শনিবার, অক্টোবর ১২

বিপাশা : কৃষ্ণ জলেশ্বর

0

অনেক বছর হ’ল সে কোথায় পৃথিবীর মনে মিশে আছে।
জেগে থেকে কথা ব’লে অন্য নারীমুখ দেখে কেউ কোনোমতে
কেবলি কঠিন ঋণ দীর্ঘকাল আপামর পৃথিবীর কাছে
চেয়ে নিয়ে তার পর পাশ কেটে, মেয়েটির ঘুমের জগতে
দেনা শোধ ক’রে দিতে ভালোবাসে, আহা।

এইটা জীবনানন্দ দাশের ‘বিপাশা’ কবিতার অংশ। অধ্যাপক গোলাম ইলিয়াস মাস্টার্সের ক্লাসে আবৃত্তি করেছিলেন। লম্বা করে সুন্দর মেয়েটার নাম বিপাশা শুনে তিনি কবিতাটি আবৃত্তি করেন। তার প্রিয় কবিতা। জীবনে বহুবার তিনি আবৃত্তি করেছেন। একেবারে মুখস্ত।

 


গোলাম ইলিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ছাত্র-ছাত্রীদের ইতিহাস পড়ান। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই করছে। তিনি শিক্ষকদের কোয়ার্টারে থাকেন। একাই। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর বিশ হয়ে গেছে। একটা মেয়ে। দেশের বাইরে। ওর পড়াশোনা শেষ। চাকরি করে। বিয়ে হয়ে গেছে মেয়েটার।

 


অনার্সের ফোর্থ সেমিস্টারের ক্লাসে তিনি যখন অ্যানশিয়ান্ট সিভিলাইজেশন পড়াতে গেলেন আজ তখনই দেখলেন ছাত্রদের মাঝে কেমন একটা পরিবর্তন। ওরা কেউই তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। কিছুটা আড়াল ফিসফাস। ক্লাসটাও জমল না। ক্লাস শেষে তিনি ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে। তখন প্রফেসর জামিল এসে জানাল ঘটনাটা।

 


অধ্যাপক গোলাম ইলিয়াসের একটা গোপন ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে।

 


গোলাম ইলিয়াস অনেকক্ষণ বসে থাকলেন চুপচাপ। অফিস সহকারী মনসুর এককাপ এলাচ চা দিয়ে গিয়েছিল। ঠান্ডা হচ্ছে। তিনি তাকিয়ে আছেন কাপের দিকে। সেই কখন থেকে কত জন ফোন দিচ্ছে! ভাইব্রেট তুলে যাচ্ছে সাইলেন্ট ফোন।

 


মাস্টার্সের একটা ক্লাস আছে তিনটায়। বিপাশাদের ক্লাস। তার মাথায় ‘বিপাশা’ কবিতাটি ঘুরপাক খাচ্ছে।

আকাশে রৌদ্রের রোল, নদী, মাঠ, পথে বাতাস
সেই স্বার্থ বুকে নিয়ে নিরুপম উজ্জ্বলতা হ’ল;
শূন্যের সংঘর্ষ থেকে অনুপম হ’ল নীলাকাশ;

 


বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুস্তফা আসলেন। বসলেন গোলাম ইলিয়াসের কামড়ায়। নরম স্বরে বললেন, ‘ইলিয়াস ভাই, আজকে আপনার আর ক্লাসে যাওয়ার দরকার নাই। আপনি বাসায় চলে যান। মুহিত সাহেবকে দিয়ে দিচ্ছি সাথে। আমার গাড়ি নিয়ে যান।’ গোলাম ইলিয়াস জানতে চাইলেন, ‘ছাত্ররা কি আন্দোলন-টান্দোলন করছে নাকি? আমার বহিষ্কার চাচ্ছে?’ অধ্যাপক মুস্তফা গলা পরিষ্কার করলেন, স্বভাবের কোমল স্বরে জানালেন, ‘না, এখনো এমন কিছু আসেনি কানে। তবে সতর্ক থাকছি। বুঝেন তো আজকালকার পোলাপান!’

 


গোলাম ইলিয়াস তার স্মার্ট ফোনে নিজের নাম লিখে সার্চ দিলেন গুগলে। এতোক্ষণ তার মনে পড়েনি ব্যাপারটা কী তা দেখার জন্য। তিনি শুনেছেন শুধু তার একটা গোপন ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে তিনি নাকি কী যেন করছেন! খুব অশ্লীল একটা ভিডিও। ব্যাপারটা নিজেই দেখতে চাইলেন। তিনি দেখলেন নিজের স্নানঘরে তিনি একা। তিনি তার ষাট বছরের নিঃসঙ্গ শরীর নিয়ে ভ্রমণ করছেন। নগ্ন। আর সুর তুলছেন আদুরে কণ্ঠে ‘বিপাশা, আমার বিপাশা, সোনা আমার’।

 


মাস্টার্সের বিপাশা নামের মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে গোলাম ইলিয়াসের সামনে। গোলাম ইলিয়াস মনে করার চেষ্টা করলেন কোন ইউনিভার্সিটিতে যেন মেয়েটা আন্ডার গ্রাজুয়েট করেছে। মনে করতে পারলেন না। মেয়েটা বলল, ‘স্যার! আমি তো মুখ দেখাতে পারছি না।’ গোলাম ইলিয়াস অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়েটার দিকে। তার মনে হলো মেয়েটা সুন্দর। টানা চোখ। বিপাশা বলল, ‘ছিঃ! লজ্জা নেই! মেয়ের বয়েসী একটা মেয়েকে নিয়ে মনে মনে! ছিঃ! আমি আর এখানে ক্লাস করতে আসতে পারব না। আমার স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, সব আপনি নষ্ট করে দিয়েছেন!’

গোলাম ইলিয়াস চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। মেয়েটা সত্যিই সুন্দর।

‘স্বাতির মতো সুন্দর!’

 

১০
‘মানুষের তবে আর একান্ত গোপন কোনো জীবন থাকবে না! নিজের ওয়াশরুমেও থাকবে না নিজস্ব পরিভ্রমণ!’ ভাবছিলেন গোলাম ইলিয়াস। কে কখন গোপন ক্যামেরায় সব ধরে ফেলছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বে। অদ্ভুত! বিপাশা কতোটা ঘৃণা ছড়িয়ে গেল! সুন্দরকে কামনা করে না কে? সে বৃদ্ধ বলে সুন্দরকে সে কামনা করবে না? পৃথিবীর সব ফুল প্রস্ফুটিত হবে আর সে মনে মনেও তার ঘ্রাণ নিতে পারবে না?

 

১১
বিপাশাকে বলা হয়নি। গোলাম ইলিয়াস বলেননি। তার মৃত স্ত্রীর নামও বিপাশা। কামরুন্নাহার বিপাশা।

 

১২
তবু স্বাতির আলো— শিশিরের মত তার অপরূপ চোখ
নিজের শরীর মন প্রাণশিল্পী আর
না জাগায়ে প্রেমিকের ঋতু পরিবর্তনের মত;
নারী আজ সময়ের নিজের আধার।

—বিপাশা, জীবনানন্দ দাশ

গোলাম ইলিয়াস তাকিয়ে আছেন জানালা দিয়ে। একটা টাংস্টানের বাল্ব জ্বলছে তার কামড়ার বাইরে। বাল্বটাকে ঘিরে অসংখ্য ঘাস ফড়িং উড়ছে আর উড়ছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম বাংলাদেশে। প্রকাশিত গল্পের বই 'আনোহাবৃক্ষের জ্যামিতি'।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।