রবিবার, নভেম্বর ১০

মিলির নাকফুল : স্নিগ্ধা বাউল

0

নাকফুলটা কেনার আগে ভাবা যায়নি কেন কেনা হবে। কয়েকটা নাকফুল মিলির আছে। আজকাল এটা এক সমস্যা, এক দোকানে গেলেই দুনিয়ার সব পাওয়া যায়। মিলি বাজারের ফর্দটা ব্যাগ থেকে বের করে তাকাতেই নাকফুলটা ঝকঝক করে ওঠে। মিলি এগিয়ে গিয়ে তাকিয়ে থাকে কাচের শেল্ফের দিকে। আজকাল শরীরের বাড়তি মেদ নিয়েই ভাবতে ভাবতে দিন যায়। নিজেকেই অসহ্য লাগে মাত্রাতিরিক্ত। নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে যাওয়ার এইসব দিনগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে যে দৈনন্দিন জীবন চলে আসে তাতে অভ্যাস করে নিলেই মূলত ভালো থাকা যায়। টাকা নেই তবুও সাহস করে কিনে ফেলা হলো একটা নতুন রূপার নাকফুল।

নাকফুলটা পরে কিছু সময় মিলি আয়নায় দেখে। সরু নয় বরং থেতলে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়া একটা নাক মিলির। এ নিয়ে জীবনে কম কষ্ট হয়নি তার। কিশোরী বয়সে চোখে জল আসত, নিজেই নিজের নাক টেনে বলত— নাক উঠ, টিয়ার ঠোঁট…

নাকফুলটা পরে কিছু সময় মিলি আয়নায় দেখে। সরু নয় বরং থেতলে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়া একটা নাক মিলির। এ নিয়ে জীবনে কম কষ্ট হয়নি তার। কিশোরী বয়সে চোখে জল আসত, নিজেই নিজের নাক টেনে বলত— নাক উঠ, টিয়ার ঠোঁট… অথচ টিয়া মোটেও সুন্দর পাখি না, তার ঠোঁটও সুন্দর না। কেন যে মানুষ এইসব ভাবে।

বাজারের ব্যাগ থেকে দুটি ইলিশ, করলা, বরবটি, ডিম আর চা পাতা বের করতেই মিলির মনে পড়ে কাঁচামরিচ আনা হয়নি। এই মনে না থাকাটা আজকাল আর অভ্যাস নয় বরং রোগ হয়ে গেছে। মাকে ফোন করার কথা মনে থাকে না। অবশ্য মায়ের ফোন মানেই এক কথা…

—কী করস

—ফিরলাম মা

—খাইছস

—না, খাব

—কী খাবি

—জানি না, দেখি কি খাই!

—ভাত খা

—আচ্ছা, রাখি। পরে ফোন করব…

এই রেখে দেওয়াটা এক ধরনের আড়াল। দূরত্ব তৈরি করতে এমন রেখে দিতে হয়। মা আর একটু পরেই বলতেন মাছ ভাজি করা আছে ডিপ ফ্রিজে বের করে রান্না কর। পাড়ায় কার বিয়ে হলো, কার বাচ্চা হলো, কার বউ চলে গেল, কার মেয়ের কি হলো— এসব গল্প মা একটানা করতে থাকবেন। কথা বলতে বলতেই আসবে জীবনে সেক্রিফাইস করার প্রসঙ্গ। কেন আমি একজন মেয়ে এবং কেন আমাকে আমার জীবনে থাকা যাবে না সেটা বলা হবে কম করে দুইবার। সন্তানের প্রয়োজন জীবনে কতো এ বিষয়টা গোপন থাকবে না। একঘেয়ে তবুও ভালো লাগে মায়ের এইসব গল্প। অপ্রয়োজনের ভালোলাগার কথা বলারও কেউ প্রয়োজন আছে জীবনে। মায়ের সাথে এই একটা জায়গাতেই টিকে আছে ভালোলাগা। অন্তত বিস্বাদ লাগে না। বিস্বাদ লাগার আগেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতা মিলির আছে। কেবল পারছে না অবজ্ঞার সে স্থান থেকে, বেরিয়ে আসতে যেখানে পলি জমে জমে ঊর্বর হয়ে গেছে অভিমানের ভাষা। ভাবতেই মোবাইল বেজে যায়, টুং, টুং, টুং…

হাই মিলি, কই তুমি, কেমন আছো, কি করো, আমি ভালো আছি, মা কেমন আছেন তোমার, ভালো থেকো… এরকম টানা দশ বারোটা একই ম্যাসেজ এসে জলের মতো ঠান্ডা হয়ে যায় ঘরের পরিবেশ। মিলি বুঝতে পারে না সে ভালো আছে না খারাপ।

হাই মিলি, কই তুমি, কেমন আছো, কি করো, আমি ভালো আছি, মা কেমন আছেন তোমার, ভালো থেকো… এরকম টানা দশ বারোটা একই ম্যাসেজ এসে জলের মতো ঠান্ডা হয়ে যায় ঘরের পরিবেশ। মিলি বুঝতে পারে না সে ভালো আছে না খারাপ। মুঠোফোন হাতে নিতেই টের পায় ব্যবধান তো অনেক, একটি মহাদেশ নয় বরং এক গোলার্ধের। দিন রাতের এমন ফারাক পৃথিবীতে মানুষ বয়ে যাচ্ছে কীভাবে! সুখী সমৃদ্ধ এক জীবন সেই মানুষটার। এক দুই মাস পর এমন একটি বার্তা পেলে মিলি আবার বেঁচে ওঠে। হাসতে ইচ্ছে করে তার। মিলির নিস্তরঙ্গ জীবনে কেমন একটি ঢেউ তুলে আবার হারিয়েও যায় লোকটি।

ওফফফফফফফ… নিজের কণ্ঠে নিজেই আঁতকে উঠে মিলি। নাকফুলটা টানতেই কেমন রক্ত বেরিয়ে এলো। খানিক লেপটে দিয়ে বসিয়ে রাখে নাকফুলটা। চেপে বসিয়ে দিতেই নাকের ব্যথা কমে এলো। মিলি এবার আয়নার দিকে এগিয়ে যায়। বরই ফুলের মতো নাকফুলে তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। মাঝ বয়সের এই সুন্দরের একটা আলাদা ঘ্রাণ আছে মনে হয়। শাড়িটা খুলে মিলি আবার দাঁড়ায় আয়নার সামনে। পেটিকোট আর স্লিভলেস ব্লাউজে তাকে বেশ আবেদনময়ী আর লাস্য লাগছে যেন। মন বলছে সে যেন সমরেশ বা সুনীলের মাঝবয়সী নায়িকা। ৩৫তম জন্মদিনে ভেসে আসা বছর ছয়েকের ছোটো ছেলেটা, যে ভালোবাসার কথা বলে, তা বিশ্বাসের বাইরের জগৎ। যে নিজের আবেগে নিজেকে থামাতে পারে না তার জন্য অন্যের আবেগ খুব একটা মানে রাখে না। তবুও অযাচিত সে ভালোবাসার গল্প মিলিকে যেন জাগিয়ে দেয়। আহ কতো ভালোবাসা গেল আবার এলো জীবনের পথে!

মিলি তাকায় এবার তার নিজের হাতের দিকে। বহুদিনের আগের একটা হীরের আঙটি অনামিকায় জমা আছে। চাইলেই আরও কেনা যেত, কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে না। হাতঘড়িতে ঠিক নয়টা সাত বাজে। ভাত খেতে চাইলে বসানো যায়। মোবাইল বাজছে। কিন্তু ধরতে ইচ্ছা করছে না। মিলি তাকায় আবার নিজের দিকে। আচমকা একজন পুরুষ মানুষের মতো ছুঁতে ইচ্ছা করল নাকফুলটা। সে ছুঁলো বরই ফুলের নাকফুল… ভেতরে জেগে ওঠা নিজেকে ছুঁতে শুরু করে তখন মিলি। তার নিজের শরীর… সারা শরীর ছুঁয়ে দেখছে নিজে। মিলি ভালোবাসছে নিজেকে। এ এক শরীরজাগা ভালোবাসা। এই ভালবাসায় অন্ধকারের ক্লান্তি শেষে সকালের বারান্দায় ফুটে থাকে রক্তজবা।

নাকফুলটা খোলা হয়নি। সকালের স্নানঘরে জালের মুখে চিকচিক করে উঠে নাকফুলটা আবার। মিলি এগিয়ে যায়। এক মগ জল ঢেলে দেয় ফুল বরাবর। গড়িয়ে হারিয়ে যায় রূপার নাকফুল পাইপের অন্ধকার থেকে ভেতরে জলের নদীতে… সমুদ্রে… আরও দূরে…

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও গদ্যকার। নরসিংদী জেলায় জন্ম আর বেড়ে উঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষে যোগদান করেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে। কবিতা লিখছেন দীর্ঘদিন। গদ্যের কাজ পরীক্ষা আর নিরীক্ষামূলক। সরল ভাষায় বয়ান করে চলেছেন জীবনের পর্ব যা নিজস্ব এবং বহুমূখী।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।