প্রতিশোধ
যাকে তুমি কেড়ে নেবে তাকে হারিয়ে ফেলবে ঠিক। প্রচলিত এই সকাল তাই শ্বাসকষ্টে ভরা। সূর্যের ঝাপসা হয়ে যাওয়া দিনে, দেখো কোনো বাগিচা নেই। যা যা গুপ্তবিদ্যা ছিল, দেহের হাড়গোড় ভেঙে তারা একদিন ঠিক হারিয়ে যায়। জগতের নরম সব গান পুনরায় পায় পরমায়ু। পুড়ে যাওয়ার জন্য যতটা তাপ দরকার তারা নয়নতারার ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা যৌক্তিক হলো আজ, আর তুমি জেনে গেলে তোমার ভুলগুলো।
ভাঙন
সংসার ভেঙে যাওয়ায় রান্নার ঘরে নামল তুমুল অন্ধকার। বাসনের ঝনঝন, রান্নার আনন্দে যারা বাজত, তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে ঢুকে গেল বস্তার ভেতর। চাকু, বটি এমনকি ঘরের পর্দার অন্ধকূপও ভাঁজ করে রাখা হলো তুখোড় মেধাযোগে। ছিঁড়ে যাওয়া অংশসমেত আস্ত জাজিমটাকে ঘর থেকে বের করা হলো অতি সাবধানে। মিনারেল পানির বোতলে পাহাড় জমে ওঠা বারান্দা আগের মতো থাকল।
নাপিতের ক্ষুর টানার মতো করে সমাজ আমাদের টেনে নিল, আমরা মেনে নিলাম ভবিতব্য। দুটো স্নানঘর, যেখানে প্রায় আত্মহারা হয়ে স্নান সারতাম, সেখান থেকে পৃথক পৃথকভাবে সরিয়ে নেয়া হলো বালতি, মগ, শ্যাম্পুর বোতল, শাওয়ার জেল। হলুদসবুজ সুতি কাপড়ের ভেতর টুকিটাকি জিনিসপত্র রেখে শক্ত করে গিঁট বাঁধা হলো। ঘরের ভেতর কোনো আয়না না থাকার দরুণ নিজেদেরকে পাশাপাশি দেখার প্রয়োজন থাকল না।
তদুপরি, যে সানকিতে ভাত খাওয়া হতো সেটিও তার জন্মতিথি মেনে যদিও অক্ষত, যদিও তার শরীর থেকে ভেসে আসছে বাসি হয়ে যাওয়া শিংমাছের ঘ্রাণ, তবু পরিষ্কার পর্ব শেষ হবার সাথে সাথে, নিয়মমাফিক তালা ঝোলাতে হলো সদর দরজায়।
বধূবরণ
তোমাদের বাড়ি থেকে অনেক উত্তরে আমাদের বাড়ি। কাঁচা রাস্তার ওপর ফুরফুরে ঘাস, তার ভেতর কি যেন এক পাখির ডিম! টিনের ঘর কাঁপানো বাতাসে তোমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দিকে আসে প্রতিফলিত সূর্য। আমাদের পুকুরে ভাসে শ্যাওলা। আধখাওয়া কদম, গাছ থেকে টুপ করে পড়ে পানিতে, এরপর ডুবে যায় নিচে।
চড়চড় করে রোদ ওঠা দিনে কল চেপে বের হয়ে আসা ঠান্ডা পানির স্রোত, তোমার বাড়িটাকে মনে করিয়ে দেয়। গাছপালা ঘেরা বাড়িতে কলাবতী আমের ছায়া। নাতি আর নাতনিময় ঘরে তোমার মা পাঁচন রাঁধেন, পুঁইয়ের বিচি দিয়ে ছবি আঁকেন ভাই, তোমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই নানা নানীর কবর।
সূর্যাস্তের মতো সরু গ্রীবা সমেত সুশীতল নারীর কলরব তোমার ভরা বুকে। মনে হয়, তুমি বরষার কোনো ভরা নদী। চাল ডাল, খুঁদকুড়ো, পানের বাটা সাজিয়ে সর্বনাশীকে যদি ঘরে আনো তবে শ্বাসরোধী খবরে ফুলে ফুলে ভরে যাবে গাছ। সিনাটান করে বাড়িময় হেঁটে বেড়াবে কালো বেড়াল, বিরান বাড়িতে সুখী সুখী মুখ নিয়ে আমি তাকে দুধ-ভাত খেতে দেব।
অসুখ
তোমার আম্মা করল্লাকে সবুজ রেখে তিতা ছাড়া ভাজি করেন। করল্লা সেদ্ধ হয়ে এলে কাঁচা মরিচ আর চিংড়ি ছড়িয়ে দেন। এরপর, আরও কিছুক্ষণ ভেজে চুলা থেকে নামিয়ে নেন। আম্মা বলেন সবুজ রংটাকে যদি পাইতে চাই তাহলে ঢাকনা ছাড়াই মাঝারি আঁচে রান্ধতে হবে। আম্মাকে আমার শিল্পী মনে হয়। করল্লাকে ধুয়ে, পানি ঝড়িয়ে বটিতে কাটেন মিহি করে। ভরাট দুটো হাতের বালা ঝিনঝিন করে বাজে সেই সময়। তোমারে বলা হয় নাই, তোমার গায়ে যেমন ঘ্রাণ পাইতাম আমি, আম্মার গায়েও একই রকম ঘ্রাণ। জ্বর বাড়লে, তোমার আম্মার রান্ধা করল্লা দিয়ে ভাত খাইতে ইচ্ছা করে।
জঙ্গলে বর্ষা যাপন
বর্ষাকালে জঙ্গল দেখেছি কিন্তু জঙ্গলে বর্ষা দেখি নাই। বর্ষা যাপনের জন্য নীরবতা দরকার। বনের সুডৌল পথঘাট, হাত পা ছড়ানো অন্ধকার রং অনভ্যাসে কতটা দূর্গম তা আজ শুনলাম। শুনতে শুনতে একটা আয়েশী অজগর কানের পাশ দিয়ে হিসফিস করে চলল, আর আমরা জড়োসড়ো হয়ে উঠে গেলাম। তীব্র ভয়ের এই বোধ এটা মূলত কল্পনায়। জানলাম, হাতির মতো অজগর সাপও তুমুল স্মার্ট। হাতি এবং সাপের আধুনিকতায় আমার আগ্রহ নাই।
আগ্রহ একটি স্বাধীন শব্দ। স্বাধীনতা শব্দটি জৈবিক ও আদিম। আদিম সমস্ত কিছুই আধুনিক। অচিন জঙ্গলে একটি আধুনিক বর্ষা আমার দেখা হয় নাই। বর্ষা ভাবলে আমি ভাবতে পারি মৃত কোনো বাড়ি, শাদা কাপড়ে জড়ানো ভারী বাতাস, যে বাতাসে দপ করে নিভে যাবে পিদিম। হৃদয়াক্রান্ত শিহরন এবং ঘন ঘন ক্রন্দন, এরা সাংকেতিক। সাংকেতিক ভাষা উপেক্ষা করে যারা বর্ষায় ডুবে যায় এবং সস্তায় গিলে খায় মদ, তারা ভাগ্যবান।
কবি