রবিবার, ডিসেম্বর ১

বাংলাদেশের মাংগা কমিকস ও আমাদের কমিকস চর্চা : শান্তনা শান্তুমা

0

মানুষ নিজের মনের তাড়নায় জন্ম থেকেই সৃজনশীল। তাই সৃজনশীল পেশা সকলকেই আকৃষ্ট করে। সৃজনশীল পেশা সেগুলোই যা আমরা শুধু ভোক্তার জন্য করি না পাশাপাশি নিজের মননশীলতার বিকাশের জন্যও করে থাকি। যেমন এনিমেটর, গায়ক, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, ডিজাইনার কিংবা মাংগা আর্টিস্ট হওয়া। এসব পেশায় মানুষের তুষ্টির পাশাপশি নিজের সন্তুষ্টি সমান প্রয়োজনীয়। কিন্তু এসব পেশায় যেমন রয়েছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমনি নেই পেশাগত নিশ্চয়তা। আজ আমরা এমন একটি পেশার কথা বলব যা আমরা করি এবং যা নিয়ে কথা বলব। আমরা আজ কথা বলব মাংগা অর্থাৎ জাপানিজ স্টাইল কমিকস নিয়ে।


শান্তনা শান্তুমা ১

মাংগা স্টাইলে আঁকা কমিকসের একটা পৃষ্ঠা  : শিল্পী শান্তনা শান্তুমা


কমিকস ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন না হলেও মাংগা ব্যাপারটি মোটামুটি নতুন। মাংগা কমিকস থেকে আলাদা এজন্যই এতে ব্যাকগ্রাউন্ড ও ক্যারেকটার দুইই গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্ত স্টোরিলাইন থাকা চাই। সেটা যে ধারার গল্পই হোক না কেন– ট্রাজিক, কমেডি, অ্যাকশন অথবা রোমান্টিক।

মাংগা– পরিচিত জাপানিজ স্টাইল কমিকস হিসেবে। মাংগার সূচনা ১২ শতকে। তখনকার ছবিযুক্ত স্ক্রোলগুলোই মূলত আজকের মাংগা সৃষ্টির অনুপ্রেরণা ছিল। ১৪ শতকে মাংগা শুরু হলেও তা উন্নতি লাভ করে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর। শিল্পী তাকাশি মুরাকামি বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতায় ব্যাথিত হয়ে মূলত সুন্দর ছবি বা কিউট পিকচার আঁকতে অনুপ্রাণিত হন যার পথ ধরে মাংগার মূল ড্রইং স্টাইল বর্তমান রূপ ধারণ করে। প্রথম সার্থক মাংগা হলো বিখ্যাত মাংগা আর্টিস্ট ওসামু তেযুকা’র মাংগা ‘অ্যাস্ট্রো বয়’ (১৯৫১) এবং মাচিকো হাসেগাওয়া’র মাংগা ‘সাযে সান’ (১৯৪৬)। আজ মাংগা ইতিহাসের এখানেই ইতি না হয় নিজের গল্পগুলো ঠিক বলে শেষ করা যাবে না।

কাজটি নিয়ে আমাদের ভালোবাসা অনেক আগ থেকেই। প্রথম ২০১০ সালে (সে কাজের শ্রী আর না দেখানোই শ্রেয়)। ক্লাসে কিন্তু বেশ সাড়া ফেলেছিল!

সেই অনুপ্রেরণায় দু’জন মিলে মাংগা আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করলাম। বেশ কিছু কাজ করলাম। কোনোটা ৮০ পেজ, কোনোটা ৬০ পেজ। ইন্টারনেট ছিলনা। বিশ্বের কাজ দেখার সুযোগ ছিল কম, রেফারেন্স দেখার সুযোগ ছিল আরও কম। যা করতাম সবই নিজের মতো মনগড়া কোনো নিয়ম না জেনে আর সেটাই ছিল আশীর্বাদ। আজকের এই পর্যায়ে আসতে সে সময়ের কাজগুলোর কোনো তাৎক্ষণিক ভূমিকা না থাকলেও এর ভূমিকা এখন কিছুটা দৃষ্টিগোচর হয়। এর ফলে আঁকার জড়তা কেটে গেছে, বানানোর ক্ষমতা বেড়েছে এবং প্রচুর প্র্যাকটিস হয়েছে।

২০১৩ তে মানবজাতির অবিস্মরণীয় আবিষ্কার পারসোনাল কম্পিউটার ইনটেল (আর) কোর টি এম ২ প্রসেসর সম্বলিত (২০১৩-২০২১ মে) হাতে পেলাম। এ যন্ত্র আমাদের রঙের খরচ কমিয়ে আনল। স্ক্যানের খরচ বাড়িয়ে দিল। পরবর্তীতে আরও কিছু ছোটোখাটো গ্যাজেট কেনা হয়েছে। এখন স্ক্যান খরচও হয় না!

২০১৬। আমাদের প্রথম ওয়ানশট কিংসা খিয়ং প্রকাশিত হলো স্বনামধন্য একটি ম্যাগাজিন থেকে। ৫ পেজের কাজটি হয়তবা আজীবনই আমাদের সব লেখাতে থাকবে। কাজটি আমাদের জীবন বদলে দিল। প্রফেশনাল আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করব, সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়ে ফেললাম!

শান্তনা শান্তুমা ২এরপর বেশ কয়েকটা কাজ করলাম ম্যাগাজিনের জন্য। কিন্তু কাজগুলো ম্যাগাজিনের জন্য ঠিক উপযোগী হয়ে উঠছিল না। হয় খুব সিরিয়াস, নয়ত খুব বড়ো। আমরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করি কিছুটা স্টোরিটেলার ধাঁচের কাজে, কৌতুক ঠিক আমাদের মতো না। তাই চেষ্টা করতে থাকলাম আর ব্যর্থতার পরিসর বাড়তে থাকল।

তখন দেশের বাইরে কিছু কাজ করলাম। স্যান জোসে, ক্যালিফোরনিয়ার একটি গ্রাফিক নভেল কন্টেস্টে আমাদের কাজ মেন্ডেল প্রদর্শিত হলো ২০১৭ সালে।

অন্যদিকে জাপান অ্যামবাসি, বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল মাংগা প্রতিযোগিতায় প্রতি বছর অংশগ্রহণ করতে থাকলাম (২০১৭-২০২১)। ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্মে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হওয়াটা সত্যিই গর্বের বিষয়।

২০১৮। আমরা বুঝতে পারলাম বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে কেবল মাংগা চর্চার জন্যই একটা পৃথক প্লাটফর্ম দরকার। তাই নিজেরাই সাহস করে ‘মাংগা স্টেজ’ নামে একটি অনলাইন ভিত্তিক মাংগা ওয়েবসাইট খুললাম, যেখানে আর্টিস্টরা তাদের কাজ প্রকাশ করতে পারবেন এবং পাঠকরা বিনামূল্যে ওয়েবসাইট থেকে কাজ পড়তে পারবেন। সেখানে আমাদের কাজের সাথে অন্য বেশ কিছু তরুণ শিল্পীর কাজ রয়েছে।

সত্যি বলতে, ‘মাংগা স্টেজ’ যে এতটা সফল উদ্দ্যোগ হবে, তা এর প্রারম্ভিক অবস্থায় বুঝতে পারিনি। সবার ভালোবাসায় আগামী ১০ই আগস্ট এটি তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। ‘মাংগা স্টেজ’ খোলার পর যেটা হলো, দেশীয় স্টাইলে মাংগা ফিউশন স্টাইলে সর্বজনগ্রাহ্যতা বৃদ্ধি পেল।

‘মাংগা স্টেজ’ সগৌরবে বিভিন্ন পপ কালচার কমিউনিটির সাথে যুক্ত আছে এবং তাদের ইভেন্টে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। বেশ কিছু পুরস্কারও যুক্ত হলো দেশের প্রথম মাংগা প্লাটফর্ম ও প্রথম অনলাইন গ্রাফিক নভেল প্লাটফর্ম হিসেবে ‘মাংগা স্টেজে’র ঝুলিতে। ‘মাংগা স্টেজে’ প্রকাশিত কাজগুলো প্রতিদিনই নতুন পাঠকদের ভালোবাসা পাচ্ছে।


শান্তনা শান্তুমা ৩

গ্রাফিক নভেল মেকিং কনটেস্ট ২০১৭


এখন আমরা বর্তমানে বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানেও মাংগা আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত আছি। বাংলাদেশের অন্যতম কমিকস পাবলিশিং সেই কোম্পানি, যেখানে দেশের নামকরা সব বাঘা বাঘা কমিকস শিল্পীরা কাজ করেন। অসাধারণ সেসব নামের মাঝে নিজেদের নামটা দেখতে বেশ ভালো লাগে! ওখানে কাজ করতে গিয়ে যাদের সাথে পরিচিত হয়েছি সবাইকেই নিজের পরিবারের মানুষের মতোই মনে হয়। মনে হয়, এতবছরের কষ্ট ও সাধনা বৃথা হয়ে যায়নি।

বেশকিছু পপ কালচার ম্যাগাজিনেও মাংগা আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছি।

আমাদের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজের নাম:

• বাশাআপ
• লকারের চিঠি
• কিনসা খিয়ং
• চিরভাসমান
• প্রতীক
• শিকার
• অগ্নিযোদ্ধা
• প্রমোদতরীতে আতঙ্ক
• টানাপোড়েন


মাংগা আর্টিস্ট হিসেবে জীবনটা অনেক রোমাঞ্চকর। মাংগার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সেটিংয়ে বিচরণ করা যায়। শূন্য থেকে একটি জগত নির্মাণ করা এবং বিভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার থ্রিলটাই অন্যরকম। যখন পাঠকরাও আর্টিস্টের দৃষ্টিতে দেখতে পায়, তখন কাজটির পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায়।


শান্তনা শান্তুমা ৬

শান্তনা শান্তুমার আঁকা মাংগা স্টাইলের কমিকসের দৃশ্য


কিন্তু মাংগা আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করা বেশ ধৈর্য ও সময়সাপেক্ষ। আর্টিস্ট হিসেবে যত পর্যবেক্ষণশীল হওয়া যায়, মাংগা ততই প্রাণবন্ত হয়। মাংগা আর্টিস্ট হিসেবে আমাদের দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা শ্রম দিতে হয়। বাইরের দেশে আরও বেশি। সব কাজ যে সফলতার মুখ দেখবে এমনটা নয়। কোন কাজটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে তা পাঠকের হাতে যাওয়ার আগে ধারণা করাও দূরহ। কাজের পরিমানটা খুব বেশি এবং অনিশ্চিত। প্রচণ্ড ভালোবাসা, কাজের প্রতি অনুরাগ, ধৈর্য, সহ্য করার ক্ষমতা এবং কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলেই কেবল এই পেশায় আসা উচিত।


শান্তনা শান্তুমা ৭

শান্তনা শান্তুমার আঁকা মাংগা স্টাইলের কমিকসের দৃশ্য


কথা হলো তবে আমরা কেন মাংগা আঁকব? কারণ আমরা ভালবাসি এবং আমরা বিশ্বাস করি চর্চা, ধৈর্য ও শ্রমই পারে সাফল্য এনে দিতে। একটি ছোটো গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করা যায়। এতে মাংগা কেন আঁকবো তার ছোটো একটি উত্তর পাওয়া যেতে পারে। গল্পটি নতুন নয়, আগেও বলেছি, আবারও বলছি।


শান্তনা শান্তুমা ৪

কাজের স্বীকৃতি


টাইটানিক নিয়ে ২০১৭ সালে আমাদের গবেষণা থেকে আমরা একটা মাংগা করলাম, নাম চিরভাসমান। আমাদের মাংগাটি ছিল লন্ডনের বিখ্যাত লেখক ও গবেষক টিম ম্যাল্টিনের বই অবলম্বনে। এত বছরের গবেষণার ফলটা কাওকে পড়াতে না পেরে অত্যন্ত মর্মাহত ছিলাম। ২০১৮ তে আমরা ভাবলাম টিম স্যারকে আমাদের কাজটা দেখানো উচিত। জানতাম, তাঁর মতো বড়ো মাপের মানুষ কখনই আমাদের মতো মাংগা আর্টিস্টের মেইলের উত্তর দিবেন না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটল সম্পূর্ণই ব্যতিক্রম। তিনি শুধু দেখলেনই না, আমাদের প্রশংসা করলেন এবং কাজটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে অনুরোধ করলেন যেন তিনি পড়তে পারেন! আমরা কর্মে লেগে গেলাম। তিনি প্রুফ রিড করে আমাদের দিলেন। সাথে দিলেন তাঁর গবেষণার আরেকটি নথির লিংক। সঙ্গে পেলাম লন্ডনে গেলে তাঁর কোম্পানিতে ভিজিট করার আমন্ত্রণ। যেই রিসার্চারের গবেষণা নিয়ে কাজ করেছি, সরাসরি তাঁর কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়া, সে তো বিশাল আশীর্বাদ! অনেক জাপানিজ মাংগা আর্টিস্টেরও হয়তো এমন সৌভাগ্য হয় না। এরকম বেশ কিছু ছোটো ছোটো সার্থকতা আছে বলেই শত ব্যর্থতা ও বাঁধার পরেও মাংগা লেখার অনুপ্রেরণা পাই। জীবনে মাংগা আর্টিস্ট হওয়ার সার্থকতা আরেকবার অনুভব করলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম মাংগা ছাড়বো না।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মাংগা আর্টিস্ট ও ফ্রিল্যান্স ইলাস্ট্রেটর। মাংগা স্টেজ ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম আর্টিস্ট যারা উপমহাদেশে প্রথম বাংলায় মাংগা তৈরি করেন। তাদের আঁকা একাধিক প্রকাশিত কমিকসের বই বাজারে পাওয়া যায়।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।