নাতালি বার বার চোখ মোছে। হাতের গোলাপের ওপর দু-এক ফোটা গড়িয়ে পড়ছে চোখের পানি। সেদিন চিঠি পাবার পর পরই অশান্ত হয়ে গেছে হৃদয়। খুব অসুস্থ ওয়ালি মানসুর। ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। নাতালিকে একটু দেখতে চায়। কোলের ওপরে ভাঁজ করে রাখা চিঠিটা আবারো খুলে নাতালি। কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা দুটি লাইন— ‘কতোদিন দেখিনি আমার কালো গোলাপকে। তবুও ভুলিনি মন উদাসী ঘ্রাণ। রেতবার ডাকে, আসবে কি একবার…’ মারিয়ামকে বসতে বলার কথা ভুলেই গিয়েছিল নাতালি। ওর হাত থেকে চিঠিটা নিয়েই কাঁদতে শুরু করেছিল ছোটো মানুষের মতো।
জানিস নাতালি, মানসুর তোকে ভুলতেই পারেনি। ষোল বছর পার হয়ে গেল। না করল প্রেম, না বাঁধল সংসার। সেই একই রকম রয়ে গেল। দিনে মাছ ধরে আর শেষ বিকেলের আলোয় বসে থাকে রেতবার তীরে।
মারিয়াম নাতালির ছোটোবেলার বন্ধু। ওরা ডাকারে পাশাপাশি বাসায় থাকত। একসাথে স্কুলে পড়ত। দিনের বেশিরভাগ সময়ই নাতালি মারিয়ামের সাথে খেলাধুলা আর গল্প হাসিতে সময় কাটাত। ওরা যখন কলেজে পড়ে তখন গলির শেষ মাথায় একতলা বাড়িটাতে লম্বা চওড়া একটা লোক ভাড়া থাকতে এসেছিল। সাথে তার ছেলে। ছেলেটার বড়ো বড়ো চোখগুলোতে ছিল সাগরসম সরলতা। নাতালিরা গলির মোড়টা পেরিয়ে মেইন রোডে উঠত। ওই বাসাটা পেরোনোর সময় একটু ধীরে হাঁটত নাতালি। শুনতে পেত বাবা টুংটাং আওয়াজ করে সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন। আর কোণে দাঁড়িয়ে কখনো পোষা কুকুর জেলোবের সাথে খেলছে ছেলেটা, না হলে মোড়ায় বসে মাছের ঝাকা বানাচ্ছে কিংবা দিয়াখাতো (সেনেগালের বেগুন) সবজির মাচা পরিচর্যা করছে।
ওরা যখন কলেজে পড়ে তখন গলির শেষ মাথায় একতলা বাড়িটাতে লম্বা চওড়া একটা লোক ভাড়া থাকতে এসেছিল। সাথে তার ছেলে। ছেলেটার বড়ো বড়ো চোখগুলোতে ছিল সাগরসম সরলতা। নাতালিরা গলির মোড়টা পেরিয়ে মেইন রোডে উঠত। ওই বাসাটা পেরোনোর সময় একটু ধীরে হাঁটত নাতালি। শুনতে পেত বাবা টুংটাং আওয়াজ করে সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন।
ও কি পড়াশোনা করে না? তা হলে করে কী? এমন একটা প্রশ্ন মাথায় আওড়াতে আওড়াতে চলে যেত নাতালি। তবে ওরা যাওয়ার সময় নাতালির দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত ছেলেটা। সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি নামল। গলির মাথায় শুরু হলো ঝুমঝুমিয়ে। নাতালি নিরুপায় হয়ে সেই একতলা বাসায় আশ্রয় নিল। মায়াবী চোখের ছেলেটা ওকে দেখে অবাক হলো।
একটু বসি? বাইরে ঝড়।
নাতালির মিনতিতে মৃদু হাসল ছেলেটা। হাতের চেরি টমেটোর ঝুড়িটা রেখে ভেতরে গেল। দুই কামরার ছোট্ট বাসা। একটা খাট, একটা কাঠের আলমারি চেয়ার-টেবিল আর সিলিং এর সাথে ঝোলানো একটা দোলনা, ব্যস, আর কিছুই নেই। টেবিলের ওপর বই-খাতা। নাতালি উঠে গিয়ে বইগুলো দেখল। জুয়োলজির দ্বিতীয় বর্ষের বই। খাতার উপর লেখা— ওয়ালি মানসুর। বুঝল এটাই ছেলেটার নাম। খাতার একটা শুভ্র পাতায় দ্রুত লিখল— `তোমার চোখ দুটো খুব ঘন, খুব গভীর। মায়ায় ভাসি আমি— নাতালি নাদেই।’
ছেলেটা তখন একটা মাটির কাপে কফি নিয়ে এলো। নাও, শীতল আবহাওয়ায় ভালো লাগবে। কফিতে চুমুক দিয়ে মনটাই ভালো হয়ে গেল নাতালির। চমৎকার ঘ্রাণ। ছেলেটা দরজার পাটাতনে বসল।
তুমি পড়ো না?
হুম, পড়ি তো। গভীর রাতে পড়ি।
তাহলে ভার্সিটিতে যাও না যে।
হুম যাই তো। তবে রেগুলার না। বাবার সাথে সময় কাটাতেই বেশি ভালো লাগে। মাছেরা কবিতা বোনে জলের বুকে। সেই কবিতা পড়ি। ঢেউয়ের প্রতিটা বাঁক যেন একেকটা গল্প। হলকা বাতাস চুল আঁচড়ে দেয়; ভালো লাগে।
কৃষ্ণকায় ছেলেটার মুখে স্বচ্ছ প্রকৃতির গান শুনে অবাক হয়ে যায় নাতালি। অন্যরকম ভালো লাগা জাগতে শুরু করে মনে।
তোমার মা কোথায়?
নেই। আমি তাকে দেখিনি। ছোটোবেলায় আকাশের তারা হয়ে গেছে। তাই তো আমি গভীর রাতে পড়ি। তারাগুলো আকাশের বুক থেকে যখন নিচে নেমে আসে তখন। আমার মনে হয়, মায়ের কোলে বসে পড়ছি।
বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। কাপটা টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে আসে নাতালি। পনেরো কী মিনিট বিশের সময়টুকুকে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল।
আচ্ছা এখন আসি।
হুম। বৃষ্টিকে কৃতজ্ঞতা।
শুভ্র হাসল নাতালি।
বিদায় মানসুর।
আরে কী হলো ভাই! অনেক জোরে ব্রেক কষল বাসটা। রাস্তার পাশে বেশ বড়ো একটা খন্দ। বাসের একটা চাকা একটু দেবে গিয়েছিল নরম মাটিতে। ড্রাইভার শক্ত হাতে ব্রেক করাতে কয়েকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের সিটে। কাফ্রিনের রাস্তার অবস্থা বেহাল। বিভিন্ন জায়গায় ভাঙাচোরা। গতি হারিয়ে কতো দুর্ঘটনা যে ঘটে। কাফ্রিন থেকে ডাকারের দুরত্ব ২৮৫.৮ কি.মি., প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার রাস্তা। মারিয়ামের মুখে মানসুরের অসুস্থতার কথা শুনে থাকতে পারেনি নাতালি। পরের দিনই রওয়ানা দিয়েছে। প্রিয় শহর রাজধানী ডাকারেই বড়ো হয়েছে নাতালি। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীর সাথে কাফ্রিনে চলে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী নাতালির পড়াশোনার জীবনটাও অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। হাতের সাদা গোলাপের তোড়াটা বুকের সাথে আকড়ে রাখে সে। মানসুর—একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে।
পরের দিনই রওয়ানা দিয়েছে। প্রিয় শহর রাজধানী ডাকারেই বড়ো হয়েছে নাতালি। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীর সাথে কাফ্রিনে চলে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী নাতালির পড়াশোনার জীবনটাও অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। হাতের সাদা গোলাপের তোড়াটা বুকের সাথে আকড়ে রাখে সে।
নাতালির বাবা হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেয়েকে তড়িঘড়ি করে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করে মোহাম্মদ জুমার সাথে। জুমা একজন ব্যবসায়ী। কাফ্রিনে নিজেদের ভালো অবস্থান। বাবাকে বলে নাতালি। বলে মানসুরকে ভালো লাগে তার।
কিহ্, মাছওয়ালাকে ভালো লাগে তোমার! কী আছে ওর গায়ে কেবল মাছের দুর্গন্ধ ছাড়া!
জুমা ভালো রাখবে তোমাকে। এ আমার আদেশ। পরদিনই বিয়ে হয়ে যায় নাতালির। সাজানো গাড়ির বহর নববধূকে নিয়ে চলে যায় কাফ্রিনে। সেদিন রেতবার পানি গোলাপি না হয়ে টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়। কেননা, সেদিন সারারাত রেতবার তীরে ভায়োলিন বাজিয়েছিল মানসুর।
আজ এতো বছর পর প্রিয় মানুষ মানসুরকে দেখবে। শিহরিত হয় নাতালি। মনে মনে। বাবা বেঁচে নেই। বেঁচে নেই জুমাও। ব্যাবসায় লোকসানের পর হার্ট অ্যাটাকের মৃত্যু হয় বছর দুয়েক আগেই। অসুস্থ মানসুরকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। ওরা আবারো হাত ধরে হাঁটবে রেতবার তীরে। রেতবার গোলাপি জলে ভিজে ভিজে যাবে দুই জোড়া পা।
বাস শাঁ শাঁ ছুটছে ডাকারের পথে। উঁচু নিচু পথ অতিক্রম করে। হঠাৎ করেই একদিকে একটু হেলে পড়ে চলন্ত বাস। চাকা ছিদ্র হয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বাসটা। বাসের ভেতর বসে থাকা মানুষগুলো হাহাকার করে ওঠে। কেঁপে ওঠে নাতালির সামনের রেতবা গোলাপি টলটলে জল। তার মনে হতে থাকে লেকের মাছগুলো তাকে কবিতা শোনাচ্ছে আর দূর থেকে ভেসে আসছে ভায়োলিনের করুণ সুর। মানসুর— তোমাকে বোধহয় দেখব না আর। টলোমলো চোখে চিঠি জড়িয়ে ধরে নাতালি। ড্রাইভার প্রাণপণে চেষ্টা করে রাস্তার পাশে থামাতে; কিন্তু বাসটা যেন বেপরোয়া। সামনে থেকে ছুটে আসা আরেকটা বাসে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়ে বসে। মুহূর্তের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে যায় বাস দুটো। জানালার কাচ ভেঙে রাস্তায় ছিটকে পরেছে নিহত নাতালির কাটা হাতটা। হাতে তখনও শক্ত করে মুঠেবদ্ধ ছিল সাদা গোলাপগুলো, রক্তমাখা…
গল্পকার ও সম্পাদক।