শুক্রবার, অক্টোবর ৪

রামকিঙ্কর : মুহাম্মদ শাওয়াব

0

রামকিঙ্কর বেইজ। একজন ভাস্কর, স্বপ্নবাজ, মাতাল ও প্রেমিক। জন্ম বাঁকুড়ায়। ১৯০৬ সালের মে মাসে। এক দরিদ্র-নিরক্ষর পরিবারে।

কৈশোরেই ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে রামকিঙ্কর চলে আসেন শান্তিনিকেতন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে হয়ে ওঠেন এখানকার ‘অন্যরকম বাসিন্দা’। ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানোর জন্য তাঁর কাছে, বোলপুরের উদ্দেশ্য ছুটেন অসুস্থ ঋত্বিক ঘটক। প্রিয় কিঙ্করদা’র সাথে হুটহাট আড্ডা দেয়ার জন্য প্রায়শই ছুটে আসতেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ট্রেন ভ্রমণে এক অচেনা তনয়ার যৌবনের দুর্মর আহ্বানের কাছে নতজানু হয়ে তিনি হারিয়ে যেতে পারতেন অজানা স্টেশনে। এমনই ছিলেন তাঁদের প্রিয় কিঙ্করদা— রামকিঙ্কর বেইজ। ছবি ও ভাস্কর্যে জীবনকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন যিনি।

প্রিয় কিঙ্করদা’র সাথে হুটহাট আড্ডা দেয়ার জন্য প্রায়শই ছুটে আসতেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ট্রেন ভ্রমণে এক অচেনা তনয়ার যৌবনের দুর্মর আহ্বানের কাছে নতজানু হয়ে তিনি হারিয়ে যেতে পারতেন অজানা স্টেশনে। এমনই ছিলেন তাঁদের প্রিয় কিঙ্করদা

মডার্ণ ওয়েস্টার্ণ আর্ট ও প্রি অ্যান্ড পোস্ট-ক্লাসিকাল ইন্ডিয়ান আর্ট ছিল তাঁর চিত্রশিল্পের মূল বিষয়বস্তু। ভারতীয় শিল্পকলা চর্চায় আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে যাদের নাম উচ্চারিত হয়, তাদের মধ্যে রামকিঙ্কর বেইজ অন্যতম।

 

০২.
কুমোরপাড়ায় মূর্তি তৈরি করেন অনন্তজ্যাঠা। ছোট্ট কিঙ্কর ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখে জ্যাঠার কাজ। একসময় রপ্ত করে ফেলে এই মহাবিদ্যা।

এক সিগারেট দীর্ঘ এক অন্ধকার চাপা রাস্তা হয়তো চলে গেছে কুমোরপাড়ার পাশ দিয়ে। সে রাস্তায় তীব্র শীতেও মানুষ চলাচল করে ছাতা মাথায় দিয়ে৷ গায়ে চাদর জড়িয়ে পেরোয় কাঠফাটা রোদ। ছাতা তো আছেই। কারো মুখ ঢাকা থাকে মোটা মাফলারে। পথের গন্তব্য পতিতালয়। কথিত সভ্য সমাজ যাকে বলে ‘নিষিদ্ধ পল্লী’। ও পথে গমনরতর দিকে বাঁকা চোখে তাকায় তাবৎ গ্যালাক্সি।

দু-চার আনার বিনিময়ে কিঙ্কর গড়তে শুরু করলেন সেই নিষিদ্ধ পল্লীর রমণীদের মূর্তি। এতেই হলো তাঁর ভাস্কর্যের সহজপাঠ।

পরবর্তীতে হাত পাকিয়েছিলেন স্বদেশি মেলায় তেল রঙে জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার এঁকে। হয়ে উঠছিলেন পুরোদস্তুর শিল্পী।


রামকিঙ্কর ১

রামকিঙ্কর বেইজ | ছবি : সংগৃহীত


০৩.
১৯২৫ সাল৷ বাঁকুড়ার যোগীপাড়ায় এক স্কুলে পড়েন কিঙ্কর। এসময় পরিচয় হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে৷ তাঁর হাত ধরে বাল্যস্মৃতি ছেড়ে মেট্রিক না দিয়েই কিঙ্কর চলে এলেন শান্তিনিকেতন।

শান্তিনিকেতনে মাস্টারমশাই নন্দলালকে দেখালেন তাঁর কাজের নমুনা। প্রথম দিনেই কিঙ্করের কাজ দেখে নন্দলাল বললেন,

‘তুমি সবই জানো, আবার এখানে কেন?’

একটু ভেবে তারপর বলেন, ‘আচ্ছা, দু-তিন বছর থাকো তো।’

মাস্টারমশাইয়ের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন কিঙ্কর। একটু নাখোশও ছিলেন। শ্রদ্ধা রেখেই বলেছিলেন, ‘মাস্টারমশাই শ্রদ্ধেয় নন্দবাবু ছিলেন ভীষণ গোঁড়া। তিনি ছিলেন জ্যান্ত মডেল ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। বলতেন ও-সব পশ্চিমে চলে। কিন্তু আমি তার উপদেশ মেনে চলিনি। মডেল ব্যবহার করেছি।’

প্রথমে আপত্তি করলেও পরে নন্দলাল মেনে নেন ছাত্রের যুক্তি।

রং-তুলি-কাঁকড়ে কাজ শিখতে শিখতে একদিন কলাভবনের পাঠ শেষ হল। স্বাধীনচেতা কিঙ্কর শুরু করলেন স্বাধীনভাবে শিল্পের সাধনা। স্বপ্ন থেকে আসা সে সব সৃষ্টির উল্লাসে, মিশিয়ে দিলেন নিজের গোপন-গহন উল্লাস!

মাস্টারমশাইয়ের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন কিঙ্কর। একটু নাখোশও ছিলেন। শ্রদ্ধা রেখেই বলেছিলেন, ‘মাস্টারমশাই শ্রদ্ধেয় নন্দবাবু ছিলেন ভীষণ গোঁড়া। তিনি ছিলেন জ্যান্ত মডেল ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। বলতেন ও-সব পশ্চিমে চলে। কিন্তু আমি তার উপদেশ মেনে চলিনি। মডেল ব্যবহার করেছি।’

এক নাগাড়ে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী শান্তিনিকেতনে থেকে গেলেন কিঙ্কর। জীবনের অন্তিমকালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সেই দু-তিন বছর আমার এখনও শেষ হল না!’


ramkinkar-baij 2

ঋত্বিক ঘটক এবং রামকিঙ্কর বেইজ। ১৯৭৫ সাল। | ছবি : সংগৃহীত


০৪.
গ্রীষ্মের ছুটি চলছে শান্তিনিকেতনে৷ প্রায় ফাঁকা হওয়া শান্তিনিকেতনে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন রামকিঙ্কর। বাড়ি যাননি। দিনমান ঘুরে বেড়াচ্ছেন রং-তুলি-ক্যানভাস নিয়ে।

স্পর্শের নির্মাণে কেটে যাচ্ছে মহার্ঘ্য সব রাত। নির্মাণে নিমগ্ন থাকা ব্যক্তি কিঙ্করকে নিয়ে গুজবে সয়লাব শান্তিনিকেতন। এক কাঁক ডাকা ভোরে এই ‘অন্যরকম বাসিন্দার’ খোঁজে এলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

কিঙ্কর ভড়কে গেলেন। ভাবলেন, এবার বুঝি তাঁকে চলে যেতে হবে শান্তিনিকেতন ছেড়ে!

প্রচুর স্বপ্ন দেখতেন কিঙ্কর। সেই স্বপ্নকে দিতেন বাস্তব রূপ। তৈরি হতো ভাস্কর্য, একেকটা মাস্টারপিস। কবির ডাক পেয়ে তাঁর ভেতরে গুঞ্জন তোলে মাস্টারমশাই নন্দলালের কথা।

নন্দলাল সবসময় তাঁর স্বপ্নকে মনে রাখতে, আগলে রাখতে বলতেন। স্বপ্ন ভেঙে গেলে প্রয়োজনে লিখে রাখতে বলতেন। মোদ্দা কথা ভুলে যাওয়া চলবে না। স্বপ্নে ছবিরা আসে, আসে প্রতিমা। স্বপ্নকে আঁকতে বলতেন।

রামকিঙ্করের যে মূর্তি নিয়ে শান্তিনিকেতনে তুলকালাম, সেটি দেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ।

‘কার মূর্তি গড়েছ কিঙ্কর?’

‘আমি ওটাকে জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি নে। স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ওই মূর্তি আমার কাছে এসেছিল।’

‘সেই মূর্তির মধ্যে কি কোনও প্রাণী আছে?’

‘আছে। অথচ যেন নেই!’

মুখ না ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছিলেন ওঁর সঙ্গে। ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যেন একটি মেয়ের মূর্তি দেখেছি, মুখ নামানো।’

কিঙ্কর মিতস্বরে বললেন, ‘হয়তো সে কাউকে চুমো খেতেই মুখ নামিয়েছে।’

রবিঠাকুরের সামনে চুমু খাওয়ার কথাটা বলে ফেলে খুব অস্বস্তি হল কিঙ্করের। গলা শুকিয়ে কাঠ।

রবীন্দ্রনাথ হয়তো বুঝতে পারেন কিঙ্করের অবস্থা। ফিরে তাকান অন্যমনস্ক ভাস্করের দিকে। বলেন, ‘একটি পাখি কি উড়ে যেতে চায় আকাশে? পাখা তার যেন সেইরকম তুলে দিয়েছে।’

কিঙ্কর মিতস্বরে বললেন, ‘হয়তো সে কাউকে চুমো খেতেই মুখ নামিয়েছে।’

রবিঠাকুরের সামনে চুমু খাওয়ার কথাটা বলে ফেলে খুব অস্বস্তি হল কিঙ্করের। গলা শুকিয়ে কাঠ।

রবীন্দ্রনাথ হয়তো বুঝতে পারেন কিঙ্করের অবস্থা। ফিরে তাকান অন্যমনস্ক ভাস্করের দিকে। বলেন, ‘একটি পাখি কি উড়ে যেতে চায় আকাশে? পাখা তার যেন সেইরকম তুলে দিয়েছে।’

চোখ ভিজে আসে কিঙ্করের। বলেন, ‘একটি মেয়ে পাখি হয়তো তার বুকের নিচেই আছে.. ‘

দুই শিল্পীর কথায় কথায় শেষ হয়ে যায় দিন। শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যা নামে। কেউ একজন গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান— ‘এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়’।

কথা শেষ করার আগে রবীন্দ্রনাথ কিঙ্করকে বললেন, ‘শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি— সামনে।’

এরপর সমস্ত জীবন তিনি পেছনে তাকান নি আর— এগিয়েছেন হাওয়ার উজানে।


রামকিঙ্কর বেইজ ৩

সাঁওতাল পরিবার | ছবি : ন্যাশনাল গ্যালারি অব মর্ডান আর্ট, দিল্লি


০৫.
কিঙ্করের ছিল ঘরে-বাইরে ‘জীবন্ত মানুষের নেশা’। নিজের নেশার কথা অকপটে স্বীকার করেন তিনি—

‘জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।…আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।’

কিঙ্কর বিশ্বাস করতেন, সব কিছুর মধ্যে যৌনতা আছে, যৌনতা ছাড়া সব কিছুই প্রাণহীন, ঊষর! এসব নিয়ে রিউমার ছড়িয়েছে বেশ।

হঠাৎ করে শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছাল ঠিকানাবিহীন এক টেলিগ্রাম। তাতে কিঙ্কর জানালেন, ‘I lost myself, search myself.’ পরে জানা গেল এক অচেনা রমণীর যৌবনের দুর্মর আহ্বানের কাছে নতজানু হয়ে নেমে গিয়েছিলেন অজানা স্টেশনে। হারিয়ে গিয়েছিলেন যেন!

রামকিঙ্কর ভুলতে পারতেন না তাঁর মডেলদেরও। বিনোদ, নীলিমা, জয়া, খাঁদু, রাধি— সকলকে মনে আছে তাঁর। জিজ্ঞেস করলে একে একে বলে দিতেন সকলের বৈশিষ্ট্য।


Nilima Barua

রামকিঙ্করের ভাস্কর্যে নীলিমা বড়ুয়া | ছবি : ন্যাশনাল গ্যালারি অব মর্ডান আর্ট, দিল্লি


মডেল বিনোদকে নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো একবার। কাজের মাধ্যমে বিনোদ তাঁর অতি পছন্দের ছাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। কাজে-অকাজে মাঝেমধ্যেই রামকিঙ্করের কোয়ার্টারে যেতেন বিনোদিনী। নিজের ঘরের মোড়ায় ছাত্রীকে বসিয়ে একটার পর একটা স্কেচ করতেন রামকিঙ্কর। বিনোদিনীর মুখটি রামকিঙ্করের মনে এমনভাবে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল যে, যখন খুশি মন থেকেই তিনি এঁকে ফেলতে পারতেন বিনোদিনীর পোর্ট্রেট।

বিনোদ সম্পর্কে কিঙ্কর একে একে বলে গেলেন। কিরকম ছিল তাঁর শরীর, এঁকেছিলেন কীভাবে। বিনোদ মণিপুরী মেয়ে। মনে আছে, একটা নাটকও লিখেছিলেন কিঙ্করকে নিয়ে।

শেষ হয়ে আসছিল বিনোদিনীর কলাভবনে পাঠের সময়। ফিরে যেতে হবে নিজের রাজ্যে। কিন্তু সেখানে কি তিনি একা ফিরবেন? কিঙ্করদাকে বিনোদিনী বললেন, ‘চলুন আমার সঙ্গে, মণিপুরে থাকবেন।’ কিন্তু তাঁর শিল্পীমন যে কোনো বাঁধনে বাঁধা পড়তে চায়নি। বলেছিলেন, ‘আসল কথাটি হচ্ছে আমি কোন বন্ধনে বাঁধা পড়তে রাজি নই। ওতে কাজের ক্ষতি হয়। আমি নানা তালে ঘুরতে রাজি নই। আমার লক্ষ্য একটাই— সেটা আর্টওয়ার্ক।’

জিজ্ঞেস করা হয়েছিল অসমের মেয়ে নীলিমার কথা।

কিঙ্করের মনে পড়ে, এক অদ্ভুত নৃত্যের ভঙ্গি ছিল খাঁদুর শরীরজুড়ে। একলা দুপুরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো দরজার চৌকাঠে। ছোট্ট একটা ছেলে ছিল, ও দুধ পান করতো মায়ের বুকের। খাঁদুর মোহনীয় শরীরে সাঁতার কেটে অজস্র স্কেচ করেছিলেন কিঙ্কর। মনে পড়ে।

নীলিমা বড়ুয়ার বেশকিছু পোর্ট্রেট করেছিলেন কিঙ্কর। আঁকতে আঁকতে তাদের শরীর থেকে শরীরে রং লেগেছে অসংখ্যবার। টাকার অভাবে ভালো রং ব্যাবহার করতে পারেননি৷ ছবিগুলো হারিয়ে গেছে সব!

মনে আছে এসথার জয়ন্তী জয়াপ্পাআস্বামীর কথা?

কিঙ্কর বলে চলেন— ‘মনে থাকবে না কেন? সে তো দক্ষিণী ছাত্রী জয়া। খুব ছিপছিপে ছিল। জয়া নামটা আমারই দেওয়া। সুজাতা করেছিলাম ওকে মডেল করে।’

ভুবনডাঙার খাঁদু?

কিঙ্করের মনে পড়ে, এক অদ্ভুত নৃত্যের ভঙ্গি ছিল খাঁদুর শরীরজুড়ে। একলা দুপুরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো দরজার চৌকাঠে। ছোট্ট একটা ছেলে ছিল, ও দুধ পান করতো মায়ের বুকের। খাঁদুর মোহনীয় শরীরে সাঁতার কেটে অজস্র স্কেচ করেছিলেন কিঙ্কর। মনে পড়ে।

আর রাধি?


রামকিঙ্কর বেইজ ৪

(বাম থেকে) এক আত্মীয়া, রামকিঙ্কর এবং রাধারাণীদেবী | ছবি : জয়তী ভট্ট, এশিয়ান আর্ট আর্কাইভ


রাধির কথা উঠতেই খানিক উদাস হয়ে যান কিঙ্কর। এই দুজনের মেলামেশা নিয়ে ব্যাপক আপত্তি ছিল সকলের৷ এমনকি ডেকে পাঠিয়েছিল বিশ্বভারতীর হর্তাকর্তারাও। এসবের পরও দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে বেচেছেন। কেউ কোনোদিন ছেড়ে যাননি কাউকে। কিঙ্করের ভাষায়— ‘আসলে রাধারানীর সঙ্গে আমার জড়ামড়ি সম্পর্ক!’

থিতু হয়েছিলেন রাধির সাথেই। ওর সাথেই কাটিয়ে দিলেন বাকী জীবন।

 

০৬.
শান্তিনিকেতনের এক বাসন্তিক বিকেল। বন্ধু সমীর সেনগুপ্তকে সাথে নিয়ে ঢুঁ মারতে এসেছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ঠিক ঢুঁ মারতে নয়। উদ্দেশ্যে কিঙ্করদা’র সাথে আড্ডা দেওয়া। অনিবার্যভাবে ওঁদের রিকশা থেমেছিল বাংলা মদের দোকান ‘আকর্ষণী’-তে। দু’বোতল বাংলা সমেত দুইজন পৌছে গেলো গন্তব্যে, রতনপল্লিতে।

ছাত্র শঙ্খ চৌধুরীর ছেড়ে দেওয়া রতনপল্লির মাটির বাড়িতে তখন উলঢাল রামকিঙ্করের ঘর-দুয়ার। স্রেফ কুঁড়েঘরের মতো একটা ঘর। ‘কিঙ্করদা, ও কিঙ্করদা…’ শক্তির ডাকে মুখে সেই চিরচেনা হাসি ঝুলিয়ে বের হলেন কিঙ্কর। লুঙ্গি ঠিক করছেন দুই হাতে।

‘আরে কবি এসেচিস— আয়, আয়, কিছু এনেচিস তো হাতে করে?…’

এরপর যা হওয়ার তাই হলো। রাতভর চললো অফুরন্ত মদ-বিড়ি-কথা, রবীন্দ্রনাথের গান। খাওয়া শেষে খালি হওয়া পাত্রকে ওদের মনে হতে থাকলো শুয়োরপোড়া, শূন্য বোতলকে মনে হলো বেচে যাওয়া পৃথিবী-সমান-বয়সী মদ।

রাত কতো আন্দাজ নেই। ঘুম ভেঙে গেলো সমীরের। ঘরজুড়ে বিশ্বাসের মতো অন্ধকার। কোনোমতে চৌকাঠ পেরোলেন সমীর। রামকিঙ্কর বসে আছেন একটা টুলের উপর। উপর থেকে আনমনে একটা অমনোযোগী লণ্ঠন ঝুলছে। লুঙ্গিটা কোমর থেকে কখন যে খুলে পড়েছে কিঙ্করের, সে খেয়াল নেই! সম্পূর্ণ নগ্ন তিনি।

আর তাঁর সামনে একটা অসমাপ্ত মাটির ভাস্কর্য। সেদিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছেন অপলক।

 

০৭.
১৯৭৫ সাল। শান্তিনিকেতনে ক্যামেরা সমেত ছুটে আসলেন স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক। অসুস্থ শরীরেই এসেছেন কিঙ্করদা’কে নিয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাবেন বলে। এসে দেখলেন পরনে আদি কাপড়ের কুর্তা। কুর্তার প্রান্তগুলো বেরিয়ে আছে, সাদা কোঁকড়া চুলের উপর ঠাঁই নিয়েছে কৃষকদের টুপি, আঙুলগুলো কার্টিজ পেপারের উপর চড়ে বেড়ানোর অপেক্ষায় যেন সর্বদা প্রস্তুত সেগুলো!

টানা চারদিন রামকিঙ্কর বেইজের পিছে ক্যামেরা হাতে ছুটেছিলেন ঋত্বিক; এতটাই মুগ্ধ ছিলেন তাঁর কাজে।

প্রথমে বুদ্ধের মুখ। মাদল আর বাঁশির আবহে কোপাই নদীর ধারে আদিবাসী গ্রাম, অনম্র বুক, সুঠাম আর ভারী কোমরের সাঁওতাল মেয়ে, ফ্রেমের পর ফ্রেমজুড়ে ঋত্বিক এঁকে চলেছেন আদুল ক্যানভাস। একটি ফ্রেমে ধরা দিলেন দুই শিল্পী। শুরু হয় তাঁদের কথোপকথন।

অসুস্থ শরীর নিয়ে শ্যুট করছিলেন ঋত্বিক। প্রতি ফ্রেমে ভেঙেচুরে দেখাচ্ছিলেন রামকিঙ্কর বেইজকে। প্রিয় কিঙ্করদা’কে৷

প্রথমে বুদ্ধের মুখ। মাদল আর বাঁশির আবহে কোপাই নদীর ধারে আদিবাসী গ্রাম, অনম্র বুক, সুঠাম আর ভারী কোমরের সাঁওতাল মেয়ে, ফ্রেমের পর ফ্রেমজুড়ে ঋত্বিক এঁকে চলেছেন আদুল ক্যানভাস। একটি ফ্রেমে ধরা দিলেন দুই শিল্পী। শুরু হয় তাঁদের কথোপকথন।

রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট করছিলেন কিঙ্কর। সেসময়কার অভিজ্ঞতা জানতে চাইছিলেন ঋত্বিক।


রামকিঙ্কর ৫

রামকিঙ্করের গড়া রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য ‘দ্য পোয়েট’ | ছবি : দিল্লি আর্ট গ্যালারি


রামকিঙ্কর স্মৃতিতাড়িত হয়ে একচোট হাসলেন। তারপর বলেন, বলে চলেন। সেসময়ে বলা একটা কথা একেবারে মাথায় গেঁথে গিয়েছিল কিঙ্করের। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— ‘দেখো, যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না। এই হল শেষ কথা।’

ঋত্বিক যখন শ্যুট করতে যান, তখন কিঙ্করের আবাসস্থলের অবস্থা খুবই করুণ। চাল ভেঙে পড়ছে, বৃষ্টিতে পড়ছে জল৷ এর কারণ জানতে চাইলেন ঋত্বিক।

জানালেন, পেনশনের অল্পকিছু টাকা পান। সেটা দিয়েই চেষ্টা করছেন। আপাতত বড় বড় ক্যানভাস উলটে রেখেছেন চালে। বলেন, ‘অয়েল কালার কিনা। উপরে কোনও ক্ষতি হবে না। বৃষ্টি পড়ে কিনা, তাই ওগুলো ঝুলিয়ে দিই।’

বলে দেন নিজের অভাবের কথা। তিনি নিজেও যে বাড়ির মতোই করুণ হয়ে আছেন, তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। বুড়ো হয়ে যাওয়ায় কোনো কাজও পাচ্ছিলেন না তিনি। আঁকার অনুপ্রেরণাও পান না৷ চোখে দেখতে, পড়তে কষ্ট বেগ পেতে হয় খুব। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন৷ কষ্ট হয় স্বাভাবিক চলাফেরাতেও৷ বলেন বলে চলেন, ‘মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হয়। পাগল পাগল লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। একেবারে বাতিল হয়ে গেছি। চোখ চলছে না, হাত চলছে না, চোখ অন্ধ। মনে মনে আঁকছি।’

ছবি এগোয়, কিন্তু শেষ হয় না। দৃশ্য ফুরিয়ে যায়। একসময় প্রায় পুরো ছবির শ্যুটিং শেষ হয়ে যায়। প্রাথমিক সম্পাদনার পর ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডট্র্যাকের কাজ শুরু হবে অচিরেই। এর আগেই ঝরে গেলেন ঋত্বিক। চিরতরে ঝরে গেলেন। শারিরীকভাবে মরে গেলেন৷ অসমাপ্ত তথ্যচিত্রের স্ক্রিনজুড়ে একসময় নেমে আসে দুই শিল্পীর মুখোমুখি অন্ধকার।

ছবি শেষ হয় না।

 

০৮.
ভয়াবহ অসুখ করেছে কিঙ্করের। চিকিৎসার জন্য কলকাতা যেতে হবে। যেতে রাজি নয়৷ এখানেই পড়ে থাকবেন৷ যেমনটা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ-ও।

সর্বক্ষণের সঙ্গিনী, মডেল রাধারানি— যাঁর সঙ্গে কিঙ্করের দীর্ঘ জীবনের সম্পর্ক, তিনিও জানিয়েছিলেন, ‘উনি যেতে চাননি, ওঁর ভাইপো দিবাকর সই করে দিল। জোর করে ওরা নিয়ে গেল।’

ডাক্তারের জোড়াজুড়িতে শেষপর্যন্ত যেতে হলো কলকাতায়।

দিবাকরবাবু বলেছিলেন ‘ওঁরা আমার সই চাইছেন। একটা লিখিত অনুমতি চাইছেন। কিন্তু আমার দেবার ইচ্ছে নাই। কিন্তু ডাক্তারবাবুদের কথায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে “সই” দিতে হল।’

সবকিছু ঠিকঠাক। কিঙ্করকে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়৷ যাওয়ার দিন স্বজনদের ডেকে জড়ানো গলায় বললেন— ‘যাচ্ছি শান্তিনিকেতন ছেড়ে। যাচ্ছি— কিন্তু আর ফিরব না। রবীন্দ্রনাথও ফেরেননি।’

সত্য হয়েছিল তাঁর কথা। রবীন্দ্রনাথের মতো সে-ও ফেরেননি আর।

মৃত্যুর দু’দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন প্রিয় সত্যজিৎ। সত্যজিৎ রায়। ছাত্রের হাত ধরে কিঙ্কর আকুতি করে বলেছিলেন, ‘মানিক, একটা রিকশা ডেকে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও

মৃত্যুর দু’দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন প্রিয় সত্যজিৎ। সত্যজিৎ রায়। ছাত্রের হাত ধরে কিঙ্কর আকুতি করে বলেছিলেন, ‘মানিক, একটা রিকশা ডেকে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও!’

সে ফেরা আর হলো না কিঙ্করের। এক ঝিরিঝিরি বৃষ্টির রাতে নিভে গিয়েছিলেন তিনি।

শেষ দাহ সেরে ফেলা হলো।

অনেক ভেতরে থেকে গেলেও চলে গেলেন রামকিঙ্কর বেইজ। প্রিয় কিঙ্করদা!


তথ্যসূত্র:

ভুবনডাঙার কিঙ্কর: আনন্দবাজার
Ramkinkar Baij: কাজের ক্ষতি করে আমি বন্ধনে
বাঁধা পড়তে নারাজ: শ্রীপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়
রামকিঙ্কর বেইজ: আবদুল্লাহ আল মোহন
রামকিঙ্কর বেইজ: ভারতবর্ষের শিল্পে আধুনিক ধারার পথিকৃৎ: ওয়াহেদুর রহমান ওয়াহেদ
উইকিপিডিয়া

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া গ্রামে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে। লেখালেখি করেন; পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।