রায়বাড়িতে আর কিছু থাক না থাক শিল্প এবং শিল্পীর অভাব কোনোকালেই ছিল না। চিত্রকলায় প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল সত্যজিতের, তা বোঝা যায় চল্লিশের দশকের শুরুতে ইংরেজিতে লেখা তাঁর প্রথমদিককার লেখা দুটি ছোটোগল্প ‘Abstraction’ এবং ‘Shades of grey’ থেকে, যা লেখা হয়েছিল পেইন্টিং নিয়ে। ২০ বছর পরে ১৯৬২-তে লিখলেন প্রথম বাংলা গল্প ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’। এক ভিনগ্রহবাসী নিয়ে গল্পটা; এটাই হয়তো তাঁর ‘দ্য এলিয়েন’ নামক চিত্রনাট্য লেখার প্রেরণা। চিত্রনাট্যটি নিয়ে সত্যজিৎ হলিউডেও গিয়েছিলেন, সিনেমা বানানোর পরিকল্পনাও ছিল কলাম্বিয়া পিকচার্সের। নানা কারণে সেটা অবশ্য পরে হয়নি।
তবে একটা কারণ হতে পারে, তিনি আসলে চেয়েছিলেন বাংলাতেই তাঁর চলচ্চিত্র সৃষ্টি করতে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে পল্টন ময়দানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘২০ বছর ধরে বাংলা ছবি করছি। বহুবার বহু জায়গা থেকে অনুরোধ এসেছে যেন বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য দেশে, অন্য ভাষায় চিত্র রচনা করি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমি জানি, আমার রক্তে যে ভাষা বইছে, সে হলো বাংলা ভাষা। সেই ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কিছু করতে গেলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, আমি কূলকিনারা পাব না, শিল্পী হিসেবে মনের জোর হারাব।’
প্রখ্যাত অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ রায় মানুষটা আর তাঁর ছবি একে অপরের পরিপূরক।’ বই পড়ার পর বইনির্মিত যেসব চলচ্চিত্র দেখতাম বেশিরভাগ সময়েই আশাহত হতাম। কিন্তু সত্যজিতের ছবি দেখে বুঝি, কিছু অংশে তিনি বইকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন।
সত্যজিতের চলচ্চিত্র বাদ দিয়ে তাকে পর্যালোচনা করা যায় না। প্রখ্যাত অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ রায় মানুষটা আর তাঁর ছবি একে অপরের পরিপূরক।’ বই পড়ার পর বইনির্মিত যেসব চলচ্চিত্র দেখতাম বেশিরভাগ সময়েই আশাহত হতাম। কিন্তু সত্যজিতের ছবি দেখে বুঝি, কিছু অংশে তিনি বইকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁর চলচ্চিত্রে তিনি শিল্পকে এমনভাবে যত্ন করতেন যা হৃদয় থেকে অনুভব করতে পারতাম। মনে হতো এটা আমার জীবনেরই গল্প। সেটাই বোধহয় একজন শিল্পীর শক্তি।
খুব সহজেই মানুষের সহজাত অভ্যাস চিহ্নিত করার ক্ষমতা সত্যজিৎ রায়ের ছিল বলেই তাঁর সব চলচ্চিত্র, সব সাহিত্য রচনা সহজবোধ্য ছিল সবার কাছে। অনেক ভালো ও গুণী সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্রকার আছেন। তাঁরা সহজ ঘটনা জটিল করে দেখাতে পছন্দ করেন কিন্তু সত্যজিৎ রায় জটিলতাকে কতটা সহজ করা যায় তাই দেখিয়েছেন ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে। তাঁর লেখা কিশোর উপন্যাসগুলোও তেমন। জটিলতা নাই। এক্ষেত্রে সত্যজিতের ওপর প্রভাব পড়েছিল তার বাবা এবং ঠাকুরদার। পথের পাঁচালীর কষ্টকর বাস্তবতা দেখতে এক ধরনের আনন্দ জাগে অপু আর দুর্গার সহজ শৈশব আর কৈশোরের দুরন্তপনায়। যেখানে অনেক অভাবের মাঝেও আশার প্রদীপ জ্বলে থাকে অপু আর দুর্গার চোখের দৃষ্টিতে। এই আশার আলোই পরবর্তীতে অপুর জীবনের পথ চলার পাথেয়। এই জীবনবোধ সত্যজিৎ রায়ের সব সৃষ্টির মধ্যেই প্রকাশিত। এইখানেই সহজ সরল সাধারণ মানুষের প্রকৃত শক্তি সব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় নীরবে নিভৃতে অগোচরে। আর এখানেই সত্যজিৎ রায় অনন্য।
মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত জীবনের প্রায়ান্ধকার জটিল দিকগুলাকে তিনি নিংড়ে বের করে আনতেন। শৈল্পিক তুলির আঁচড়ে তিনি এমনই জীবন্ত করে তুলতেন যে, চরিত্রগুলো কথা বলত। স্ট্যানলি কুব্রিক যেমন চন্দ্রাভিযানের আগেই চন্দ্রভ্রমণ দেখিয়েছেন, সত্যজিৎ রায়ও কৃত্রিমতা বাদ দিয়ে নিখাদ মানুষের জীবনের প্রতিবিম্ব এঁকেছেন। তাই এত এত বিশেষণের পরও সত্যজিৎ রায় একজন চলচ্চিত্রকার, সাচ্চা চলচ্চিত্রকার।
সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে বড়ো গুণ ছিল, ছবি এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে তিনি তাঁর মনের কথা স্পষ্ট ভাষায় সোজাসুজি বলতে কখনও দ্বিধা বোধ করতেন না; নিছক ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে থাকা তাঁর ধাতে ছিল না, আবার ব্যক্তিগত আক্রমণও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতেন। পণ্ডিত ও সুলেখক অশোক রুদ্র, যিনি ‘চারুলতা’ মুক্তি পাওয়ার পর সমালোচনায় সত্যজিৎকে বারবার বিদ্ধ করেছিলেন। উত্যক্ত সত্যজিৎ তার জবাবে লিখেছিলেন, ‘রুদ্রমশাই সাহিত্য বোঝেন কিনা জানি না; সিনেমা তিনি একেবারেই বোঝেন না। শুধু বোঝেন না নয়, বোঝালেও বোঝেন না। যাকে বলে একেবারে বিয়ন্ড রিডেম্পশন্।’
তবে এক্ষেত্রে একটা কথা বলে রাখা ভালো বাংলা ভাষায় সিনেমা সমালোচকদের মধ্যে অশোকবাবুই একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি সত্যজিতের বিরক্তির কারণ হয়েছিলেন। এই বিশেষ সমালোচনাটির আগে এবং পরে, বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বাংলা পত্রপত্রিকায় তাঁর ছবিগুলির যে সমস্ত সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে, তার অনেকগুলিই সত্যজিৎবাবুকে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ করেছে, এবং সেকথা তিনি নির্দ্বিধায় বলতেও কসুর করেননি।
বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন বেশ দেরি করেই। তবে লেখার ভঙ্গিটা যেন তাঁর সিনেমার মতো শান্ত-স্নিগ্ধ নয়, বরং চমক আর রোমাঞ্চে মোড়া। ঠিক মেলানো যায় না যে ‘পথের পাঁচালী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘চারুলতা’, ইত্যাদির পরিচালকই গল্পের ইতি টানছেন শেষ প্যারার টুইস্ট বা পাঞ্চ লাইন দিয়ে। ফেলুদা, শঙ্কু বা তারিনীখুড়োর মতো জনপ্রিয় সিরিজগুলোর পাশাপাশি তাঁর স্বতন্ত্র ছোটোগল্পগুলোর জন্যও বাঙালি পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে আছেন তিনি। তেমনি রহস্য-রোমাঞ্চ পাঠকেরাও একেবারে তাঁদের মণিকোঠায় রেখেছেন সত্যজিৎ রায়কে।
‘ফেলুদা’ সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র। তোপসের মুখ দেখে সে বলে দিতে পারত দার্জিলিং মেলের কোন পাশের বেঞ্চে সে বসেছিল—যার ব্যাখ্যা ফেলুদা দেয় এভাবে, ‘আজ বিকেলে রোদ ছিল। তোর বাঁ গালটা ঝলসেছে, ডান ধারেরটা ঝলসায়নি। একমাত্র ওই বেঞ্চিগুলোর একটাতে বসলেই পশ্চিমের রোদটা বাঁ গালে পড়ে।’
গোয়েন্দা গল্প কিন্তু এই বাংলায় নেহাত কম লেখা হয়নি। কিন্তু এমন টানটান, মেদবিহীন গল্প সত্যিই বিরল। ফেলুদার রহস্য কাহিনির কোনোটিতেই কোনো রকম আড়ষ্টতা নেই। নেই কোনো বাহুল্য। একটা বাড়তি শব্দও খুঁজে পাওয়া ভার।
সব বয়সী এবং সব গোয়েন্দা গল্পই বেশিরভাগ পাঠকের প্রিয়─ গোয়েন্দা ফেলুদার রহস্য, রোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চার। গোয়েন্দা গল্প কিন্তু এই বাংলায় নেহাত কম লেখা হয়নি। কিন্তু এমন টানটান, মেদবিহীন গল্প সত্যিই বিরল। ফেলুদার রহস্য কাহিনির কোনোটিতেই কোনো রকম আড়ষ্টতা নেই। নেই কোনো বাহুল্য। একটা বাড়তি শব্দও খুঁজে পাওয়া ভার।
গল্পজুড়ে ছবির পর ছবি ফুটে ওঠে। ফেলুদার একটা পোশাকি নাম আছে—প্রদোষ মিত্র। কিন্তু ফেলু মিত্তির নামেই তার সমস্ত খ্যাতি। রহস্যের জট খুলতে ফেলুদার জুড়ি নেই। তার সহকারী ‘তোপসে’ নিজের জবানিতে যেসব গল্প লিখেছেন তার মধ্যে ফেলুদার চরিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্ব-মহিমায়।
গল্পের শুরুতে তিনি নিজেকে রহস্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখলেও শেষ মুহূর্তে সাফল্যের শীর্ষ স্পর্শ করেন। সব সময়ই তিনি তদন্তের ওলিগলি কিংবা গোলোকধাঁধা পেরিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফাঁস করেন রহস্যের সকল জট। যাবতীয় রহস্য-জাল বা অন্য কোনো বাধাই ফেলুদার কাছে বড়ো নয়।
গোয়েন্দা ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারে তৃতীয় যিনি অপরিহার্য, তিনি লালমোহন গাঙ্গুলী। ‘জটায়ু’ ছদ্মনামে তিনি অদ্ভুত সব রহস্য-উপন্যাস লেখেন। তোপসের গল্পে বর্ণিত রহস্যের দুর্দান্ত ঘনঘটা ও মগজের ব্যায়ামের ফাঁকে ফাঁকে, অনাবিল হাসি ও সরসতার আশ্চর্য দরজাটা খুলে দেয় লালমোহন বাবুর অতি সরল ও সাবলীল উপস্থিতি।
শুধু গল্প নয়, ফেলুদার গল্প-উপন্যাসে যেসব জায়গায় রহস্য ঘনিয়েছে, তা দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই হোক, সেখানকার নিখুঁত ইতিহাস ও ভূগোলের বর্ণনা পাঠকদের চমকে দেয়। কোথাও এতটুকু ভুলচুক নেই। স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে ফেলুদার জ্ঞান যেন গভীর বিস্ময় জাগায় যা ‘প্রফেসর শঙ্কু’র গল্পগুলোতেও বিদ্যমান। সব মিলিয়ে গোয়েন্দা ফেলু মিত্তিরকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য কিন্তু কারও নেই। ফেলুদা, তোপসে আর লালমোহনবাবুকে নিয়ে লেখা সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি অ্যাডভেঞ্চার-অভিযান বাঙালি পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। লীলা মজুমদারের সহজ স্বীকারোক্তি, ‘ফেলুদার গল্প যারা পড়েনি, তারা ঠকেছে। ভালো জিনিস উপভোগ না-করতে পারার দুঃখ আর কিছুতে নেই।’
ফেলুদার মোট ৩৫টি সম্পূর্ণ ও চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ফেলুদার গল্পে তার চরিত্রকে আঁকা হয়েছে প্রায় ২৭ বছর বয়সী একজন যুবক হিসেবে। যার উচ্চতা ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। ফেলুদা মার্শাল আর্টে বিশেষ দক্ষ। যদিও অসম্ভব ভালো বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ওপরে ভিত্তি করেই তিনি যেকোনো রহস্যের সমাধানে আস্থা রাখতে ভালোবাসেন। তার এই বিশেষ ক্ষমতাকে সে মজা করে বলে থাকে মগজাস্ত্র। তবে বাড়তি সতর্কতার জন্য তার নিজস্ব পয়েন্ট থ্রি টু কোল্ট রিভলভার রয়েছে। রিভলভার থেকে গুলি চালাতে ফেলুদাকে খুব কম গল্পেই দেখা যায়। যদিও সাম্প্রতিক ফেলুদার সিনেমাগুলোর প্রায় সবকটায় ফেলুদাকে গুলি চালাতে দেখা গেছে।
অ্যাডভেঞ্চার, কল্পনা, বিজ্ঞান, হাস্যরস মিলিয়ে ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রটি, যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। একাধারে বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভাবক, অভিযাত্রী, বহু ভাষাবিদ প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু-কে সবাই প্রফেসর শঙ্কু হিসেবেই চেনে। মাতৃভাষা বাংলা হলেও তিনি ৬৯টি ভাষায় পারদর্শী, পড়তে পারেন হায়ারোগ্লিফিক লিপি। মস্ত এই বিজ্ঞানী ১২ বছর বয়সে গিরিডির এক স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৪-তে কলকাতার কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৬ বছর বয়সেই ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্সসহ বিএসসি পাশ করেন। বিএসসি পাশের পর বছর চারেক বেদ, উপনিষদ, আয়ুর্বেদ সহ বিভিন্ন সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপনা শুরু করেন। তবে বিজ্ঞানী হিসেবেও তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সুইডিশ আকাদেমি অফ সায়েন্স তাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছে। ব্রাজিলের রাটানটান ইনস্টিটিউট থেকে পেয়েছেন ডক্টরেট সম্মাননা। পাঁচটি মহাদেশের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারক হিসেবে তাকে স্থান দিয়েছেন টমাস আলভা এডিসনের পরেই। এছাড়াও হরোপ্পা ও মহেঞ্জোদারো লিপি তিনিই পাঠোদ্ধার করেন প্রথম।
প্রফেসর শঙ্কু তার গিরিডির বাড়িতে নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে তৈরি করেছেন অদ্ভুত সব আবিষ্কার। পুরো বইতে তার অনেকগুলো আবিষ্কারের কথা জানা গেলেও কিছু আবিষ্কারের কথা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: চার ইঞ্চি লম্বা অ্যানাইহিলিন পিস্তল যেটা দিয়ে যেকোনো কিছুকে চোখের পলকেই অদৃশ্য করে দেওয়া যায়, হোক সেটা জীব বা জড়। সপ্তপর্ণী বৃক্ষের রস থেকে তৈরি করেছেন মিরাকিউরল বড়ি যা কিনা সর্বরোগনাশক। ঘুমের বড়ি সমনোলিন। এই বড়ি খেলে ১০ মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে চলে যেতে বাধ্য। তৈরি করেছিলেন ‘রিমেমব্রেন যন্ত্র’ যা কিনা হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। পরলোক চর্চা বা আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য শঙ্কু বানিয়েছিলেন কম্পুডিয়াম মেশিন। রক্তপাত বা প্রাণনাশ না ঘটিয়ে শত্রু বা প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য বানিয়েছিলেন নস্যাস্ত্র, যার প্রয়োগে প্রতিপক্ষ হাঁচতে থাকবে। বট ফলের রস থেকে বানিয়েছিলেন ক্ষুধা তৃষ্ণানাশক বটিকা ইন্ডিকা। মানুষের কানে যেসব শব্দ শোনা যায় না, তা শোনার জন্য বানান ‘মাইক্রোসনোগ্রাফ’। শ্যাঙ্কোভাইট নামক একপ্রকার ধাতু তৈরি করেছিলেন, যা মাধ্যাকর্ষণকে উপেক্ষা করতে সক্ষম। বিবর্তন দেখতে তৈরি করেন এভিটিউটন। বিড়াল ‘নিউটনের’ খাবারের জন্য আবিষ্কার করেন ফিস পিল।
তাঁর ছোটোগল্পগুলো প্রায় সবই কিশোর উপযোগী। এর একটা কারণ হতে পারে তিনি মূলত শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর জন্যই এগুলো লিখতে শুরু করেন। বিষয়বৈচিত্র্যে গল্পগুলো রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, ভৌতিক ইত্যাদি ধরনের, সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল কাহিনির টুইস্ট কিংবা থ্রিল, সাদামাটা ভাষা, অ্যাডভেঞ্চারমুখিতা, মনে রাখার মতো সমাপ্তি ইত্যাদি।
তাঁর ছোটোগল্পগুলো প্রায় সবই কিশোর উপযোগী। এর একটা কারণ হতে পারে তিনি মূলত শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর জন্যই এগুলো লিখতে শুরু করেন। বিষয়বৈচিত্র্যে গল্পগুলো রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, ভৌতিক ইত্যাদি ধরনের, সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল কাহিনির টুইস্ট কিংবা থ্রিল, সাদামাটা ভাষা, অ্যাডভেঞ্চারমুখিতা, মনে রাখার মতো সমাপ্তি ইত্যাদি।
সত্যজিতের ছোটোগল্প বাঙালি পাঠকদের জন্য বিস্ময়-রসের খোরাক হয়ে থাকবে সব সময়—সে কথা হলফ করে বলা যায়, আটপৌরে জীবনের নানা ব্যস্ততায় অতিষ্ঠ পাঠক পালানোর পথটি সহজেই খুঁজে পাবে তাঁর ডজন ডজন গল্পে। উৎকণ্ঠা, চমক আর মন-ধাঁধানো প্লটের সঙ্গে সরল-মনোমুগ্ধকর ভাষাশৈলীতে মোড়া তাঁর এসব ছোটোগল্প তাই অতিক্রম করেছে বয়সের রেখা, ছেলে-বুড়ো—সবার জন্যই মণিমুক্তো ছড়িয়ে রেখে গেছেন সত্যজিৎ রায়।
সত্যজিৎ লেখালেখির ক্ষেত্রে আর্থার কোনান ডয়েল দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন সেটা হয়তো অনুমান করা চলে। কেননা শার্লক হোমস আর ফেলুদা, বিজ্ঞানী চ্যালেঞ্জার আর প্রফেসর শঙ্কু, এমনকি বেশ কিছু ছোটোগল্পও তাঁদের দুজনার একই বৈশিষ্ট্যময়। কোনান ডয়েল যে আসলেই সত্যজিতের প্রিয় লেখক ছিলেন, সেটার প্রমাণ মেলে তাঁর করা অনুবাদ গল্পগুলোর দিকে তাকালে। ডয়েলের ‘দ্য টেরর অব ব্লু জন গ্যাপ’, ‘দ্য ব্রাজিলিয়ান ক্যাট’-এর অসাধারণ অনুবাদ করেছেন তিনি, যথাক্রমে ‘ব্লু জন গহ্বরের বিভীষিকা’ এবং ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ’ শিরোনামে। এ ছাড়া ‘সন্দেশ’-এর জন্য তিনি অনুবাদ করেন রে ব্রাডবেরির ‘মারস ইজ হেভেন’ (মঙ্গলই স্বর্গ), আর্থার সি ক্লার্কের ‘দ্য নাইন বিলিয়ন নেমস অব গড’ (ঈশ্বরের নয় লাখ কোটি নাম)। এ ছাড়া মোল্লা নাসিরুদ্দিনের অনেক কৌতুক চমৎকার রসাল আর মেদহীন অনুবাদ তিনি করেন ‘সন্দেশ’-এর জন্য।
বাংলা মা যুগে যুগে অনেক জ্ঞানীগুণীকেই গর্ভে ধারণ করেছেন। কিন্তু এর মাঝেও কয়েকজন মহাপুরুষ আছেন, যাঁদের তুলনা তাঁরা নিজেই। শ্রেষ্ঠদের মাঝেও তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ। সত্যজিৎ তেমনই একজন। সেরাদের সেরা, গড অব দ্য গডফাদার!
তথ্যসূত্রঃ
১। ফেলুদা সমগ্র – সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স
২। শঙ্কু সমগ্র – সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স
৩। গল্প ১০১ – সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স
৪। বিষয় চলচ্চিত্র – সত্যজিৎ রায়, কবি প্রকাশনী
৫। একাই ১০০ – কৌশিক মজুমদার, অন্তরীপ পাবলিকেশন
এছাড়াও বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা ও ম্যাগাজিন।