সোমবার, ডিসেম্বর ২

সাফওয়ান আমিনের কবিতাভাবনা ও কবিতা

0

Safwan Aminনিঝুম রাতের ভেতরে ঘুঘুর পরিতৃপ্ত বিশ্রামই যেন কবিতা


শূন্য থেকে উঁকি দেওয়া চড়ুই পাখিটির ভাষা অনুবাদ করতে করতে সন্ধ্যার ভিতর হারিয়ে যাবার পর, কোনো ঘোর কালি সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিঝুম রাতের ভেতরে ঘুঘুর পরিতৃপ্ত বিশ্রামই যেন কবিতা! মনে হয়, কবির শেষ পর্যন্ত শৈল্পিক ঘোর সৃষ্টি করাই প্রকৃত উদ্দেশ্য—

কবিতা লিখতে গিয়ে মনে থাকে, পাঠককে ভাবনার সুযোগ করে দেবার কথা। কবিতায় ব্যবহৃত সিম্বল (অলংকার)— ইঙ্গিত—শব্দ—বর্ণ দিয়ে, ভাবতে দেই পাঠককে। টেক্সট পড়েই যেন পাঠক নিজের অভিজ্ঞতা ও জানার মধ্য দিয়ে ইচ্ছে মতো নির্মাণ করতে পারে স্ব স্ব স্বর্গ কিংবা নরক। মনে থাকে, কবিতার ভাষা আঙ্গিক যেন মসৃণ হয়। শব্দ চয়ণ করার সময় ভাবি, পড়েই একজন পাঠক যেন তৃপ্তি বোধ করে, বুঝতে পারে প্রতিটি শব্দের অর্থও। কিন্তু তারে যেন পড়তে হয় বড়ই গোলকধাঁধায়। চাই, এই মসৃণতার সহবাসে হোক কবিতায় ভাবনার দৌড়…

সৃষ্টির খেলা খেলতে ভালো লাগে। প্রতিমা তৈরির মতো এক একেকটা শব্দ দিয়ে সুনিপুণভাবে গাঁথতে গাঁথতে যেন নির্মাণ করি নিজেকেই; শব্দের আমিকে গড়ে তুলি। কিন্তু পরিপূর্ণ আমাকে নির্মাণ যেন হয়ে ওঠে না। খুঁত রয়েই যায়। আরও নিখুঁত করে নিজেকে নির্মাণ করার আকাঙ্ক্ষা জাগে প্রতিবার। থাকুক এ আকাঙ্ক্ষা। বোধকরি, এই অতৃপ্তির দরকার আছে। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘আমি’ বলতে কি বোঝাচ্ছি ; ‘আমি’ আসলে আমার সমস্ত নিয়েই আমি। আমার দেখা, আমার শোনা, আমার বলা, আমার অনুভূতির সাথে জড়িয়ে আছে এমন সমস্ত প্লট নিয়েই আমি। আর এই আমার আমিকেই আমি প্রতিবার সুনিপুণ করে নির্মাণের জার্নি করি। নিজেকে নির্মাণের এ জার্নি আনন্দের… নিজেকে নির্মাণের যে আকাঙ্ক্ষা, তা আছে বলেই হয়তো কবিতা লিখি।

আশির দশকের পর কোনো কবিকেই স্বীকার করে নেননি বাংলা সাহিত্য। কবিতা হয়েছে, অবশ্যই ভালো কবিতা লেখা হয়েছে, হচ্ছে…হতে পারে, উৎকৃষ্ট মানের কবিদের আমরা ধরতেই পারছি না। এই কথা ভাবতে এসেই সংকট বোধ করি বাংলা সাহিত্যে কিছু ভালো মানের সমালোচক-আলোচকের। উৎকৃষ্ট আলোচক-সমালোচকেরাই কেবল উৎকৃষ্ট শিল্পকে তুলে আনতে পারে সাধারণ পাঠকদের সামনে। জাপানিজ আর্টের যে বৈশ্বিক আলোড়ন, এর পিছনে কাদের অবদান? অবশ্যই গুণীগুণী সব আলোচক-সমালোচকদের। তারা উৎকৃষ্ট শিল্পগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন বলেই, সেসব এখন এত সমাদৃত। বিগত দশকগুলোর মধ্যে থেকে এক ঝাঁক স্বচ্ছ পায়রা বের হয়ে আসবে, যদি গুণী আলোচক-সমালোচক সৃষ্টি করতে পারে এই বাংলা সাহিত্য। শক্ত কণ্ঠেই উচ্চারণ করছি যে, লেখা হচ্ছে, ভালো লেখাই হচ্ছে। কিন্তু আমরা ভালো শিল্পকে খুঁজে পাচ্ছি না। চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেবার কে আছে? সবই স্রোতের পোনামাছ মনে হচ্ছে… কিন্তু পোনামাছের মধ্যে যে বোয়ালও আছে, তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি না। ভাবছি, কবিতার সাথে তো কবির ভবিষ্যৎও সম্পৃক্ত। আর তার ভবিষ্যৎ যেন নির্ভরশীল গুণী আলোচক-সমালোচকদের উপরে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে যদি পারি, তবে কবি ও কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এই সোস্যাল মিডিয়ার যুগে, শত তরঙ্গের বিনোদনের মধ্যে সাহিত্য কিছুটা স্তিমিত হয়ে আছে বটে। কিন্তু সাহিত্য মরে যায়নি। বিশ্বাস করি, বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা কবিতা নতুন উদ্যমে এন্ট্রি নেবে, মানে আমরা নেওয়াবো… আমি আত্মবিশ্বাসী এবং বিশ্বাস করি এ সময়ের তরুণ কবিদের কবিতার শক্তিকেও—কবিতার দ্যূতি খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়বে। আর তা হয়তো ছড়িয়ে পড়তে সোস্যাল মিডিয়াই ব্যাপক সহায়তার মাধ্যম হবে। তাই কবিতার ভবিষ্যৎ বলব যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। আর আমি নিজেকে দেখতি পাচ্ছি নির্মাণের স্ব আসনে… এ সময়ে লিখতে এসে, এত এত ধারার মধ্যে বিহ্বল হয়ে যাচ্ছি। তবু লেখায় নিজস্বতা আনার চেষ্টা আমার অব্যহত… তারপরেও থেকে যাচ্ছে কারও না কারও প্রভাব। প্রভাব নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি, সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠবার কথা। জানি, এ জার্নি অনন্তের—ভাঙতে চাই। কবিতা বিমুখ সমাজকে কবিতামুখী করতে চাই। এই অন্ধত্ব ভাঙার অভিপ্রায়ে আছি…উপযুক্ত প্রিপারেশনটুকুও গ্রহণ করব এমন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করছি না। সাহিত্যের এইটুকুন জার্নিতে বোধ হচ্ছে, কবিতাকেই জীবনের সবচেয়ে বেশি ইমপোর্টেন্স দিয়ে এসেছি। একমাত্র কবিতাকেই আপন করে নিতে পেরেছি। ভাবি, কবিতার সাথে এ জীবন তো জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। এ থেকে রেহাই নেই, জরুরতও ফিল করছি না।

কবিতা প্রাণের আঁধার, বেঁচে থাকার মন্ত্র! আমৃত্যু কবিতার সাথেই থাকতে চাই।


ডিলেমার নীলগাই ও অন্যান্য কবিতা


সিসিফাস


দুপুরের শালিক বিকেলের গমখেতের দিকে হাঁটছে…
ধীবরের হয়নি জাল বিছানো শেষ—

দু’টি পাখি ডাঙায় বসে, আয়ু যেখানে ফুরানোর সাধ;
আলতা, নই-বাদাম ও জিলাপিও অপেক্ষায়, দোকানে—

বঁধু সমস্ত দিবসজুড়ে দেয়ালে লিখে যাচ্ছে মাছের স্বপ্ন

তবু অনন্তের দৌড়ে দানবও তো হার মেনে যায়—


নিমফলের প্রহর


আকাশে খুব মেঘ করলে কইমাছ উজানে বুঁদ আঁকে—
তোমার চোখ ফোটে কুড়মি বিবাহে, মহুল ফুলের মতো…

তবু দেখি গ্রামগুলোও এক একটি পাথরখণ্ড,
কর্পোরেট তিয়ানজিন—তোমার শিউলি-অঞ্চল গেল কই? তখন ভাবি সবুরে মেওয়ার গুরুত্ব…

সংগ্রহের পরেও আমনের ক্ষেতে পরে থাকে ফসল, বহু সংশয়;
প্রেম ভারতীয় ফিনিক্সের ডিম না তো?
পূর্ণতায় যদি উত্তরসূরির পথে হাটে?


ঔষধী


এক সহজ ব্যর্থতায়, মাকড়সা বুক সেঁধিয়ে রাখে
মেটারনিটির নামে

নিজেই ছা এর খাদ্য হয়ে যায়…

মা বোঝে এপাড়ে ক্রমশ বিলীন হচ্ছে, ওপাড়ে
নতুন সৃষ্টির উল্লাস—

তবু তৃপ্তির বুদবুদ সন্ধ্যার ভিতর…

কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঘ্রাণে
নিজেরি ফাঁদজালে ঝুলছে আটটি শূন্য—


ডিলেমার নীলগাই


সমস্ত আহ্বান যদি হয় তোমার জরির চুমকি নিয়ে; মন বাড়ি না ফেরার বাদসাধে—

ওদিকে অভ্যস্ত উঠনের ঘ্রাণ
পুত্র! পুত্র! বলে জোছনা বিলয়,
লাল সবরি গাছটাও—

মহুয়া ফুল রেখে, নীলগাই আকাশে উড়লো…এই বাঞ্ছা ছিল কি নীলগাই?


বটগাছ


শুকিয়ে যাওয়া ছাড়া বকুলের স্বাধীনতা কিসে?

তোমার প্রেম যেন স্টকহোম সিনড্রোম

পারিন্দা উড়ে যাক,
প্রেম কি এক সুদীর্ঘ সহিসের পথ?

শুধু প্রতিধ্বনি ছেয়ে থাকে সর্পিল আস্তিনে—

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম সিরাজগঞ্জের বিল অঞ্চল তাড়াশে হলেও পড়াশোনা সূত্রে ২০১৩ সাল থেকে বগুড়ায়, বলা চলে, যৌবন প্রেম ও কবিতা সব বগুড়ার জলে ও বাতাসে পাওয়া। মূলত কবিতা লেখেন। ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন করে কবিতার ঘাড়ে চেপে বসেছেন। 'নিমফলের প্রহর (২০২১)' নামের একটা কবিতাগ্রন্থও রয়েছে। ছোটোকাগজ 'নিওর' এর সম্পাদনার সাথে দীর্ঘদিন হলো যুক্ত আছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।