রায় পরিবারের সঙ্গে দাশ পরিবারের আত্মীয়ের সম্পর্ক। জীবনানন্দ দাশের ছোটোভাই অশোকানন্দ দাশ যাঁকে বিয়ে করেছিলেন, সেই নলিনী দাশ সত্যজিৎ রায়ের পিসি পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ছোটো মেয়ে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। সুকুমার, সুখলতা, সুবিনয়, সুবিমল, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই জীবনানন্দ দাশের কমবেশি যোগাযোগ ছিল। আমরা জীবনানন্দ দাশের ডায়েরিতে যেমন সুখলতা রায়ের গান গাওয়ার উল্লেখ পাচ্ছি তেমন সুবিমল রায়ের হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে লাবণ্যর অসুস্থ হয়ে পড়বার কথাও পাচ্ছি।
ডায়েরির ভাষায় :
‘একদিন সুবিমল-এর বিশেষ ওষুধে রাত দুটোর সময় ভীষণ কাশি কফ— বারান্দায় গিয়ে লাবণ্য creates a scene… ক্রমাগত জল ঢালা আর coughing scandalously and suffocating—’!
সব থেকে বড়ো কথা ১৯৪৩-এ অশোকানন্দ ও নলিনীর বিয়ের পর যে বাড়ি প্রায় জীবনানন্দ দাশেরও অস্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠেছিল, প্রায়ই গ্রীষ্মের ছুটিতে সেখানে গিয়ে টানা মাস দুয়েক থাকতেন, সেখানে নলিনীর আত্মীয়স্বজন কি আর আসতেন না। পরবর্তীকালে এই বাড়ির নিচের তলাই তো সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠবে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমাকে বলেছেন, জীবনানন্দ দাশের ছেলে সমরানন্দ(রঞ্জু)-র শেষজীবন এই বাড়িতেই অতিবাহিত হয়েছে। ‘সম্দেশ’-এর অফিস ঘরে তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত।
তাছাড়া, সত্যজিৎ রায় ও জীবনানন্দ দাশের মধ্য প্রধান যোগসূত্র ছিলেন দিলীপকুমার গুপ্ত (১৯১৮-১৯৭৭) বা ডিকে। ডিকে বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনার জগতে স্বনামখ্যাত। ১৯৪৩-এ ‘সিগনেট প্রেস’ প্রকাশনা সংস্থা শুরু করে বাংলা প্রকাশনায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন।
জীবিতকালে জীবনানন্দ দাশের মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫। আর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ও ‘বনলতা সেন’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ ধরলে ৭!
আমার বর্তমান নিবন্ধের প্রধান অভিমুখ এই ‘বনলতা সেন’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ। একে কেন্দ্র করে এক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।যদিও সবটাই জীবনানন্দ দাশের পক্ষ থেকে, আমরা সত্যজিৎ রায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পারি না।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ যদি জীবনানন্দ দাশকে স্বতন্ত্র ধারার একজন কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে, বলতে দ্বিধা নেই, ‘বনলতা সেন’ (প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ১৯৪২) জীবনানন্দ দাশকে জনপ্রিয় করেছে। এই বইটির প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার শম্ভু সাহা (১৯০৫-১৯৮৮)। পরবর্তীকালে যিনি রবীন্দ্রনাথের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছবি তুলবেন। এই ‘বনলতা সেন’-এর প্রচ্ছদ নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে দেখিনি জীবনানন্দ দাশকে।
তো ১০ বছর পরে প্রকাশিত ‘বনলতা সেন’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তখন তিনি কলকাতায়। তবু স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে ডিকে-কে চিঠি লিখে খোঁজখবর নিচ্ছেন। ‘প্রেমের বা প্রকৃতির কবিতা’ খুঁজে পেতে দেখে কীভাবে জুড়ে দেওয়া যায় তা দেখছেন।
বই বেরোনোর পর দিলীপকুমার গুপ্তকে চিঠিতে লিখছেন :
”বনলতা সেন’ বইটি পেয়ে খুবই আনন্দিত হয়েছি। খুবই চমৎকার বই হয়েছে। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।…’।
কোথাও কোনো বিরূপতা নেই। অথচ সত্যজিৎ রায় কৃত ‘বনলতা সেন’-এর প্রচ্ছদ জীবনানন্দ দাশের একেবারেই পছন্দ হয়নি। বারবার এ বিষয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বইটি প্রকাশের মাস তিনেকের মধ্যে ৬ অক্টোবর ১৯৫২-তে সুরজিৎ দাশগুপ্তকে লিখেছেন :
‘আমার বনলতা সেন দেখে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। এত খারাপ প্রচ্ছদপট আমি জীবনে দেখিনি’।
গোপালচন্দ্র রায়কে সাক্ষাতে বলেছিলেন :
‘কাগজ, ছাপা, বাঁধাই সবই ভালো, কিন্তু ছবিটা আমার আদৌ পছন্দ হয়নি’।
আর মোক্ষম কথাটি বলেছিলেন বোন সুচরিতা দাশকে!
‘এই বইয়ের প্রচ্ছদটা কেমন হয়েছে বল্ তো? আমার কিন্তু একেবারেই ভাল লাগে নি। আমি কি রাজকুমারী অমৃতকুমারীকে ভেবে এই সব কবিতা লিখেছিলেম নাকি’।
কে এই অমৃতকুমারী?
রাজা হরমন সিংএর কন্যা। স্বাধীন ভারতে প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
এমন নয় যে সত্যজিৎকে জীবনানন্দ দাশ চিনতেন না, যে ‘সিগনেট প্রেস’-এর প্রশংসায় মুখর জীবনানন্দ, মনে করতেন ‘কাব্যসাহিত্যের জন্যে সিগনেট প্রেস শ্রেষ্ঠ অগ্রণীর কাজ করছে।’ সেই সিগনেট প্রেসের একজন প্রধান স্থপতি সত্যজিৎ রায়।
শুধু তো ‘বনলতা সেন’ নয়, চার বছর আগেই জীবনানন্দর ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮) কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন সত্যজিৎ।
এমনকি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর সিগনেট প্রেসের ‘টুকরো খবর’-এ একটি অসাধারণ স্কেচ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়।প্রচ্ছদ করেছেন ‘রূপসী বাংলা’, ‘কবিতার কথা’, ‘মাল্যবান’, ‘সুতীর্থ’ প্রভৃতি বইয়ের। এমনকি ‘টুকরো কথা’য় ‘বনলতা সেন’-এর বিজ্ঞাপনের ছবিও সত্যজিতের আঁকা।
কী এমন ঘটল যে শুধু ‘বনলতা সেন’-এর প্রচ্ছদ নিয়ে জীবনানন্দের এত অসন্তোষ!
আমার মনে হয় জীবনানন্দ এমন ধাতের কবি যিনি তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব ও সত্তা ক্ষয় করে কবিতা লেখেন। যেমন বোদল্যের, র্যাঁবো, রিলকে বা আখমাতোভা। এঁদের কাছে কবিতা ও জীবন একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে এঁরা কবিতা লেখেন না। কবিতা এঁদের কাছে আত্মহত্যার বিকল্প।
‘বনলতা সেন’ নিয়ে জীবনানন্দ দাশ সারাজীবন ঘোরে ছিলেন। এবং বনলতা সেন কোনো কাল্পনিক নারী নয়। কাল্পনিক যে নয়, এমনকি শোভনা বা লাবণ্যও যে নয় তা স্পষ্ট করে লিখে গেছেন তাঁর ডায়েরিতে :
‘Frustration in Literature, Love, Herodias Daughters, বনলতা সেন, Imaginary Women, Bus Women and Life’
হেরোদিয়াসের মেয়ে এখানে মেজোকাকার দুই মেয়ে জ্যোৎস্না ও শোভনা। কাজেই শোভনা বনলতা নয়। বনলতা সেন কোনো কাল্পনিক রমণীও নয়; কেননা বনলতার পরেই আছে কাল্পনিক নারী।
‘শিল্পী ও কবিমাত্রই জীবনপ্রেমিক। প্রেম ছাড়া সৃষ্টি হয়? প্রকৃতি পুরুষকে সেই আবহমানকাল জুড়ে রঙে, রূপে, গন্ধে, স্পর্শে, মোহে মুগ্ধ করে রেখেছে। প্রকৃতির প্রেমেই ঘর বেঁধেছে পুরুষ আবার প্রকৃতির প্রেমেই ঘর ছেড়েছে, সে সবই শান্তি পাবার কামনায়।
কে তবে এই বনলতা সেন? জীবনানন্দ দাশ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তার উত্তর দিয়েছেন :
‘শিল্পী ও কবিমাত্রই জীবনপ্রেমিক। প্রেম ছাড়া সৃষ্টি হয়? প্রকৃতি পুরুষকে সেই আবহমানকাল জুড়ে রঙে, রূপে, গন্ধে, স্পর্শে, মোহে মুগ্ধ করে রেখেছে। প্রকৃতির প্রেমেই ঘর বেঁধেছে পুরুষ আবার প্রকৃতির প্রেমেই ঘর ছেড়েছে, সে সবই শান্তি পাবার কামনায়।
কিন্তু শান্তি কি সে পেয়েছে। অতৃপ্তিই শিল্পীর রূপ… আমার সকল কবিতার প্রেরণা। …এক-একটি ছবি যা আমরা ভুলতে পারি না সারাজীবনেও। রোজই তো কত মানুষের মুখ দেখি, প্রতিমুহূর্তে মানুষের মুখের মিছিল। তবু তো ভুলি না দু-একটি মুখ, একটি কন্ঠস্বর, একটি রং আলোর রেখা, দু’দণ্ডের শান্তি। এক অপরিচিতের ভিড়ে তাদের সঙ্গে বোধহয়, আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের পরিচয়। কোনদিন হয়তো আমাদের পরম আত্মীয় ছিলেন। অবিস্মরণীয় মুহুর্তই হয়তো সৃষ্টির মূল, কে জানে?’
জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন নিয়ে এই দীর্ঘ সংলাপে আমি কয়েকটিমাত্র শব্দ লক্ষ্য করি। স্পষ্ট করে বলছেন ‘মুখ’, ‘কন্ঠস্বর’,’রং আলোর রেখা’ র কথা। আছে ‘দু’দণ্ডের শান্তি’র কথাও।
জীবনানন্দ দাশের হয়তো মনে হয়েছিল সতজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদে সেই ‘মুখ’, ‘কন্ঠস্বর’ ও ‘রং আলোর রেখা’ নেই।
সত্যজিৎ রায় নিশ্চয় ‘বনলতা সেন’ পড়েছেন। পড়ে নিজের মতো করে কল্পনা করেছেন। এবং ছবি এঁকেছেন। কিন্তু তা কখনওই জীবনানন্দ দাশের জন্ম-জন্মান্তরের পরিচিত পরম আত্মীয় নন। আর সেটা সম্ভবও নয়।
যদি ধরি, সত্যজিতের প্রচ্ছদে বাস্তবের সেই বনলতা সেনের সামান্যতম কোনো আভাসও ধরা পড়েছে, তাহলে জীবনানন্দের মতো অখুশী কেউ হতেন না।
তাঁকে তো ‘কল্যাণীয়াসু’ লিখে প্রেমিকাকে বই উৎসর্গ করতে হয়। জীবনানন্দের বোন জ্যোৎস্না দাশগুপ্ত ডায়েরির কথা শুনে এক সাক্ষাৎকারে আমাদের বলেন :
‘আমরা যখন খেলতাম, দাদা তো একটা চেয়ারে মুখ গুঁজে বই নিয়ে বসে থাকত। দাদার পেটে পেটে এত’।
সত্যিই জীবনানন্দ এক ধাঁধা। সত্যজিৎ রায় এক অমীমাংসিত খেলায় জড়িয়ে পড়েছেন এই মাত্র।
রায়বংশের কাছে জীবনানন্দ ঋণী। সুকুমার রায়ের ‘স্বকীয়তা’য় জীবনানন্দ দাশ বিস্ময়ে ও আনন্দে একদিন স্তব্ধ হয়েছিলেন। ‘আবোল-তাবোল’ বইটি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ কোনোদিন ফুরাইনি। বাস্তব না হয়েও কীভাবে বাস্তবের মতো পরিচিত ও সত্য গড়ে তোলা যায় তা সুকুমার রায়ের থেকে শিখেছিলেন জীবনানন্দ।
রায়বংশের কাছে জীবনানন্দ ঋণী। সুকুমার রায়ের ‘স্বকীয়তা’য় জীবনানন্দ দাশ বিস্ময়ে ও আনন্দে একদিন স্তব্ধ হয়েছিলেন। ‘আবোল-তাবোল’ বইটি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ কোনোদিন ফুরাইনি। বাস্তব না হয়েও কীভাবে বাস্তবের মতো পরিচিত ও সত্য গড়ে তোলা যায় তা সুকুমার রায়ের থেকে শিখেছিলেন জীবনানন্দ।
সত্যজিৎ রায় সুকুমার রায়ের ছেলে, তিনিও জানতেন, বাস্তবকে কীভাবে রেখায় ধরতে হয়। আসলে আমার মনে হয় ৩০ বছরের যুবকটির সাথে ৫৩ বছরের প্রৌঢ়টির একটি ডায়ালগের প্রয়োজন ছিল।
এই যোগাযোগহীনতা বাংলা প্রচ্ছদশিল্পে এক বড়ো ক্ষতি। ভাবতেই শিহরিত হই, জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেনের বর্ণনা করছেন আর সত্যজিৎ রায় সেই অক্ষর রেখায় রূপান্তরিত করছেন।
আগামী দিনে তো এই কাজেই জগৎবিখ্যাত হবেন। তাঁর মতো ছবি আর ক’জন বুঝেছেন।
কবি, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। প্রায় দু-দশক ধরে জীবনানন্দ চর্চায় নিমগ্ন। সম্পাদনা করেছেন জীবনানন্দ দাশের ‘অপ্রকাশিত জীবনানন্দ-১ ও ২’ (২০১৫-২০১৬), ‘নভেলের পাণ্ডুলিপি’ (২০১৮), ‘শীতসবিতা’ (২০১৯)। ভূমেন্দ্র গুহ-র সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা— ‘ছায়া আবছায়া’ (২০০৪)! এবং ‘পাণ্ডুলিপির কবিতা-১’ (২০০৬)। ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি : জীবনানন্দের খোঁজে ১ ও ২’ (২০১৯ ও ২০২০)। ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি’ তাঁর মৌলিক গ্রন্থ। এছাড়া ভূমেন্দ্র গুহ-র সঙ্গে ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে সম্পাদনা সহয়তা করেছেন জীবনানন্দ দাশের ‘পাণ্ডুলিপির কবিতা ২-৬’ (২০০৭-০৮), ‘সমরেশ ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৪), ‘চারটি উপন্যাস’ (২০০৬) এবং ‘দিনলিপি ১-৪’ (২০০৯)।