শুক্রবার, অক্টোবর ৪

যেমন করে নির্ঝর, যেমন করে নৈঃশব্দ্য : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

0

Eid Motifএই লেখাটাকে আমার ‘নির্ঝর নৈঃশব্দ্য’ নামের ইতিহাস বলা যায়। আমার এই নাম কেমন করে এলো তা নিয়ে অনেকের মাঝে তীব্র কৌতূহল আছে, অনেকে আমার দাপ্তরিক নাম মানে কাগজপত্রে, সনদাদিতে যে-নাম আছে তাও জানতে চান প্রবল আগ্রহ নিয়ে। কেন তা ঠিক জানি না। তাদের জন্যে এই লেখাটা লিখে ফেললাম।

প্রথমে নামগুলি বলে নিই— আমার দাপ্তরিক নাম ‘মঈনউদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী’। আমার ডাকনাম প্রথমে ‘খোকন’, পরে ‘নির্ঝর’। এই পর্যন্ত আমার মা-বাবার দেওয়া। আমার লেখক ও চিত্রী-নাম ‘নির্ঝর নৈঃশব্দ্য’। এই নামই সকলে জানেন। এই নামেই আমি গত ২৮ বছর ধরে লিখি আর আঁকি।

নির্ঝর মানে যা অঝর ধারায় ঝরে বা ঝরনা, নৈঃশব্দ্য মানে নীরবতা। আর নির্ঝর নৈঃশব্দ্য মানে যে নীরবতা অঝরধারায় বা ঝরনার মতো ঝরে। বাঙলায় সংক্ষেপে লিখি নিনৈ। নি মানে শূন্য বা নাই, নৈ মানে নদী। আর নিনৈ মানে শূন্যনদী। ইংরেজিতে নামের বানান Nirzhar Noishabdya. সংক্ষেপে লিখি NN.

আমার নামের ‘নৈঃশব্দ্য’ শব্দের বানান কেউ কেউ শুদ্ধ করে লিখতে গিয়ে ‘নৈঃশব্দ’ লিখে ভুল করে ফেলেন। তারা জানেন না যে ‘নৈঃশব্দ্য’ বানানটাই শুদ্ধ। নৈঃ এর পর বিসর্গ আছে বলে শেষে দ-এর পর য-ফলা দিতে হয়। ‘নৈঃশব্দ্য’ শব্দের বিকল্প শুদ্ধ বানান হলো ‘নৈশব্দ’। কিন্তু আমার নামের ক্ষেত্রে এই বানান লেখা যাবে না। কারণ আমি নিজে লিখি না। ফলে অতি অবশ্যই ‘নৈঃশব্দ্য’ বানানটাই লিখতে হবে।

ভূমিকা শেষ। এইবার নিচে বলব কেমন করে আমি নির্ঝর, আর কেমন করে নৈঃশব্দ্য হলাম সেই গল্প।

এক ক্লাস, দুই ক্লাস এইসব ওইঅর্থে ঠিক আমি ইশকুলে পাড়ি নাই। বলা যায় বাড়িতেই পড়াশোনা। আব্বার যেহেতু বদলির চাকরি ছিল ফলত পটিয়ায় মোহছেন আউলিয়া প্রাইমারি ইশকুলে কিছুদিন পড়েছিলাম, পরীক্ষা দেওয়া হয় নাই। গ্রামে এসে আব্বা আমাকে চকরিয়া কোরক কেজি ইশকুলে পরে যেটা কোরক বিদ্যাপীঠ হয়েছে সেখানে নিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।

প্রতিদিন ইশকুল-ড্রেস ও ব্যাগভর্তি বই নিয়ে কেজি ইশকুলে যেতে আমার ভালো লাগত না তাই একদিন নিজে নিজেই গ্রামের প্রাইমারি ইশকুলে তিন ক্লাসে গিয়ে ক্লাস করা শুরু করি। আর ওই বছরই তখন ক্লাসের একটা মেয়েকে আমার ভালো লেগে গেল। ওর দিকে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকি। দূর থেকে অনুসরণ করি। ও খুব টের পায় বুঝতে পারি। কিন্তু কোনোদিন কথা হয় না। নাম ছিল নয়না।

১৯৮৯ সাল, আমার বয়স ৮ বছর। প্রতিদিন ইশকুল-ড্রেস ও ব্যাগভর্তি বই নিয়ে কেজি ইশকুলে যেতে আমার ভালো লাগত না তাই একদিন নিজে নিজেই গ্রামের প্রাইমারি ইশকুলে তিন ক্লাসে গিয়ে ক্লাস করা শুরু করি। আর ওই বছরই তখন ক্লাসের একটা মেয়েকে আমার ভালো লেগে গেল। ওর দিকে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকি। দূর থেকে অনুসরণ করি। ও খুব টের পায় বুঝতে পারি। কিন্তু কোনোদিন কথা হয় না। নাম ছিল নয়না।

যেহেতু নয়নার নাম নয়না, সেহেতু নয়নার সঙ্গে মিলিয়ে আমি আমার নিজেরও একটা নাম দিই। সেই নাম হলো নয়ন। আমি খাতার মধ্যে, ইশকুলের বেঞ্চে হাতের তালুতে, টেবিলে, বইয়ের পাতায়, গাছের গায়ে, পুকুরের ঘাটে, নদীর ব্রিজে নানা জায়গায় লিখে রাখি ‘নয়ন চৌধুরী’। আর মনে মনে আকাশে, বাতাসে, পাখির ডানায়, ফুলের পাপড়িতে, গাছের পাতায়ও লিখে রাখি।

১৯৯২ সাল। আমার এই নামের কথা বাবা জানতে পারেন, তখন আমি ছয় ক্লাসে পড়ি। হয়তো খাতার মলাটে দেখে জানতে পারেন। তখন তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘যা অঙ্ক খাতাটা নিয়ে আয়।’

আমি খাতা নিয়ে তার সামনে টি-টেবিলের ওপর রাখলাম। তিনি বললেন, ‘খাতার ঢালটা ছিঁড়ে ফেল এইবার।’ তার চোখ রাগে লাল। বই কিংবা খাতার আলগা মলাটকে আমরা ঢাল বলি। আমি খাতার মলাট ছিঁড়ে ফেললাম এক টানে। তিনি ছোটো টি-টেবিলটা তুলে আমাকে মারতে এলেন। আম্মা পাশে শাক বাছছিলেন। তিনি ছুটে এসে আব্বার হাত থেকে টেবিলটা কেড়ে নিলেন। আব্বা চিৎকার গালি দিয়ে বললেন, ‘নয়ন নাম যদি আর কোথাও দেখি, মাথা ভেঙে ফেলব…’।

কয়েকদিন পর আব্বা আমাকে ডেকে একটা ডাকনাম ঠিক করে দিলেন। তিনি আমার নাম দিলেন নির্ঝর। হয়ত রবিনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা থেকে এই নাম। আব্বা আমাকে ইশকুলের হোস্টেলে থাকতে আর ভার্সিটি ক্যাম্পাসে থাকতে চিঠি লিখতেন, মানি অর্ডারের নিচে নোট লিখতেন এই সম্বোধনে।

কয়েকদিন পর আব্বা আমাকে ডেকে একটা ডাকনাম ঠিক করে দিলেন। তিনি আমার নাম দিলেন নির্ঝর। হয়ত রবিনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা থেকে এই নাম। আব্বা আমাকে ইশকুলের হোস্টেলে থাকতে আর ভার্সিটি ক্যাম্পাসে থাকতে চিঠি লিখতেন, মানি অর্ডারের নিচে নোট লিখতেন এই সম্বোধনে। নির্ঝর নামটা কেন জানি না আমারও খুব প্রিয় হয়ে গেল।

আমার যে এর আগে কোনো ডাকনাম ছিল না তা কিন্তু নয়, বাড়িতে আমাকে খোকন নামে ডাকতো। কিন্তু এই নামটা আমার তেমন ভালো লাগতো না। কারণ আমার মনে হতো এটা তো শিশুদের নাম, আমি তো শিশু নই। আর একদিন আরো বড়ো হবো। বড়দের এমন নাম হয় নাকি আবার! মনে হতো লোকজন ছড়া কাটছে, ‘আয়রে খোকন ঘরে আয়, দুধমাখা ভাত কাকে খায়।’

আমি আমার লেখা-পত্র মানে ছড়া, পদ্য, কবিতা ইত্যাদি ‘নির্ঝর, কখনো নির্ঝর শব্দ থেকে ‘নি’ অংশটাকে পেন-নেম হিশেবে নিয়ে নানা জায়গায় পাঠাতে থাকলাম। এবং ছাপাও হলো বেশ কয়েক জায়গায়।

১৯৯৩ সাল। আমি সাত ক্লাসে পড়ি। একদিন দেখি চট্টগ্রামের একটা দৈনিক পত্রিকায়, পত্রিকার নাম ঠিক মনে নাই আমার দুটো কবিতা জনৈক কবির কবিতার নিচে ছাপা হয়ে গেছে। মানে সম্পাদক আমার লেখক-নামটাকেও হয়তো কবিতার শিরোনাম বা কবিতার শব্দ ভেবে অন্য কবির কবিতার সঙ্গে ছাপিয়ে দিয়েছে। হয়তো একই ফাইলে পর পর রাখা ছিল।

আমি করলাম কী, ‘চৌধুরী’ টাইটেলটা সবার আগে দিয়ে শেষে ‘নির্ঝর’কে নিয়ে গেলাম। আর ‘চৌধুরী মঈনউদ্দীন মাহমুদ নির্ঝর’ নামে আমার লেখা ছাপা হতে থাকল।

আমি একটা ধাক্কামতো খেলাম আমার লেখক-নাম নিয়ে। আমি ভাবতে লাগলাম। শুরুতেই বলেছি আমার কাগজি লেবুর মতো একটা কাগজি নামও আছে। যে-নামটা অফিসিয়াল কাজকর্মে ব্যবহৃত হয়। যেটা ঠিকঠাক মতো আমার বাড়ির লোকজনও জানে না। কাগজপত্র দেখে বা আমাকে জিজ্ঞেস করে তারপর তাদের কোথাও দরকার হলে লিখতে হয় বা হতো। আমি ঠিক করলাম নির্ঝর নামটা এই নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লিখব। আমি করলাম কী, ‘চৌধুরী’ টাইটেলটা সবার আগে দিয়ে শেষে ‘নির্ঝর’কে নিয়ে গেলাম। আর ‘চৌধুরী মঈনউদ্দীন মাহমুদ নির্ঝর’ নামে আমার লেখা ছাপা হতে থাকল।

কায়কোবাদের নাম ছিল কাজেম আল কোরায়শী, আল মাহমুদের নাম ছিল মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। পরে তারা লেখক-নাম নিয়েছেন।

১৯৯৪ সাল। আমি আট ক্লাসে পড়ি। এই বছরের মাঝামাঝিতে কায়কোবাদের জীবনী আর আল মাহমুদের কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হলো লেখক কবির এত বড় নাম এক প্রকার বারো হাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো। কায়কোবাদের নাম ছিল কাজেম আল কোরায়শী, আল মাহমুদের নাম ছিল মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। পরে তারা লেখক-নাম নিয়েছেন।

আমারও এমন একটা লেখক নাম নিতে হবে। আমি খাতায় লিখলাম। নির্ঝর মাহমুদ। কিন্তু লিখেই কেটে দিলাম। কারণ নাম পড়েই মানুষ আমাকে ধর্মের ছকে ফেলে দেবে। মনে হলো আমাকে এমন একটা নাম নিতে হবে যে নামে ধর্মের গন্ধ নাই। তারপর খাতায় লিখলাম ‘নির্ঝর চৌধুরী’। এই নামে কিছুদিন লিখলাম। কিন্তু মনের ভিতর খচ খচ করে। কারণ ‘চৌধুরী’, এই পারিবারিক জমিদারি টাইটেল আমার ভালো লাগত না। এর প্রতি এক ধরনের বিবমিষা ছিল আমার মধ্যে। এর ইতিহাসটা কৌতুহল বশতই জেনে গিয়েছিলাম। তারউপর জমিদারি ব্যাপারটাও আমার কাছে ভালো লাগত না। আমার দাদার বাবা জমিদার ছিলেন বলে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনিও জমিদার হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা হতে পারেননি। কারণ তিনি ছিলেন তার বাবার ত্যাজ্যপুত্র। কেন ত্যাজ্য সেই কাহিনি অন্য কোথাও বলব। তবে এটা সত্য যে, আমার দাদা যদি জমিদার হতেন তবে আমার বাবাও কিছুটা জমিদার হতেন। তখন হয়তো জমিদারি টাইটেল বেশ লাগত আমার। সে যাইহোক নির্ঝরের সঙ্গে ‘চৌধুরী’ টাইটেল শেষপর্যন্ত নিলাম না আমি।

হঠাৎ করেই একদিন ‘নৈঃশব্দ্য’ শব্দটা আমার মাথায় এলো। হয়তো নীরবতা আর নির্জনতা আমার ছোটোবেলা থেকেই প্রিয় ছিল বলেই এই শব্দটা মাথাতেই ছিল। ফলে নির্ঝরের সঙ্গে ‘নৈঃশব্দ্য’ জুড়ে দিয়ে হয়ে গেলাম ‘নির্ঝর নৈঃশব্দ্য’, ২৮ বছর ধরে এখনো ‘নির্ঝর নৈঃশব্দ্য’ই আছি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

  • মূলত লেখেন ও আঁকেন। জন্ম : ২৪ আগস্ট ১৯৮১, চকরিয়া, কক্সবাজার, বাঙলাদেশ। পড়াশোনা : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৮টি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।