শুক্রবার, অক্টোবর ৪

রহিম বক্সের বাহিনী : ফয়জুল ইসলাম

0

খুনখুনে বুড়ো রহিম বক্সের সাথে বদিউরের আলাপ হয় উনিশ শ একাত্তর সালের আগস্টের উনিশ তারিখে। সেদিনই কুমারখালির আমবাড়িয়া থেকে নৌকায় পদ্মানদী পারি দিয়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের সদস্য বদিউর তার আটজনের গেরিলাদল নিয়ে পাবনায় ঢুকেছিল। রাত তিনটার দিকে নৌকা থেকে তারা নেমেছিল সুজানগর থানার ভায়না ইউনিয়নের চর-এলাকায়। কথা মতো তাদের পৌঁছানোর অপেক্ষাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতরে পদ্মাপারের চরে দাঁড়িয়েছিল শেল্টার মাস্টার কাদের বক্স। কাদের বক্স তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল কিছুটা দূরের চরপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক রহিম বক্সের বাড়িতে। ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙা থেকে বস্তা আর ঝাঁকায় ভরে লুকিয়ে আনা অস্ত্রগুলো পয়লাতে রহিম বক্সের খড়ের পালা দুটোয় লুকিয়ে রাখল বদিউররা। অস্ত্র বলতে তারা পেয়েছিল একটা মাত্র এসএলআর, আটটা ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল, সব মিলিয়ে পাঁচ শ গুলি, কুড়ি পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ এবং চল্লিশটা হ্যান্ড গ্রেনেড। এসএলআর আর ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেলের মতো লম্বা হাতিয়ার নিশ্চয় গেরিলাযুদ্ধের উপযোগী নয়! এসএমজি বা স্টেনগান বরং সহজে লুকিয়ে নিয়ে চলাফেরা করা যেত। কিন্তু সেই মুহূর্তে লাগসই হাতিয়ার তাদের সাপ্লাইয়ে ছিল না। যাহোক, অপরিচিত একটা এলাকায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য বদিউররা শুয়েবসেই থেকেছিল তিন দিন। এ জন্য রহিম বক্সের পড়ো পড়ো বেড়ার ঘরটা বেছে নিয়েছিল তারা। নতুবা তাদেরকে থাকতে হতো উঠানের পশ্চিম দিকের অপরিসর গোয়ালঘরটায়। গরু-ছাগলের মুত আর লাদির ভেতরে থাকার চাইতে ভাঙাচোরা ঘরই আরামের বলে মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। বৃষ্টি এলে ছনের ছাউনি গলে বেড়ার ঘরের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ছিল—এই যা! খড়ের পালায় হাতিয়ার লুকিয়ে পরে মাটির মেঝেতে পেতে দেওয়া পাটিতে শুয়ে শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল ক্লান্ত গেরিলাদের কেউ, বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে কেউবা চুপচাপ বসেছিল, ঝিমিয়ে পড়েছিল কেউ কেউ। উঠানের এক কোনায় বাঁশের মাচায় বসে বসে সেন্ট্রি ডিউটি শুরু করেছিল দলনেতা বদিউর স্বয়ং। তার পাশে বসে বিড়ি ফুঁকছিল তার দুই বাল্যবন্ধু—দিলালপুরের অসিত এবং দক্ষিণ রাঘবপুরের রুবেল। একটু পরে আধো আলোতে বদিউররা দেখতে পেল, সামনের ছোট্ট মাটির ঘরের ডুয়া থেকে কাদের বক্সের হাত ধরে উঠানে নামছে একজন বৃদ্ধ; নেমে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে সে। কাদের বক্সের দেওয়া তথ্য থেকে বদিউররা বুঝে নিয়েছিল, সেই বৃদ্ধই তাদের আশ্রয়দাতা রহিম বক্স—সম্পর্কে কাদের বক্সের বড়ো চাচা। পরিচয়পর্ব শেষ হলে বদিউরকে আলিঙ্গন করে স্নেহে বলেছিল রহিম বক্স, ‘বাবাজি! পাবনা টাউনির ছাওয়াল-পাওয়াল আপনেরা! আমার এই ভাঙাচুরা বাড়িত থাকতি আপনেগারে কষ্টই হবিনি!’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র বদিউর উল্টো কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়েছিল রহিম বক্সের সামনে; বলেছিল, ‘কী যে বলেন চাচামিয়ে! আমাগারে কোনো অসুবিধেই হবিনানে।’ ‘আমি কি আর তা বুঝিনে বাপু!’ এই বলে ফের লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এলাকার মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করতে চলে গিয়েছিল রহিম বক্স।

বদিউররা যে ঘরটাতে বিশ্রাম নিচ্ছিল সেই ঘরের মেঝেতে বসে গোগ্রাসে ভাত খাচ্ছিল তারা। তখন কাদের বক্স বদিউরদের জানিয়েছিল, ঘরটার বাঁশের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুফিয়া নামের সেই বালিকা আসলে অনাথ। সংঘটিত সাতবাড়িয়া গণহত্যার কালে তার বাবা-মা-সহ প্রায় ৪০০ জন গ্রামবাসীকে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলিতে খুন করেছে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা।

বেড়ার হেঁশেলঘর থেকে বদিউরদের জন্য পুঁইশাকের চচ্চরি, কলাইয়ের ডাল আর এক ধামা ভাত নিয়ে এসেছিল রহিম বক্সের আট-দশ বছরের নাতনি। বদিউররা যে ঘরটাতে বিশ্রাম নিচ্ছিল সেই ঘরের মেঝেতে বসে গোগ্রাসে ভাত খাচ্ছিল তারা। তখন কাদের বক্স বদিউরদের জানিয়েছিল, ঘরটার বাঁশের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুফিয়া নামের সেই বালিকা আসলে অনাথ। সংঘটিত সাতবাড়িয়া গণহত্যার কালে তার বাবা-মা-সহ প্রায় ৪০০ জন গ্রামবাসীকে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলিতে খুন করেছে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা। সেটা এই গেল মাসের ১২ তারিখের কথা। বুদ্ধি করে বাঁশঝারের একটা গর্তে মরা ডাল আর মরা পাতার নিচে লুকিয়ে থেকে সুফিয়া প্রাণে বেঁচে গেছে। সুফিয়ারা তখন সপরিবারে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে থাকত। এ কথা শোনার পরে রাগে শক্ত হয়ে উঠেছিল গেরিলাদলটার ডেপুটি লিডার মিন্টুর চোয়াল। মিন্টু তখন ঢাকা শহরের জগন্নাথ কলেজে ডিগ্রি-ক্লাসের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছিল। বদিউরের চোখে তাকিয়েছিল সে। সেই দৃষ্টিতে ছিল দৃঢ় সংকল্পের চিহ্ন।

রহিম বক্সের আশ্রয়ে থাকাকালীন তিন দিনে বদিউররা কোনো গেরিলা-অ্যাকশনে গেল না। মনে মনে বদিউর স্থির করে নিল, সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কুড়িপাড়া গ্রামের মুসলিম লীগ নেতা ইয়াকুব খন্দকারকে পয়লাতে তারা নিকেষ করবে। ইয়াকুব খন্দকার পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীকে সাতবাড়িয়ার হিন্দু-অধ্যুষিত আঠারোটা গ্রামে গণহত্যা চালাতে প্ররোচিত করেছিল; আতাইকুলা থেকে পথ দেখিয়েও এদিকে নিয়ে এসেছিল তাদেরকে। গেরিলাযুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী বদিউর তার পরিকল্পনাটা ডেপুটি লিডার মিন্টু বাদে দলের আর কারও সাথে আলাপ করল না তখন। বদিউরের পরিকল্পনার সাথে ঐকমত্য হয়ে মিন্টু মন্তব্য করেছিল, বড়ো কোনো অ্যাকশনে নামার আগে প্রথম সারির ক’জন রাজাকারকে খতম করাটা প্রয়োজন রয়েছে। এর কারণ হলো: টেলিগ্রাফ আর বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়া, কংক্রিটের ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া, আঞ্চলিক রাস্তাগুলোর জায়গায় জায়গায় কেটে দেওয়া এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী, পুলিশ আর মিলিশিয়াদের ওপরে চোরাগুপ্তা হামলা চালানোটাই যথেষ্ট নয়। কে না জানে, পাবনা বা অন্যান্য জেলায় ঘটে যাওয়া গণহত্যাগুলোর মূল ক্রীড়নক আসলে গাদ্দার বাঙালিরাই। এলাকাগুলোর মুক্তিকামী বাঙালিরা তাই ঘৃণা করে তাদেরকে; তাদের মরণও চায়। এই যুক্তিতে কিছু রাজাকার খতম করতে পারলে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গণমানুষের সমর্থন পাকাপোক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জনসমর্থন ছাড়া তো আর কোনো বড়ো গেরিলা-অ্যাকশন সফল হতে পারে না!

ভারত থেকে সুজানগরে ঢোকার প্রথম তিন দিন রহিম বক্সের আশ্রয়ে শুয়েবসে থাকা আর নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেন্ট্রি ডিউটি দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না বদিউরদের। তখনই তারা লক্ষ করে, খুনখুনে বুড়ো রহিম বক্সের আশপাশে ভিড় জমিয়েছে নানান পশুপাখি—কুকুর-বেড়াল হাঁটছে তার পায়ে পায়ে; পাগার থেকে উঠে এসে উঠানে রোদ পোহাচ্ছে তিনটা গুঁইসাপ; ঘরের কোনায় বাস্তুসাপেরা আড়মোড়া ভাঙছে; কাঁঠালগাছে কিচিরমিচির করছে শালিক-বুলবুলি-চড়াই-কবুতরেরা; রেইনট্রির ডালে বসে আছে গোটা কয়েক লক্ষ্মীপ্যাঁচা-হুতুমপ্যাঁচা-খুঁড়লেপ্যাঁচা; রহিম বক্সের কাঁধে বারবার এসে বসছে একটা সবুজ টিয়ে। সচরাচর তো এমন অভয়াশ্রম দেখা যায় না! রহিম বক্সের সাথে পশুপাখির এমন খাতির দেখে তাই বদিউররা অবাকই হচ্ছিল। কাদের বক্স তাদেরকে বলেছিল—এ আর নতুন কী? তার চাচা যখন ছোটো ছিল তখন থেকেই পশুপক্ষীদের সাথে বেজায় দোস্তি তার। একদা একটা মস্ত বড়ো বাজপাখিও পুষেছিল তার চাচা, আর পুষেছিল একটা শেয়াল। পাখিটা অবশ্য বয়সের ভারে মারা গেছে। মাঝে মাঝে এখনো আসে শেয়ালটা। এডওয়ার্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র সোমনাথ তখন কাদের বক্সকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই দোস্তালির ফায়দা তবে কী? কাদের বক্স উত্তর দিয়েছিল, আসলে এতে করে বাস্তব কোনো উপযোগ নেই। রহিম বক্স তার নিজের বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে পারছে—এটাই যা লাভ! পাবনা শহরের ট্রাক-ড্রাইভার এনামের অনুরোধে এক দিন রহিম বক্স তার কাঁধে বসে থাকা সবুজ টিয়েটাকে বলেছিল, ‘ধলা গিরিক ডাকে লিয়ে আয়।’ গিরি মানে—গিরিবাজ কবুতর। সবুজ টিয়ে উড়ে গিয়ে রেইনট্রির মাথা থেকে সাথে সাথেই সাদা গিরিবাজটাকে ডেকে এনেছিল। গিরিবাজ নেমে এসে দাঁড়িয়েছিল উঠানে, নিচু একটা টুলে বসে থাকা রহিম বক্সের ঠিক সামনেটায়। রহিম বক্স তাকে হুকুম দিয়েছিল, ‘একখেন কাঁচা মরিচ লিয়ে আসেকগা, যা!’ আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে গিরিবাজ তার ঠোঁটে করে কোথাও থেকে এনে দিয়েছিল দু-দুটো কাঁচা মরিচ! তা দেখে আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠেছিল সাধুপাড়ার পাট-ব্যবসায়ীর বেকার পুত্র বাবুল আর এডওয়ার্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র—গোবিন্দা-এলাকার তুলিপ।

নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরেই গেরিলাদেরকে এক শেল্টারে বেশি দিন থাকা যাবে না—গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় বদিউরদেরকে এমন একটা কৌশল শেখানো হয়েছিল। চতুর্থ দিন রাতে তাই ভায়না ইউনিয়নের চরপাড়া থেকে অন্য জায়গাতে চলে যায় বদিউররা। টমটমে করে পাশের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের শেল্টারে যথারীতি তাদেরকে নিয়ে যায় কাদের বক্স। পাবনা-সুজানগর রোডের দক্ষিণে পড়েছে জায়গাটা। নিশ্চিন্দিপুর থেকে উত্তর-পুবে আঞ্চলিক সড়কের ওপারেই কুড়িপাড়া গ্রাম। সেখানেই থাকে সাতবাড়িয়া গণহত্যার মূল নায়ক—রাজাকার ইয়াকুব খন্দকার। বদিউরদের কন্টাক্ট—সাতবাড়িয়া প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক মুন্নাফ আলি তখন বদিউরদেরকে জানায়, সাতবাড়িয়া বাজার থেকে আঞ্চলিক সড়ক ধরে দক্ষিণ-পূর্বে আগালেই চোখে পড়বে শ্যামনগর বাজার। সেখানে একটা বড়ো পাটের গুদাম আর একটা রড-সিমেন্টের দোকান রয়েছে ইয়াকুব খন্দকারের। তাই কুড়িপাড়া থেকে রিকশায় চেপে প্রায় প্রতিদিনই সে ব্যাবসা দেখতে শ্যামনগর বাজারে যায়। এই তথ্যের উপরে ভিত্তি করে রাজাকার ইয়াকুব খন্দকারকে শ্যামনগর বাজারে প্রকাশ্যে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় বদিউর। শাকসবজি কেনাকাটার ছলে শ্যামনগর বাজারের এলাকাটা দু-দিন ধরে রেকি করে এডওয়ার্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র টিপু। তারপর আগষ্ট-শেষের এক বুধবার সন্ধেবেলায় ইয়াকুব খন্দকারকে তার নিজের রড-সিমেন্টের দোকানে ছুরিকাঘাতে খুন করে বদিউর আর গোবিন্দার তুলিপ। দিলালপুরের অসিত এবং দক্ষিণ রাঘবপুরের রুবেল দোকানের গেটে দাঁড়িয়ে তখন চারদিকে নজর রাখছিল। খুন হয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ইয়াকুব খন্দকার গদিতে বসে দুজন মানুষের সাথে জমিয়ে গল্প করছিল। তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল না কেউই। শ্যামনগর বাজারের চতুর্দিকে তখন পাটখড়ির আঁটির ভেতরে ৭.৬২ মিলিমিটার এনফিল্ড রাইফেল লুকিয়ে রেখে হাটুরের ছদ্মবেশে পজিশন নিয়েছিল গেরিলাদলটার বাকি পাঁচজন সদস্য। ইয়াকুব খন্দকারকে খতম করার পরে সেদিন রাতেই নিশ্চিন্দিপুরের শেল্টার থেকে বদিউররা পদ্মানদী বেয়ে চলে গেল প্রায় ছয় মাইল দক্ষিণ-পূর্বের হাজারিপাড়ায়। নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরেই তাদেরকে শেল্টার বদল করতে হয়েছিল।

রাজাকার-খতমের ফলাফল মোটেই ভালো হলো না। তার পরদিন সুজানগর থানা থেকে পাকিস্তানি মিলিশিয়া, পুলিশ এবং রাজাকারেরা গিয়ে পুড়িয়ে দিল শ্যামনগর বাজারের আশপাশের গোটা দশেক বাড়িঘর; মুক্তিযোদ্ধাদেরকে খুঁজে না পেয়ে গুলি করে খুন করল ছয় জন মানুষকে। মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করার অভিযান আরও ব্যাপক হবে ভেবে বদিউররা তাই হাজারিপাড়ার শেল্টার ছেড়ে উত্তাল গাজনার বিল পারি দিয়ে সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন থেকে দূরে চলে যায়। উত্তরের পাবনা-নগরবাড়ি মহাসড়কের ধারের দুলাই-এলাকার আহম্মদপুর ইউনিয়নে আশ্রয় নেয় তারা। দুর্গাপুর, মোবারকপুর এবং সোনাতলা—এই তিনটা গ্রামে পালাক্রমে শেল্টার বদল করতে করতে বদিউররা পয়লাতে এক রাতে আক্রমণ চালায় মহাসড়কের দুলাই ব্রিজে। এই ব্রিজের ওপর দিয়েই নগরবাড়ি ঘাট থেকে পাবনা শহরে পাকিস্তানি সৈন্যদের অস্থায়ী সেনানিবাসে রসদ এবং অস্ত্রশস্ত্র যায়। লোহার তৈরি ব্রিজ বলে ব্রিজটাকে আর উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেনি বদিউররা, তারা কেবল সন্ত্রাস ঘটাতে চেয়েছিল। ব্রিজে পাহারারত ষোলো জন মিলিশিয়া এবং রাজাকারদের দলটার ছয়জন সেখানে খতম হয়, বাকিরা অন্ধকারে পালিয়ে যায় এদিক-ওদিক। বদিউরদের গ্রুপের কেউ সেদিন হতাহত হয়নি। কাছাকাছি সময়ে তারা ঢাকা-নগর বাড়ি মহাসড়ক ধরে আতাইকুলা এবং পাবনা শহরের দিকে ধাবমান এক কোম্পানি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কনভয়কে গভীর রাতে অ্যামবুশ করে। দুর্গাপুর ও বিরামপুরের মাঝের নির্জন একটা জায়গাতে অ্যামবুশটা করা হয়। ঝটিকা আক্রমণে নিহত হয় জনা দশেক পাকিস্তানি সৈন্য। তারপর বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া বিল-এলাকা নৌকায় পারি দিয়ে সাতবাড়িয়ার দিকে ফিরে যায় বদিউররা, যাওয়ার পথে তারা সুজানগর-নগরবাড়ি আঞ্চলিক সড়কের নাটাখোলা ঘাটের কাছে থামে। তাদের মনে হয়েছিল যে সুজানগরের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দমন করার জন্য নাটাখোলা হয়ে নগরবাড়ি থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা সাগরকান্দি বাজারের দিকে যেকোনো দিন অগ্রসর হতেই পারে। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে পাবনা শহর থেকে কেবল দুবলিয়া-বাজার হয়ে এসেই সাতবাড়িয়াতে আক্রমণ চালাবে—এমনটা এক শ ভাগ নিশ্চিত করে বলা যায় কি? তাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য নাটাখোলা ঘাটের উত্তরে আঞ্চলিক সড়কের ওপরের তিনটা নতুন কালভার্ট ডায়নামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় তারা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, পুলিশ এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে বদিউরদের গেরিলাযুদ্ধের দিনগুলো তার ব্যতিক্রম ছিল না মোটেই। এভাবে বদিউররা ভুলেই যায় চরপাড়া গ্রামের পশুপাখিদের বন্ধু রহিম বক্সের কথা।

গেরিলা অপারেশনের সাথে জড়িয়ে থাকে উত্তেজনা, ঘন হয় শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি। যুদ্ধ এমন একটা পরাক্রমশালী ঘটনা যেখানে যোদ্ধাদের সামনে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে ঘটমান বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যৎ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, পুলিশ এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে বদিউরদের গেরিলাযুদ্ধের দিনগুলো তার ব্যতিক্রম ছিল না মোটেই। এভাবে বদিউররা ভুলেই যায় চরপাড়া গ্রামের পশুপাখিদের বন্ধু রহিম বক্সের কথা। দুবলিয়ার শ্রীকোল বাজারের ব্রিজটা উড়িয়ে দেওয়ার অপারেশনের আগ দিয়ে রহিম বক্সের পশুপক্ষীপ্রীতির প্রসঙ্গটা ফিরে আসে। সেটা ১৯৭১-এর অক্টোবর মাসের কথা।

ততদিনে সুজানগর থানার মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিয়েছে দেরাদুন থেকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে আসা আরও ষাট জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। এবাদে এলাকার পঁয়তাল্লিশ জন তরুণকে বদিউররা গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়েও ফেলেছে। এভাবে সুজানগর থানার গ্রুপে গেরিলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪ জন। এলাকার বিভিন্ন আউট পোস্টে রেইড করে মিলিশিয়া, পুলিশ ও রাজাকারদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে নিয়েছে এলএমজি, ব্রেনগান, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল এবং এনফিল্ড রাইফেলের মতো হালকা কিছু অস্ত্রশস্ত্র। লোকবল এবং অস্ত্রের শক্তি বেড়ে যাওয়ার কারণে শ্রীকোল বাজারের কংক্রিটের ব্রিজটা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে বদিউর আর মিন্টু। তারা তখন নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের হাসামপুর গ্রামে গা ঢাকা দিয়ে আছে। বলে রাখা ভালো যে কৌশলগত দিক থেকে শ্রীকোল বাজার খুবই জরুরি একটা জায়গাতে পরিণত হয়েছিল সেই সময়টায়। শ্রীকোল বাজারের পুষ্পপাড়া হয়ে নূরপুরের অস্থায়ী সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শ্রীকোল বাজারের কংক্রিটের ব্রিজটার ওপর দিয়েই সচরাচর দুবলিয়া বাজারে যেত, তারপরে সেখান থেকে তারা পৌঁছাত গিয়ে পুবের সুজানগর বাজারে। জুলাই মাসে বন্যা তীব্র হওয়াতে ডুবে গিয়েছিল সেই আঞ্চলিক সড়ক। তাই পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যাযজ্ঞ চালানো এবং মুক্তিযোদ্ধা নিধনের জন্য আর সুজানগর থানার গ্রামগুলোর দিকে একবারেই যেতে পারছিল না। তাদের অবর্তমানে অবশ্য অত্যাচার, খুন আর ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিল সুজানগর থানায় আশ্রয় নেওয়া মিলিশিয়া, পুলিশ ও রাজাকারদের দল। সেপ্টেম্বরের শেষে বন্যার পানি নেমে যাওয়াতে আবারও জেগে উঠছিল পুষ্পপাড়া-দুবলিয়া আঞ্চলিক সড়ক, সুজানগরে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের আশঙ্কাও সেই সাথে বাড়ছিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে কৃষ্ণনগর থেকে বদিউরকে ওয়ারলেসে ধরে পাবনা জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের কমান্ডার এবং সে দুবলিয়া বাজারের উত্তরের শীকোল-ব্রিজটা ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। দুবলিয়া পড়েছে পাবনা সদর থানার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নে। কমান্ডার যুক্তি দিয়েছিল: এই ব্রিজটা উড়িয়ে দিতে পারলে পাবনা শহরের নূরপুর অস্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট থেকে দুবলিয়া হয়ে সুজানগরে রি-এনফোর্সমেন্ট আসতে পারবে না এবং তখন সহজেই সুজানগর থানা দখল করে পুরো এলাকাটাকে মুক্তাঞ্চল বানিয়ে ফেলা যাবে। কমান্ডারের নির্দেশ মতো বদিউর শ্রীকোল বাজার-এলাকা রেকি করার জন্য রুবেল আর টিপুকে পাঠায়। রেকি-রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে থেকে মিলিশিয়া এবং রাজাকার মিলিয়ে মোট তেতাল্লিশ জন পালা করে ব্রিজটা পাহারা দিচ্ছে। তিন শিফটে ডিউটি দেয় তারা। বাজারের ভেতরের পাটের গুদামের মূল ঘাঁটি ছাড়াও ব্রিজের দুই ধারে তাঁবু খাটিয়ে তারা থাকছে। পুষ্পপাড়া যাওয়ার পথে, ব্রিজের ঠিক উত্তরে, রয়েছে একটা চেকপোস্ট। বদিউর স্থির করে, ডিনামাইট মেরে তারা উড়িয়ে দেবে কংক্রিটের ব্রিজটা, সেই সাথে হত্যা করা হবে মিলিশিয়া এবং রাজাকারদেরকে। সেই অপারেশনে অংশ নেবে অসিত, রুবেল আর টিপুর নেতৃত্বে পাঁচজন-পাঁচজন করে মোট পনেরো জনের তিনটা দল। পরিকল্পনা অনুযায়ী নাজিরগঞ্জ, মাণিকহাট এবং হাটখালি থেকে নৌকায় চেপে পদ্মানদী বেয়ে পঞ্চাশ জন গেরিলাযোদ্ধা আশ্রয় নেয় সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নিশ্চিন্দিপুর, তারাবাড়িয়া, হেমরাজপুর, লক্ষ্মীপুর, মোজাইতপুর, চরপাড়া এবং কুড়িপাড়া গ্রামে। মোজাইতপুর গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক আব্দুর রবের বাসায় ওঠে বদিউরসহ আটজন। পনেরোজনের গেরিলাদলটার ব্যাক-আপ হিসেবে কাজ করবে তারা। খোদা না খাস্তা যদি রেইড থেকে বড়ো আকারের যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায় তবে বিভিন্ন গ্রামে শেল্টার নিয়ে থাকা যোদ্ধারা বদিউরদের সাথে যোগ দেবে। এমন তো হতেই পারে যেকোনো কারণে রেইড দীর্ঘায়িত হলে পাবনা শহর থেকে শ্রীকোল বাজার-এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর রি-এনফোর্সমেন্ট এসে পড়ল!

বদিউর স্তম্ভিত হয়ে প্রশ্ন করে: মশা আবার চালান দেওয়া যায় নাকি? বাটি চালানোর মামলা হলে একটা কথা ছিল! রহিম বক্সের হয়ে যুক্তি দেয় কাদের বক্স—কেন তা হবে না? মশাবাহিনী কি অত্যাচারী নমরুদকে ধ্বংস করে দেয়নি?

শেল্টার মাস্টার কাদের বক্স তখন বদিউরের কাছে অদ্ভুত একটা খবর নিয়ে আসে—পাকবাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য নাকি মশা চালান দেবে বুড়ো রহিম বক্স! বদিউর স্তম্ভিত হয়ে প্রশ্ন করে: মশা আবার চালান দেওয়া যায় নাকি? বাটি চালানোর মামলা হলে একটা কথা ছিল! রহিম বক্সের হয়ে যুক্তি দেয় কাদের বক্স—কেন তা হবে না? মশাবাহিনী কি অত্যাচারী নমরুদকে ধ্বংস করে দেয়নি? নমরুদ আর তার কাতারে কাতার সৈন্যরা যুদ্ধে নেমেছিল আল্লাহ্তালার বিরুদ্ধে। আকাশের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তির ছুড়ছিল তারা। তখন নমরুদ আর তার বাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য মাত্র এক ঝাঁক মশাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন আল্লাহ্। সেই অল্প ক’টা মশাই কি নমরুদের বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়নি? একটা মশা কি ঢুকে যায়নি নমরুদের মাথার ভেতরে? তখন মশাটার কামড়ের যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য কী করেছিল নমরুদ? সে তার খাস পেয়াদাকে বলেছিল তার মাথায় মুগুর দিয়ে ক্রমাগত বাড়ি মারতে। শাস্ত্রে বলে, শেষতক মুগুরের আঘাতেই মাথা ফেটে মারা যায় নমরুদ। একেই বলে আল্লাহর বিচার! অত্যাচারী ইয়াহিয়া খানের বাহিনীদের জন্য তেমন করেই কোনো ক্ষমা নেই। কাদের বক্স জানায়, মশাবাহিনীর হাতে নমরুদ আর তার সৈন্যদের পর্যুদস্ত হওয়ার গল্প সারা গাঁয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বেড়াচ্ছে বুড়ো রহিম বক্স। কাদের বক্স আরও জানায়, রহিম বক্সের পক্ষে যে মশা চালান দেওয়া সম্ভব তা বিশ্বাস করে চরপাড়ার প্রতিটা মানুষ। মানুষজন মনে করছে, পশুপক্ষীদের সাথে যার এত দোস্তি মশাদের ওপরেও নিশ্চয় তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ব্যাপারটা চরপাড়ায় রটে যাওয়াতে সেখানকার মানুষজন আরও ঋজু হয়েছে ভরসায়—এবার কেবল মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, তাদের পাশে আল্লাহ্‌র দুনিয়ার মশারাও রয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্য, মিলিশিয়া, পুলিশ আর রাজাকাররা তবে নির্বংশ হতে কতক্ষণ?

এখানেই দম নেয় কাদের বক্স। আর তখন বদিউররা সন্দিগ্ধ হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সেই নীরবতার মাঝে কাদের বক্স বলে, বদিউরদেরকে এতগুলো কথা জানানোর উদ্দেশ্য একটাই—বদিউরকে একটু কষ্ট করে দেখা করতে বলেছে রহিম বক্স। বয়সের ভারে রহিম বক্সের চলতে ফিরতে অসুবিধে না হলে সে নিজেই বাড়ি বয়ে এসে বদিউরের সাথে দেখা করে যেত; খুলে বলত তার পরিকল্পনাটা। কৌতূহলের বশেই শেষমেশ রহিম বক্সের সাথে দেখা করার জন্য অনতিদূরের চরপাড়ায় যেতে রাজি হয়ে যায় বদিউর। সে স্থির করে, তুলিপ আর দেরাদুনের তৃতীয় ব্যাচের মনসুরকে সে সাথে নিয়ে যাবে। মোজাইতপুর থেকে চরপাড়ার দূরত্ব এক মাইলের কাছাকাছি হলেও সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে কেননা চতুর্দিকে বিস্তৃত হচ্ছে শান্তিবাহিনীর নেটওয়ার্ক। রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং হঠকারী বামপন্থী কর্মীরা সংখ্যায় খুব একটা কম নয়! কাজেই চরপাড়ায় বদিউরের একা যাওয়া চলবে না।

পরদিন গভীর রাতে মোজাইতপুর থেকে চরপাড়ায় যায় বদিউর। রহিম বক্সের উঠানের আমগাছটার নিচের চরাটে বসে হুকা টানে রহিম বক্স আর সে মিলে। মিনিট পাঁচেক পরে রহিম বক্স চুপিচুপি তাকে বলে, সুজানগর থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা পাকবাহিনীর সৈন্যদের প্রতিতুলনায় খুবই কম বলেই তার ধারণা। রহিম বক্স বদিউরকে জিজ্ঞাসা করে, পাবনা জেলায় দায়িত্বরত হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের সংখ্যা আনুমানিক কত হতে পারে? ব্যাপারটা রহিম বক্সকে বুঝিয়ে বলে বদিউর: পাবনার নয়টা থানা, ঈশ্বরদী এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা মিলিয়ে সেই মুহূর্তে পাকবাহিনীর ১৬ পদাতিক ডিভিশনের ২৯ ক্যাভালরি ব্রিগেড হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। পাবনার নয়টা থানায় সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে ২৯ ক্যাভালরির তিন কোম্পানি সৈন্য। একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, দুজন মেজর এবং একজন ক্যাপ্টেন মিলিয়ে সংখ্যায় তারা হবে নয় শ মতো। নিয়মিত সেনাদের সাথে যোগ হয়েছে পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা বেসামরিক মিলিশিয়া, পাকিস্তানি ও বাঙালি পুলিশ এবং রাজাকারেরা। শেষের এই তিনটা ক্যাটাগরি মিলিয়ে তৈরি হয়েছে দখলকার পাকিস্তানিদের অনিয়মিত বাহিনী। পাকিস্তানের নিয়মিত এবং অনিয়মিত সৈন্য মিলিয়ে পাবনা জেলায় দায়িত্বরত পাকবাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় বারো শ’তে। তারপর রহিম বক্স বদিউরকে প্রশ্ন করে; সারা পাবনা জেলায় সেই মুহূর্তে বিশাল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে কয়জন মুক্তিযোদ্ধা? বদিউর উত্তর দেয়, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের গেরিলাযোদ্ধা এবং ৭ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর সদস্য মিলিয়ে প্রায় পাঁচ শ জন গেরিলাযোদ্ধা ছড়িয়ে আছে পাবনা জেলার নয়টা থানার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে। এ তথ্য জানার পরে রহিম বক্স একটু থামে। তারপর সে পাকবাহিনী এবং অনিয়মিত ক্যাটাগরির বাঙালি গেরিলাদের ফায়ার পাওয়ার সম্পর্কে জানতে চায়। বদিউর উত্তর দেয়: নিঃসন্দেহে সে হিসেবটা অসমই হবে কেননা গেরিলাদের কাছে সাধারণত ভারী হাতিয়ার থাকে না, ভারী হাতিয়ার হলো গিয়ে নিয়মিত বাহিনীর ব্যাপার স্যাপার। বাংলাদেশের নিয়মিত মুক্তিবাহিনী রয়েছে পাবনা থেকে দূরে—সীমান্তবর্তী এলাকায়। তাদের ফায়ার পাওয়ার পাবনার গেরিলাদের সাথে তো আর যোগ হচ্ছে না! এসব তুলনামূলক তথ্য জানার পরে স্বাভাবিকভাবেই রহিম বক্স মন্তব্য করেছিল, ‘তা-হলি পরে বাপজান পাকবাহিনীর সৈন্য আর তাগারে অস্ত্রশস্ত্রের মুখে আপনেরা যুদ্ধ করে টিকে থাকপেন ক্যাম্বা করে?’

রহিম বক্সের প্রশ্ন আর বক্তব্যের মাঝে তখন একটা ফাঁক ধরেছিল বদিউর। সে বলেছিল: সৈন্যসংখ্যা এবং অস্ত্রশস্ত্রের মাপটাই সবটুকু নয়, গেরিলাযুদ্ধের কৌশলই সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ভিয়েতনাম তার সবচাইতে বড়ো উদাহরণ—গেরিলাযুদ্ধের নিত্যনতুন কৌশলের কারণেই ভিয়েতকং-গেরিলারা দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং আমেরিকান সৈন্যদেরকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল। গেরিলাযুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে অবশ্য বুড়ো রহিম বক্সের কোনো ধারণাই ছিল না। রহিম বক্স বরং প্রত্যয় নিয়েই বদিউরকে বলেছিল—শক্তির দিক থেকে অসমতার এ সমস্যার একটা যথাযোগ্য সমাধান তার কাছে আছে। কী সেটা? মশাবাহিনী গঠন করছে রহিম বক্স। এই মশাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। সেটা কেমন? পাকবাহিনীর সৈন্যদের কান দিয়ে মাথার ভেতরে ঢুকে পড়বে মশারা; মাথার ভেতরে গিয়ে তারা ক্রমাগত ফরফর করতে থাকবে; কামড়াবে আচ্ছা মতন। সেই শারীরিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য দেয়ালে মাথা ঠুকবে পাকবাহিনীর সৈন্যরা, মুগুর দিয়ে একে অপরের মাথায় তারা আঘাত করবে, নিজের খুলিতে পিস্তল চালিয়ে আত্মহত্যাও করতে পারে কেউ কেউ! রহিম বক্সের ভাবনাটা শুনে চরাটের সামনের টুলে বসে থাকা তুলিপ একটু নড়েচড়ে বসে। গভীর সংশয়ে তুলিপের ভুরু কুঁচকে গেল কি না তা অবশ্য অন্ধকারের কারণে বোঝা যায় না। বদিউর ভাবে, মানুষের বিশ্বাসে কখনো আঘাত করতে নেই। এসব বিশ্বাসই নিশ্চয় কোনো জনপদের উপদ্রুত মানুষজনদেরকে একতাবদ্ধ করে থাকে; তাদেরকে জড়িয়ে ফেলে জনযুদ্ধের ভেতর। এমন একটা ভাবনা থেকে বদিউর উষ্ণতা নিয়েই রহিম বক্সকে বলে, ‘তা’লি পরে মশাবাহিনী পাঠা দিয়েন আপনে। আমারে সাথে যুদ্ধ করবিনি।’

কিন্তু কবে কোথায় রহিম বক্স পাঠাবে তার মশাবাহিনীকে? স্বাভাবিকভাবেই তখন এ প্রশ্নটা উঠেছিল। সে প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগই হয়েছিল বদিউর কেননা গেরিলাযুদ্ধের কৌশল হিসেবে অপারেশনের স্থান এবং দিনক্ষণ ডেপুটি লিডার ছাড়া গ্রুপের কোনো গেরিলাকেও জানানোর নয়, রহিম বক্স তো কোন ছাড়! কাজেই নীরবতাই অবলম্বন করে বদিউর। রহিম বক্সের পীড়াপীড়িতে সে তার নীরবতার পেছনের যুক্তিটা খোলাসা করেও বলে শেষপর্যন্ত। বিরক্তি নিয়ে তখন রহিম বক্স প্রশ্ন করে: তবে কি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে এলাকার মানুষজনদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই? সে কী কথা? শশব্যস্ত হয়ে বদিউর উত্তর দেয়: তা থাকবে না কে? এই যে আপনারা আমাদেরকে শেল্টার দিচ্ছেন; যত্ন করে খেতে দিচ্ছেন; পাকসেনা, মিলিশিয়া, পুলিশ আর রাজাকারদের অবস্থান এবং গতায়ত সম্পর্কে নিয়মিতভাবে তথ্য দিচ্ছেন—এলাকার মানুষজনের এসব সহযোগিতা তো গেরিলাযোদ্ধাদের জন্য পরম পাওয়া! তাইই নয় কি? বদিউরের এসব কথায় মন ভরে না রহিম বক্সের। কঠিন গলায় সে কেবল বলে, ‘ঠিক আছে! আমারে রাস্তা আমরাই বাইর করে লেবনে!’ এই বলে উঠানে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হেঁটে নিজের মাটির ঘরটায় উঠে যায় রহিম বক্স। অস্বস্তি নিয়েই রহিম বক্সের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বদিউর আর তার সহচরেরা।

পুষ্পপাড়া-দুবলিয়া সংযোগ-সড়কের শ্রীকোল ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য অক্টোবরের চার তারিখটাকে মনে মনে বেছে নেয় বদিউর। অক্টোবরের এক তারিখে পরিকল্পনা মতো শ্রীকোল বাজারের আশপাশে সে তিনটা গেরিলাদলকে পাঠায়: উত্তর-পশ্চিমের এলাকা কামারডাঙায় যায় অসিতসহ পাঁচজন গেরিলাযোদ্ধা, উত্তর-পুবের চোমরপুরে রুবেলের নেতৃত্বে পাঁচজন গেরিলা এবং দক্ষিণের মধ্যপাড়ায় টিপুর নেতৃত্বে যায় আরও পাঁচজন। তাদেরকে বিভিন্ন কন্টাক্টের বাড়িতে রেখে আসে শেল্টার মাস্টার কাদের বক্স। বদিউর সেই তিনটা দলকে বলে দেয়: অক্টোবরের দুই আর তিন তারিখে তারা শ্রীকোল ব্রিজ-এলাকায় নজরদারি করবে, চার তারিখ দিবাগত রাতে ঝটিকা আক্রমণে ব্রিজে পাহারারত পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও রাজাকারদেরকে খতম করবে তারা তারপর ডিনামাইট বসিয়ে উড়িয়ে দেবে কংক্রিটের ব্রিজটা। কিন্তু পরিকল্পনা মতো কী আর সব কিছু ঘটে? চার তারিখ ফজরের আজানের পরপর অসিতদের কামারডাঙার আশ্রয় ঘিরে ফেলে জনা তিরিশেক মিলিশিয়া এবং রাজাকারেরা। মিলিশিয়া এবং রাজাকারদের শক্ত ব্যূহ ভেদ করে অসিতরা আর বের হতে পারেনি। গুলি বিনিময়ের কালে নিহত হয় অসিতসহ তিনজন গেরিলা। এসএমজি এবং ৭.৬২ মিলিমিটার এনফিল্ড রাইফেলের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর বাসাটার পেছনের বাঁশঝাড় দিয়ে বাকি দুজন গেরিলা পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়। মিলিশিয়া এবং রাজাকারেরা পেছন থেকে তাদের পিঠে গুলি চালালে তারা ঢলে পড়ে হলদিখেতে। এদিকে কামারডাঙার দলের উপরে মিলিশিয়া এবং রাজাকারদের আক্রমণের খবর পেয়ে শ্রীকোল-এলাকায় অবস্থান নেওয়া গেরিলাদের আর দুটো দল তখন জলদি ফল ব্যাক করে পদ্মার ধারের মোজাইতপুরে চলে যায়। এভাবে পণ্ড হয়ে যায় শ্রীকোল ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটা। প্রতিশোধ হিসেবে পরে কামারডাঙার দুজন ইনফর্মারকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দক্ষিণ রাঘবপুরের এনাম ও তার ছোটো একটা দল।

অসিতদের অকাল মৃত্যুতে খুবই আঘাত পেয়েছে রহিম বক্স! রহিম বক্স বদিউরকে জানাতে বলেছে যে তার মশাবাহিনী ঠিকঠাক মতো কাজ করেনি—এটা সত্য। কেন করেনি—সেটাই এখন ভেবে দেখার বিষয়।

অসিত, সালেহ, নাসিম, লিখন আর গাফফার পাকবাহিনীর হাতে খুন হওয়ার পরে সুজানগরের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের সদস্যরা সবাই ভীষণ ব্যথিত হয়ে পড়ে। অসিতের মৃত্যুতে বদিউর নিজেই ভেঙে পড়ে বেশি। এর কারণ হলো: দিলালপুরের একই পাড়ায় বড়ো হয়েছে সে আর অসিত, ক্লাস থ্রি থেকে এইট পর্যন্ত অসিত তার সাথে পাবনা জেলা স্কুলে পড়েছে। তারপর অসিত হুট করেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে তার বাবার মুদির দোকানে বসতে শুরু করলে সেখানেই বদিউররা তাদের তারুণ্যে আড্ডা দিয়েছে বেশি, এই সেদিনও। বাল্যবন্ধু-বিয়োগের ব্যথা নিয়েই মোজাইতপুরের শেল্টার থেকে হেমরাজপুরের শেল্টারে চলে যায় বদিউর। সেখানে গিয়েও সে থম মেরে বসে থাকে তিন দিন। চতুর্থ দিন রাতে নিশ্চিন্দিপুরের শেল্টারে বদিউরকে পৌঁছে দেওয়ার পরে কাদের বক্স তাকে জানায়, অসিতদের অকাল মৃত্যুতে খুবই আঘাত পেয়েছে রহিম বক্স! রহিম বক্স বদিউরকে জানাতে বলেছে যে তার মশাবাহিনী ঠিকঠাক মতো কাজ করেনি—এটা সত্য। কেন করেনি—সেটাই এখন ভেবে দেখার বিষয়। ভবিষ্যতে যাতে মশাবাহিনী গেরিলাদেরকে কার্যকরভাবে সহায়তা দিতে পারে সে ব্যাপারে নজর রাখবে রহিম বক্স। কাদের বক্সের কথা মন দিয়েই শোনে বদিউর। তবে তার কাছে রহিম বক্সের প্রতিক্রিয়াকে মোটেই জরুরি বলে মনে হয় না। বন্ধুর মৃত্যুর শোকে তখন বদিউরের মাথার ভেতরে সব কিছুই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে, এমনকি গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাটুকুও।

বদিউরের মনে যখন শূন্যাবস্থা চলছে তখন এক দিন তার সাথে আলাপে বসে গেরিলাদলের ডেপুটি লিডার মিন্টুসহ সাতজন কোর সদস্য। তারা সবাই মনে করে, দুবলিয়ার শ্রীকোল ব্রিজ এবার উড়িয়ে দিতেই হবে। বদিউর যুক্তি দেয়, সে কাজটা সহজ হবে না কেননা তথ্য বলছে, শ্রীকোল বাজার এবং ব্রিজ এলাকায় এবার পাবনা শহর থেকে বাড়তি পাকিস্তানি মিলিশিয়া এবং রাজাকার ডিউটি দিতে এসেছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে সুজানগর থানায় অবস্থান নেওয়া মিলিশিয়া, পুলিশ ও রাজাকাররা। সব মিলিয়ে শ্রীকোল ব্রিজ এলাকায় এবার পাকবাহিনীর সৈন্যদের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় পঁচাত্তর জনে। বাজারের ভেতরে একটা পাটের গুদামে ঘাঁটি গেড়েছে তারা। সেখান থেকেই তারা পালাক্রমে ব্রিজ পাহারা দিচ্ছে। তারা এবার সাবধানও হয়ে গেছে—ব্রিজে পাহারা বাড়ানো ছাড়াও শ্রীকোল বাজার সংলগ্ন দুবলিয়া এবং তাঁতিবন্ধের গ্রামগুলোতে তারা বেশি সংখ্যায় চর নিয়োগ দিয়েছে। গ্রামের হালট ধরে প্রতিদিন দুবেলা সন্নিহিত গ্রামগুলোতে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে পাকবাহিনীর সদস্যরা; বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, খুন এবং ধর্ষণের মাত্রা তারা বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে সদাসতর্ক পঁচাত্তর জন শত্রুর বিরুদ্ধে হিট অ্যান্ড রান অপারেশন চালানোটা কঠিন একটা কাজ ছাড়া আর কিছুই হবে না। বদিউরের সহযোগীরা তার এই পর্যবেক্ষণের সাথে সহজেই ঐকমত্য হয়। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ভায়না, সাতবাড়িয়া, মাণিকহাট, হাটখালি এবং নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে লুকিয়ে থাকা ১১৪ জন গেরিলা যুগপৎভাবে শ্রীকোল বাজার রেইড ও ব্রিজ ধ্বংসের অভিযানে অংশ নেবে। মিন্টুর নেতৃত্বে শ্রীকোলের পূর্ব এবং উত্তর দিক থেকে আক্রমণ চালাবে মাণিকহাট, নাজিরগঞ্জ, হাটখালি এবং গাজনার বিল এলাকায় ছড়িয়ে থাকা গেরিলারা। বদিউরের নেতৃত্বে সাতবাড়িয়া এবং ভায়না ইউনিয়নে অবস্থান নেওয়া গেরিলারা দু-ভাগ হয়ে রেইড করবে শ্রীকোলের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে। রয়েসয়েই স্থির করা হবে শ্রীকোল ব্রিজে আক্রমণের দিনক্ষণ। রেকিদলগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে সে কাজটা করবে বদিউর স্বয়ং।

পরের সপ্তাহ দুয়েক ধরে রেকি-রিপোর্ট শুনতে শুনতে শ্রীকোল ব্রিজ রেইড করার জন্য কতগুলো কৌশল চূড়ান্ত করে ফেলে বদিউর: (১) পাবনা সদর থানার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের গেরিলাদেরকে দুবলিয়া বাজার পাহারা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হবে যাতে করে দোগাছি-ভারারা হয়ে দুবলিয়া-সুজানগরের দিকে পাবনা শহর থেকে কোনো রি-ইনফোর্সমেন্ট আসতে না পারে; (২) নাটাখোলায় অবস্থান নিয়ে সুজানগর-নাটাখোলা রেডের দিকে নজর রাখবে সাঁথিয়া থানার গেরিলারা; (৩) নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাটে যেহেতু পদ্মানদী দিয়ে জলযান নামা সম্ভব কাজেই সেখানে সুজানগরের দশজন গেরিলা এলএমজি নিয়ে পজিশনে থাকবে; (৪) পুষ্পপাড়া-দুবলিয়া আঞ্চলিক সড়কের চোমরপুর এলাকার উত্তর দিকে এলএমজি নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকবে সুজানগরের গেরিলাদের দশ জনের একটা কাট অব পার্টি; (৫) চোমরপুরের পুবে আতাইকুলা-সুজানগরের দিকে মুখ করে সুজানগরের গেরিলাদের দশজনের আরেকটা কাট অব পার্টি এলএমজি নিয়ে পজিশনে থাকবে, এবং (৬) সুজানগরের গেরিলাদের বাকি ৮৪ জন তিন দিক থেকে আক্রমণ চালাবে শ্রীকোল ব্রিজসহ বাজার ও বাজার-সংলগ্ন এলাকায়; এবং (৭) রেইডের শেষে তারা মিলিত হবে চরপাড়ার অ্যাসেম্বলি পয়েন্টে। এসব কৌশল নির্ধারণের পরেও একটা অস্বস্তির দিক রয়ে যায়: বদিউরদেরকে কেবল অ্যামবুশ, রেইড আর হ্যারাসিং ফায়ারের মতো ছোটোখাটো গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, বড়ো আকারের কোনো যুদ্ধের নয়। বড়ো কোনো যুদ্ধ বলতে জুলাই মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সীমান্তে তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দু-বার মাত্র সম্মুখযুদ্ধে নেমেছিল। সেই বড়ো আকারের যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল সাত নম্বর সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর ক্যাপ্টেন। সেখানে স্বাধীনভাবে যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে বদিউরের কোনো সুযোগ ছিল না। কাজেই শ্রীকোল বাজার রেইড করার যুদ্ধে নামার আগে সে বাস্তব পরিস্থিতি ভালো মতো খতিয়ে দেখতে চেয়েছিল। এ ধরনের বড়ো মাপের রেইড নিশ্চয় রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে কোনো অবস্থানে গ্রেনেড ছুড়ে মেরে পালিয়ে যাওয়ার মতো ছোটো কোনো হিট অ্যান্ড রান অপারেশন হবে না!

অক্টোবর মাসের সাতাশ তারিখ সন্ধেবেলায় নাজিরগঞ্জ, মাণিকহাট, হাটখালি এবং গাজনার বিল এলাকা থেকে ডেপুটি লিডার মিন্টুকে অনুসরণ করল চল্লিশ জন গেরিলাযোদ্ধা। তাঁতিবন্ধের উদয়পুর গ্রামে এক দিন বিশ্রাম নিয়ে সন্ধেবেলায় যাত্রা করে আটাশ তারিখ রাত একটার দিকে তারা শ্রীকোল-চরপাড়ায় পৌঁছাল। অন্যদিকে বদিউরের চুয়াল্লিশ জনের দলটা সাতবাড়িয়া এবং ভায়না ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পদ্মানদী বেয়ে থামল গিয়ে দুবলিয়া বাজারের দক্ষিণে। সেখান থেকে চর তারাপুরে দিনটা কাটিয়ে রাতের বেলায় সিঙ্গেল ফাইলে পায়ে হেঁটে তারা থামল গিয়ে শ্রীকোল-মধ্যপাড়ায়। রাত তখন দুটো বাজে। চুরাশি জন গেরিলা ব্রিজের দু শ গজের ভেতরে ব্রিজের দুপাশের বাড়িঘর এবং গাছপালার আড়ালে পজিশন নিল। ট্রেঞ্চ আর ফক্সহোল খোঁড়ার মতো সময় ছিল না তাদের হাতে। তাই বাসাবাড়ির আশপাশের গর্তগুলো তারা কোদাল-শাবল চালিয়ে খানিকটা গভীর করে নিল মাত্র। তারপর অন্ধকারের ভেতরে তারা অপেক্ষায় রইল বদিউরের সিগন্যালের। ফজরের নামাজের পরে, যখন বেলা উঠছে, তখন বদিউরের নির্দেশে ব্রিজ আক্রমণ করল সুজানগর থানার গেরিলারা। এলএমজির গুলি ছুটল পয়লাতে। প্রত্যুত্তর এলো সাথে সাথেই। একই সময়ে বাজারের পাটের গুদামের ঘাঁটিতে অবস্থানরত সৈন্যদেরকে আক্রমণ করল গেরিলাযোদ্ধাদের আরেকটা দল। বাজার এবং ব্রিজ এলাকায় শুরু হয়ে গেল রেইড।

দু-দলের ফায়ার পাওয়ার প্রায় সমানই ছিল সেদিন। যুদ্ধে দু-দলই ব্যবহার করছিল এলএমজি, ব্রেনগান, স্টার্লিং সাব-মেশিনগান, টমিগান, স্টেনগান, ৭.৬২ আর ৭.৯২ মিলিমিটার এন-ফিল্ড রাইফেল এবং দেড় ইঞ্চি আর দু-ইঞ্চি মর্টার। দু-পক্ষেরই মিলস্ হ্যান্ড গ্রেনেড তো ছিলই! পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণ—এই তিন দিক থেকে গেরিলাযোদ্ধাদের যুগপৎ আক্রমণের ফলে ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরেই পর্যুদস্ত হয়েছিল ঘাঁটিতে বিশ্রামরত এবং ব্রিজে ডিউটি দিতে থাকা ৭৫ জন পাকিস্তানি মিলিশিয়া, পুলিশ এবং রাজাকারেরা। এর কারণ হলো: ব্রিজের দু-পাশের চৌকি এবং আশপাশের খোলা জায়গাতে দাঁড়িয়ে বা বসে ডিউটি দিচ্ছিল যারা তারা আর কাভার নিতে পারেনি। রাস্তাটা সরু বলে রাস্তার পাশে কোনো বাঙ্কার খোঁড়াও ছিল না যে তারা সেখানে নেমে এলএমজি নিয়ে পজিশনে যেতে পারবে। এদিকে পাটের গুদামে সেন্ট্রি ডিউটিতে চারজন রাজাকার টহল দিচ্ছিল, বাঙ্কারে এলএমজি হাতে পজিশনে ছিল দুজন মিলিশিয়া এবং গুদামের ভেতরে ঘুমাচ্ছিল বাকি মিলিশিয়া এবং রাজাকারেরা। তারা এমন অকস্মাৎ আক্রমণের মুখে পড়ে গিয়ে ভীষণ ভরকে গিয়েছিল। যারা ব্রিজ রক্ষা করছিল তাদের কেউ কেউ আবার উপায়ন্তর না দেখে কাভার নিতে ঢুকে পড়েছিল বাজার-এলাকায়। সেখানে যুদ্ধরত গেরিলাদের থাবার ভেতরে খুব সহজেই পড়ে কতল হয়ে গিয়েছিল তারা। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের রেইডের মুখে সেদিন শ্রীকোল ব্রিজের চৌকির আশপাশ এবং বাজারের ভেতরের পাটের গুদামে নিহত হয় শত্রুদের সাতচল্লিশ জন। অবস্থা বেগতিক দেখে শত্রুপক্ষের পনেরো জন পুষ্পপাড়া-দুবলিয়া রোডের উত্তর দিকে পুষ্পপাড়া লক্ষ করে দৌড়ে পালাতে বসে। চোমরপুরে যে দশজন মুক্তিযোদ্ধা রাস্তার ধারের আমবাগানে ঘাপটি মেরেছিল কাট অফ পার্টি হিসেবে তাদের অ্যামবুশে পড়ে গিয়ে নিকেষ হয়ে যায় তারা। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের তেরো জন হাতিয়ার ফেলে ভোঁ-দৌড় দেয় ব্রিজের দু’পাশের মাঠ ভেঙে গ্রামের দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তাদের পাঁচজন। বাকি আটজন গুলির ভেতর দিয়ে দৌড়ে কামারডাঙা ঢুকে পড়লে গ্রামবাসীরা তাদেরকে ধাওয়া করে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এভাবে সেদিনের রেইডে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় শ্রীকোল বাজার এবং ব্রিজ-এলাকায় অবস্থান নিয়ে থাকা পঁচাত্তর জন পাকিস্তানি মিলিশিয়া, পুলিশ এবং রাজাকারদের সবাই। পাবনা শহর থেকে তখনো তাদের সহায়তায় পাকবাহিনী এগিয়ে আসেনি। এ সম্ভাবনা নিয়ে ভয়েই ছিল বদিউররা।

পাবনা শহর থেকে পুষ্পপাড়া-দুবলিয়া রোড ধরে শ্রীকোলে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৯ ক্যাভালরি তাদের সাম্প্রতিক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আসতে পারে—এই জোর সম্ভাবনার কারণে তখন গ্রামবাসীরা যে যার মতো নিজেদের এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও সরে পড়তে শুরু করেছে। এমনই তো হচ্ছিল তখন—মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অ্যাকশনের পর দিয়ে সেই জায়গাটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছিল, যথেচ্ছ হত্যা আর ধর্ষণ চালাচ্ছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা!

অন্যদিকে সেদিন কমব্যাটে নিহত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আটজন সদস্য। সৎকারের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ নিয়ে যায় কামারডাঙা এবং শ্রীকোল-চরপাড়ার মানুষজন। গ্রামবাসীদের সহায়তায় শ্রীকোল ব্রিজের দু-পাশের ধানিজমিতে গর্ত খুঁড়ে কোনো মতে পুঁতে রাখা হয় শত্রুপক্ষের লাশগুলো। তারপর শ্রীকোল ব্রিজের পিলার ছয়টাতে ডিনামাইট বসায় ডেমলিশন এক্সপার্ট বাবুল এবং তার ৭ জন সহযোগী মিলে। দূর থেকে ডেটোনেটিং কর্ডে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। প্রচণ্ড শব্দে খণ্ডে খণ্ডে কংক্রিটের ব্রিজটা ভেঙে পড়ে যায় মুহূর্তের ভেতরে। আটজন শহিদকে শ্রীকোল বাজারের এক কোনায় দাফন করে তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের দু’টো দল পদ্মাপারে ফিরে যায়। পাবনা শহর থেকে পুষ্পপাড়া-দুবলিয়া রোড ধরে শ্রীকোলে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৯ ক্যাভালরি তাদের সাম্প্রতিক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আসতে পারে—এই জোর সম্ভাবনার কারণে তখন গ্রামবাসীরা যে যার মতো নিজেদের এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও সরে পড়তে শুরু করেছে। এমনই তো হচ্ছিল তখন—মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অ্যাকশনের পর দিয়ে সেই জায়গাটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছিল, যথেচ্ছ হত্যা আর ধর্ষণ চালাচ্ছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা!

রেইডের শেষে শ্রীকোল বাজার থেকে বদিউর আর মিন্টুর দল সিঙ্গেল ফাইলে গ্রামের হালট এবং খেতের আইল ধরে দক্ষিণে হেঁটে যায়। দুবলিয়া বাজার পার হয়ে দক্ষিণে-পশ্চিমে চরপাড়ার অ্যাসেম্বলি পয়েন্টে গিয়ে তারা থামে। চরপাড়ায় রয়ে যায় বদিউরসহ পাঁচজন গেরিলা। বাকিরা পদ্মানদী বেয়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ে ক্ষেতুপাড়া, শহীদপুর, হাজারিপাড়া এবং হাসামপুর এলাকায়।

চরপাড়ায় গিয়ে শেল্টার মাস্টার কাদের বক্সের বাড়িতে ওঠে বদিউররা। বড়ো একটা অপারেশনের শেষে খুব নির্ভার মনে হচ্ছিল তাদের। মেলা দিন পরে তাই সময় নিয়ে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল করে তারা। তারপর ভয়ানক ক্ষিধে পেয়ে যায় তাদের। ততক্ষণ দুপুরের খানা হিসেবে পুঁটিমাছ ভাজা, মিষ্টি কুমরার ঘণ্ট এবং কলাইয়ের ডালের ব্যবস্থা করে ফেলেছে কাদের বক্স। কাঁচুমাচু হয়ে কাদের বক্স বদিউরকে বলে যে মধ্যাহ্নভোজে সে গ্রামের পাঁচজন মুরব্বিকে দাওয়াত দিতে চায়। শ্রীকোল ব্রিজ ধ্বংসের অভিযানে সাফল্যের কারণে মুরব্বিরা গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। সেজন্যই গ্রামের মুরব্বিদেরকে না ডাকলে আর চলছে না! এখানে বলে রাখা ভালো, হাইড আউটের এলাকায় অন্য কোনো মানুষের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখে না বদিউর বা তাদের দলের গেরিলাদের কেউই। চারদিক যখন রাজাকার দিয়ে ছেয়ে আছে তখন কে শত্রু আর কে যে মিত্র তা অল্প সময়ে বুঝে উঠতে পারাটা আসলেই কঠিন। তাই মানুষের সাথে মাখামাখি করতে গিয়ে আর ঝুঁকি বাড়াতে চায় না বদিউররা। গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় তাদেরকে এসব বিষয়ে খুব সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে বারবার। তবে সেদিনের রেইডের সাফল্যের পরে অন্যরকম ভাবনা হয় বদিউরের। সে ভেবে দেখে, এলাকাবাসীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা না থাকলে অত বড়ো একটা অপারেশন কখনোই তুলে আনা যেত না। এ কারণে এলাকার মানুষজনকে ধন্যবাদ দেওয়াটা ভদ্রতার ভেতরেই পড়ে। এভাবে এলাকায় জনসমর্থন আরও বাড়াবে বলে তার ধারণা হয়। জনসমর্থন ছাড়া তো দীর্ঘমেয়াদি জনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। এই যুক্তিতে মধ্যাহ্ন ভোজে পাঁচজন মুরব্বির উপস্থিতিতে সম্মতি দেয় বদিউর।

কাদের বক্সের উঠানে পাতা কাঠের পুরোনো টেবিল-চেয়ারে মুরব্বিদের সাথে বসে পুঁটিমাছ ভাজা, মিষ্টি কুমরার ঘণ্ট আর কলাইয়ের ডাল, সাথে পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খায় বদিউররা। খেতে খেতে পাবনা জেলাসহ সারা দেশে দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়। গ্রামবাসীরা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র এবং আকাশবাণীর সম্প্রচার থেকে সেসব সংবাদ জেনেছে। খাওয়ার পরে হুঁকা ধরায় মুরব্বি ইন্তাজ মৃধা। উপস্থিত অতিথিদের হাতে হাতে হুঁকা ঘুরতে থাকলে ইন্তাজ মৃধা শ্রীকোল ব্রিজ ধ্বংসের সাফল্য নিয়ে কথা তোলে। সেই প্রেক্ষিতে তোরাব আলি বলে, ‘জব্বর একখেন যুদ্ধ হলে ভাই! মিলিশিয়া, পুলিশ আর রাজাকারেরা তো মুক্তিবাহিনীর সামনে কুলাবেরই পারলে না! পারবি ক্যাম্বা করে? রোদ উঠলি পরে দেহা গেল, আকাশ ছায়ে গেছে কালা কালা ম্যাঘ দিয়ে। পরে ভালো করে তাকা সারে দেখি: ওমা! ঐগুলেন তো আসলে ম্যাঘ লয়—ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আকাশ থেন নামে আসে সারে পাকসেনারে মাথার উপের দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে! আল্লার কীড়ে ভাই!’

তোরাব আলির সমর্থনে ইন্তাজ মৃধা বদিউরকে জানায়, দুবলিয়া, সুজানগর বাজার আর তাঁতিবন্ধের সবাই দূর থেকেই সেই দৃশ্য দেখেছে।

মুরব্বিদের আরেক জন—লাভু পরামানিক গর্বের হাসিতে মন্তব্য করে, ‘যাক! ইবার রহিম বক্স চাচার কেরামতি ঠিকঠাক মতো কামে দেছে! তা না-হলি কী যে হতে আইজ? হারামীর বাচ্চা মিলিশিয়ারা খৈ ফুটানের মতন করে মেশিনগান চালায়ছে আমারে ছাওয়াল-পাওয়ালের দিক এইম করে। ভাগ্যিস রহিম বক্স চাচার পুষা মশারা মুক্তিযোদ্ধারে সাথে হাত লাগাইছিলে!’

ইন্তাজ মৃধা, তোরাব আলি এবং লাভু পরামানিকের কথায় ধন্ধেই পড়ে যায় বদিউর! অবাক হয়ে সে ইন্তাজ মৃধাকে বলে: কই? তারা তো যুদ্ধক্ষেত্রে মশার ঝাঁকগুলোকে আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখেনি! কী তাজ্জব কথা এসব!

ইন্তাজ মৃধা হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, ‘বাজান! আপনেরা যুদ্ধ করতি ব্যস্ত হয়ে ছিলেন। অত কিছু কি আর আপনেরে চোখে পড়েছে তহুন?’

লাভু পরামানিক বদিউরকে বলে, মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ না করলেও কামারডাঙা এবং শ্রীকোল-চরপাড়ার প্রতিটা মানুষ দেখেছে, পাকিস্তানি মিলিশিয়া, পুলিশবাহিনী আর রাজাকারদের নাক-মুখ দিয়ে শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে রহিম বক্সের মশাবাহিনী। তখন শত্রুরা নিশ্চয় নিজেদের মাথা নিজেরাই ঠুকরে মরেছে! কামারডাঙার মানুষজন বলছে, জান বাঁচানোর জন্য মাঠ ভেঙে দৌড়ে যে কয়জন মিলিশিয়া তাদের গ্রামে ঢুকে পড়েছিল তাদের দুজনকে কোনো আঘাত করতেই হয়নি—মাটিতে বসে পড়ে থান ইট দিয়ে নিজেদের মাথায় ক্রমাগত বাড়ি মারছিল তারা। এক সময় তারা নিজেরাই নিজেদের মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে দেয়!

লাভু পরামানিকের কথা শুনে আরেক প্রস্থ অবাক হয় বদিউর। সে তার চারজন সহযোদ্ধার বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে লাভু পরামানিককে অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করে, ‘তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি চাচা! কই? আমরা তো এইতার কিছুই জানিনে!’

বদিউরকে অবাক হতে দেখে বেশ জোরে হেসে ওঠে লাভু পরামানিক। সে যুক্তি দিতে নামে, ‘বাবাসগল! আপনেরা বোম মারে বিরিজ উড়া দিচ্ছিলেন তহুন। তালি পরে আপনেরা ঐসব লগর দেইখপেন ক্যাবা করে?’

এসব আলাপ-আলোচনা যখন বেগবান হচ্ছে তখন টেবিলের ওমাথায় বসে থাকা খুনখুনে বুড়ো রহিম বক্সের চোখে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে তাকায় বদিউর। সে দেখতে পায়, মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছে রহিম বক্স; কিছু বলছে না। রহিম বক্সের ডান কাঁধে বসে আছে ধলা গিরিবাজ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাশিল্পী, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে, ঢাকা শহরের সিদ্ধেশ্বরীতে। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের ভেতরে রয়েছে: ‘নক্ষত্রের ঘোড়া’, ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’, ‘আয়না’, ‘নীলক্ষেতে কেন যাই’,  ‘বখতিয়ার খানের সাইকেল’ এবং ‘ঘুমতৃষ্ণা’। উপন্যাসটির নাম–‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২২-এর সৃজনশীল শাখায় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ামস কলেজ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে তিনি স্নাতোকোত্তর।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।