শনিবার, জুলাই ২৭

মুহুর্মুহু মিউ মিউ : বেঁচে থাকাই মৃত্যুর প্রগাঢ় স্বীকৃতি : নিয়াজ মাহমুদ

0


‘মুহুর্মুহু’ শব্দটি বাংলায় ব্যবহৃত হয় একটু ভারিক্কি ধরনের শব্দ হিসেবে। তাই মুহুর্মুহু’র পর বজ্রপাত, তোপধ্বনি কিংবা হ্রেষারব─এসব শুনতে আমাদের কান অভ্যস্ত। কিন্তু কবি পিয়াস মজিদের লেখা ২০২১ সালের মার্চে প্রকাশিত কবিতার বইটির নাম হলো ‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’। এই বইয়ের নাম ‘ঘন ঘন মিউ মিউ’ অথবা ‘থেকে থেকে মিউ মিউ’ কেন দেওয়া হলো না─এমন এক ধন্দ নিয়ে বইটি পড়তে শুরু করি। কবিতার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা যা দেখতে পাবো তা আসলে ভাষা নিয়ে কবিদের নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইতিহাসও। কবিকুলের কাছে অন্য যেকোনো শিল্প-মাধ্যমের শিল্পীদের থেকে সমাজের প্রভাব ও প্রত্যাশা বেশি ছিল বরাবর। একারণেই হয়তো আমরা ‘বিশ্ব কবি’, ‘জাতীয় কবি’, ‘পল্লী কবি’ ইত্যাদি অভিধা কেবল কবিদেরই দিয়ে থাকি; জাতীয় ঔপন্যাসিক, জাতীয় ছোটোগল্পকার অথবা জাতীয় চিত্রশিল্পী হিসেবে কাউকে মনোনীত করি না।

Pias Mojid

মুহুর্মুহু মিউ মিউ | পিয়াস মজিদ | প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত | প্রকরণ : কবিতার বই | প্রকাশক : বৈভব | মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’-এর কবিতাগুলো কবি এক বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে লিখলেন, যে সময়ে পুরো এক শতাব্দীকাল পরে পৃথিবীর মানুষ পুনরায় আক্রান্ত হয়েছে এক সংক্রামক রোগের মহামারীতে। মানুষে-মানুষে বেড়ে যাওয়া যোগাযোগের সূত্রে চোখের পলকে এই মহামারী পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ‘অতিমারী’ হয়ে দাঁড়াল। প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেরিয়ে আসা এই প্যানডেমিকে যাবতীয় মৃত্যু-বিচ্ছেদের পাশাপাশি আমরা শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষেরা এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেলাম। লকডাউন আমাদের ছোটাছুটি-ভরা জীবনে হঠাৎ একটা ছেদ এনে দিলো। ঘরবন্দি পরিবারকে দেওয়ার মতো অনেকটা সময় হাতে। আমাদের এতদিনের ময়লা হয়ে থাকা ঘরের আনাচ-কানাচ পরিষ্কার হলো। ফুলের টবে রং করে আমরা সেখানে ডালিয়া-চন্দ্রমল্লিকার গাছ লাগালাম, সাথে ইউটিউবে কোনো এক শৌখিনের কবিতাপাঠে শুনলাম ‘সবচেয়ে আকাশ-নক্ষত্র-ঘাস-চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো’। শুধু কবিতা পাঠ কেন, প্রচুর মোটিভেশনাল ভিডিও ও রিল দেখে এবং আপলোড করে নিজের বিপুল পজিটিভিটি ইন্টারনেটের ইথারে ছড়িয়ে দিলাম দুনিয়াজুড়ে। কোভিডের অবসরে আবার অনেকদিন চর্চায় না থাকা মগজ কিছুটা অবসর পেয়ে, আর কিছুটা মোটিভেশনাল বক্তাদের কুমন্ত্রণায় পড়ে আমরা কেউ কেউ রংতুলি কিনে ছবি আঁকতে বসে গেলাম, বাকিরা সাহিত্য উদ্ধারকল্পে লেখালেখিতে হাত দিলাম। কিন্তু এসবের কিছুই আমাদের মনঃপূত হলো না, কারণ তখন আমাদের মনে শান্তি ছিল না। প্রতিনিয়ত স্বজনের আক্রান্ত হবার সংবাদে, অহরহ কাছে-দূরে মৃত্যুর সংবাদে, অপচনশীল প্ল্যাস্টিকের বডি-ব্যাগে মুড়ে কবরস্থ হবার ভয়, টেলিভিশনের খবরে নানা দেশে রোগীর অক্সিজেনের তীব্র সংকট, অর্থনীতি আগের স্থানে ফিরবার অনিশ্চয়তা─এসব দেখে-শুনে আমাদের মনে শান্তি ছিল না তখন। আর ভালো লিখতে পারা যেহেতু নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের ফসল, হঠাৎ অবসর মিলে যাওয়ায় শৌখিন কবি বা লেখক লিখতে বসলে ভালো লেখা বের হবে, এ কল্পনা অলীক। অর্থাৎ হাতে-গোনা কয়েকটি ব্যতিক্রম কাজ ছাড়া কোভিড পরিস্থিতিতে শৌখিন বা পেশাদার কোনো লিখিয়ে তেমন ভালো লেখা আমাদেরকে উপহার দিতে পারেননি।

এমন কৌতুহল নিয়ে পড়তে শুরু করি ‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’। প্রকৃত শিল্প দিন-ক্ষণ-উপলক্ষ-সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। প্রকৃত শিল্পী তাঁর যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই শিল্পী থাকেন। পুঁথি-পঞ্জিকা ধরে শিল্প নির্মাণ করেন মৌসুমী শিল্পব্যবসায়ী।

এসবের বিপরীতে, গত দুই দশক ধরে কবিতা লেখার সচেতন চর্চায় থাকা এক কবি বিশ্বের বিপন্ন এই পরিস্থিতির প্রতি কিভাবে সাড়া দেন─এমন কৌতুহল নিয়ে পড়তে শুরু করি ‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’। প্রকৃত শিল্প দিন-ক্ষণ-উপলক্ষ-সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। প্রকৃত শিল্পী তাঁর যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই শিল্পী থাকেন। পুঁথি-পঞ্জিকা ধরে শিল্প নির্মাণ করেন মৌসুমী শিল্পব্যবসায়ী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে উক্তিটি সাহিত্য-আলোচকের কাছে টেক্সটবুক-উদাহরণ, তাতে তিনি বলেছেন, ‘অন্তরের জিনিসিকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসিকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ। ’ অর্থাৎ চিরকালের বস্তু হয়ে উঠবার দিকেই সাহিত্যের গতিমুখ বলে তিনি রায় দিয়েছেন।

 


কবি পিয়াস মজিদের কাব্যপ্রয়াসের এক উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সেখানে সমকাল এবং মহাকাল যুগপৎ হাতে হাত ধরে অবস্থান করে। ‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’ বইয়ের প্রথম কবিতাতেই এমন সমকাল-মহাকালের যুগলবন্দি আমরা দেখতে পাই─‘ক্ষুধা-রক্ত আর রিরিংসার রেসিপিতে/ জমে ওঠে যুদ্ধভোজ/ ঘৃণাই যুদ্ধের বাপ-মা/ এত এত প্রকাশ ঘৃণার/ অথচ পৃথিবীর প্রতিটি সিনেপ্লেক্সে/ চলছে চলবে বিরতিহীন/ প্রেমের পিকচার। ’ [ফুলগন্ধ অন্ধকার] তাই আমরা ‘পাতাদের প্রতিবেদন কবিতায় লিখে রেখে কাটা সব গাছের গোড়ায় নিবেদন করি মানুষের রক্তমাখা পুষ্পের করোটি’। [ফুলগন্ধ অন্ধকার]

ক্ল্যাসিক হবার আকাঙ্ক্ষায় কবি সমকাল বিস্মৃত হন না। লেখেন, ‘এইমতো মরণের মাতৃভাষা জানুয়ারিতে বিষাদঘন হয়ে কী মধুর ছাপা হয়ে চলে ফেব্রুয়ারির বইমেলার পাতাতে পাতাতে’ [অস্তজানুয়ারির কবিতা]। ফেব্রুয়ারি আমাদের ‘ফাল্গুনের অভিজ্ঞানও’। প্রেমের ঋতুতে তাই প্রেমিকার কাছে কবির আকাঙ্ক্ষা─‘যে বহন-সক্ষম তুমি নামের মহুয়ায় বিভোর,/ মরণের মন্ত্র কতটুকু প্রগাঢ় হলে/ তুমি পাবে এই ফিকে বেঁচে থাকার স্বাদ/ সেই ফয়সালা হয়ে যাক আজ;/ ফাল্গুনের ফুলে, পাতা ঝরা ওমে। ’ [ফাল্গুনের অভিজ্ঞান]। জীবন আর মৃত্যুর এই অঙ্গাঙ্গি সহাবস্থানে আমাদের অন্তরে মন্দ্রসপ্তকে বেজে ওঠে গান─ ‘কার মিলন চাও বিরহী’।

কবিতা সম্পর্কে কবির বলার মত কথা শেষ হয়ে যায় না। কবিতা বস্তুটি কী সে সম্পর্কে কবি পিয়াসও নিরুত্তর থাকেননি। লিখেছেন, “জীবন থেকে মরণের দিকে যাওয়া─ এইই তো ছিল সোজাসাপ্টা রাস্তা। তবু ভুল করে যে মধুপথ বেছে নিল সে; লোকে সেই সন্দেহজনক সন্দর্ভকে ‘কবিতা’ বলে ডাকে।’ [অবশেষ]

বইটির কবিতাগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে আছে কবির অন্তর্বোধির অনুসন্ধান। ‘ব্রহ্মমিনার’ শিরোনামের তিনটি কবিতার সিরিজে এ অনুসন্ধান ব্যক্ত। এর প্রথম কবিতাটিতে আমরা পাই, ‘বৃষ্টির ভূবনে ব্যাখ্যা হয় বজ্রের তাৎপর্য। ‘সিরিজের কবিতাগুলো অনেকটাই উত্তর-উত্তরাধুনিক। সুখপাঠ্য নয় বলেপাঠকের নিকট সেগুলো কিছুটা দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। কিন্তু কবির নিজ আত্মার কাছে পৌঁছনোর প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি আছে এই কবিতাগুলোয়। ‘মায়ের গর্ভমাঠের মাটির অনন্ত থেকে অনিবার্য সাড়ে তিন হাত। / ব্যতিব্যস্ত সবাই অবাক তৃষ্ণাপানে; … বিক্ষত বসন্তের জন্য তৈরি তোমার ষোড়শোপচার, চৈতালি চুম্বন।’ [ব্রহ্মমিনার] যে যাপিত জীবনে ‘বুদ্ধবৃক্ষের বিগ্রহে হিংসা-হাওয়ার স্তব’, সেই ক্ষুধা ও নবান্নের সংসারে কবি সবাইকে স্বাগত জানালেন এ কবিতায়। ভিন্ন সুরে বাঁধা ‘ব্রহ্মমিনার ২’ এ কবির স্বীকারোক্তি,’এই যে গাছালি, গাছ তোমার/ সবুজ শিলাবিন্যাস জীবন আমার/ মৃত্যুর নির্বাচিত গল্প।’ ব্রহ্মমিনারে অন্তর্বোধের অনুসন্ধান কবিকে পোঁছে দেয় ‘মৃত্যুর মেটাফর’এ। মৃত্যুর ছায়াপথপৃথিবীতে আটকে পড়া জীবাত্মার অচেনা, কিন্তু তাতে মৃত্যুর প্রকটতা কিছুমাত্র কমে না। কবির বয়ানে, ‘শীতল এই অবরুদ্ধ আত্মা/ আমারই আহূত/ দাউ দাউ আগুনের আরাধনা। ‘ [মৃত্যুর মেটাফোর]।

‘ব্রহ্মমিনার ৩’ কবিতাটি অনেকাংশে উত্তরাধুনিকতাকে ধারণ করে। রূপক হিসেবে একটি হাঁসের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে আমাদের অন্তর্জগৎকে উদঘাটনের চেষ্টা করে কবিতাটি। যেমন এ কবিতায় কবি লিখেছেন─ ‘হাঁস তার জলশয্যায় দেখে,/ কবি নেই, গ্রহ ভরে আছে কবিতার কোর্সে/ কবিতার কায়া কই?/ আছে কবির কঙ্কালের সঙ্কলন। …… কবিতার পাঠে তাই সুন্দরের মাংসে ঢালা মসলার তীব্র খুব রক্তসুবাস। ‘

‘অন্ধকার তারাদের তোপধ্বনি’ কবিতায় আমরা কবিকে দেখি আত্মবিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করতে,

‘বেঁচে থাকা ফুরোতে হলে দুঃসাহসী দুঃস্বপ্ন লাগে!
বাস্তবের দাসেরা শুধু
শ্বাস নেয়ার প্রকরণ খোঁজে, আমাদের রবিশস্যের মাঠ,
কালেক্টিভ কনশাসনেস, আমাদের আঁতুড় উর্বরতায় সাজানো কিচেন!

‘কান্নার কারাগারে হাসিখুশি নতুন আসামী’ হিসেবে আবির্ভূত কবির উপলব্ধিতে আবহমান কালের উনুনে অল্প আঁচে বিরিয়ানি রান্না হতে থাকে; আর খাদক তার নিজেরই খাদ্য হওয়ার ঘ্রাণে উদ্বেল হয়। মৃত্যুর ক্ষুধার্ত মুখে আমরা গছিয়ে দিতে পারি আমাদের জংধরা জীবন। [প্রবচন, কবিতা ইত্যাদি]

এহেন অস্তিত্ববাদী শূন্যতায় আমরা ‘সকল নিয়ে শুয়ে থাকি উত্তেজক শূন্যতার সাথে সঙ্গমের আশায়’ [ভাইসব, বোনসকল]। এর কারণ হিসেবেও কবি একই কবিতায়উল্লেখ করেছেন যে ‘জন্মদিনের ঢেউ আমাদেরকে নিয়ে চলে কবরের তীরে’।

 


‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’ বইয়ের প্রথম এক তৃতীয়াংশে স্থান পাওয়া কবিতাগুলোর এবং শেষদিকে মুক্তগদ্যের স্টাইলে লেখা কবিতাগুলোর সম্পর্কে কেউ কেউ দুর্বোধ্যতার অভিযোগ আনতে পারেন। সহজ ভাবের কবিতা হয়তো কবি সচেতনভাবেই লিখতে চাননি এই কবিতাগুলি লেখার বেলায়। আবার যাঁরা পিয়াসের কবিতার স্টাইলের সাথে পরিচিত, তাঁরা হয়তো আশা নিয়ে পড়তে আসবেন, এবং আবিষ্কার করবেন যে তাদের চেনা কবি এবার চেনা পথে না হেঁটে অন্য পথে হেঁটেছেন। যেন বক্স অফিসে হিট হতে থাকাহালের নির্মাতা হঠাৎ করে একটা দুর্বোধ্য আর্টফিল্ম বের করলেন, যেটি তার নির্মাতাজীবনের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

অবশ্য গভীরতর ভাবনায় উপলব্ধি হয় যে, সুখপাঠ্যতার বিপরীতে দুর্বোধ্যতা আদতে কবিতা নির্মাণের আরেকটি স্টাইল মাত্র। কারণ কবি যত দ্রুত শেপ ভাঙতে পারেন, কবিতা বুঝবার ন্যারেটিভ তত দ্রুত আমাদের সামনে তৈরি হয়ে আসে না। উদাহরণস্বরূপ বলতে চাই, বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো, চাকা’ অথবা ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইদু’টো বেশিরভাগ পাঠকের ভালো লেগেছে, কিন্তু সেই কবিতাগুলো পড়ে বুঝেছে কে? বরং পাঠক ভালোবেসেছে কবিতাগুলো পড়ে বোঝা-না-বোঝার যে আলো-আঁধারি তৈরি হয়েছে, তাকেই। একটা ভালো কবিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, এতে যে বোধের উন্মোচন ঘটল, সেটি নতুন কি না। প্রতিটি ‘ভালো’ কবিতার বইই তার নিজস্ব সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন বোধের উদ্ঘাটন করে এসেছে।

তবে এ বইটিরপড়া কিছুদূর সামনে এগোলে পাঠকের আর্টফিল্ম-জনিত হতাশা কাটবে। বইয়ের এক তৃতীয়াংশ পার হয়ে গেলে আবার চিরচেনা পিয়াসকে একটু একটু করে ফিরে পাওয়া গেছে। আবার ফিরে পাই তার সিগনেচার স্টাইল -’জপযজ্ঞ, ঊষার আয়াত শেষে/ পাওয়া যেতে পারে অন্ধকার জমিজিরেত, প্রার্থিত পলি।’ [ধ্বংসদীপ্র] এবং ‘অগ্রন্থিত আমাকে তুমি কোথায় পাবে এই বইয়ের ভূবনে?’ এবং পুনরাবির্ভূত কবি জাহির করেন নিজেকে, ‘হ্যাঁ, আমিই বড়োকাগজের বাহাদুর/ লিটলম্যাগের লাট/ করোনাজনিত লাইভের লাভার/ ভিডিয়ো-ভৃত্য’ এবং উপর্যুপরি স্বরূপে কবিকে আমরা আরও পাই, ‘তারপর আসন্ন যুদ্ধের ময়দানে/ কে বাঁচি, কে হারি/ দেখা হবে ফের/ বিদ্রোহে না হোক, বিস্মরণে/ আজ প্রত্যেকে বক্তব্য রাখবে যে যার শোকসভাতে।’ [ধ্বংসদীপ্র]।

বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট এই কালে বেঁচে থাকা অবশ্যই একটা উদযাপনের বিষয়। যেহেতু মানুষের ইতিহাস এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস, তাই জীবনকে পিছনে ফেলে মানুষ ধ্বংসের দিকে হলেও এগিয়ে যাবে। সে সূত্রে পৃথিবীব্যাপী কায়েম হয়েছে ‘মধুময় বিষের সমবণ্টন’ ।

‘বেঁচে থাকার তোপধ্বনি’ কবিতাটি এ বইয়ে গ্রন্থিত একটি শক্তিশালী কবিতা। বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট এই কালে বেঁচে থাকা অবশ্যই একটা উদযাপনের বিষয়। যেহেতু মানুষের ইতিহাস এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস, তাই জীবনকে পিছনে ফেলে মানুষ ধ্বংসের দিকে হলেও এগিয়ে যাবে। সে সূত্রে পৃথিবীব্যাপী কায়েম হয়েছে ‘মধুময় বিষের সমবণ্টন’ । অভাবের আয়োজনেও তাই প্লেটভর্তি প্রেমের পয়ার।

কবি পিয়াস মজিদের কাব্যচর্চা যে কয়টি বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত, সেগুলোর মাঝে একটি হলো তাঁর মৌলিকত্ব। প্রকার ও প্রকরণে তাঁর কবিতা খুবই মৌলিক। তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তোলা বক্তব্যও মৌলিক। তাঁকে অপর কোনো ভাষার কবিতা অনুবাদ করতে দেখা যায় না। তাঁর কবিতায় আমরা দেখি সুন্দরকে ধরবার আন্তরিক চেষ্টা। আলবেয়ার কাম্যুর একটি উক্তিকে স্মরণ না করে পারছি না─’যদি তুমি সত্যিই মনোযোগ দিয়ে দেখে থাক, দেখবে ‘সুন্দর’ মাত্রই অসহ্য। সুন্দর আমাদেরকে অপ্রাপ্তিবোধের দিকে ঠেলে দেয়, অনন্তকালকে তুলে ধরে এক লহমার পরিসরে; কিন্তু আমরা তো অনন্তকালকে অনন্তকালের আকারেই দেখতে চাই।’

পিয়াসের কবিতা আমাদের চেনা জগতের অনেক কিছুকে ধারণ করেই সুন্দর হয়ে উঠতে সচেষ্ট। যেমন একখানে তিনি লিখেছেন─ ‘মোমবাতি তার গলমান আয়ুর আত্মায়/ ধরে রাখে প্রজ্জ্বলনের প্রজ্ঞাবীজ টানটান’ এবং একই কবিতায় আরেক জায়গায়─’জিরো আওয়ার থেকে হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড/ আমরা কেবল মাঝামাঝি কোথাও একটা/ সেঁধিয়ে যাওয়ার সুযোগে থাকি।’

এবং শেষাংশে─ গ্রীষ্মে সেদ্ধ এমন কবিতা প্রায়শই বুকের বেদিতে
বৃষ্টির বিভা নিয়ে
শারদীয়া সকাল থেকে
হলুদ পাতার হেমন্তে জমা রাখে
ছায়া-আবছায়া কুয়াশা-কল্লোল। [ছাইয়ের মুকুট]

 


‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’-এর কবিতাগুলোয় বিষয়বস্তু হিসেবে মৃত্যু এসেছে বার। বইয়ের প্রায় প্রয়েকটি কবিতায় এক বা একাধিকবার মৃত্যুর কোনো না কোনো অনুষঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে, যা ক্ষেত্রবিশেষে আতিশয্য মনে হতে পারে। অবশ্য কবিতাগুলির রচনাকাল খেয়াল করলে আমরা দেখব যে মৃত্যুই ছিল তখনকার সবচেয়ে ট্রেন্ডিং টপিক। আজকে কোভিড প্যানডেমিক থেকে কয়েক বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে হয়তো সেসব কিছুটা দূরের জিনিস হয়ে গিয়েছে।

মহামারীকালে লেখা এই বইয়ের কবিতায় ধরা দেয় আমাদের বিপন্ন হৃদয়ের আত্ম-উপহাস─

দূরত্ব ঘুচে গেছে কিচেনে আর কফিনে
পাল্লা দিয়ে সুবাস ছড়াচ্ছে বৈশ্বিক মহামারী
রোগা রাজনীতি আর রক্তমাখা এলাচ-দারুচিনি
ঘরে থেকে আমাদের সঙ্গে আজ লাইভে যুক্ত থাকছেন
পাঁচ পাঁচজন কবি [লাইভেই ছিলাম বাবা]

কবির সমাজ-সচেতনতা বরাবরের মত শ্লেষ হয়ে বেরিয়ে আসে─’মৃত্যু আর গুজবে/ এখন কতটুকু পার্থক্য। / বেঁচে যে আছি এখনও,/ এটা আসলে বেঁচে থাকার গুজব নয় তো?’ [পরিস্থিতি]

কবির দর্শন অনুযায়ী, মানুষ ছেড়ে যায় তার পাশের এবং ভেতরের মানুষকে, এবং ক্রমশঃ ছেড়ে যায় সংগঠনকেও।
‘তখনই কাগজ আসে কর্পোরেশন থেকে,
আজকেই অবৈধ আত্মার উচ্ছেদ
শরীরের ছটা তো তবিয়ত বহাল’
[নিদ্রা, জাগৃতি, এইসব চুমকি]
এহেন এক কুৎসিত বাস্তবতায় ‘আমরা─ যার জন্ম একটা সংখ্যা/ মৃত্যু একটা সংখ্যা/ মাঝখানের বেঁচে থাকা রেজিস্টার খাতা/ আবর্তক বা রাজস্ব খাতে ন্যস্ত আমাদের আয়ু’ [শ্বাসের রেসিপি, স্তব্ধতার ঝিকিমিকি]।

কবির গত কয়েক বছরে প্রকাশিত কবিতার বইয়ের তুলনায় এ বইয়ে রাজনীতি সচেতনতা কম দেখা গেছে, তবে সমাজ-সচেতনতা বরাবরের মতো অটুট রেখেছেন কবি। তবু কয়েকটি পঙক্তিতে ঝলকে উঠেছে শুভবোধ-জারিত রাজনীতি-সচেতনতা। যেমন─ ‘ইশতেহার বিলি করো সুরের অক্ষরে,/ আত্মাকে বন্ধক রেখে কোন অসুরের দরবারে?’ [কালো তারার ক্রনিকল]। অথবা, ‘এইখানে এসে থামে/ ভরপেট পৃথিবীর ধূসর গতিস্বাদ/ এবার ক্ষুধিতের খাদ্য/ নিজেরই নুলো আত্মার আওয়াজ/ সবুজ ঘামে ভিজে আছে শ্রান্ত ঘাস’ [কালো তারার ক্রনিকল]

কিছুটা আত্মকেন্দ্রিকতার দেখা মিলবে কয়েকটি স্তবকে। যেমন─ ‘এমন নাটমঞ্চের/ কোন অঙ্কে, কোন দৃশ্যে/ ধুলোয় ঝাড়া হয় স্বপ্নের স্নায়ু/ ভিক্ষার চালডাল আর আমাদের আকাড়া আয়ু’ [যেমন]।

বইয়ের কবিতাগুলোতে প্রেমের অবতারণা খুবই অপ্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে হয়েছে। বলতে গেলে প্রেমের কবিতা এ বইয়ে খুব বেশি নেই। হঠাৎ দুয়েক জায়গায় পাই প্রেমের উল্লেখ─ ‘নৈকট্যে নৈঃসঙ্গ্য বাড়ে,/ দূরত্বেই দুরন্ত প্রেম/ …… নিঃশ্বাস ফুরিয়ে এলে/ গতিহীন ফুঁটেছি ভীষণ/ গহিন গজলের/ গোপন-গোলাপে।’ [মৃত্যুকবিতা, জন্মবীজ]

একমাত্র ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ শীর্ষককবিতাটির সর্বাঙ্গে দেখা মেলে সুললিত প্রেমের পরিস্ফুটন─

‘ঘৃণার মুকুট মাথায়/ প্রেমের পায়েল পায়ে/ কতদূর যাওয়া যেতে পারে/ মধুর পাতাল থেকে/ একঝাঁক মহুয়া মিনারে… … বেঁচে থাকার বাস্তবে বিক্ষত বর্ণের নিচে/ আমি এক ফিরোজা ফুল;/ দ্যাখো, তুমি তার সুবাসের নগ্নতায় / পেলেও পেতে পার/ তোমার পছন্দের ড্রেস/ পার্পল কালার।’ [আত্মপ্রতিকৃতি]
আবার সেই প্রেমকে কবি পূর্ণতার রূপে দেখেছেন কবি বইয়ের শেষ কবিতাটিতে─

‘আমাদের প্রাচীন প্রেম
এ গাছে ও গাছে
মরেটরে ভূত হয়ে গিয়ে
সবুজের রূপ ধরে আছে
ভোরের মায়াবৃক্ষ রাতের জীবনে হেলে যায়
ছায়ালু রোদের অলীকে
আমি তবু আগুনে শীতল বসে বসে
পুড়ে ছাই স্মৃতির পাহারায়’ [শেষের কবিতা]

 


বইয়ের শেষাংশে গ্রন্থিত বেশ কয়েকটি কবিতায় আমরা পাই অস্তিত্ববাদী কবিকে, যেখানে তিনি ‘আলো হাওয়া আরও কিছু ঋণ করে কোনোমতে শ্বাসটাকে জারি রাখেন’ অথবা ‘কিছু মাছ হয়ে আত্মার অতলান্ত অ্যাকোয়ারিয়ামে আহার-বিহার করেন’ [কুয়াশা-কবুতর]। কবির প্রকাশে─ ‘জল আর আগুনের খেলায়/ জ্বলে-পুড়ে ডুবে গিয়েও বোঝা দায়/ কতটা দাহ্য আমি, ডুবন্ত কতটা।’ [খেলা] আমরা যেখানে একালে ‘পরিবার ভেঙে বানাই পারিবারিক গোরস্থান’ সেখানে ‘কবির ক্ষেত্রে নিজের ঘরই তার কবর’। [শূন্যতায় ভরপুর]।

‘কবিতার মুহূর্ত’ এবং ‘নিউ নর্মাল’ শীর্ষক কবিতাদুটিতে আমাদের মহামারী-বিড়ম্বিত জীবনযত্রায় তৈরি করা মেকি বাস্তবতার প্রতি কবির শ্লেষের প্রকাশ ঘটেছে। কোভিড-বাস্তবতায় কবিদের কবিতা লেখার ভড়ং এবং ফেসবুক-লাইভ-সর্বস্ব জীবনযাপনকে কবি একহাত নিয়েছেন এই দু’টি কবিতায়।

পুনর্বার দৃষ্টিপাতে ‘সুষম মৃত্যু’ ও ‘অগ্নিকোমল’ কবিতা দুটিতে মৃত্যু কবির সামনে উন্মোচিত হয় ‘ঊষা কিংবা গোধূলির একটি বাকভঙ্গি হিসেবে’ [অগ্নিকোমল]।

‘কবিতার মুহূর্ত’ এবং ‘নিউ নর্মাল’ শীর্ষক কবিতাদুটিতে আমাদের মহামারী-বিড়ম্বিত জীবনযত্রায় তৈরি করা মেকি বাস্তবতার প্রতি কবির শ্লেষের প্রকাশ ঘটেছে। কোভিড-বাস্তবতায় কবিদের কবিতা লেখার ভড়ং এবং ফেসবুক-লাইভ-সর্বস্ব জীবনযাপনকে কবি একহাত নিয়েছেন এই দু’টি কবিতায়।

আগেই বলেছি যে গদ্যে লেখা ‘বেশ আছি’, ‘বিচ্ছেদিয়া’, ‘ধূসর বসন্ত’, ‘পূর্ণিমা-পটপ্রভা’, ‘আঁধার প্রজ্ঞা’ ‘ইত্যাদি’ কবিতাগুলি দুর্বোধ্য লেগেছে। এই কবিতাগুলিতে পরাবাস্তবতাই উপজীব্য। কিন্তু যেহেতু বইয়ের অন্যান্য কবিতার বাস্তবের মধ্যে পরাবাস্তবতাকে স্থান দেওয়ায় সেগুলোর স্বাদ পাওয়াটা কঠিন হয়ে উঠেছে। একারণে সেগুলোর আলোচনা এই লেখায় করছি না।

‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’ নামটির মতই এই বইয়ের কবিতাগুলোর নাম আনকোরা। পিয়াসের আগেকার কবিতাগুলোর চেয়ে এ বইয়ের কবিতার নামগুলো ব্যতিক্রম। বইয়ের সুচিপত্রে চোখ বোলালে পাঠকের কাছে তা স্পষ্ট হবে।

‘মুহুর্মুহু মিউ মিউ’ বইটি পড়া শেষ হয়। কবি যদি চিত্রশিল্পী হতেন, তাহলে বলা সমীচীন হত যে তিনি এযাবৎ করে আসা ইম্প্রেশনিস্ট ধারা বদলে এ বইয়ে এক্সপ্রেশনিস্ট ঢংয়ে তুলি চালিয়েছেন। পাঠককে তাই এক্সপ্রেশনিস্ট ছবি দেখার প্রস্তুতি নিয়েই বইটি পড়তে হবে। সেই সাথে বইটি হয়ে উঠেছে প্রাণ-সংহারী বৈশ্বিক মহামারীর অরুন্তুদ সময়ের এক যথার্থ সাক্ষ্য।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

লেখকের জন্ম ১৯৮৯ সালে, খুলনা শহরে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আইন বিষয়ে৷ পেশাগত জীবনে ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন এবং করছেন। মূলত: গদ্যেই লেখার চেষ্টা করেন। লেখার প্রিয় মাধ্যম বড় গল্প ও উপন্যাসিকা, তবে কবিতা পড়া এবং কবিতার ওপর লেখাও তার প্রিয়।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।