হাত মুখ ধুতে এলাম। জিপে আমার পাশে বসা মেয়েটা একরকম আমার পিছুই নিয়েছে! মেয়েটার দাঁতের ব্রেস দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। এ জাতীয় মেয়েরা খুব গায়ে পড়া হয়। আমার ধারণা সত্য করে দিয়ে সে আমাকে চেপে ধরল।

কী করছেন কী এইসব?

মেয়েটা বলেছিল, সমস্যা কী?

মানে আমার বোন আছে। মানে সে একসময় আমার স্ত্রী ছিল।

ছিল তো ছিল এখন তো আর নেই তাছাড়া কিভাবে বউ বোন হয়ে যায় আমার জানতে হবে। আপনি আমাকে সব খুলে বলুন। জানেন? আমি কারো বোন হতে চাই না। আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ।

কী জ্বালা! মেয়েটা আবার আমাকে চেপে ধরল। আমাদের এই অবস্থায় হাতে নাতে ধরে ফেলল কবি রনি। এক গাদা ভাত মাখা এঁটো হাতে সে এসেছে ওয়াশ রুমে হাত ধুতে। ওভাবে আমাদের দেখে সে এঁটো হাতেই মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের দিকে টানল কিন্তু মেয়েটা তাকে চড় ঘুষি মারতে লাগল।

ইতোমধ্যে ওয়াশরুমে আরও লোকজন চলে এসেছে। মোটা মহিলাটা রেইপ রেইপ বলে চিৎকার করতে করতে বের হয়ে গেল। আমাদের তিনজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করল প্রজেক্ট ম্যানেজার। সব খুলে বলার পর ম্যানেজার বিজেতার মতো মেয়েটার হাত উঁচিয়ে বলল, এই মেয়েটার উপর এখনই প্রজেক্ট এফেক্ট করা শুরু করে দিয়েছে। হাত তালি, জোড়ে হাত তালি।

প্রবল করতালির মধ্যে দিয়েও মেয়েটার ভাইকিংস চেহারার বন্ধু দুজন আমার কানে কানে বলে গেল, ‘কোনো কথা না, জেমি আপনাকে পছন্দ করেছে, এখন থেকে আপনার সাথেই থাকবে।’ জেমির সাথেই থাকতে হবে বলে আমাকে পরিষ্কার করে ভাবতে হলো, রিতু এতে কষ্ট পাবে কি না। যেহেতু রিতু এখন আমার বোন হয়ে গেছে সেহেতু এই ব্যাপারে তার আর হিংসা হবার কথা না। তাছাড়া রিতু হিল্লোলসহ আরও কয়েকজনের সাথে ঢলাঢলি করার সময় নিশ্চয়ই আমার কথা ভেবে দেখে না। এভাবে একটা ইমোশনাল ডিফেন্স নিয়ে আমি অবশেষে মেয়েটার হাত ধরলাম। কবি রনি অবশ্য তার দিকে মেয়েটাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে গেল।

 

*
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমরা এখন এলিফ্যান্ট রাইডে। মোটা একটা হাতির উপরে বসেছি আমি আর জেমি। জেমির চাপাচাপিতে হাতির পিঠে দুলে দুলেই আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। আমার আর রিতুর ব্যাপারটাও তাকে খুলে বলতে হচ্ছে—

আমি আর রিতু লক ডাউনে একসাথে ছিলাম প্রায় তিন চার মাস। আস্তে আস্তে আমাদের ঘরটা একটা মায়ের পেট হয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমরা নিরাপদ বোধ করছিলাম, সহোদরের মতো বেড়ে উঠছিলাম।

আপনারা তো প্রাপ্ত বয়স্কই আবার কিসের বেড়ে উঠা!

পৃথিবীতে অনেক রকম বেড়ে উঠা আছে, জেমি।

তারপর?

তারপর, একদিন হঠাত আবিষ্কার করলাম আমরা ভাই বোন।

তাহলে ঘরটাই একটা কালপ্রিট।

হয়তো।

জেমি আমাকে আগের চেয়েও জোড়ে চেপে ধরল। আমার ভীষণভাবেই জেগে উঠার কথা কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে

তা হয়ে উঠল না।

 

*
আমি দল পছন্দ করি না কিন্তু না চেয়েও একটা না একটা দল মানুষকে বেছে নিতেই হয়, বেছে না নিলেও ঢুকে পড়তে হয়। পঁচিশজন যাত্রীর মধ্যে আমাদের দশজনের একটা বড়ো দল হয়েছে। সেই দশজনের মধ্যে আবার আমি আর কবি রনি আলাদা একটা বোঝাপড়া বানিয়ে বসে আছি। কাজিরঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গতকালের সন্ধ্যাটা কেটেছে আমাদের সেই দশজনের দলটার সাথে। নানান পদের বেম্বো ড্যান্স তারপর স্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠে ভূপেন হাজারিকার কাজিরঙ্গা কাজিরঙ্গা শুনতে শুনতে আমাদের চোখ কান পচে গেছে।

রাতে ক্যাম্পে ফিরে এসেও আমরা একসাথেই গল্প করেছি, গাজা টেনেছি। একজন প্রফেসর আছেন এই দলে যার কাজ ছিল শুধু বিয়ার খাওয়া আর একটু পর পর প্রস্রাব করা। একটা বোবা ধরণের ছেলে আছে যে শুধু ছবি তুলে যায়। দুটো মেয়ে ছিল যারা লেসবিয়ানদের মতো মাখামাখি করে আর সবার সব কথায় হসে; তবে নিজ থেকে কিছু বলে না। জেমির দুই বন্ধু ও দুই বান্ধবীও আছে। জেমি বেজোড় হওয়ার মূল্য আমাকে তখন দিতে হয়েছে, সে সারাটাক্ষণ পোষা কুকুরের মতো আমার গায়ের নানান জায়গা শুকে দেখেছে।

তারপর রাত বাড়তেই দলটা ভেঙে গিয়ে যার যার তাঁবুতে ফিরে গেছে। জেমির বন্ধুরা তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার পর রয়ে গেছি কেবল আমি আর কবি রনি। আমরা জানতাম জঙ্গল কাছে আসবে না তাই আমাদেরই যেতে হয়েছে।

 

*
রাতে জঙ্গলের ভেতর কখন কিভাবে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি এখন মনে পড়ছে না। সূর্য বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেছে। আমরা যখন জঙ্গল থেকে বের হয়ে এসেছি, মনে হচ্ছে বিশাল এক যুদ্ধ জয় করে ফিরেছি, প্রজেক্ট ম্যানেজার বলছে, হাত তালি, জোড়ে হাত তালি।

 


সর্বপ্রথম যে মুক্ত হয়, হঠাত দাঁড়াতে বাধ্য হয়, ঘাড় ঘুরাতে পারে, হাঁটতে পারে, আলোর দিকে তাকাতে পারে, সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করে, আলো তাকে ঝলসে দেয় —সক্রেটিস/গুহা রূপক/প্লেটো

সকালে আমাদের খুঁজে না পাওয়ার কারণে একটু বেলা করেই বের হয়েছে প্রজেক্টের বাস। নাশতা খেয়েছি স্থানীয় বাজারে। পাহাড়ি মানুষজন বাংলা মিশ্রিত এক অবোধ্য ভাষায় কথা বলে, খুব একটা বোঝা যায় না। আজকের গন্তব্য কাজিরঙ্গা অর্কিড গার্ডেন আর বাটারফ্লাই মিউজিয়াম তবে এর মাঝে আমাদের আগর কাঠের কারখানা দেখাতে বাস থামিয়েছে সন্তু। সন্তু এখানকার প্রভাবশালী গাইড। তার কথা ফেলার উপায় নেই।

আগর কাঠের কারখানায় এসে আমরা অবশ্য বেশ হতাশ হয়েছি। অফিস ঘরের সামনে গাদা গাদা কালো কাঠ স্তূপ করে রাখা। বা দিকে কিছু লোক কুঠার দিয়ে কাঠ কাটছে আর কিছু মহিলা কাঠ বাছাই করছে।

*
আমাদের এখন কারখানার পেছনের জঙ্গলে নিয়ে এসেছে সন্তু। আসলে আগর বলে কোনো গাছে নাই, গাছের নাম একুলিরিয়া। সবগুলো গাছের গায়ে শত শত পেরেক মারা। সবাই গাছদের এই ভীষণ শাস্তি দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সন্তু যা বলল তার মানে হচ্ছে, এগুলা কৃত্রিমভাবে আগর বানানোর প্রক্রিয়া। একুলিরিয়া গাছের কাণ্ডে ফাঁক-ফোকর থাকলে একরকম ছত্রাকের আক্রমণ হয় তখন গাছ তা প্রতিরোধ করতে একরকম রেসিন জাতীয় পদার্থ নির্গমন করে আক্রান্ত জায়গুলোতে। একসময় সেগুলা শক্ত হয়ে যায়। সাধারণত মধ্য কাষ্ঠায় এই জিনিসটা জমে থাকে। মূল কাঠ থেকে কেটে এই আলাদা কালো অংশটা বের করলেই পাওয়া যায় আগর, যা যুগ যুগ ধরে সুগন্ধির কাঁচামাল। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া আগর দিয়ে এখন আর ব্যবসা করা হয়ে উঠবে না তাই এই প্রক্রিয়া বেছে নিতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

শত শত পেরেক মারা গাছের বাগান দেখে কারোই ভালোলাগার কথা নয়। কবি রনি তার লম্বা শার্টের হাত গুটিয়ে বলল, ‘তার মানে আগর একুলিরিয়ার নিজস্ব আর্ট। গাছগুলোকে কৃত্রিম ভাবে আর্ট করিয়ে ছাড়ব বলে আমরা গাছকে কষ্ট দিচ্ছি, টাকা কামাচ্ছি, তাদের অসুস্থ বানাচ্ছি। ছি ছি!’

মোটা মহিলাটা উচ্চস্বরে ছিঃ ছিঃ করল। পঁচিশজন একসাথে ছিঃ ছিঃ করতে করতে আমরা বাসে উঠে পড়লাম।

 

*
এরপর আমরা গিয়েছি অর্কিড গার্ডেন, বাটারফ্লাই মিউজিয়াম। এত এত গাছের যৌনাঙ্গ, মানে, ফুল আর বিলে কেলিরত পাখি দেখে আমার মনে হয়েছে এই গ্রহটাই আসলে একটা যৌনতার ভাগাড়। তারের ঘের দেওয়া বাটারফ্লাই জোনেও একই বার্তা ছিল, প্রজনন আর প্রজনন।

এরপর আমরা ক্যাম্পে ফিরে এসেছি। ক্যাম্প নিকোরিতেই এখন আমি প্রথম এয়ার-মোটরে উঠেছি। পঞ্চাশ মিটার উপর থেকে মানুষগুলোকে জঙ্গল আর মাঠ থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। আলো চোখে তীরের মতো বিঁধছে, বাতাস একটা প্রবাহিত নদীর মতো আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে। একটু দূরেই পাখি উড়ছে ঝাঁক ধরে, নিজেকে ওজনহীন মনে হচ্ছে, পুরো মহাবিশ্বের সাথে আমার চেতনা মিশে যাচ্ছে। আমি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি তবু বিড়বিড় করছি, আমরাই প্রকৃতি, আমরাই প্রকৃতি।

 


ধীরে ধীরে তার চোখে সূর্যের আলো সয়ে যাবে, প্রথমে সে কেবল ছায়াই দেখতে পাবে তারপর পানিতে মানুষ ও বস্তুর প্রতিফলন দেখতে পাবে আর তারপর দেখতে পাবে মূল বস্তুটা —প্লেটো/গুহা রূপক

আজকের দিন আমাদের দশজনের দলটা ক্যাম্প নিকোরিতেই থাকলাম। ইতোমধ্যে কয়েকজন ঠান্ডা কাশি বাঁধিয়ে বসে আছে। দুপুরের খাবারের পর আমরা জঙ্গলের ভেতরে হাঁটতে বের হলাম। তীর্যকভাবে রোদের ফলা এখানে ওখানে পড়ে আলাদা মাত্রা এনে দিল। বোবা ছেলেটা কেবল ছবি তুলল। সন্ধ্যার পর এখন আড্ডা হচ্ছে ধানসিড়ির পাড়ে। অবিরত বিয়ারের ক্যান খোলার শব্দ হচ্ছে, সিগারেটের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে বাতাসে।

প্রজেক্টের নাম মেডুসা কেন হলো?

জেমির একটা বন্ধু তার বান্ধবীর কোলে শুয়ে প্রশ্নটা করল। অনেকেই গ্রিক মিথোলজির দেবী মেডুসার নাম নিল। কিন্তু দেবী মেডুসার সাথে প্রজেক্টের উদ্দেশ্যের সাথে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া গেল না। অংকের প্রফেসর এবার নীরবতা ভেঙে বলল, মেডুসা সমুদ্রের একরকম জেলি ফিস বা নিডারিয়া পর্বের প্রাণী। ধারণা করা হয় মেডুসারাই সমুদ্রের বুকে প্রথম সাঁতার কেটেছে। এদের দুইটা পর্যায়, এক পলিপ, দুই মেডুসা।

ব্যাপারটা আমরা অনেকে জানলেও বুঝে উঠতে পারলাম না। এর মধ্যে বোবা ছেলেটা প্রমাণ করল সে আসলে বোবা না। সে তার ক্যামেরা মুছতে মুছতে বলল, মেডুসা হলো নিডারিয়ার যৌন বা সচল অবস্থা আর পলিপ অযৌন ও অচল অবস্থা।

ভাইকিংদ্বয় একসাথে বলে উঠল, কী! আমরা কি তবে পলিপ!

তারপর তারা নিজেদের মধ্যে কানা-কানি করে বান্ধবী অদল-বদল করে নিল। নিজেকে একটা অযৌন দশা ভেবে আমারও কষ্ট হলো কেন যে রিতু আমার বোন হয়ে গেল! আমি নিজের সাথে একটা বোঝাপড়া করে প্রজেক্টের প্রথম সচল জীব জেমিকে খুঁজলাম, জেমি ইতোমধ্যে কবি রনির গলা জড়িয়ে হাসছে। কবি রনি জেমির দাঁতের ব্রেসটা কিছুক্ষণ টানাটানি করে বলল, লোহা লক্কড় সহই তাহলে চুমু খেতে হবে।

জেমি জিজ্ঞেস করল, আপনার বোন মানে পলিপ জাতীয় বৌ নেই তো?

না না।

নাইস টু হেয়ার, আচ্ছা শুনুন আমরা কিন্তু এক ঘরে বেশিদিন থাকব না।

কবি রনি বলল, আমরা মেডুসা, আমরা সাঁতার কাটব।

আমার হিংসা হলো আবার আনন্দও হলো। সহযাত্রীর সফলতা আসলে নিজের সফলতারই পূর্বাভাস। ধানসিড়ি নদীর শব্দের সাথে কবি রনি আর জেমির চুমুর শব্দ মিশে যাচ্ছে। আমরা দেখছি তাকিয়ে তাকিয়ে। আমাদের সবার শ্বাস ঘন হয়ে আসছে।

 


গুহার বাইরে স্বাগতম বন্ধুরা, বাইরে কিছুটা ঠান্ডা তবে চমৎকার কিছু তারা আছে আকাশে! —প্লেটো/গুহা রূপক/দ্য রিপাবলিক।

আমরা ফিরছি নিজের দেশে, জায়গায় জায়গায় থামছি, খাচ্ছি, হাঁচি কাশি দিচ্ছি, সামাজিক দূরত্বের কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। জেমি আর কবি রনি গলে গলে পড়ছে একজন আর একজনের উপর। প্রজেক্ট ম্যানেজার ভাষণ দিচ্ছে…

গুহাবাসী কিছু মানুষ ছিল এক সময়। এখনকার মানুষের মতো এত কৌশলী ছিল না। আবহাওয়া খারাপ হলে বা খুব শীত পড়লে বা কোনো বিপদ হলে তারা বাইরে বের হতে পারত না। গুহার মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ত। খাবার না সংগ্রহ করতে পেরে একসময় নিজেরাই নিজেদের খাওয়া শুরু করল, হয়ে উঠল নরখাদক। এই হলো শরীরের ক্ষুধার কথা। মনের ক্ষুধাও তাই। মনের খিদে না মিটলে একসময় মানুষের মন নিজেকেই খেতে শুরু করে। মনের খাবার হচ্ছে দৃশ্য, গন্ধ, স্পর্শ আর শব্দ। মনকে খাওয়ান, ভালো থাকুন।

আমরা করতালি দিচ্ছি, আমরা হাসছি। কবি রনির সাথে সাথে আমরা কোরাস করছি, ‘আখ খেতে যাব না কেন?’ ‘আখ খেতে যাবই যাব’, ‘যাবই যাব, যাবই যাব’।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ইডেন কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। তার প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে (সময় প্রকাশন থেকে)। এ পর্যন্ত চারটি অনুদিত ও দুটি মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার, সাহিত্য ম্যাগাজিনগুলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ছোটোগল্প।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।