শুক্রবার, অক্টোবর ৪

বব মার্লের সাক্ষাৎকার : রাস্তায় ভবিষ্যৎ : ভাষান্তর : উপল বড়ুয়া

0

Motif-01বব মার্লে। পুরো নাম রবার্ট নেস্তা মার্লে। জন্ম ১৯৪৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, জ্যামাইকায়। মৃত্যু ১৯৮১ সালের ১১ মে, ফ্লোরিডায়। মাত্র ৩৬ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবন। কিন্তু ছোট্ট জীবনটি নিয়েই পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। রাস্তাফারি, র‍্যাগে মিউজিক ও মারিজুয়ানা মানেই মার্লে। রাস্তাফারি ধর্মানুসারীদের রাস্তাফারি, রাস্তাস, রাস্তাফারিয়ানস বা রাস নামেও ডাকা হয়। নিউজিল্যান্ড সফরে দেশটির রক মিউজিক সাংবাদিক ডিলান তাইতেকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। যেখানে দুজনে র‍্যাগে মিউজিকের আত্মা, মারিজুয়ানাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাইতে জানতে চেয়েছেন, মার্লের জীবন দর্শন সম্পর্কে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন বর্ণনাকারীও। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। ‘নিউজিল্যান্ড ইন্টারভিউ ১৯৭৯’ নামে জিনিয়াস ডটকমে প্রকাশিত মার্লের এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন উপল বড়ুয়া। তিনি এখানে ইচ্ছেকৃতভাবে সাক্ষাৎকারটির কিছু প্রশ্নোত্তর অনুবাদ করেননি। এ ছাড়া মার্লের কথায় কথায় ‘you know?’ বলার মুদ্রাদোষও কিছু ক্ষেত্রে এড়িয়ে গেছেন।


bob marley

বব মার্লে


আপনি কি সবসময় শুধু একজন র‌্যাগে মিউজিসিয়ান হতে চেয়েছেন, নাকি আগে রক ও সোল মিউজিকও করতেন?

মার্লে: আসলে… আমি প্রচুর গান শুনতাম, জানেন? মানে শুরুর দিকে… রেডিওতে বাজানো গান শুনতাম। আমাদের রেকর্ড কেনার সামর্থ্য ছিল না, তাই রেডিও শুনতাম। এবং রেডিওতে যা বাজত তাই শুনতাম। আমি আসলে ওসব কিছুর মধ্যে ছিলাম না। আমার পছন্দ ছিল—তারা এটাকে বলে আধ্যাত্মিক সংগীত। এটা আমাকে বিপ্লবী করেছে।

 

কত দিন ধরে আপনি রাস্তায়?

মার্লে: আমি তখন থেকেই রাস্তায়। কিন্তু কত দিন ধরে রাস্তায় আছেন সেটি নয়, বিষয় হলো বেড়ে উঠতে আপনার কত দিন লাগল—কারণ আপনি যেমন তেমনই আপনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আপনি কখনো পালটাবেন না, পরে যদি আপনি কিছু পরিগ্রহণও করেন—আপনার নিজের ভাগ্য লেখা হয়ে আছে। তাই আমরা সৃষ্টি থেকে রাস্তা। বিষয়টা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। আমরা শিক্ষিত মানের লোক পেয়েছি, কিন্তু আমাদের এখনো এমন লোক আছে, তারাও এটা বুঝাতে পারবেন না। তবে আমি সাধারণ জ্ঞানের মানুষ। যার অর্থ হলো, যখন আমরা বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করি তখন খুবই, খুবই সহজপন্থায় ব্যাখ্যা করি। যেভাবে আমি এক শিশুকে ব্যাখ্যা করি। শিশুরাও বুঝবে, জানো? তাই আমরা এখন বলি, বাইবেলের মতো। বাইবেল মতে, ঈশ্বর বলেছেন তিনি রাজার রাজা, প্রভুর প্রভু, বিজয়ী, জুডাহ উপজাতির সিংহ হয়ে ফিরবেন। এবং তিনি ফিরে আসবেন নতুন নামে। এবং তাঁর নতুন নাম বিধর্মীদের কাছে ভয়ংকর হবে।

 

ড্রেডলকস কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
(ড্রেডলকস: রাস্তাফারিয়ানদের এক প্রকার চুলের স্টাইল। চুল ধোয়া হলেও আঁচড়ানো ও পেঁচানো হয় না। ভেজা চুল বিনুনি হয়ে ঝুলে থাকে চারপাশে।)

মার্লে: এটা? (নিজের ড্রেডস চুলের দিকে দেখিয়ে) ম্যান, এটা আমার পরিচয়। হ্যাঁ, এটাই আমার পরিচয়।

 

রাস্তা হলেই কি আপনার ড্রেডলকস থাকতে হবে?

মার্লে: আচ্ছা, যদি আপনি রাস্তার অনুসারী হোন তবে আপনি বলবেন না কেন আপনার এটা থাকা অনুচিত, কারণ আপনি জানেন স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতা এবং আপনি খেয়ালখুশি মতো মাথা নত করবেন না। তবে এটা বলার বিষয় নয় যে, ‘আমি রাস্তা হতে পারব না কারণ আমি এটা পছন্দ করব না।’ করবেন? এমন কিছু হতে পারে না। তাহলে এটা হবে বোকামি। আপনি নিজেই জানেন যে, এটি ঈশ্বরের সৃষ্টি আমি এবং আমি কোনো জীবন কোনো বাধ্যবাধকতা চাই না। যার অর্থ আপনিই আপনার, এই প্রথম আপনি আপনাকে ধরে রেখেছেন। আপনার যা করতে মন চায় করেন। লোকজন আপনার সম্পর্কে কিছু বলতে চায়—আপনি পাত্তা দেবেন না কারণ… আপনি জানেন আমি কী বলতে চাই। এমনকি তারপরও আমাদের প্রত্যাবর্তন আছে… (শ্রবাণাতীত)

 

বর্ণয়িতা (ন্যারেটর): সম্ভবত রাস্তাফারিজমের সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো দর্শনের কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে মারিজুয়ানা সেবন। যার আনুষ্ঠানিক নাম গাঁজা। রাস্তারা এটাকে সাধারণ কথোপকথনে ‘হার্ব’ বা ‘ভেষজ’ হিসেবে বর্ণনা করেন, এবং জানা যায়, বব মার্লে সপ্তাহে এক পাউন্ড ধূমপান করেন। এটি জ্যামাইকায় নিষিদ্ধ, এবং ধূমপানে অপরাধীর ১৮ মাস পর্যন্ত জেল শাস্তি হতে পারে।

 

মার্লে: আপনি যত বেশি হার্ব নেবেন তত বেশি রাস্তাফারি হয়ে উঠবেন। আমি কী বলছি শুনেছেন? আমি হার্ব নিই… হার্ব গুরুত্বপূর্ণ, তবে হার্ব সেসব লোকদের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যারা এটি এখনো নেয়নি। কারণ এটিই বাস্তবতা। আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা তাদের এমন কিছু বিক্রি করছি না যা আপনি আকাঙ্ক্ষা করেন। হার্ব—হার্ব হলো উদ্ভিদ। হার্ব সবকিছুর জন্য খুবই ভালো। কেন সেসব লোকেরা যারা সবার জন্য ভালো করতে চায়, যারা নিজেদের সরকার বলে—কেন তারা বলে না, আপনি কখনো হার্ব ব্যবহার করবেন না? দেখেছেন? এবং আমরা এটা নিই এবং খুঁজে পাই না… আমরা কেবল তাদের বলতে দেখি, ‘না, তোমরা এটা নেবে না কারণ এটা তোমাদের বিদ্রোহী করে তুলবে।’ কীসের বিরুদ্ধে? মানুষের নিজের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে, কারণ তারা এসবই আকাঙ্ক্ষা করে… বলুন তাদের কিছু বস্তুগত জিনিস আছে এবং সেসব আপনার মনকে মোহিত করতে চায় এবং বলতে চায়, ‘আচ্ছা, আপনাকে কাজ করতে হবে, এবং আমরা আপনাকে পেনশন দেবো’। হার্ব আপনাকে নিজের দিকে তাকাতে বলে।

 

রাস্তা হলে কি ধূমপান করতে হবে?

মার্লে: নো ম্যান। তবে—এই সময়ে, আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার অবস্থান কেমন… আপনি এমন বোধের জায়গায় পৌঁছাচ্ছেন যেখানে আপনি যথেষ্ট শক্তিশালী। একটু ধূমপান করতে পারেন (ধূমপানের মতো অ্যানিমেশন করে দেখিয়ে)। এটা সমস্ত কোলাহলকে চাপা দেয়… যদি আপনি শহরে বাসও করেন তবুও আপনি শুনবেন না। কারণ আপনি চিন্তায় মগ্ন। আপনি জানেন, পুরো পৃথিবী আপনাকে বিভ্রান্ত ও উদ্‌বিগ্ন করেছে এবং আপনার চিন্তা করার সময় নেই। হার্ব এমন জিনিস যা আপনাকে একটু সময় দেবে, যাতে আপনি বাঁচতে পারেন। যদি আপনি এটা নেন।

 

অ্যালকোহল নিয়ে কী বলবেন?

মার্লে: অ্যালকোহল আপনাকে মাতাল করবে ম্যান। এটা শুধু আপনাকে মাতাল করবে, আপনি ধ্যান করতে পারবেন না। যখন আপনি অ্যালকোহল নেন তখন আপনি ধ্যান করতে পারেন না—আপনার মাথা আরও ঘোলা হয়ে যায়। তবে হার্ব হলো চৈতন্য।

 

এটাও আপনার সমস্যা করতে পারে, যখন আপনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যাবেন, যেখানে সম্ভবত এটা ‘বেআইনি’।

মার্লে: আচ্ছা, আমরা যা বলছিলাম… আমি এসব কেয়ার করি না। দেখেন, যারা এটাকে বেআইনি মনে করে তারা সংখ্যায় মাত্র কয়েকজন। দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ এটা চায়। বেআইনি ভাবা লোকজন যৎসামান্য, কারণ বন্দুক ও কারাগার এবং খারাপ জীবন আপনার সঙ্গে খারাপ আচরণই করে। তাই কিছু লোক… তবে আমি কিছু লোকের শক্তি চায়… এবং একমাত্র জনশক্তি হলো রাস্তাফারি।

 

বর্ণয়িতা (ন্যারেটর): আসলে, মার্লে শান্ত মানুষ, তার কাছে পৌঁছানো কঠিন কারণ রক তারকাদের ব্যস্ত রাখা হাইপ ভাইবের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি সাক্ষাৎকার না দিয়ে নিউজিল্যান্ডের অনেক সাক্ষাৎগ্রহীতাদের নিরাশ করেছেন। আকস্মিক কারণে নয়, আসলেই তিনি এমন বিষয়ের প্রতি আগ্রহী নন।

 

মার্লে: মিডিয়া। আমি যদি সংবাদপত্রে কাজ করতাম, অনেক সাক্ষাৎকার দিতাম। কারণ যা আমি বলতে চাই তাই বলতে পারতাম। কারণ যখন আপনি কারো সঙ্গে কথা বলেন, আপনাকে কারো কাছে যেতে হয়, এবং এটা তাদের ব্যাবসার জন্য স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। এবং জঙ্গিও যদি হয়, তারা এক প্রকার অপপ্রচার ছড়ানোর চেষ্টা করে। আপনি মিডিয়াকে তো চেনেন (হাসি)… নিয়ন্ত্রণ।

 

আপনার নিজের দেশ জ্যামাইকায়, রাজনৈতিক বন্দুক হামলায় আপনি একবার মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। নিজের অবস্থান থেকে যদি বলেন, কারো শখের বশে রাজনীতি চর্চা কী ভালো ধারণা বলে মনে করেন?

মার্লে: আচ্ছা… আপনি বলছেন শখের রাজনীতি? এটা কী জিনিস আমি জানি না। আপনি দাঁড়িয়ে আমার অধিকারের কথা বলবেন? কাউকে আমি পরোয়া করি না… কারণ আমার অধিকার হলো আমার অধিকার। আমার জীবনের মতো। আমার যা আছে তা হলো আমার জীবন, যার অর্থ হলো, আমি ওটা চাই না বা আমি এটা চাই না। যখন আমি পরীক্ষা করে দেখি, সবচেয়ে বড়ো মানুষটিও একসময় শিশু ছিল, তাই আমি জানি না কখন (তারা) এসব ধারণাগুলো পায়, শাসক হতে চায়, লোক চায়, এবং ‘শয়তানবাদ’ প্রয়োগে সহায়তা চায়। বুঝি না। নিতেও পারি না। আমি বিদ্র্রোহী লোক, আমি বিপ্লবী।

 

নিজেকে কি আপনি এভাবেই দেখেন?

মার্লে: হ্যাঁ, আমি নিজেকে বিপ্লবী হিসেবে দেখি, যে সাহায্য পায় না। এবং কারো থেকে ঘুস নেয় না। আমি এক হাতে লড়াই করি। সংগীত। রাস্তায় ভবিষ্যৎ। দেখেন? (হেসে রাস্তায় ভবিষ্যতের মুক্তি।)

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

উপল বড়ুয়া। জন্ম: ১৯ ডিসেম্বর। রামু, কক্সবাজার। প্রকাশিত বই: কানা রাজার সুড়ঙ্গ (কবিতা), উইডের তালে তালে কয়েকজন সন্ধ্যা (কবিতা), তুমুল সাইকেডেলিক দুপুরে (কবিতা) ও ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল (গল্প)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।