রবিবার, অক্টোবর ১৩

বন ভয়েজ

0

তোমাকে বলতেই হবে আজ আমায়, কি করে লুকিয়ে থাকে নিখাগি জীবন! কি করে আলো চুঁইয়ে পড়ে, কার্ণিশ বেয়ে। যাকে তুমি ভালোবাসবে না বাসবে না ভেবেও বেসে ফেলছো, সে তোমার কেউ, পূর্ব বা উত্তরজন্মে তার সাথেই কাটাকুটি খেলতে খেলতে দুপুর গড়াবে। এঁটো থালায় আঁকা হবে যে অস্থির চিত্র, তা তোমার সময়, সে তুমি চাও বা না চাও, তাকে তোমায় অতিক্রম করতেই হবে। এটুকু পেরোলেই দেখ শান্তির পথ, দূরে এঁকে বেঁকে মিলিয়ে গেছে, পাহাড়ের ওপরে…তোমাকে বলতেই হবে আজ, সেখানে ঝর্ণা আছে, অঢেল সবুজ,নীল উপছে পড়ছে আকাশ থেকে। পাখি ডাক… আর গুছিয়ে নিয়েছি টুকি টাকি, যা যতটুকু লাগে জার্নিতে, এবার বন ভয়েজ…

টেবিলে টেবিলে যখন ভরে গেছিল পৃথিবী, অনিশ্চয়তা কাপ হয়ে তখনও নড়ছে। চা-এর রঙে সন্ধ্যে নামছে। বিরহী যক্ষের মত নিজেকে পাহারা দিচ্ছি। যদি তুমি আসো, শরীরের যেখানে হাত রাখছি, ম্রিয়মাণ আলো ফুটে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে, যদি তুমি আসো, একটা কালো পাখি উড়ে যাচ্ছে,সেই কি তবে ট্যুরিস্ট গাইড? যদি তুমি আসো, উঠে দাঁড়াতেই নড়ে উঠলো দুর্বল পাহাড়, দুর্বলতাও এক আপেক্ষিকতা, দুর্লভতার মতোই। পা ফেলতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো, কার? একটা গান ভেসে আসছে, খুব হাল্কা শব্দ, কিন্তু মাদকতা আছে। থাকতেই হতো। যদি তুমি আসো, কিছুটা বিরতির পর, যেভাবে মাইল স্টোন থাকে।

….হুঁ আর তারপর? কতটা বলা হলো বল’তো। আগে বলি, সে আসলে লিখতে চেয়েছিল একটা রূপকথার গল্প। যে গল্পে রাজা রাণী, সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি, আর একটা বন্ধ সিন্দুকে রয়েছে প্রাণ। সাদা আর কালোর গল্প যেমন হয়। ডোডোকে নিয়ে তার এ এক খেলা। এই যে বিছানাটায় সে শুয়ে, অনন্তকাল, তার হাত নড়ে না, পা নড়ে না। কিন্তু ইচ্ছে? তাকে কি কেউ মারতে পারে? নাকি প্যারালাইজ করে রাখা যায়, তাই সে এখন নাচতে এসেছে, কুমারীদের গ্রামে। এ এক আদিবাসী গ্রাম। কেবল অবিবাহিতা আদিবাসীরাই এ গ্রামে থাকতে পারে। কোর্টশিপ হলে ছেড়ে যেতে হয় অন্যত্র। ড্রাম বাজছে, যেমন বাজে, সামনে প্রসারিত অগ্নিক্ষেত্র, মহুয়া অঢেল, সে এখন নাচছে, ওই ভোরের সূর্য ওঠার আগে, এদের এমনটাই রীতি। কোমরে হাত, হাতের মধ্য দিয়ে আর একজনের হাত, পায়ের সাথে পা,ওরা নাচছে। ঘটনা যাই ঘটুক সে লিখছে কিন্তু… বেলুন, আর সাদা পায়রার কথা, যেভাবে আবহমান পৃথিবী শান্তিকে দেখে রঙিন চশমায়। তলপেট ভারি হলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে যায় কুকুর জন্মের কথা। তেমন কিছুই না, আশ্রয়হীন হলে যেভাবে ঘাড় কামড়ে সরে যায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, আর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে সন্তান আড়াল করে। তাকে নিরীহ ভেবো না। তার কান তীব্র, চোখ নিমিলীত, কিন্তু জাগ্রত, বাতাসে বিন্দুমাত্র বারুদ গন্ধ পেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। আর, তোমাকে বলতেই হবে, এই সব মাতৃত্বকালীন সতর্কতার কথা। যার আগে ও পরে কেবল এক খাড়াই লম্বা জার্নি…যদি তুমি আসো, নক্ষত্র পথ দেখাবে, যেভাবে বেথেলহেমে দেখিয়েছিল…

এই যে মাথার নিচে রাখা বালিশ, তাতে ঘা হবার মতোই দাগ, এক দিক ফিরেই তো বহু দিন, ডোডো চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। কিন্তু সে তো ছেলে মানুষ, কতই বা ক্ষমতা তার। কিন্তু ইচ্ছে, সে তো দিব্য পাশ ফিরতে পারে। সে তো উঠেও বসে দিব্য! এবার সে পৌঁছায় রেইন ফরেস্টে। অবিরাম বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে চাষ করছে চাষী। মাথার টোকা যেন রেইন পাইপ। অবিরাম ঝরছে জল। গোরু নয়, এখানে হাল টানে বুনো মোষ, যাকে বাইসন বলে, পাশে চাষি বউও হাঁটছে দ্রুত। ওরা কি যেন একটা গান গাইছে, ওদের মুখ গুলো এত বৃষ্টিতেও লাল টকটকে। সেও হাত লাগায়, হেই সামালো হেই সামালো…তার পেশী জুড়ে বিদ্যুৎ খেলছে, আর ফার্স্ট ফরোয়াডে, ফসল ফলছে দ্রুত। প্রজাপতি আর ভ্রমরের এ মুক্তাঞ্চলে তখন শীত শেষের বসন্ত, কিন্তু সে লিখছে, একটা সেতুর কথা, দড়ির। ধর, দুটো পাহাড়, নিচে বিস্তীর্ণ খাদ। সে লিখছে সমুদ্রের কথা, ত্রস্ত চুম্বকের কথা, যেভাবে জাহাজকে টেনে নিতো কোনো এক রাতের কুহক। আর একে একে আত্মসমর্পণ করত, নিরীহ যাত্রী সব, কেউ কাঁদছে, কেউ আপত্তি না করেই তুলে দিচ্ছে যা আছে সব, কেউ বা আপত্তি করলে দোনলা থেকে ছিটকে আসছে, গুলির ছররা। কিছু স্তব্ধতা, জেগে উঠছে লাইট হাউস। সে লিখছে একটা জার্নির কথা, যদি তুমি আসো, লাইট হাউস পথ দেখাবে, কতটুকুই বা পথ, ঝড় উঠলেও জাহাজকে থামতে নেই। ধীর গতিতে এগোতে হয়, ঈশ্বর ঠিক অভীষ্টে পৌঁছে দেন। অথবা শয়তান!

এই যে শরীর জুড়ে অজস্র ক্ষত, পোকা ঘুরছে, রক্ত উপছে পড়ছে, পচা গন্ধ, ওয়াটার বেডটাও জীর্ণ হলো, ডোডো আর কতটুকুই বা পারে, ক্যান্ডিড পাউডার ছড়ায়, তাতে কি? মুখে কিন্তু অঢেল হাসি। আর  ইচ্ছে! ইচ্ছে তো মিলিয়ে দেয় সব ক্ষত চিহ্ন, এবার সে আপেল বাগানে।

এই যে আপেল বাগান, অদূরেই মদ তৈরির কারখানা, সেখান থেকে সোজা মই উঠে গেছে আকাশ বরাবর। এখানে যারাই আসেন, তারা একবার ওই মইতে পা রাখবেই। স্বর্গের সিঁড়ি। শেষ অবধি কেউই  পারে না। পারার কথাও না। সেও পা রাখল। সাথে সেই গাঁও বুড়ো। যে কখনও নিজে যায়নি ওখানে। কিন্তু কারা যেন গেছেন শুনেছে। বয়স কত তার কে জানে! সাথে আজ ডোডোও। বুড়োর দম প্রবল। সিঁড়ি ভাঙতে তার কষ্ট নেই। আর সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতেই বলে চলেছেন একের পর এক গল্প। দূরের ওই যে গিরিখাত, আঙুল উঁচিয়ে দেখাচ্ছেন, ও পথেই এসেছিলো নাদির শাহ, তৈমুর লঙ, মহম্মদ ঘুরি, বাবর… সে দেখছে নিসর্গ! পাশের লেকে শালুক ফুটেছে, ওক আর ম্যাপল গাছ জুড়ে কচি পাতা, আপেলে আপেলে ছয়লাব, এমন কোনো জায়গাতেই সে আসতে চেয়েছিল…

সে লিখছে কিন্তু অন্য কথা, এমন কোনো অক্ষরেখাই কি বিষুবরেখা? মাঝ বরাবর দাঁড়ালে ওপারে অরোরা বোরিয়ালিস আর এপারে মনাস্টারি…গুম গুম গুম…লক্ষ্য কর, সে কিন্তু শব্দ প্রেমী। নিস্তব্ধতার সাথীদের যেমন হয় আর কী! সে লিখছে আসলে এক জার্নির কথা, সে লিখছে যদি তুমি আসো, একবারও খোঁজ করো উড়তে থাকা পাতাদের কাছে, ওরা তোমায় বলে দেবে ওই পথেই চলে গেছে ওরা। জার্নি যেমন হয় আর কী! যেভাবে অনন্ত নক্ষত্র রেখায় কাঠপেন্সিলে আঁকা হচ্ছে, একটা ঘর, নিতান্তই সাদামাটা, সামনে সামান্য বাগান, সেখানে ঈশ্বর আর বিপ্লব দাবা খেলছে, ভেতরে বারুদ জমছে।

তোমাকে বলতেই হবে আজ, সেখানে ঝর্ণা আছে, অঢেল সবুজ, নীল উপছে পড়ছে আকাশ থেকে। পাখি ডাক…আর গুছিয়ে নিয়েছি টুকি টাকি, যা যতটুকু লাগে জার্নিতে, এবার বন ভয়েজ…

সে আর ডোডো হেঁটে চলেছে… গ্যালাক্সি পেরনো এ জার্নি আসলেই ইনফাইনাইট। ‘ম্যানিলা’ এসেওছিলো। তবে বড্ড দেরি করে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম-১৯৭০। বিজ্ঞানে স্নাতক, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাইয় স্নাততকোত্তর। ‘ঐহিক’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। পেয়েছেন একাডেমি পুরস্কার-২০১৫, প্রকাশিত বই : তিতিরের নৌকো যাত্রা, হ্যালুসিনেটেড অক্ষরমালা ও নিঝুমপুরের না রূপকথা

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।