শনিবার, জুলাই ২৭

ফিরে আসার একটাই নাম : রুমা মোদক

0

Eid Motifহিমেলকে পিঠের নিচে হাত দিয়ে আস্তে করে পাশ ফিরিয়ে দেই। মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে অতীতের সব স্মার্টনেস ভুলিয়ে দেয়। আমার প্রাথমিক জীবনের মুগ্ধতা পরাজিত হয় এই সময়ের শুশ্রুষা জনিত বিরক্তির পাহাড়সম ক্লান্তিতে। পাশে রাখা টাওয়েলের টুকরো দিয়ে মুছে দেই। বাটিতে থেকে নরম ভাতের লেই মুখে তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করি, মেয়ের যে বিয়ে দেবো টাকা কই? ঘোলা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে হিমেল, ওর ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি কোনো অর্থ তৈরি করে না, কোনো উত্তরও। চোখ গড়িয়ে জল পড়তে থাকে অঝোরে। এ আরেক রোগ। সারাজীবন বেহিসেবি চলার মাশুল এই দুঃসহ জীবনের ভার কেবল বয়ে যেতে হয়। মেনে নিতে হয়। কোনো সমাধান মেলে না। তবু জিজ্ঞেস করি, কেন যে করি। কোন সমাধানই এখন আর দিতে পারবে না হিমেল। জিজ্ঞেস করে করে নিজের উপায়ান্তর হীন ভারকে একটু লাঘব করার চেষ্টা শুধু।

আমার নিয়ত বুঝি এতোটাই খারাপ ছিল, এতোটাই ভোগান্তি লেখা হয়েছে পরিণামে? বিবাহবার্ষিকীতে পাওয়া ছোটোখাটো উপহারাদি দোকানে বিক্রি করে করে সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি। কেন আমার জন্যই লেখা হলো এই দুর্বিষহ দিন।

হিমেলের গোঙানির শব্দ শোনা যায়। বোধহয় প্রস্রাব পায়খানার করে বিছানা ভরিয়েছে। উফ আর পেরে উঠি না। মেয়ে চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে, মা দেখ…। বাপের গোঙানিতে ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে। সারারাত জেগে পড়েছে মেয়েটা। একমাত্র মেয়ের বিয়ের কার্ডটা দিতে যাওয়ার উপলক্ষ্য ছাড়া আর কোনো উপলক্ষ্য ছিল না নাহিদের ওখানে যাবার।

হিমেলের গোঙানির শব্দ শোনা যায়। বোধহয় প্রস্রাব পায়খানার করে বিছানা ভরিয়েছে। উফ আর পেরে উঠি না। মেয়ে চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে, মা দেখ…। বাপের গোঙানিতে ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে। সারারাত জেগে পড়েছে মেয়েটা। একমাত্র মেয়ের বিয়ের কার্ডটা দিতে যাওয়ার উপলক্ষ্য ছাড়া আর কোনো উপলক্ষ্য ছিল না নাহিদের ওখানে যাবার। ওখানে মানে নাহিদের কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের রুমে। উদ্দেশ্য এক নিয়ে গেছি আরেক। ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম কীভাবে আসল উদ্দেশ্যটা বলা যায়, আদৌ বলা যায় কি না ইত্যাদি অনেক কিছু। আসলে নাহিদের ওখানে আদৌ যাওয়া যায় কি না এটাই ছিল মূল ভাবনার বিষয়। ভাবতে ভাবতে উপলক্ষ্যটা যখন সামনে চলে এলো, তখন দ্বিধাগ্রস্ততা সঙ্গী করেই নাহিদকে উদ্দেশ্য করে বের হয়ে পড়লাম। আসল উদ্দেশ্য যদি বলতে না পারি নকলটা তো আর মিথ্যে নয়।

বাইশ বছর পর নাহিদের মুখোমুখি হবো আমি। একই শহরের আনাচেকানাচে দুজন। অথচ দেখা নেই। যোগাযোগও। একদিন বইয়ের ভেতরে নাহিদের একটা চিঠি আবিষ্কার করে অশান্তির কী চূড়ান্তই না করল হিমেল! চরিত্রহীন, নষ্টা, মাগী কিচ্ছু বলতে বাকি রাখেনি। চিঠিতে মিশুদের চিলেকোঠার স্মৃতিঘেরা আফসোসের কথা। হিমেল কী বুঝেছে কে জানে! অথচ আমি জানি, সেদিন যেভাবে উন্মত্ত এক পুরুষ মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি আমি, সেটা কোনো পুরুষকে হত্যারই সমতুল্য। সংসারের শান্তির জন্য গত বাইশটি বছর আমি তিলে তিলে নাহিদকে হত্যা করেছি আমার জীবন থেকে। ঘষেমেজে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যার হতে চাইনি, হইনি— তাকে নিয়েই সংসার অশান্ত হলো আমার। তারপর তো তাকে অস্বীকার কেবল। ভেতরে বাইরে। তবু হিমেল যখন কথায় কথায় নাহিদের প্রসঙ্গ তোলে আমি মুখ বুজে সহ্য করি আর ভাবি বরং নাহিদকে না ঠকালেই কি হতো! কি হতো নাহিদের চাওয়াকে নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে সময়ের চাহিদাকে পূরণ করলে! কী হতো!

নাহিদ খুব বুদ্ধিমান। বুদ্ধি ওকে এখানে এই প্রতিষ্ঠার পাদদেশে নিয়ে এসেছে। আমাকে দেখে চমকে গেলেও ও এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই ব্যাপার না। আমি আসতেই পারি। কিংবা আমার আসারই কথা। অথচ নাহিদের সাথে আমার দেখা পাক্কা বাইশ বছর পরে। ওর যে আবেগঘন চিঠি নিয়ে আমার সংসারে নিত্য অশান্তি আমি তারও কোনো উত্তর দেইনি। নাহিদ একে চিরাচরিত উপেক্ষাই ভেবেছে। চিরকালই নাহিদ একতরফা আমাকে অনুনয় করে গেছে আর আমি তাকে এভাবে এড়িয়েই গেছি।

এই বাইশ বছর কোনো অজুহাত, দুর্ঘটনা, ঘটনা কোনো ক্রমেই ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। এমন নয় যে আমি চাইনি। হয়তো উদ্যোগ নেইনি। কিন্তু মনে মনে সবসময় চেয়েছি পথেঘাটে, বিয়ে বাড়িতে, নেহায়েত দুপক্ষের পরিচিত কারো মৃতদেহের সামনেও তো আমাদের দেখা হয়ে যেতে পারে।

হতে পারে নাহিদের সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময়। আমার অশ্রুসজল চোখে হঠাৎ বাসা বাঁধতে পারে প্রথম যৌবন। যৌবনের শিহরন। যে যৌবনে আমি ওর প্রেমকে অস্বীকার করেছিলাম, আমি সেই প্রেমকে আবার আক্ষেপের সোনার কাঠি রূপার কাঠি ছুঁয়ে জাগিয়ে দিতাম।

কিন্তু দীর্ঘ বাইশটি বছর নাহিদের সাথে আমার দেখা হয়নি। যোগাযোগও হয়নি। আমি চেষ্টা করিনি। হয়তো ও নিজেও করেনি। করলে হয়তো দেখা হতো। আমার আগ্রহ অপ্রকাশ্য হলেও অনাগ্রহ ছিল না। কিন্তু নাহিদ সেই একটি চিঠি লেখার পর আর কোনোদিন চেষ্টা করেছে বলে জানি না।

কিন্তু দীর্ঘ বাইশটি বছর নাহিদের সাথে আমার দেখা হয়নি। যোগাযোগও হয়নি। আমি চেষ্টা করিনি। হয়তো ও নিজেও করেনি। করলে হয়তো দেখা হতো। আমার আগ্রহ অপ্রকাশ্য হলেও অনাগ্রহ ছিল না। কিন্তু নাহিদ সেই একটি চিঠি লেখার পর আর কোনোদিন চেষ্টা করেছে বলে জানি না।

আমারই বরং দেখা করার প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল। অথচ স্বীকারের সাহস কিংবা সুযোগ তৈরির দুঃসাহস কিছুই ছিল না। আজ হয়তো সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করতে চাইনি। আদতে আজ সুযোগ কিংবা ইচ্ছের চেয়েও প্রয়োজনের তাগাদাটা বেশি ছিল।

নাহিদ আমাকে বসতে বলে, ঠিক তার ক্লায়েন্টকে যেভাবে বলে। নাহিদ তার ক্লায়েন্টকে কিভাবে বসতে বলে আমি কি কখনো দেখেছি? বাইরে ঢাকার চৈত্রের গরমকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে ভেতরে এন্টার্কটিকার শীতলতায় কোট প্যান্ট টাই পরা ধোপদুরস্ত নাহিদকে তো আজ আমি প্রথম দেখলাম। আমি যে নাহিদকে দেখতাম, আমি যে নাহিদকে চিনতাম, আমি যে নাহিদের প্রেমিকা ছিলাম সে তখন কুড়ি বয়সের তরুণ। আমিও কুড়ি বছরের তরুণী। পিতৃহীন অনাথ নাহিদ তখন ক্লাস শেষ করে খালি পেটে টিউশনিতে যায়। ছাত্রের বাড়িতে খাওয়ানো নাস্তাটুকুই তার লাঞ্চ। বিকালে হাঁটতে হাঁটতে আমার হলগেট পর্যন্ত আসে। আমি রুমে পরে থাকা মলিন পোশাক পরেই বের হয়ে আসি। নাহিদের সাথে দেখা করতে আবার ভালো পোশাক পরতে হয় নাকি? আমার মলিন পোশাকে এমন তাচ্ছিল্য লেগে থাকত কি না জানি না। তবে এই যে যৌবনের উজ্জ্বল বিকেল নাহিদকে দিচ্ছি তাতে পরোক্ষ দয়া ঠিকই লেগে থাকত। আমি অস্বীকার করতে পারি না। আমি প্রতিষ্ঠিত পরিবারের মেধাবী মেয়ে, তায় আবার গড়পড়তা সুন্দরী। আমার কি পায়ের চটিতে তারকাঁটা মারা, ইস্ত্রীহীন শার্ট পরা কোনো ছেলের সাথে বিকেল কাটানো মানায়? যার চোখেমুখে সারাদিনের পরিশ্রমী ক্লান্ত চকচকে ঘাম! আমার তো তখন দস্তুরমত মার্সিডিজ চড়ে লং ড্রাইভে যাওয়ার অধিকার, তার সাথে, যার গা থেকে বিদেশি পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে যৌবনকে উদ্দীপিত করে দেয়।

নাহিদ খুব কাছে এগিয়ে আমার কফির কাপটা আরও ঠেলে দেয় আমার দিকে। বাইশ বছর পর আমি বিদেশি পারফিউমের গন্ধ পাই। যৌবনের উদ্দীপনা পাই না বটে আকুল হয়ে একটু প্রশ্রয় চাই। বাইশ বছর আগের প্রশ্রয়।

বাইশ বছর আগে যে প্রশ্রয়ের জন্য নাহিদ হাপিত্যেশ করত। একটু হাত ধরা, গায়ে গা ঘেঁষা, আড়চোখে বুকের মাপ দেখা। ব্রা কিনে দেওয়ার বায়না করা। নিজের বিরক্তি এড়াতে কিছু তাচ্ছিল্যও ছুঁড়ে দিতাম ওর দিকে। আমার একটা ব্রায়ের দাম ৫০০ টাকা। তোমার তিনদিনের খাবার খরচ। অপমানটা গায়ে না মেখে বুঝি না বুঝি না করে নাহিদ দিব্যি অন্য প্রসঙ্গে চলে যেত।

মিশুদের ছাদের চিলেকোঠায় দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর যেদিন আমাকে আর নাহিদকে একঘরে রেখে বাকি সবাই বেরিয়ে গেল নানা অজুহাতে নাহিদ সেদিন বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। একদিন, সেদিনই আমরা সীমানা ডিঙিয়েছিলাম খিল আঁটা দরজার ভেতরে। আমার শরীর কেঁপেছিল নাহিদের স্পর্শে। হুঁশ হারিয়ে মত্ত হয়ে গিয়েছিলাম পরস্পর। হঠাৎ স্বাভাবিকতায় ফিরে উন্মত্ত নাহিদকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে কাপড় গায়ে চড়িয়ে দ্রুত নেমে এসেছিলাম মিশুদের ছাদ থেকে। মনে বোধহয় ফুঁসছিলাম, কত্তো সাহস মিচকা নাহিদের! কী যোগ্যতায় সে আমার কৌমার্য ভাঙতে পারে।

নাহিদ কার্ডটা খুলে দেখে, তোমার মেয়ের বিয়ে! সত্যি সত্যি, মনে হয় এই তো সেদিন তোমার বিয়ে হলো! নাহিদ এভাবে কথা বলে যেন আমি কোনোকালে নাহিদের কেউ ছিলাম না। কিচ্ছু ছিলাম না। নেহায়েত পরিচিত একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে ও। যে সম্পর্ক একদা আমি প্রাণপণে অস্বীকার করতে চাইতাম, সে সম্পর্কের স্বীকৃতি চাইছি প্রাণপণে।

নাহিদ কার্ডটা খুলে দেখে, তোমার মেয়ের বিয়ে! সত্যি সত্যি, মনে হয় এই তো সেদিন তোমার বিয়ে হলো! নাহিদ এভাবে কথা বলে যেন আমি কোনোকালে নাহিদের কেউ ছিলাম না। কিচ্ছু ছিলাম না। নেহায়েত পরিচিত একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে ও। যে সম্পর্ক একদা আমি প্রাণপণে অস্বীকার করতে চাইতাম, সে সম্পর্কের স্বীকৃতি চাইছি প্রাণপণে। যে আবেগী কথা একদা বিরক্ত করত আমাকে আমি বাইশ বছরের ব্যবধানে সেই কথাগুলিই খুঁচিয়ে তুলি, এখনো দুধ ভাত দিয়ে সেহেরি খাও নাহিদ? বিশাল হলরুমের সুসজ্জিত কক্ষে আমার বেখাপ্পা কথাটা ঠিক কোথায় ধাক্কা খেয়ে আমাকে অপ্রস্তুত হওয়া থেকে বাঁচাবে যেন বুঝে উঠতে পারে না।

নাহিদ আমার প্রতি চরম উপেক্ষা কিংবা অমনোযোগিতায় নিজের স্লিম ল্যাপটপে মনোযোগ দেয়। টক টক করে কীবোর্ডে আঙুল চালায়। স্ক্রিনের উজ্জ্বল আলোতে চকচক করে নাহিদের বিত্তের চর্বি। আমি মেলাতে পারি না দারিদ্র্যের নতজানু ভাঁজের সাথে এই টানটান চামড়ার নাহিদকে।

আর দুধ ভাত! জীবন অনেক বদলে গেছে। বলেই প্রসঙ্গ পাল্টায় নাহিদ। তো তোমার মেয়ের বিয়েতে যেতেই হবে? তোমার হাসব্যান্ড কিচ্ছু মনে করবে না?

হিমেল তো বেঁচে নেই, চরম মিথ্যেটা বলি আমি। আসলে হিমেলের এই বেঁচে থাকা তো মৃত্যুরই মতো। এইবার নাহিদ চোখ তুলে তাকায় যে চোখে আমি বাইশ বছর আগের আকুল ছায়া পড়তে পারি। ল্যাপটপ স্লিপিং মুডে রেখে নাহিদ যেন এবার একটু অবসর খুঁজে নেয় অতীতে ফেরার। কবে মারা গেল হিমেল ভাই? জানি না তো!

তুমি ফেসবুক চালাও না? সবাই তো জানে। আসলে সময় পাই না, কৈফিয়তের অসহায় সুর স্পষ্টই অকৃত্রিম লাগে আমার কাছে। নাহিদের ঘন ঘন ফোন বাজা, মেইল ঢোকার টিং টং, ঘরের অতিমাত্রার শীতলতা। কয়েক সেট হাতিলের সোফা সব সাক্ষী দিচ্ছে নাহিদের সময় নেই।

কীভাবে মারা গেলেন হিমেল ভাই, আমি বিস্তারিত বলার প্রস্তুতি নেই। ফোর্থ সেমিস্টারে পড়তে পড়তে হিমেলের সাথে যখন গাঁটছড়া বাঁধি হিমেল তখন তরুণ ব্যাংকার। হ্যান্ডসাম সেলারি। ঢাকায় ফ্ল্যাট। গাড়ি করে আসা যাওয়া। ছয়মাস অন্তর কক্সবাজার। নাহিদের আর খোঁজই রাখিনি আমি। নাহিদও খোঁজ না নেওয়াতে কী যে স্বস্তি পেয়েছিলাম তখন।

এই স্বস্তিই হয়তো স্বস্তি হয়ে থাকত হিমেল হঠাৎ অসুস্থ না হয়ে পড়লে। আমি আসল উদ্দেশ্যটা বলার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকি। এই সুযোগটা আমাকে নিতেই হবে। সুযোগ নিতেই এই মিথ্যেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

আমি ভাবতে পারিনি নীলা, দুদিনের জন্য বাড়ি গিয়ে তুমি বিয়ে করে ফেলবে। এতো ভেঙে পড়েছিলাম, জানো মাসখানেক ঘর থেকে বাইরে বের হইনি। নাহিদকে যেন ঘোরে পায়। পরে যখন বের হলাম, ঠিক করি আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে, নাহিদ বলতে থাকে।

নাহিদ জানতে চায় আমার মেয়ের বয়স কতো, ও এখন কী করে? আমার মেয়েটা এখন বাইশ। সেই বাইশ। নাহিদের ভেতর থেকে আগের নাহিদ বের হয়ে আসছে আমি টের পাই। আমি কতোটা আগের আমি হতে পারি বুঝি না। মেয়ের বিয়ে কুলিয়ে ওঠার দুশ্চিন্তা আমাকে পীড়িত করে রাখে। আমি আগের আমি হতে চাইলেও পারি না। বরং স্মৃতির যে মৌচাকে আমি খোঁচা দিয়ে নাহিদকে জাগাতে চেয়েছি নাহিদ এবার আমূল তাতে ঢুকে পড়ে। আমি ভাবতে পারিনি নীলা, দুদিনের জন্য বাড়ি গিয়ে তুমি বিয়ে করে ফেলবে। এতো ভেঙে পড়েছিলাম, জানো মাসখানেক ঘর থেকে বাইরে বের হইনি। নাহিদকে যেন ঘোরে পায়। পরে যখন বের হলাম, ঠিক করি আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে, নাহিদ বলতে থাকে।

আমার সবই হয়েছে নীলা, সব। যা থাকলে তোমাকে পাওয়া যেত। তোমাকেই শুধু পাওয়া হলো না। আমি অপরাধী হয়ে থাকি। যত যাই চাই, বুঝতে পারি প্রকৃতি প্রাপ্যটাই বরাদ্দ করে রাখে। বেশি চাইলেই হয় না।

হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নাহিদ। তার চেহারাটা অচেনার মতো বদলে যায়। ওকে নীলা তবে আসো এখন। বিয়েতে দেখা হবে। আমি ড্রাইভারকে বলে দেই, পৌঁছে দেবে।

এতো প্রস্তুতি, স্মৃতিচারণ, মিথ্যাচার সব ভেস্তে যাচ্ছে চোখের সামনে। আমি ডুবন্ত টাইটানিকের শেষ কাঠটা আঁকড়ে ধরি। চেহারা বদলে ফেলি নিমিষে। আমার প্রয়োজনটা অনেক বড়ো। মেয়েটা আজীবন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে বড়ো হয়েছে। সংসারের অনটন বোঝার মতো সচেতন করে তুলতে পারিনি ওকে। আমারই ব্যর্থতা। কানিজ আলমাসের কাছে সাজতেই হবে ওকে। বিয়েতে দুশো বর যাত্রী হবে।

মেয়েকে বলেছিলাম, বাবার চিকিৎসায় এতো খরচ বিয়েটা দুবছর পরে হোক। মেয়ে ক্ষেপে উঠল চোর দেখে ফেলা কুকুরের মতো। নিঝুম বিদেশ চলে যাচ্ছে মা। পড়তে। চার বছর পর ফিরবে। আমি ওকে চার বছরের জন্য একা ছেড়ে দিতে পারবো না। যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলো না।

সারাজীবন আমি যে কিছুই বুঝিনি তা এখন বুঝি। নাহিদের প্রেম, আকুতি কিছুই বুঝিনি। এবার কীভাবে টাকাটা চাইতে হবে তাও বুঝতে পারছি না। কাঁচুমাচু করে বলা যায়, নাহিদ তুমি হেল্প না করলে… সেদিকে যায়ই নি পরিবেশ। কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া কিভাবে বলি?

নাহিদ উঠে দাঁড়ায়, সাথে আমিও। এটাই ম্যানার। নাহিদ বোধহয় প্রথমবার পূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকায়। তুমি তো আগের মতোই আছো নীলা, একটুও বদলাওনি। বয়স একটুও বাড়েনি তোমার।

তোমার রুমে সিসি ক্যামেরা আছে নাহিদ? নাহিদ হঠাৎ এ প্রশ্নে একটু বোকা হয়। আমি চেয়ার ছেড়ে নাহিদকে জড়িয়ে ধরি। করছ কী করছ কী— নাহিদ তীব্র প্রত্যাখ্যান করে আমাকে। নাহিদকে প্রলুব্ধ করি আমি, শাড়ির আঁচল ফেলে বুকের অর্ধাংশ উন্মুক্ত করে দেই। নাহিদ ধমক দেয়, এসব কী করছো তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি?

একদিন তো চাইতে খুব। আজ নাও। আজ নাও আমাকে নাহিদ। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ফুরিয়ে যাইনি আমি। নাহিদের চোখে বিস্ময় ছাপিয়ে ক্রোধ। যে ক্রোধ একদিন আমার দৃষ্টিতে ছিল মিশুদের চিলেকোঠায়।

প্রকৃতি সব ফিরিয়ে দেয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, নাট্যকার, মঞ্চাভিনেত্রী, শিক্ষক। বাংলাদেশ তার গল্পের আত্মা জুড়ে থাকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আশা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, বেদনা ও বৈষম্যকে বিষয় করে তিনি গল্প লেখেন, যা একই সঙ্গে ডকুমেন্টেশন এবং শুধু ডকুমেন্টেশনই নয়, আখ্যান; কথাসাহিত্য। তার গল্পে জীবনের বাঁকবদল স্পষ্ট এবং অন্যদের থেকে আলাদা এক স্বর, যে-স্বর আমাদের আত্মা খমচে ধরে, বেদনাহত করে। সমকালীন বাংলাদেশ তার সমস্ত রকমের ঘা, রক্তপুঁজ নিয়ে উপস্থিত থাকে। ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি (২০১৫), প্রসঙ্গটি বিব্রতকর (২০১৬), গোল (২০১৮), সেলিব্রেটি অন্ধকারের রোশনাই (২০২০), নদীর নাম ভেড়ামোহনা (২০২০) তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত বই। মঞ্চ তার অদ্বিতীয় সত্ত্বা। গড়েছেন নাট্যদল- জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী। মঞ্চায়িত হয়- কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি নাটক।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।