শনিবার, জুলাই ২৭

শববাহকের ছেলেবেলা : তৃতীয় পর্ব

0

Rana Roychowdhury_Pro Picতোমার অল্প উপস্থিতি
রাণা রায়চৌধুরী


০১.
এখন লাঙ্গল দিয়ে বলদ দিয়ে জমি চাষ করার দিন শেষ। ৭০ ৭১ ৭২ সালের সূর্য সবে পূব দিকে উঠেছে। তার অল্প উপস্থিতি গ্রামের রাস্তায় এসে পড়ছে। সেই অল্প সূর্যের আলো মেখে কোনো চাষী লাঙ্গল বলদ নিয়ে পিচের রাস্তা ছেড়ে কাদা বর্ষার জমিতে নামবো নামবো করছে। মুখে বিড়ি, চারিদিকে বাংলাদেশ; জড়ানো ছড়ানো এলানো মায়ায় মাখামাখি। আমি বই খুলে বসেছি পড়তে (বাধ্যতামূলক, নিয়মানুযায়ী, মা পেটাবে)। বইতে জলধর সেন-এর কাজী নজরুলের লেখা এলিয়ে আছে, পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছে, আমি আবার সেই পৃষ্ঠায় ফিরে যাচ্ছি— আনমনে আবার দেখছি লাঙ্গল বলদ নিয়ে মানুষটা জমিতে নামবো নামবো করছে—চারিদিকে বাংলাদেশ; জড়ানো ছড়ানো এলানো—চারিদিকে মা মেয়ে কন্যা, আশ্রয়, গান, সূর্যের ওঠানামা, পাখির ডানায় সূর্য অল্প এসে বসেছে, আমার পড়ায় মন নেই, আমার মন অন্য চড়াইয়ের মতো, ছোটো টিয়ার মতো সবুজ হয়ে উড়ছে ঘুরছে। লাঙ্গল বলদ নিয়ে চাষীমানুষ জমিতে নামবো নামবো করছে— আমার গার্জিয়ান পড়াশোনা করছি না বলে আমাকে বকাবকির স্নিগ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে— লাঙ্গল বলদ হাল চোষতে জমিতে মিলিয়ে গেল…

 

 

০২.
এই পাঁচ দিনের কবিতা পড়ার ডাকটা আমি খুব এনজয় করছি। এতে কবিতার কোনো ক্ষতি তো হয়ই না, বরং আমার মতো অতি সাধারণ পাঠক খুব উপকৃত হচ্ছি। শেখার কি শেষ আছে ভাই! অসম্ভব সব ভালো কবিতা পড়ার সুযোগ হচ্ছে।

আজ তো কিছু (ফাটাফাটি) সাঙ্ঘাতিক ভালো কবিতা পড়লাম।

পূর্বা মুখোপাধ্যায়, বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়, বাপন চক্রবর্তী, শমীক সেন, বিজয় সিংহ, শান্তনু চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় (যে কটি চোখে পড়ল আর কী, সময় সুযোগে, আরও অনেকেই আছেন, হয়তো খেয়াল করিনি)।

ফেসবুক মাঝে মাঝে যেমন ভয়াবহ মনখারাপের, যন্ত্রণার, তেমন আনন্দেরও।

প্রচুর ভালো কবিতা গল্প পড়ার সুযোগ পাই আমি। যেমন কাল রাতে অলোকপর্ণা-র অসামান্য একটা গল্প পড়লাম। আবার অনেক বইয়ের নামও এখানে দেখেই আমি; জেনেছি ও কিনেছি বা কিনিনি, কিনব কিনব করছি।

সাহিত্যের (বাংলা) জগতে অশিক্ষিতের হার বাড়ছে কি না জানি না, কিন্তু অশিক্ষিতরা অল্প অল্প করে শিক্ষিত হচ্ছে এটুকু মনে হচ্ছে।

কেবল প্রতিভাবানরা, শিক্ষিতরা এবং প্রচুর দমের লোকেরা শুধু কাব্য করবে, সাহিত্য করবে তা হয় না। অল্প লেখাপড়া জানা, অল্প কাব্য-সাহিত্য বোঝা, কম কল্পনা-প্রতিভার লোকজন যদি এই উঠোনে মাঝেমাঝে আসে, পায়চারি করে, একটু ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে তাতে ক্ষতি কী!

কেবল প্রতিভাবানরা, শিক্ষিতরা এবং প্রচুর দমের লোকেরা শুধু কাব্য করবে, সাহিত্য করবে তা হয় না। অল্প লেখাপড়া জানা, অল্প কাব্য-সাহিত্য বোঝা, কম কল্পনা-প্রতিভার লোকজন যদি এই উঠোনে মাঝেমাঝে আসে, পায়চারি করে, একটু ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে তাতে ক্ষতি কী! বরং ভালোর সংখ্যা বাড়বে। এতো গেল গেল রব তুললে হবে না। যে ‘ঐ কম প্রতিভার কবি এসেছে, ঐ কম কল্পনাশক্তির গল্পকার এসেছে!’ যাকে ‘কমা’ মনে হচ্ছে তাকে স্ক্রল করে এড়িয়ে গেলেই তো হলো! তাই না!

আমি অনেক মানুষকে দেখেছি, কবিতা লেখে, কিন্তু তিনি কোনোদিন ‘বিরাট ফিগার’ হবেন না, এই সাহিত্যের ‘সার্কিটে’ আসবেন না, (চেনেনই না এই সার্কিট বা চত্বর কোথায়) কিন্তু তিনি এতো ভালো মানুষ যে তাকে রোজ ফলো করলে ভিতরের অনেক জানলা দরজা খুলে যায়, ভিতরটা একটু একটু করে ওয়াস হয়।

একঘেয়ে এই মাস্ক পরা স্যানিটাইজেশনের জীবন, সেখানে এতো ভালো ভালো কবিতা বা লেখা, আমার ভিতরটাকেও অনেক জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করছে।

জীবনের কোনো জিনিসই খারাপ নয়, ভালোটা আছেই তাতে।

ঈশ্বর মঙ্গলময়। ফেসবুক মঙ্গলময়।

দূরে ধানখেতে কেউ অল্প আলো নিয়ে অল্প জীবন নিয়ে এসেছে খেতের ফসল দেখতে। ঐ ফসল বোনা, শষ্য তৈরিই তার জীবনের শিল্প। কবি যেমন মাঝরাতে উঠে, আবার কবিতার পঙ্‌ক্তি কারেকশন করেন বা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নিজের সৃষ্টির দিকে

 

০৩.
অন্ধকার এক অপূর্ব অপূর্ণ মায়া।

চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, আলো বলতে জোনাকির আলো। ঝিঁঝিঁ পোকার চলাচল।

দূরে ধানখেতে কেউ অল্প আলো নিয়ে অল্প জীবন নিয়ে এসেছে খেতের ফসল দেখতে। ঐ ফসল বোনা, শষ্য তৈরিই তার জীবনের শিল্প। কবি যেমন মাঝরাতে উঠে, আবার কবিতার পঙ্‌ক্তি কারেকশন করেন বা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নিজের সৃষ্টির দিকে— ঠিক সেই রকম, চাষীও এসেছেন অল্প আলো নিয়ে নিজের বিরাট সৃষ্টিকে দেখতে এই চরাচরব্যপী অন্ধকারে।

অন্ধকার আসলে এক রং— যা জীবনকে দৌড়ে বাস ধরতে, দৌড়ে প্রেমিকার কাছে যেতে, দৌড়ে উপাসনার কাছে যেতে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় অন্ধকার। মৃত্যুর পরেও অন্ধকার। মধ্যের এই ঝিঁঝিঁ-র ডাক ও আলোই হলো কোথাও যাওয়ার বা প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার তাগিদ। ঐ তাগিদেই পৃথিবীর এতো আলো, এতো আত্মত্যাগ, এতো সুর।

 

০৪.
শিশুরা, বাচ্চারা এত সুন্দর সেটা প্রথম টের পাই আমাদের বাড়িতে যখন পুচু আর তিতির এলো। আমার এত ভালো লাগত ওদের উপস্থিতি, আমি খুব জোরে সাগর সেন চালাতাম, (তখন উচ্চরবে গান শুনতে ভালো লাগত, অথবা মনের মধ্যে একটা জিনিস কাজ করত যে, পাড়ার লোককেও শোনাতে হবে, ঋতু গুহ রমা মণ্ডল খালি গলায়, এর মধ্যে নিজে কত সংস্কৃতি প্রেমী সেই অহংকারেরও প্রকাশ থাকত হয়তো) পুচু সেই গান শুনে দুলত, মৃদু দুলত। একটু বড়ো হলে বলত ভূমি চালাও, বারান্দায় রোদ্দুর চালাও, সাউন্ড বাড়াও সাউন্ড বাড়াও বলে চিৎকার করত। অথচ ডাক্তার বলেছিল ওর জন্য ফাস্ট মিউজিক নয়, স্লো মিউজিক। আমি হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি নিয়ে এলাম, সন্তুর নিয়ে এলাম, বাড়িতে শিশুদের কারণেই এত বড়ো বড়ো শিল্পীরা এলেন। তখন আমাদের বাড়িতে সবসময় বসন্তকাল।

তখন উচ্চরবে গান শুনতে ভালো লাগত, অথবা মনের মধ্যে একটা জিনিস কাজ করত যে, পাড়ার লোককেও শোনাতে হবে, ঋতু গুহ রমা মণ্ডল খালি গলায়, এর মধ্যে নিজে কত সংস্কৃতি প্রেমী সেই অহংকারেরও প্রকাশ থাকত হয়তো

তিতির দেয়ালময় রবীন্দ্রনাথ লিখছে। ‘তিনটে শালিখ ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে…, কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি…, কিম্বা হ্যাপি বার্থডে মামা, প্লাইউডের দরজায় চক দিয়ে লেখা, আমার সঙ্গে সাইকেলে পলতা স্টেশন, সাইকেলের স্পোকে কচি পা ঢুকে কঁকিয়ে কেঁদে ওঠা, সব মিলিয়ে বেশ সুখের সেসব দিন, কীর্তনাঙ্গের গানের মতো দোল খেত আমাদের জীবন। তারপর ওরা বড়ো হয়ে গেল। সুখের দিন শেষ। জটিলতা শুরু। পুচু মানসিক হোমে, তিতির কলেজে।

 


এখন আবার সেই বসন্তকাল ফিরে এসেছে আমাদের বাড়িতে। অ্যামি এসেছে। অ্যামি, অমৃতা সেনগুপ্ত, আমার শ্যালকের মেয়ে। ফাইভ প্লাস। অ্যামির বাবা-মা উভয়েই অকাল প্রয়াত।

কিন্তু অ্যামির শিশুমন আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। শিশুর সঙ্গে, বাচ্চাদের সঙ্গে থাকলে আমার কবিতা আসে, বাঁচতে এবং বাঁচাতে ইচ্ছে করে। মনে হয় চিৎকার করে বলি, এ-লড়াই বাঁচার লড়াই, এ-লড়াই গানের লড়াই, এ-লড়াই জিততে হবে।

অ্যামির আদোআদো কথা, দুষ্টুমি, বায়না, ভয় দেখানো, লুকিয়ে পড়া এইসব কিছুই এক ঐশ্বরিক আনন্দ, আমাদের বাড়িতে আবার বসন্তকাল, মনের গাছে গাছে কোকিল কোকেইন কোকেইন বলে ডাকছে, আমাদের সব ডালপালা আলোর স্রোতে ভাসছে। অ্যামির মুখভঙ্গি, হাসি, খেতে না চাওয়া, অভিমান, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে আমাদের আনন্দের বালিয়াড়িতে।

 


প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে শিশুদেরই কারণে।

শুভজিৎ বাগচি বলে একটা ফোরের বাচ্চা ছিল, মুখে মুখে বড়ো বড়ো যোগবিয়োগ করে দিত। বাপ মাতাল, মা রুগ্ন। আমি শুভজিতের ভিতর থেকে অনুপ্রেরণা পেতাম। অসাধারণ বুদ্ধি এবং মেধা।

এরকম আরও আছে যেমন নীল গুহ, হেবি ছবি আঁকে। যেমন দেব সরকার, হেবি সুন্দর কাগজের প্লেন ও নৌকো বানায়। এরাই আগামীর রামকিঙ্কর, যামিনী রায়।

শিশুদের জন্যেই পৃথিবীটা সুন্দর।

বাচ্চারা না থাকলে শিল্পীর সব শিল্প ব্যর্থ, কে যেন ঘুমের মধ্যে আমাকে বলল, সেদিন ভোরে।

শিশুশ্রম শিশুশ্রমিক এসব বন্ধ করা যায় না?

 

 

০৫.
ফ্যানটা জানলার বাইরের দিকে ‌মুখ করে চালিয়ে দে। দেখবি ভিতরের গরম হাওয়া, ভিতরের লুকনো ‘যাবতীয় ভিতর’ হাওয়ায় হাওয়ায় বাইরে চলে যাচ্ছে।

তুই এইচ এস-এ ইকোনমিক্স-এ ব্যাক পেয়েছিলি না? —সেই এক-সাবজেক্টে ফেলের কষ্ট— সেই গ্লানি ফ্যানের হাওয়ার সঙ্গে বাইরে চলে যাবে।

অবশ্য আমরা সবাই কিছু গ্লানি কিছু কষ্ট কিছু কিছু পোড়া দাগকে আত্মীয় ভেবে তোশকের নিচে বালিশের ওয়ারের ভিতর লুকিয়ে যত্নে রেখে দিই।

ফলত কিছু ব্যর্থতা অবিবাহিত ছোটোকাকার মতো রয়ে যায় জ্যামিতিবক্সের ভিতর।

ফ্যানের হাওয়ায় ঘরের গরম হাওয়ার সঙ্গে কিছু পুরনো রেডিও-অনুষ্ঠান‌ও বাইরে চলে যায়, ভিতরে আসে ব্লুটুথের একাকিত্ব।

 

 

০৬.
এতো কষ্ট, এতো মনখারাপ কেন নেব? নেব না। যা যা এখান থেকে যাআআআ।

আজ পাগলামি করব।

পাগলামি।

একে চিমটি কাটব। ওর জন্য জিলিপি আনব। ওলো সই তোকে ‌নাগরদোলা চাপাব।

হাওয়া হু হু করে বয়?

আমি তো জানি মনখারাপ ভরা আনন্দ হু হু করে বয়। হাসি হু হু করে বয়।

এই পাগল আরও পাগলকে ডাক।

চল, আজ হাওয়ার বাঁকে বাঁকে হেঁকেডেকে আমরা পাগলামো করি।

চল চিৎকার করি।

দেখবি মা সুস্থ হয়েছেন। দাদা বাড়ি ফিরে এসে আবার রেওয়াজে বসেছেন।

মিনু অক্সিজেন লেবেল বাঁচিয়ে আবার তার প্রেমিকের মিষ্টি হাসিটির কথা ভাবছে।

এই চল চল পাগলামি করি। এই চল চল আজ রাজভবনে গিয়ে ঐ দুষ্টুটাকে একটু গরম শিঙারা দিয়ে আসি। যাতে জিভ পুড়ে যায়।

এই তোর বেগুনি খেতে গিয়ে জিভ পুড়েছিল? ছোটোবেলায়?

আরে ছোটোবেলাতেই তো জিভ পোড়ে। আর বড়োবেলায় পোড়ে মন।

রাজভবনের জিভ পুড়ে গেছে! কী হবে এখন? এখন রাজভবন ইংলিশে দুপাতা চিঠি লিখবে। সে লিখুক। লিখতে লিখতে লেখা শিখবে।

চল চল আজ প্রবল পাগলামি করি। মাতালের মতো গায়কের মতো প্রেমিকের মতো পিতার মতো পাগলামি! জল ছল ছল ছলাৎছল পাগলামি।


এই ধারাবাহিকের অন্য পর্বগুলো পাঠ করুন

শববাহকের ছেলেবেলা : প্রথম পর্ব
শববাহকের ছেলেবেলা : দ্বিতীয় পর্ব

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনায়। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের স্নাতক রাণা পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সম্প্রতি অবসরে। তিনি লেখক এবং মূলত লেখকই। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরোটি। কবিতা, গদ্য ও গল্পের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন একটি উপন্যাসও। তাঁর প্রকাশিত বইসমূহ মধ্যে গদ্যবই : ‘রং ও দাগের কাটাকুটি’, ‘পাগলদের বাড়ি’, ‘রাণার কথা’। উপন্যাস : ‘কিতকিত খেলা’। গল্প : ‘দ্রাবিড়ের ভাঙা উইকেট’। কবিতা : ‘একটি অল্পবয়সী ঘুম’, ‘শরীরে সন্দীপন নেই’, ‘লাল পিঁপড়ের বাসা’, ‘বুনো গাধার ডাক’, ‘বাংলা ভাষার মাদুর’, ‘অগাস্ট মাসের রাস্তা’, ‘রোদ ওঠার খাতা’, ‘আমাদের প্যাথোজ একাদশ’, ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ ও ‘কবিতা সংগ্রহ’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।