শনিবার, নভেম্বর ৯

সাক্ষাৎকার : আমাদের অনেক পাঠক এখনও ধ্রুপদী ছবি বা ধ্রুপদী লেখাগুলো পড়েননি —মুম রহমান

0
Moom Rahman

মুম রহমান

মুম রহমান একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, আলোকচিত্রী আবার নাট্যকারও। অর্থাৎ শিল্পের প্রায় সকল শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। সমকালে যাঁরা শিল্প-সাহিত্য চর্চা করছেন তাঁদের মধ্যে এমন সব্যসাচী লেখক প্রায় বিরল। শিল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, শিল্পের প্রতিটি শাখায় তাঁর বিচরণ নিয়ে সম্প্রতি তিনি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন কবি ও কথাকার জব্বার আল নাঈম-এর কাছে। এখানে সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ শ্রী-র পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।


জব্বার আল নাঈম: মুম ভাই, আপনি কবিতা চর্চা করেন, গল্প ও উপন্যাস লেখেন, নাটক নিয়ে কাজ করছেন, প্রবন্ধ তো লিখছেনই। আবার আলোকচিত্র ধারণ করছেন ক্যামেরায়, রান্না বিষয়ক মজার মজার রেসিপির প্রসঙ্গও আপনার লেখা ও বলায় বারবার এসেছে—আপনি কোন কাজটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতে চেয়েছেন?

মুম রহমান: নাঈম, প্রশ্নটা তোমার একার না। ধারণা করি, অনেকেরই। অনেকের ভেতরে এই প্রশ্নটা দেখে আমি প্রায়শই দ্বিধান্বিত হই। মনে হয় যেন একজন কৃষককে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তা জনাব, আপনি ধান বুনেছেন, পুঁই শাক করেছেন, হাল বাইছেন, জোয়াল দিচ্ছেন, এতো কিছু করছেন, আসলে কোনটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেন। কৃষক তো জোর করে কিছু করে না। চাষেই তার আনন্দ। আর বাকী যা করে চাষের প্রয়োজনেই। লেখালেখিই তো তাই। এমন কি হয় যে একজন লেখক উপন্যাস লেখার সময় স্বতঃস্ফূর্ত থাকবে আবার গল্পের সময় নয়? আমরা সর্বোচ্চ বলতে পারি, ভাই, কৃষকের যেমন এবারের সরিষার ফলন ভালো হয়নি তেমনি মুম, তোমার উপন্যাসটি জমেনি। এই ভালো না হওয়া, জমাট না হতে পারা তো অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। কিন্তু চাষটা তো স্বতঃস্ফূর্তই হওয়ার কথা। এমনিতে আমি টাকার জন্য অনেক সময়ই লিখি, অনেক কিছুই লিখি, যাকে তোমরা খ্যাপ বলো। তো এইসব খ্যাপ তো আর সব সময় সাহিত্য কর্ম নয়। টিকে থাকার জন্যও তো মানুষকে কিছু করতে হয়। আমি তো লেখালেখি ছাড়া অন্য কিছু শিখিনি, পারি না। কাজেই ও থ্যাপ বা আক্ষেপও লেখালেখি কেন্দ্রিকই। আর আলোকচিত্র, রান্না এগুলো আমার শখের কাজ। লেখালেখির পাশাপাশি এগুলোও সৃজনশীলতা দাবী করে। বিশ্বব্যাপী রান্নার সাহিত্য মানে কুকিং লিটারেচার কিন্তু খুব শক্তিশালী। আমরা সে তুলনায় ভারী দুর্বল। সত্যিকার অর্থে দুর্বলই শুধু নয়, দূর্লভও বটে। অথচ রান্না বা খাওয়াতেও তো আমরা দারুণ সরস। কিন্তু সাহিত্যে তেমন করে রান্না তো এলো না। মানে, রান্নাটা প্রাধান্য পেল না। রেসিপি টাইপের যে সব বই বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো অপাঠ্য। খুবই গৎবাঁধা ভাষা আর বাজে উপস্থাপন। তাই আমার মনে হলো, রান্না নিয়েও লেখি। আলোকচিত্র চর্চা করি ব্যক্তিগত শখে, সেই শখেই সামান্য পড়াশোনা। তাই থেকে আলোকচিত্র নিয়ে বই করা। খেয়াল করে দেখলাম, বাংলা ভাষায় আলোকচিত্র নিয়ে তেমন বই নেই। অথচ আলোকচিত্রে আমরা বিশ্বমানের। তাই আমি বিশ্ব সেরা ১০০ আলোকচিত্রের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিলাম। আদতে এই পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা নিজের সঙ্গেই। নিজের জানা-শোনাটাকে পরে ভাগ করে নেওয়া। কিন্তু এর সবগুলো কাজই কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত বলে আমি বিবেচনা করি।

 

জব্বার আল নাঈম: রান্না বিষয়ক সাহিত্য আমাদের এখানে না হওয়ার কারণ কী? বিশ্বসেরা ১০০ আলোকচিত্রের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে কি বাংলাদেশের কোনো আলোকচিত্র নেই কাজ করার?

মুম রহমান: রান্না বিষয়ক শুধু নয়, অনেক বিষয়েই সাহিত্য আমাদের এখানে হয়নি। আসলে আমি ঠিক এর কারণ জানি না; এর জন্য পাঠক দায়ী নাকি লেখক। মানুষের একটা সরল প্রবণতা হলো চেনা পথে হাঁটা। আমাদের পাঠকরা গল্প শুনতে চায়, সে গল্পও হতে হবে বিস্তৃত, অনেকটাই এলিয়ে ঝেলিয়ে। রসিয়ে-কষিয়ে, রয়ে-সয়ে গল্প করাটা কিন্তু আমাদের রক্তের মধ্যেই রয়ে গেছে। হয়তো সে কারণেই এ দেশে উপন্যাসের খুব চল। অবশ্য এ দেশেই কেন, উপন্যাসের জয়জয়কার তো সারাবিশ্বেই। তবে বিশ্বের অন্য দেশে উপন্যাসের বাইরেও অন্য বইয়ের বড়ো একটা বাজার আছে। আমাদের নেই। আমাদের পাঠকরা চেনা আদলের গল্প-উপন্যাস পড়ে, লেখকরাও লেখে। এর একটা বাজার কাটতি আছে। সেটা তুমি বাজারি ঈদ সংখ্যাগুলোতেই দেখতে পাবে। প্রচুর উপন্যাস ছেপে মোটা মোটা ঈদসংখ্যা করা হয়। সেগুলো আবার খসড়া টাইপ উপন্যাস। বইমেলার সময় এগুলোকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড়ো করা হয়। উপন্যাস এতো যে ছাপা হয়, দেখবে সেখানেও আঙ্গিকগত নীরিক্ষা নেই। সবাই কাহিনি বয়ান করে যাচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকটা ‘এক দেশে ছিল এক রাজা আরেক দেশে ছিল এক রানি টাইপের’। অথচ গল্প, বিশুদ্ধ গল্প, যাকে বলি ছোটোগল্প, যার মধ্যে চূড়ান্ত মুন্সিয়ানা থাকে তা কিন্তু অতো গুরুত্ব পায় না আমাদের দেশে। খুবই নিমগ্ন পাঠকরা ছোটোগল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়, তারচেয়েও নিমগ্ন পাঠক কবিতার সঙ্গে একাত্ম হয়। কবিতা সাহিত্যের সহি আর বিশুদ্ধতম মাধ্যম। আপাতভাবে সেটাই সবচেয়ে বেশি চর্চা হয় এ দেশে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে আমাদের বিশুদ্ধতম কিংবা সহি কবির সংখ্যা অধিক। বরং এর কারণটা অন্যরকম। তুমি তো জানো, কবিতার সঙ্গে আবেগের যোগাযোগ সরাসরি এবং প্রবল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবিতায় তাৎক্ষণিক আবেগ চলে আসে, আবেগের তাড়নায় তাৎক্ষণিক কবিতা লেখা হয়। খুব দক্ষ শব্দশিল্পী, গভীর বোধ আর কৌশলী ছন্দ জানা লোক না হলে তার কবিতাটা স্রেফ তাৎক্ষণিক প্রকাশ হয়ে যায়। যা আমাদের দেশে বেশি হয়। আকৃতিগত দিক থেকেও কবিতা ছোটো, মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক বসায় লেখা যায় এবং কবি নামধারী অনেকেই এক বসায় যে কবিতাটা লেখেন সে কবিতার পানে নিজেও আর ফিরে তাকান না, ফলে কবিতা তার গভীরতর মনোযোগ হারায় কবির কাছেই। আর নিরীক্ষা? সে তো সূদুরের আলাপ! যে অর্থে ফরাসী কবিতায়, ইতালীয় কবিতায় নীরিক্ষা হয়েছে সে অর্থে আমাদের কবিতাতে নীরিক্ষা প্রায় হয়নি। শায়েরি, হাইকু, রুবাই, তানাকা ইত্যাদির মতো ঘরণার সৃষ্টি করতে পারিনি আমরা। আঙ্গিকের নীরিক্ষা আমাদের নেই। গল্প, কবিতা, উপন্যাসের গৎবাঁধা প্রচলিত পথে আমরা চলি। আর যাকে বলে নন-ফিকশন, মানে গদ্যের বিশুদ্ধ জগৎ তা আমাদের প্রায় নেই। সৈয়দ মুজতবা আলি অসাধারণ কিছু বিশুদ্ধ গদ্য লিখেছেন। তাঁকে আমরা কেবল রম্যরচয়িতা হিসেবেই চিনি। অথচ বই পাঠ থেকে রান্নার মতো বিষয় বৈচিত্র্য তাঁর রচনাবলীতে বিদ্যমান। আমার মনে হয়, নন-ফিকশন লিখতে প্রচুর পড়ালেখা লাগে, তারচেয়ে বেশি লাগে যেকোনো বিষয়কে স্বাদু গদ্যে রূপান্তর করার দক্ষতা। আমাদের অনেক বড়ো বড়ো লেখকদের অনুরোধ করলেও তাঁরা নিজের জানা-শোনা আর চেনা পথের বাইরে লিখতে রাজি হন না। এ কারণেই হয়তো রান্না বা বিবিধ বিষয়ে আমাদের সাহিত্য কম। তেমনি আলোকচিত্র বিষয়ক বইও কম। আলোকচিত্র, স্থাপত্য, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে লেখাটাকে কেউ সাহিত্য মনেই করে না। অথচ এটা তো হতেই পারত আমাদের গল্পে, উপন্যাসে আলোকচিত্র, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি আসতে পারত। আবার এ সব বিষয় নিয়েই আলাদা বই হতে পারত, যা একই সঙ্গে তথ্য ও সাহিত্যমানে ভরপুর হতো। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ একটা ভিন্ন ধারার উপন্যাস। নামকরণেই বোঝা যায় চিত্রকলার সঙ্গে তার সংযোগ আছে। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘ঈর্ষা’ নাটকে বাংলাদেশের চিত্রকলাকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন। জয়নুল আবেদিনের প্রসঙ্গ এসেছে। এই কাব্যনাটকটি একটা জটিল, গভীর সাহিত্যকর্মের উদাহরণ হতে পারে। একে তো নাটক, তাও আবার কাব্যে প্রকাশ, তাতে আবার সাতটি মাত্র সংলাপ, সেই সঙ্গে আমাদের চিত্রকলা এবং শিল্পীর মনস্তত্ত্ব দারুণভাবে এসেছে ‘ঈর্ষা’তে। আদতে এমন ঈর্ষণীয় কাজ করতে গেলে তো লেখককে শিল্পের নানা মাধ্যমগুলোও বুঝতে হবে। আফসোস, আমরা সৈয়দ হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ নিয়ে কথা বলি কিন্তু ‘ঈর্ষা’ নিয়ে কথা বলি না। ‘ঈর্ষা’ হলো নানা মাধ্যমের সুবর্ণ সমাহার। একটু নিজের কথা বলি। আমি নিজে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি, সমকালের প্যাকেজ নাটক, সিনেমা ইত্যাদির প্রসঙ্গ এনেছি আমার ‘মায়াবি মুখোশ’ উপন্যাসে। আমি যেহেতু টিভি মাধ্যমে কাজ করেছি দীর্ঘদিন, সিনেমা নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ পড়ালেখা আছে সেহেতু এটা লিখতে পেরেছি। আমার ‘মায়াবি মুখোশ’ যিনিই পড়েছেন তিনিই ভালো লাগা জানিয়েছে। তথাপি এটা নিয়ে কোনো লিখিত আলোচনা আমার চোখে পড়েনি। আমাদের টিভি বা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা যদি এ উপন্যাস পড়ত তারা হয়তো এ উপন্যাসকে নতুন করে মূল্যায়ন করত। আবার ধরো, আলোকচিত্র নিয়ে আমাদের বই আছে অনেক, কিন্তু সেগুলো ক্যাটালগ ধরণের। মানে আলোকচিত্রীর বাছাই করা ছবি নিয়ে দুই মলাটের ভেতরে একটা ক্ষুদ্রাকারের প্রদর্শনী। সেগুলোকে পড়ার জন্য কেউ কেনে না। কারণ ওখানে পড়ার কিছু নেই। স্রেফ ছবি দেখা। আমি আর বন্ধু আজাদ মিলে গত বছর ‘জমিন’ নামে একটা বই করেছি। বইটি আকারে বড়ো, যাতে ছবিগুলো বড়ো আকারে দেখা যায় আর এই বইতে প্রত্যেক ছবির সঙ্গে আমি কবিতা লিখেছি, পাঁচ লাইনের, মানে অনেকটা লিমিরিক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। সেই সব কবিতা কিন্তু আজাদের ছবি বা আলোকচিত্রের ক্যাপশন নয়, সেটা বরং ওইসব আলোকচিত্র দর্শনে আমার অনুভূতি। এ অনুভূতিটুকুর একটা সাহিত্যিক প্রকাশ ভঙ্গিমা আছে, হয়তো সাহিত্যিক গুরুত্বও আছে। আলোকচিত্র ও কবিতার একটা যুগলবন্দি আমি করেছি। এর আগেও আজাদের আলোকচিত্র আর আমার কবিতা নিয়ে বই হয়েছে ‘সমুদ্রের বই’, যেখানে আজাদের আলোকচিত্র আর আমার কবিতা ছাপা হয়েছে দুই মলাটে এবং সবগুলো আলোকচিত্র ও কবিতা সমুদ্রবিষয়ক। বাংলাদেশে একাধিক আলোকচিত্রী আছেন যাঁদের কাজ বিশ্বের যেকোনো উঁচুদরের আলোকচিত্রীর সঙ্গে তুলনীয়। ইমতিয়াজ আলম বেগ, শহিদুল আলম, হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন, তানভীর, সুজন, মাহমুদুল প্রমুখ আলোকচিত্রী আমাদের বাংলাদেশের আলোকচিত্রকেই শুধু নয়, বিশ্ব আলোকচিত্রকেও নতুন আলো দিয়েছেন। কিন্তু বই করার প্রেক্ষিতে একটা সমস্যা আছে। সমকালের আলোকচিত্রী, চিত্রশিল্পী, কবি, চলচ্চিত্রকার প্রমূখকে নিয়ে আমি কাজ করতে আগ্রহ বোধ করি না। এতে নানা বিতর্ক আর জটিলতায় জড়াতে হয়। অনুমতি নেওয়া, এর তার কাছে ধরনা দেওয়া এবং বিতর্ক। জটিলতায় জড়ানোর মতো সময় বা রুচি আমার নেই। আমি তাই চেষ্টা করি ধ্রুপদী কাজকে নিয়েই লিখতে। একদিকে সেটা নিরাপদ, অন্যদিকে আমাদের অনেক পাঠক এখনও ধ্রুপদী ছবি বা ধ্রুপদী লেখাগুলো পড়েননি সব। সেসব দেখা বা পড়া জরুরি। ধ্রুপদী সাহিত্য, চিত্রকলা, আলোকচিত্র আসলে একজনের নন্দনের বুনিয়াদ তৈরি করে দেয়।

 

জব্বার আল নাঈম: এই যে বললেন, ‘সমকালের আলোকচিত্রী, চিত্রশিল্পী, কবি, চলচ্চিত্রকার প্রমুখকে নিয়ে আমি কাজ করতে আগ্রহ বোধ করি না।’ সমকালেই মূলত ‘ধ্রুপদী’ কাজটি হয়। সেক্ষেত্রে সাহিত্যের নানা আঙ্গিক নিয়ে যদি তার মূল্যায়ন না করা হয় সেটা ধ্রুপদী হবে কীভাবে? একজন আল মাহমুদকে নিয়ে প্রথম লিখে আলোচনায় এনেছেন সৈয়দ আলী আহসান, একজন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে প্রথম লিখে আলোচনায় এনেছেন আহমদ ছফা। এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপই মূলত এদেরকে এগিয়ে দিয়েছে তা অস্বীকার করবেন?

মুম রহমান: কোনোক্রমেই তা অস্বীকার করব না। আমি কিন্তু সমকাল থেকে বিচ্ছিন্ন নই। আমি তোমার লেখা পড়ি, তোমাদের লেখা পড়ি। আমি বলেছি আমি পারতপক্ষে সমকালের কথিত বড়ো বড়ো ব্যক্তিদের লেখা বা শিল্পকর্ম নিয়ে সচারাচর কথা বলি না। বলতে চাই না। এটা আমার সীমাবদ্ধতা। দেখা যায়, সমকালের অনেকেই আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। ফলে লিখতে গেলে, বলতে গেলে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সীমাটা পার হতে হয়। আবার লেখার পরও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দুয়েকবার। আমি যেহেতু খুব রেখেঢেকে লিখি না, বলি না, সেহেতু অপরপক্ষের সমস্যা হয়। আমি এই সমস্যাগুলো এখন এড়াতে চাই। এটা হয়তো বয়সের দোষ। আমার শরীর ও মনের বয়স হয়েছে, হচ্ছে। এখন তাই বাড়তি চাপ নিতে চাই না। আবারও বলছি, এটা আমার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা অথবা নিজস্ব নিরাপত্তা বলয়।

 

জব্বার আল নাঈম: রান্না বিষয়ক বইগুলো অপাঠ্য বা অখাদ্য হওয়ার কারণ কী? আমাদের রান্না বিষয়ক বইগুলোতে থাকবে বাঙালি রেসিপির প্রকরণ ও ধরন। সেখানে তো ইতালি, তুরস্ক, আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা ভারতীয় রান্নার ধরন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা নয়। পরিবেশ বা দেশ আলাদা হওয়ার কারণে বইয়ে রান্নার ধরনটাও আলাদা থাকবে। নাকি?

মুম রহমান: এটা মজার বিষয়, খাদ্য বিষয়ক অধিকাংশ বই অখাদ্য। এর মূল কারণ হলো, রান্না বিষয়ক বইগুলো কোনো কথাসাহিত্যিক রচনা করেন না। কথিত টেলিভিশনের রন্ধন শিল্পীরা এইসব বইয়ের মূল হোতা। তারা টিভি পর্দার কারণে জনপ্রিয়। কিন্তু সত্যিকার কথাটি হলো, তাদের অনেকে তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারেন না, লিখবেন কী! রান্নার বইগুলো চকচকে ছবির জন্যও বেশি বিক্রি হয়। আর আমাদের প্রকাশকরাও মনে করে কোন কোন উপাদান লাগবে কোনটার পর কোনটা চড়াবে সেটাই মোক্ষম কথা। অথচ উইলস বি’র লেখা ‘কন্সিডার দ্য ফোর্ক’ বইতে কেবল কাঠের চামচ নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় আছে। প্রতিটি বাড়িতে শত শত বছর ধরে একটা কাঠের চামচ বা খুন্তি থাকে। সেটার ইতিহাস খুঁজেছেন তিনি, সেটার প্রয়োগ বলতে গিয়ে নানা রকমের রান্নার প্রসঙ্গ টেনেছেন তিনি। এই বইটার পুরো নাম ‘কন্সিডার দ্য ফোর্ক: আ হিস্টোরি অব হাউ উই কুক এ– ইট’। মানে আমরা কীভাবে খাই, কীভাবে রাঁধি এ সবও এসেছে এই বইতে। তারচেয়েও বড়ো কথা এটা অত্যন্ত সুস্বাদু গদ্যে লেখা। মাইকেল পোলানের ‘দ্য অম্নিভেরা’র ডিলেমা’ও অসাধারণ সুখপাঠ্য বই। মানুষ যে সর্বভূক সেটা কেন, কীভাবে— এমন সব বিষয় এসেছে এই বইতে। মানে নেহাত রান্নার রসকষহীন রেসিপির বই দিয়ে তো আর সাহিত্য দাঁড়াবে না। আর রান্নার ধরন, মশলার ব্যবহার ইত্যাদি তো দেশভেদে আলাদাই হবে। ইতালীর খাবার আর বাংলার খাবার তো এক নয়। ইলিশ পাতুরির নেহাত রেসিপি না লিখে এর উৎপত্তি থেকে শুরু করে এর কৌশল ও নন্দন নিয়েও লিখতে হবে। সেটা লেখা কমই হয়েছে। ‘নূনেতে ভাতেতে’ নামে একটা সিরিজ বই আমার দৃষ্টি কেড়েছে। বাংলা ভাষায় এমন বই হওয়া উচিত। বাঙালির মাছ, শাক, সবজি এসব নিয়েও সাহিত্যমান সম্পন্ন বই হতে পারে। বিভূতিভূষণের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ কিন্তু রান্না বিষয়ক একটা উঁচুদরের সাহিত্য। সম্প্রতি কল্লোল লাহিড়ির লেখা ‘ইন্দু বালা ভাতের হোটেল’ নামের একটি উপন্যাসেও রান্নার বিষয়টি নান্দনিকভাবে এসেছে। রান্নার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আমার ‘ঊর্মিমালা’ গল্পটি নিয়ে তো তোমরাই আলোচনা করেছ।

 

জব্বার আল নাঈম: আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা রন্ধন বিষয়ক বই লেখেন না, যা সমাজকে ধাক্কা দেবে তেমন বই লেখেন না, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু বিষয় আছে যা সাহিত্যের জন্য খুবই দরকারি সেসবও লেখেন না।

মুম রহমান: আসলে কে লিখবে, কি লিখবে, কেন লিখবে এগুলো খুব জরুরি অথচ অমিমাংসিত প্রশ্ন। লেখক তো নিজের আয়ত্ব আর সাধ্যের মধ্যেই লিখবেন। কোনো কোনো লেখক হয়তো একটা সিলেবাস করেই লেখেন। মানে একটা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, একটা দেশভাগ, একটা নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস, একটা নিম্নবর্গের মানুষের উপাখ্যান এগুলো নিয়ে লিখলে আলোচনায় আসা সুবিধা হয়। ক্ষুদ্র বিষয়কে বোধহয় আমরা ক্ষুদ্র করেই দেখি। জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাকে আমরা বোধহয় সাহিত্যের মানদণ্ডে এখনও গুণতে শিখিনি। আমি ঠিক এইসব প্রশ্নের উত্তর জানি না। কে কোন বিষয়ে লিখবে, কোনটা লেখা জরুরি এটা বলা মুশকিল খুব। আর সমাজকে ধাক্কা-টাক্কা আমি বুঝি না। ধাক্কা-ঝাঁকি এসবের একটু গুরুত্ব হয়তো আছে। কিন্তু স্রেফ ধাক্কা দিলে তো হবে না, ঝাঁকি দিলে তো হবে না, সাহিত্যের কাজ তো আরও গভীরতর।

 

জব্বার আল নাঈম: আমরা এখন একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে বেশি লিখছি। আপনার এমনটা মনে হয় আমাদের সাহিত্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্যান্য সাবজেক্টগুলোর চেয়ে একাত্তর নিয়ে সাহিত্য রচনাই এখন বেশি দরকার? আর এই একাত্তর নিয়ে মনে দাগ লাগার মতো আমাদের সাহিত্য কোনগুলো বলে মনে করেন?

মুম রহমান: আবারও সৈয়দ শামসুল হকের কথা বলবো। তাঁর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্যনাটকটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা নয়া পাঠ বলা যায়। এখানে মুক্তিযুদ্ধকে প্রচলিত পন্থার বাইরে দেখা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘অনিল বাগচীর একদিন’ নামে একটা ছোট্ট উপন্যাস আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসের একটি ভিন্ন কিন্তু গভীর পাঠ এটি। একাত্তরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে যে পীড়ন হয়েছে এ উপন্যাসে তার দারুণ বয়ান আছে। আজকের আধুনিক ‘ট্রমা থিওরি’র সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এই কাজটিকে আমার খুব উঁচুদরের কাজ মনে হয়। শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে যুদ্ধকালে মানুষের যে তীব্র অস্তিত্ব সংকট দেখি, যুদ্ধত্তোর স্বাধীন রাষ্ট্রেও সে সংকট বিলুপ্ত হতে দেখি না। উপন্যাসের সময়কাল পনেরো বছর। পাক হানাদার বাহিনীর আকস্মিক হামলায় ২৫ শে মার্চ রাতে বাঙালির চরম দুর্ভোগ ও সংকটের কাল থেকে কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে ১৯৮৫ সাল নাগাদ। যুদ্ধের কালে আবদুল মজিদ এক কিশোর। আর ১৯৮৫-তে এসে সে পরিণত। ১৫ বছরের এই পরিণতকালে পৌঁছাতে আবদুল মজিদকে সামষ্টিকভাবে পার হতে হয়েছে এক অনিশ্চিত, সংকটময় পরিস্থির মধ্য দিয়ে। মানুষের জীবন টিকিয়ে রাখার চরম সংকট থেকে মুক্তি পেতেই আবদুল মজিদকে উপন্যাসের শেষে এসে দেখি চেনা পরিবেশ, প্রতিবেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে। রাজাকারের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কারণে আবদুল মজিদ শেষ পর্যন্ত নিজের আদি নিবাস থেকে অস্তিত্ব টেকাতেই স্বপরিবারে পালায় এবং তাদের পলায়নের মধ্য দিয়ে পুরোনো ঠিকানা থেকেই তাদের নাম অবলুপ্ত হয়ে যায়। যুদ্ধ, ক্ষমতা, রাজনীতি ইত্যাদির কাছে মানুষের অস্তিত্ব একটা স্যান্ডেলের ফিতার মতো, কিংবা মুরগির মতো, কিংবা উঁইপোকার মতোই ঠুনকো। শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যের এক অনন্য দলিল। আসলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেরা সাহিত্যটি এখনও লেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ এমন এক মহাকাব্যিক ঘটনা যা নিয়ে ‘মেঘনাদ বধ’-এর মতো, ইলিয়াড, অডেসি, ইউলিসিসের মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস আশা করি আমি। অথচ এখানেও একটা চেনা পথে হাঁটার প্রবণতা আছে। যেকোনো লেখকই মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর দুয়েকটা গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাস থাকা উচিত। এই ঔচিত্যবোধ ভালো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে গেলে যে প্রস্তুতিটা দরকার আমাদের লেখকদের মনে হয় সে প্রস্তুতির সময় নেই।

 

নাঈম: আমাদের সাহিত্যে নন্দন কতটুকু এসেছে বলে মনে করেন? না আসার কারণ কী বলে মনে করেন?

মুম রহমান: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নন্দনতত্ত্বের চর্চা কিন্তু আমাদের এখানে হয়েছে। সেই প্রাচীন ভারতবর্ষের আমল থেকেই আমাদের নিজস্ব নন্দন তৈরি হয়েছে। আধুনিককালে এসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ দিয়ে আমাদের রীতিমতো আলোড়িত করেছেন। তবে, এটা দুঃখের কথা কথাসাহিত্যে সে অর্থে নন্দনতত্ত্বের লক্ষণ আমার চোখে পড়ে না। কবিতায় কিন্তু আছে, কবিতায় নন্দনতত্ত্বের প্রয়োগের উদাহরণ অসংখ্য। সে তুমি রবীন্দ্রনাথ বলো, জীবনানন্দ বলো, শামসুর রাহমান কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলো, কবিতায় নন্দনতত্ত্বের চর্চাটা প্রাধান্য পেয়েছে। কথাসাহিত্যে, আরও সরল করে বললে, ছোটোগল্পে, উপন্যাসে এ চর্চাটি আমি খুব কম দেখি। কমল কুমার মজুমদারের ‘গোলাপ সুন্দরী’ একটা ব্যতিক্রমী কিন্তু জোরালো উদাহরণ হতে পারে। এর বাইরে আমার পাঠের মধ্যে তেমন গল্প-উপন্যাস পাইনি, যেটাতে নন্দনতত্ত্বের তেমন ঝিলিক আছে। এমনও হতে পারে, আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা কম। এখন বাংলা কথাসাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের চর্চা কেন হয়নি, সেটা বলা আসলে গবেষকের কাজ। হুট করে আমার পক্ষে এর কারণ বলে ফেলা কঠিন। তবে যেটুকু অনুধাবন করি, নন্দনতত্ত্ব জীবনের গভীর দর্শনের ফল। আমাদের সাহিত্য এখনও ভাত-কাপড়ের সাহিত্য, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, সেখানে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি দেখারও একটা নন্দন আছে কিন্তু সেটা তরুণ সুকান্তের কবিতাতেই। বিভূতিভূষণ থেকে হুমায়ূন আহমেদ— অনেকের লেখাতেই প্রকৃতির রূপ বর্ণনা আছে। বাংলা সাহিত্যে নারী রূপের বর্ণনা তো বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু রূপ বর্ণনা করলেই তো একটা ভাষা বা জাতির বা দেশের নন্দনতত্ত্ব চর্চা সম্পূর্ণ হয়ে যায় না। নন্দনতত্ত্ব, আগেই বলেছি একটা গভীর দর্শন চর্চার অংশ। এমন প্রশ্নও প্রায়শই মনে জাগে, দর্শন, চিত্রকলার গভীর পঠন-পাঠনের প্রস্তুতি নিয়ে ক’জনই বা কথাসাহিত্য চর্চায় আসেন। নন্দনতত্ত্ব অনুধাবন করা, চর্চা করার চেয়ে ফেসবুক বুস্টিং অনেক সহজ।

 

নাঈম: ‘আমাদের সাহিত্য এখনও ভাত-কাপড়ের সাহিত্য’ যদি এটাই হয় আমাদের সাহিত্যের অগ্রগতি নেই। ভাত কাপড়ের জন্য যারা লড়াই করে তারা বড়োজোর দিনমজুরি করে। মাল্টিবিলোনিয়র হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না। ভাত-কাপড় থেকে বের হয়ে উন্নত জীবন যাপনের জন্য লেখকের ভূমিকা কী? অথবা ভূমিকা আছে ভাবেন? সেটা কেমন? মানে পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের পথ রচনায় অতীতের সাহিত্যিকদের কেমন ভূমিকার প্রয়োজন ছিল? বর্তমান প্রজন্মের সাহিত্যিকদের কেমন ভূমিকার দরকার?

মুম রহমান: তুমি বড়ো জটিল জটিল প্রশ্ন করে আমাকে বিপদে ফেলে দিচ্ছ, নাঈম। উন্নত জীবন যাপন জিনিসটা কী? মানে আমার কোটি কোটি টাকা থাকলেই আমি উন্নত জীবনের অধিকারী? ধরো, টাকার অঙ্কে বাংলাদেশের বড়োলোকদের একটা তালিকা যদি করি, এর অধিকাংশ লোকই হবে শিল্প-সাহিত্যের বাইরের লোক। যে ভ্যানগঘের একটা ছবি কেনার সামর্থ আমাদের কারো নেই, সেই ভ্যানগঘ তো জীবিতকালে না খেয়েই মরেছেন। এটা ঠিক পিকাসো, এন্ডি ওয়ারহল জীবদ্দশায় সম্পদ-প্রাচুর্য উপভোগ করেছেন। একজন নোবেল বিজয়ী লেখককে তো অর্থমূল্যে বড়োলোকই বলা যায়। এমনকি আমাদের দেশেও একটি সাহিত্য পুরস্কারের অর্থমূল্য আট লক্ষ টাকা। একজন লেখকের জন্য এই নগদ প্রাপ্তিটা অনেক আনুকূল্য দেয়। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞেস করো, আমি ব্যক্তিগতভাবে, পয়সা কামানোর জন্য লেখালেখি করি না। মার্কেজ, মুরাকামি থেকে আমাদের হুমায়ূন— জীবিতকালেই অর্থ-বিত্ত-খ্যাতি উপভোগ করেছেন। সেটা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি বা অসুবিধা নেই। তারচেয়েও বড়ো কথা আমি নিজে এই অর্থ-বিত্ত-খ্যাতির সাফল্যকে খুব বড়ো করে দেখি না। তুমি জানো, আমি নিজে খুব দামী চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। প্রতি মাসে সুনিশ্চিতভাবেই লক্ষাধিক টাকা কামাই করতাম আমি। আমি যে পেশাগত জীবনে ছিলাম সেখানে সফল ছিলাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমাকে লিখতে হবে। অর্থ নয়, কীর্তি নয়, অন্য কোনো বিপন্ন বিস্ময় আমাকে টেনেছে। এটা আসলে যার যার ইচ্ছা বা পছন্দের ব্যাপার। কেউ টাকার জন্য লিখতে পারে, কেউ খ্যাতির জন্য লিখতে পারে, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমি পড়ার সময় এটা মাথায় রাখি না, কে কতো টাকা দামের লেখক, কে কতো জনপ্রিয় লেখক। আমি আমার নিজের জন্য লিখি। আর ভাত-কাপড়ের ব্যাপারটি যে এড়িয়ে যাব তা তো নয়। এটা তো সত্যি যে আমাদের সাহিত্যের সেরা কাজগুলো ভাত-কাপড়ের সংকট, রাজনীতি নিয়েই হয়েছে। সেটা তুমি মানিক থেকে শুরু করে ইলিয়াস পর্যন্ত পাবে। তবে আধুনিক মানুষের তো এখন আর শুধু ভাত-কাপড় দিলেই জীবনযাত্রার উন্নয়ন হয় না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভাত-কাপড়ের চেয়েও আরও অনেক বিষয় সাহিত্যে আসা দরকার। অর্থনীতি, নন্দন, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, অতীত, ভবিষ্যৎ ইত্যাদির বিবিধ ব্যাখা বিশ্লেষণ সাহিত্যের সীমানায় আসতেই পারে। কিন্তু অতীতে বা বর্তমানে, এই প্রজন্মে বা আগের প্রজন্মে বা পরের প্রজন্মে কোন লেখক কী ভূমিকা রাখবেন, কার কি কাজ করা দরকার তা নির্ধারণ করে দেবে কে? আমার তো মনে হয়, যার যার মতো করে যথার্থ সাহিত্য চর্চাটাই জরুরি। প্রত্যেকে যদি চেষ্টা করে তার নিজের একটা বলার ভঙ্গি, লেখার ভঙ্গি তৈরি করার, প্রত্যেকে যদি বিষয়ের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করে, আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে যদি প্রত্যেকে কাজ করে— তাহলে আপনা আপনিই এক বা একাধিক সাহিত্য ঘরাণার জন্ম হবে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১১ নভেম্বর, ১৯৮৬; চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার বদপুর গ্রাম। হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়েটিভ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। ‘জীবনের ছুটি নেই’ পাণ্ডুলিপির জন্য পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০২০। প্রকাশিত বই : তাড়া খাওয়া মাছের জীবন [কবিতা; শুভ্র প্রকাশ, ২০১৫], বিরুদ্ধ প্রচ্ছদের পেখম [কবিতা; বিভাস প্রকাশন, ২০১৬], এসেছি মিথ্যা বলতে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭]। কিশোর উপন্যাস :বক্সার দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী [ অন্বেষা প্রকাশ, ২০১৯]।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।