রবিবার, ডিসেম্বর ১

সামুদ্রিক

0

‘সমুদ্রের কাছে যেতে সমর্পণ চাই হে ছোকরা, বিশ্বাস চাই। একটু একটু করে গোড়ালি ডুববে, হাঁটু ডুববে, তবু ডুবে যাবার ভয় পাবে না। ভিজে যাবে, নোনতা হয়ে যাবে আর ভাববে নতুন হলাম। এভাবে সমুদ্র দেখতে হয়। আরে ভাই জুতোটা তো আগে খোলো!’

সদ্যপরিচিত ভদ্রলোক একথা বলেছিলেন অনেক হেমন্ত আগে কোণারকের কাছাকাছি এক ছোট বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে। কথায় আর ব্যক্তিত্বে নেশা ছিল। সেবার সোমককে জলে নামিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেননি। সোমক আজও সমুদ্র শেখেনি। অধিকাংশ সময় পাড় ধরে হেঁটে বেড়ায় জল এড়িয়ে। জুতো খোলে না। সমুদ্র দেখে, আকাশ দেখে, নৌকো দেখে, ছোঁয় না কিছুই। কোথাও কিছু ছোঁয় না, শুধু দেখে… সে যুদ্ধ হোক বা নারী। সামান্য দূরত্ব রেখে দ্রষ্টার ভূমিকা বেছে নেয়। মন দিয়ে খুঁটিনাটি দেখে, তারিফ করে মাঝেমাঝে, বিশ্লেষণ করে, বোঝার চেষ্টা করে, দোটানায় ভোগে, কিন্তু ছোঁয়ার তাগিদ অনুভব করে না। হয়তো ভয় পায় ছুঁতে। ছুঁয়ে ফেললে যদি দ্রষ্টার নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়ে যায়? সেই ক্লাস সেভেনে প্রথম গল্পটা লেখার পরেই বাবা শিখিয়েছিলেন কীভাবে দেখতে হয়। সাহিত্যিককে হতে হবে নির্মোহ দ্রষ্টা। জড়িয়ে পড়লে, আবেগতাড়িত হলে কোনোকিছুকেই আর স্বরূপে চেনা হবে না। সত্য অধরা থেকে যাবে। লেখাও হয়ে যাবে গ্যাদগ্যাদে, জোলো, স্কুল বালকের গল্পের মতো। সেই থেকে সোমক দেখা অভ্যাস করে চলেছে। জীবনে প্রায় অনুপস্থিত থেকে জীবন দেখতে দেখতে পার করে দিল অনেকটা বয়স। লোকে বলে তার লেখা বেশ পরিণত, সবদিকের ভারসাম্য বজায় থাকে। এটুকুই উপার্জন। তবু আজকাল সোমকের মনে হয়, প্রবন্ধগুলো কোনোমতে উতরে গেলেও গল্পগুলো প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। আজকাল আর লেখাই আসে না। উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেও মাঝপথে বন্ধ করতে হয়েছে। বস্তুত গত বছর দুয়েক ধরে লেখাই বন্ধ রেখেছে সোমক, লেখাগুলোকে ছুঁতে পারছে না বলে। হয়তো ছুঁতে শিখলে ভালো হতো। 

জলে নামতে জানত দেবলীনা। চটিজোড়া খুলে রেখে পোশাকের তোয়াক্কা না করে তড়তড়িয়ে এগিয়ে যেত ঢেউ ভেঙে। সোমক তাকে দেখত অবাক হয়ে। সমুদ্রের বুকের ভেতর মিশে যেতে যেতে দেবলীনা ক্রমশ সমুদ্র হয়ে যেত। কখনো সোমকের হাত ধরে টেনে নামালেও সোমকের শরীরটুকু ভিজত কেবল, দেবলীনার মতো করে জলদেহে ঢেউ হতে পারত না সে। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে জল দেখত, দেবলীনাকে দেখত। সাগর অধরা থেকে গেল, মেয়েটাও। সে মেয়ে লবণ লবণ… শিখেছে সহজ মিশে যাওয়া… জলসমুদ্রে, জনসমুদ্রে।

মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় দেবলীনার সঙ্গে আলাপ। সে পড়ত ইতিহাস, যাদবপুরে। দেখা হলো এক তৃতীয় জায়গায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের ক্যান্টিনে। সেটা ছিল আড্ডার জায়গাগুলোর অন্যতম। বিদ্যুৎদাই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। বিদ্যুৎ ব্যানার্জি ততদিনে ইংরেজিতে মাস্টার্স শেষ করে ফেলেছে পাশের ইউনিভার্সিটি থেকে, কিন্তু পুরনো কলেজের ক্যান্টিনের মায়া কাটাতে পারেনি। একটা লিটল ম্যাগাজিন শুরু করার পরিকল্পনা করছিল ‘য-র-ল-ব-হ’ নামে। রেজিস্ট্রেশন করাতে গিয়ে দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে তার নাম বদলে হয়ে গেল ‘এবং য-র-ল-ব-হ’। ইচ্ছে ছিল সব ছোট পত্রিকার মতোই সেটা হবে ‘অন্যরকম’ এবং সিরিয়াস সাহিত্য-ইতিহাস-দর্শন চর্চার আঁতুড়ঘর। দেবলীনার ইতিহাসবোধ তাতে প্রয়োজন ছিল, সোমকের বিজ্ঞানচেতনাও। তাই দুজনকেই দলে নিল বিদ্যুৎদা। পত্রিকাটা বছর দুয়েক পর আর বাঁচেনি, কিন্তু দেবলীনা আর সোমক পরস্পরের সঙ্গে টিকে গিয়েছিল। প্রায় বিপরীত চরিত্রের দুই মানুষ কিছু দ্বৈত ভালোলাগার বিষয় অবলম্বন করে ভালোবাসায় পৌঁছে গেল। বছর পাঁচেক পর বিয়েও করে ফেলল। দেবলীনা ততদিনে পড়া শেষ করে সাংবাদিকতায় ঢুকেছে, সোমক ফের প্রবেশিকা দিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছে চক্ষুরোগ নিয়ে। দুজনের বেতনে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালানো যেত। তারপর সোমক স্পেশালিষ্ট হয়েছে, আয় বেড়েছে। ভাড়ার বাসা ছেড়ে নিজেদের দু’কামরা কিনে ফেলেছে দুটো বাথরুম, ড্রয়িং-ডাইনিং-বারান্দা সমেত। কিনতে না পারলেও ভাড়াবাড়িতে সংসারটা চলত, সোমক জানে। ওটুকুর অভাবে জানালা দিয়ে বউ পালাত না। দেবলীনা ভালবাসায় মিশে যেতে জানত। সোমক কি জানত? জানলে কি আজ এই অন্ধকার ব্যালকনির বদলে দেবলীনার সঙ্গেই থাকত না সে দিল্লিতে?

দেবলীনা দিল্লি গেছে কদিন আগে কৃষক আন্দোলনের পাশে থাকতে। বছরখানেক আগেও দিল্লি গিয়েছিল দাঙ্গার পরেই।

দেবলীনা দিল্লি গেছে কদিন আগে কৃষক আন্দোলনের পাশে থাকতে। বছরখানেক আগেও দিল্লি গিয়েছিল দাঙ্গার পরেই। সেবার সাংবাদিক হিসেবে নিজেদের সংবাদপত্রের তরফে তথ্যের সন্ধানেই যেতে পেরেছিল, যদিও কিছু সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ত্রাণ বিলি করা ছিল তার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য। চাঁদা তুলেছিল অনেকের কাছ থেকে, সোমকের কাছ থেকেও। এবারেও প্রধান সম্পাদককে অনুরোধ করেছিল তাকে কৃষক আন্দোলন কভার করার দায়িত্ব দিয়ে দিল্লি পাঠাতে, কিন্তু সুশান্তবাবু রাজি হননি। তাঁর ভয় অমূলক নয়। দেবলীনা দক্ষ সাংবাদিক, কিন্তু তার জড়িয়ে পড়ার, পক্ষ অবলম্বন করার অভ্যাস সাংবাদিকসুলভ নয়। সুশান্ত বিশ্বাস বহু বছর ধরে চেনেন দেবলীনা মজুমদারকে। স্টোরি কভার করতে দিল্লি গিয়ে সে কী করবে, তাও জানেন তিনি। বাঙলার অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদপত্রের একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক পত্রিকার তরফে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিচ্ছে, এই দৃশ্য দেখতে চাননি তিনি। প্রকাশ্যে এমন করার মতো অনভিজ্ঞ বা দায়িত্বজ্ঞানহীন নয় দেবলীনা, তবু ভরসা পেলেন না সুশান্তবাবু। সোমকের মতো নির্লিপ্ত দ্রষ্টা কাউকে পেলে তাঁর সুবিধা হতো, যে সব দিক থেকে সবকিছু দেখে একটুও আবেগপ্রবণ না হয়ে ‘ভারসাম্য’ বজায় রেখে খবর লিখে পাঠাতে পারত। অনিন্দ্যকে পাঠালেন শেষ পর্যন্ত। সেও দেবলীনার সঙ্গেই কাগজে এসেছিল।

দেবলীনার তাতে সুবিধেই হল। তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে চলে গেল। পত্রিকার স্বার্থে নিজেকে সংযত রাখার দায়টুকুও রইল না। ছুটির দিনে নিজের বিবেক ছাড়া অন্য কোনো মালিক নেই। মেডিকেল কলেজের প্রাক্তনি তপনদা, সুব্রতদারা তখন যাচ্ছিল সিংঘু বর্ডারের কৃষক সমাবেশে চালু হওয়া মেডিকেল ক্যাম্পটা সামলাতে। আগের মাসে যাওয়া দু-তিনজন এবার ফিরবে, বদলে দায়িত্ব নেবে এরা। ওদের সঙ্গেই চলে গেল দেবলীনা। গণ্ডগোলের ভয়, শীত, মহামারী কোনো অজুহাতই তাকে নিজের শহরের নিরাপদ আশ্রয়ে সুরক্ষিত রাখতে পারল না। এতদিনের জন্য অন্য কেউ ছুটি চাইলে হয়তো চাকরি ছাড়তে হতো, কিন্তু সুশান্তদা দেবলীনাকে স্নেহ করেন এবং সাংবাদিক হিসেবে তার মূল্য জানেন। এই মেয়েকে তাড়ালে কাগজের ক্ষতি।

সোমককেও ডেকেছিল তপনদা। সোমক যেতে পারেনি হাসপাতাল আর চেম্বার ফেলে। তাছাড়া সে চোখের ডাক্তার। ক্যাম্পে যে ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে, তার সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত বেশ কয়েক বছর। কী করতে পারবে ওখানে গিয়ে? এসব ছেঁদো যুক্তির আড়ালে আরেকটা দ্বন্দ্ব ছিল। সোমক আসলে এই পুরো ঘটনাপ্রবাহটাকে দেখছিল নিরপেক্ষ অসম্পৃক্তভাবে, যেভাবে সে দেখে সমুদ্র, পাহাড়, মানুষ, ইতিহাস সবকিছুই। কৃষির অবস্থা, এতদিন ধরে বহু কৃষকের আত্মহত্যা, ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, কৃষিবিলের ভালোমন্দ, আন্দোলনকারী কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থান বা শ্রেণীচরিত্র… ইত্যাদি প্রভৃতি সবকিছুই সে বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছিল। ফলে নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধে কোনো অবস্থানেই সে পৌঁছতে পারেনি। সে যখন বুঝছিল, দেবলীনা তখন অনুভব করছিল তপনদাদের মতো করে। ডিসেম্বরের রাতে জমে যেতে থাকা মানুষগুলোর শীত কম্বল ভেদ করে সোমককে কাঁপাতে পারেনি, কিন্তু জলকামানের দৃশ্যে ভিজে দেবলীনা কেঁপে উঠছিল। নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্ব স্ত্রীকে জানিয়ে তাকে নিরস্ত করার ক্ষীণ চেষ্টাও কি করেনি সোমক? শেষ অব্দি দেবলীনা যখন পথে বেরিয়েই পড়ল, তখন তার ব্যাগে কতগুলো মাস্ক আর স্যানিটাইজারের বোতল গুঁজে দিয়েছিল সোমক। কে জানে সেসব আদৌ ব্যবহার করছে কি না মেয়েটা?

দেবলীনা এভাবেই বারবার চলে যায়। অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের নিয়ে কোর্টে দৌড়য়। নারীপাচার চক্রের পিছনে দৌড়য়। ভাঙড়ে চলে যেত যখনতখন। সেখানে তখন গোলাগুলি, ধরপাকড়। চিন্তায় থাকত সোমক। দুএকবার বুঝিয়ে থামানোর চেষ্টা করেছিল। এই হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে খুব স্পষ্ট প্রতিবাদ করেছিল দেবলীনা। অশান্তি হয়েছে, তারপর চুপ করে গেছে সোমক। কাউকে বেশি জোর করতে পারে না সে। সরে এসে একটু দূর থেকে স্পর্শ এড়িয়ে স্ত্রীর কাজকর্ম দেখে সে। জড়িয়ে না পড়ে এসবও দেখতে শিখে গেছে। দেখে, বিশ্লেষণ করে, বোঝে… কোথাও পৌঁছতে পারে না। দেবলীনা সহজেই পক্ষ অবলম্বন করে, জড়িয়ে পডে। অথচ সে সাংবাদিক। এমন হবার কথা নয় তার। তার জন্য নির্দিষ্ট কাজ তো শুধু দেখা। সিংহ যদি হরিণের পিছু ধাওয়া করে শিশু হরিণের ঘাড় কামড়ে ধরে, তবে সম্পূর্ণ ছবিটিকে ফ্রেমবন্দী করাই তার দায়িত্ব, সিংহের পথ রোধ করা নয়। পেশা নির্বাচনে গোলমাল হয়ে গেছে কি? সোমকেরই সাংবাদিক হওয়া উচিত ছিল? খবর বা কাগজের নিবন্ধ লেখার সময় নৈব্যক্তিক থাকার শিল্প শিখে নিয়েছে দেবলীনা। সেখানে সে ত্রুটিহীন। গল্প-উপন্যাসে সে স্বয়ং উপস্থিত যাবতীয় পক্ষপাত সমেত। মহৎ সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা কি দুর্বলতা নয়? অথচ কি আশ্চর্য, তার লেখাগুলো ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে। তিনটে ছোটগল্পের বই, দুটো উপন্যাস উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে পাঠক মহলে। বিক্রিবাটা ঈর্ষণীয়। সোমক নিজে পড়ে দেখেছে, সহজভাবে বলা গল্পগুলো কীভাবে যেন সব ব্যারিকেড ভেদ করে বুকের ভেতর ঘণ্টা পেটায়। সোমক জানে, এমনভাবে সে কোনোদিন লিখতে পারবে না। এই আন্তরিকতা, পক্ষপাত, প্লাবন তার শক্তি নয়। দূরত্ব, স্পর্শহীনতা, নির্লিপ্তিই তার অবলম্বন। সেভাবেই তাকে লিখতে হবে। চেষ্টা করে, পেরে ওঠে না। ক্রমশ ক্লান্ত লাগতে থাকে। উপন্যাসে হাত দিয়ে বুঝতে পারে ক্ষেত্র নির্বাচনে বোধহয় ভুল হয়ে গেছে। না ছুঁয়ে দেখে নেওয়া টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো সাজিয়ে ছোটগল্প তবু লেখা যাচ্ছিল, কিন্তু অভিজ্ঞতা ছাড়া উপন্যাস লেখা প্রায় অসম্ভব। চল্লিশের দোরগোড়ায় পৌঁছে সোমক টের পেল চার দশকের জীবনে কোনো অভিজ্ঞতা জমা হয়নি তার। এতদিন ধরে সে জীবনকে দেখেছে শুধু, জীবনযাপন করতে ভুলে গিয়েছিল। উপন্যাসের কাছে হেরে গিয়ে ক্রমশ লেখা থেকেই পিছিয়ে আসে সোমক। তারপর নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে খানিক পিছিয়ে এসে নির্লিপ্তভাবে নিজের পরাজয় দেখতে থাকে। একজন দ্রষ্টা আরেক দ্রষ্টার ব্যর্থ হওয়া দেখে চুপচাপ। উপভোগ করে না, বিব্রতও হয় না।

দিল্লি থেকে দেবলীনা ফোন করে নানারকম অভিজ্ঞতার কথা বলে আর সোমক টের পায় আবারও জীবনের কাছে যাওয়া হলো না। সমুদ্রে নামতে জানলে বড় ভালো হতো। আজ ছাব্বিশে জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবস ভারতে। পাঁচ লক্ষ কৃষকের ট্রাক্টর র‍্যালি দিল্লি শহর ঘিরে। শহরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে মিছিল। আইটিও, লালকেল্লা ধুন্ধুমার। সকাল থেকে বারবার ফোন করেও দেবলীনাকে ধরতে পারেনি সোমক। যত বেলা বেড়েছে, উত্তাপ বেড়েছে দিল্লির পথে পথে। দেবলীনা কোথায় আছে, কেমন আছে জানা যাচ্ছে না। উৎকণ্ঠা গ্রাস করতে থাকে সোমককে। উদ্বেগ একরকম অনুভূতি, একরকম অভিজ্ঞতা। যে মুহূর্তে একথা মনে এলো, অমনি চিরকালের অভ্যাসবশত নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের উদ্বেগটাকে অথবা উদ্বিগ্ন সোমককে দেখতে আরম্ভ করল সোমক। উৎকণ্ঠার শারীরিক অনুভূতি থিতিয়ে গেল ক্রমশ। সন্ধেবেলা নিজের শরীর আর চোখ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল পড়ন্ত শীতের মুখোমুখি।

২.
নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার প্রাথমিক পাঠ সোমককে তার বাবাই দিয়েছিলেন। ক্লাস সেভেনের বড়দিনের ছুটি। বছরের শেষদিনের আলতো বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিল বাবা-ছেলে, দু’দিন পরেই হস্টেলে ফিরে যেতে হবে সোমককে। একত্রিশে ডিসেম্বর দুজনে মিলে শহরের পথে এলোমেলো হাঁটা ছিল বাৎসরিক উৎসব। দুর্গাপুরের ফাঁকা রাস্তায় বেশ হাঁটা যেত। বছরের এই একটা দিন সোমক নিজের কৈশোর আর বিদ্রোহ অগ্রাহ্য করে বাবার কথা মন দিয়ে শুনত এবং প্রায় মেনে নিত। তিনশ চৌষট্টিদিনের অবাধ্য অ্যাডোলেসেন্সের ক্ষতিপূরণ লজেন্স হিসেবে বাবার জন্য এই জানালাটুকু উদার খোলা রেখেছিল সে। হর্ষবর্ধন রোড ছাড়িয়ে বাঁদিকে ঘুরে একটা নতুন পথে চলতে চলতে এক বাবা বলছিল কীভাবে দেখতে হয়, এক ছেলে শিখছিল।

এমন ভাবে দেখবি যেন তুই সেখানে নেই। মানে আছিস, কিন্তু থেকেও নেই। যেন তোর কিছুই যায় আসে না। 
তার মানে যা হচ্ছে হতে দেব?
না। ঠিক সেরকম নয়। যখন কাজ করছিস, তখন তো করছিস। কিন্তু যখন দেখছিস, তখন শুধু দেখবি। নির্মোহ দেখা ছাড়া মহৎ সাহিত্য হয় না।সোমকের বাবা ছিলেন পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার সাহিত্যিক। খুব বেঁটে বলা যায় না এদেশের মাপে। কিন্তু খুব লম্বা হতে পারেননি। এক সময় কিছু প্রশংসা পেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপক সংখ্যায় পাঠক পাননি। বাবা কোনোদিন বাজার ধরতে পারেননি। বাজারকে ধরতে পারেননি। হেরে গিয়েছিলেন একটু একটু করে। হেরে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেননি। ঘুড়ি ওড়ানোর খেলায় ভো কাট্টা ছেঁড়া সুতো বোকা লাটাই বালকের মতো অভিমানে গোঁজ হয়ে বসে ছিলেন বারান্দার এক কোণে ঠোঁট ফুলিয়ে। পরের বিশ্বকর্মা পুজোয় মাঞ্জা দেওয়া সুতো আর নতুন ঘুড়ি নিয়ে তেড়ে আসেননি দ্বিগুন বেগে। যেন পরাজয়কে বেছে নিয়েছিলেন। বাবাকে খুব একটা লিখতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না সোমকের, যেমন নিজেকেও লিখতে দেখে না আজকাল। সোমক বুঝেছিল দুই রকমের লেখক হয়… যারা পয়সার জন্যে গুচ্ছ গুচ্ছ লেখে, আর যারা প্রকৃত সাহিত্যের কথা ভেবে ক্লান্ত হয়, লেখে না কিছুই। বাবা দ্বিতীয় দলে। বাবাকে এজন্য শ্রদ্ধা করত সে এবং সন্দেহ করত।

এই যেমন ঐ বাড়িটা দেখছিস তো? হ্যাঁ, ওটা। লেটার বক্সটা খোলা পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছিস। কিন্তু কিছু মনে হচ্ছে কি তোর? স্রেফ একটা খোলা লেটার বক্স। এই যে দেখলি, এটা যখন লিখবি, সেটা হবে খোলা লেটার বক্সের প্রকৃত চেহারা। যদি লেটার বক্সটা আমাদের বাড়ির হতো, তাহলে ভাবতিস, এমা খোলা পড়ে আছে! চিঠি হারিয়ে গেল কি না, কে খোলা ফেলে রাখল, হাবিজাবি। বাক্সটা দেখাই হতো না ভালো করে। তখন যদি লিখতে যাস, নিজের আবেগ লিখবি শুধু। লেটার বক্সের কথা আর লেখা হবে না। 

তার মানে নিজের বাক্স সম্বন্ধে কেউ কিছুই লিখতে পারে না?
কেন পারবে না? তার জন্যে প্র্যাকটিস চাই। নির্মোহ হতে হবে।
নির্মোহ কী রকম?
ভাববি যেন বাক্সটা আসলে তোর নয়। মানে বাক্সটা যার, সেই লোকটা যেন তুই না। দেখবি একটা লোক একটা লেটার বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যে বাক্সটা খোলা। সেই লোকটা তুই আসলে, কিন্তু তুই না। এতে আরো সুবিধে হল যে বাক্সের সাথে, বাক্সের মালিককেও স্টাডি করতে পারবি। ঠিক বোঝাতে পারছি? মানে তুই দেখছিস যে তুই দাঁড়িয়ে আছিস।
মানে অটোস্কোপি মতো বলছ?
অটোস্কোপি কী? 
ঐ যে, আছে না? একটা লোক মরে যাচ্ছে। পুরো মরে যাচ্ছে না। আবার বেঁচে উঠছে। মরে যেতে যেতে লোকটা অনেক ওপর থেকে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। আশে-পাশে মানুষ দেখতে পাচ্ছে। তারপর ফিরে এসে, মানে বেঁচে উঠে, সে সব বলছে।
এরকম হয় নাকি রে?
বলে তো।
ধুস! গাঁজাখুরি। ভূত বলে কিছু নেই। ভূত মানে অতীত। ইতিহাস। 
না বাবা, ভূত না। নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স বলে। মানে লোকটা তো সত্যি সত্যি মরেনি। মরতে মরতে বেঁচে গেছে।
হতে পারে। অনেকটা সেরকমই ধর। কিন্তু সবাই তো আর মরতে মরতে বেঁচে যাবে না। সাহিত্যিকদের এটা অভ্যেস করতে হবে মরার আগেই। রোজকার অভিজ্ঞতাগুলোকে দেখতে হবে নির্লিপ্তভাবে।
সাহিত্যিকরা তাহলে বাঁচে কখন?
বাঁচে কখন মানে? 
মানে কিছুই তো অনুভব করতে পারবে না তাহলে।
কেন পারবে না? সাহিত্যিকের অনুভূতি অন্য স্তরের। সবাই শরীর দিয়ে বাঁচে। সাহিত্যিক বাঁচবে নিজের লেখার মধ্যে। 

বাবার ইচ্ছে ছিল সোমক সাহিত্যিক হবে। সে ইচ্ছে গোপন করেননি। নিজের জীবনে সাড়ে পাঁচ ফুটের বেড়া টপকাতে পারেননি। তাই স্বপ্ন দেখতেন সোমক আরো দীর্ঘদেহী সাহিত্যিক হবে… ছ-ফুট… সাড়ে ছ-ফুট। যে মোহ, আবেগপরায়ণতা, বন্ধন বাবাকে লম্বা হতে দেয়নি, তা ছেলেকে ন্যুব্জ করতে পারবে না। শম্ভুনাথ মিত্র আর তার কলম বেঁচে থাকবে ছেলের মধ্যে।

এই নামটাও বাবার একটা ক্রাইসিস ছিল। বাবার নামে স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটে ‘নাথ’ ছিল না। সবাই চেনা শম্ভু মিত্রের সাথে গুলিয়ে ফেলত। তারপর ভুল বুঝতে পেরে বিরক্ত হতো। তাঁর লেখা লোকে ‘আসল’ শম্ভু মিত্রের ভেবে কিনে নিয়ে গেছে, তারপর লোকের মুখে ‘নকল’ শম্ভুর কথা শুনে না পড়েই ফেরত দিয়ে গেছে বইয়ের দোকানে বা সাহিত্য পরিষদের অফিসে লোক ঠকানোর অভিযোগ সমেত।

এই নামটাও বাবার একটা ক্রাইসিস ছিল। বাবার নামে স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটে ‘নাথ’ ছিল না। সবাই চেনা শম্ভু মিত্রের সাথে গুলিয়ে ফেলত। তারপর ভুল বুঝতে পেরে বিরক্ত হতো। তাঁর লেখা লোকে ‘আসল’ শম্ভু মিত্রের ভেবে কিনে নিয়ে গেছে, তারপর লোকের মুখে ‘নকল’ শম্ভুর কথা শুনে না পড়েই ফেরত দিয়ে গেছে বইয়ের দোকানে বা সাহিত্য পরিষদের অফিসে লোক ঠকানোর অভিযোগ সমেত। লেখার গুণাগুণ বিষয়ে তাদের প্রায় কারোরই কোনো বক্তব্য ছিল না। বাবা নিজের নামটাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। নিজের নামটাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। একটা নাথ জুড়ে দেয় মাঝামাঝি। কিন্তু আইনত সেটা আর বদলানো হয়নি। সম্পাদকেরা, যাঁরা তখনো তাঁকে ত্যাগ করেননি, আপত্তি জানান… মশাই শম্ভু মিত্র নামেই তো লোকে চেনে আপনাকে। এখন বদলালে ভাববে নতুন লেখক। সে হবে না।

সোমকের বাবা নামটাকে হত্যা করতে পারেননি। নিজেকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন লেখক হিসেবে, সামাজিক মানুষ হিসেবে। ক্রমেই গুটোতে থাকেন গুটিপোকা কোকুনের মতো। গুটিয়ে যেতে যেতে, ঘন হতে হতে প্রবেশ করেন সোমকের মধ্যে। তার ভেতর বাঁচতে চেষ্টা করেন, আর একটু একটু করে সোমককে ঠেলে বের করে দেন সোমকের শরীর থেকে। ক্রমশ সোমক এক দর্শক হয়ে যায়, আর দেখতে পায় সোমক নামের ছেলেটি হয়ে যাচ্ছে নির্বিকার ধাতব কলম। একসময় ভয় পেয়ে যায় সে। যে বয়সে সবে শরীর চিনছে, মন চিনছে, সেই বয়সে শরীর মন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না। সোমকের রাগ হয়। সাদামাটা রাগ নয়, ক্রোধ। হিংস্রতা। প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাবার বিশ্বাস, রাজনীতি, ইচ্ছা, চেতনা… সবকিছু ছিঁড়ে ফেলে। দেওয়াল থেকে সব তসবির নামিয়ে, সেখানে বড় বড় করে টাঙিয়ে রাখে বাবার সমস্ত পরাজয়। বাবাকে ধ্বংস করতে করতে তার গাল ভর্তি রাগত দাড়ি গজায়। কিন্তু এই যুদ্ধের প্রহরে সে শিখে ফেলে সরে আসার কায়দাটা। 

ডাক্তারি পড়তে এসে জুটেছিল তার দ্বিতীয় পাঠ। প্রথমে শিখল মানুষের মৃতদেহকে, স্রেফ মৃতদেহ মনে করতে। তার হাতকে হাত, মাথাকে মাথা ভাবতে। সাবধান, সবটা এক সাথে জুড়ে মানুষ না হয়ে যায় যেন। মানুষ থেকে সরে এসে মানুষকে দেখতে শেখায় ওখানে। কিন্তু সোমক তো আরো একটা খেলা জানে। নিজের পিছনে দাঁড়িয়ে সে দেখত সাদা টেবিলে শোয়ানো ডিসেকশন-বিদ্ধ দেহ আর তাকে ঘিরে দাঁড়ানো ছুরি হাতে আততায়ী দেহদের, যাদের একজন সোমক। 

শবদেহ বিচ্ছিন্নকরণের কাজ সম্পূর্ণ হলে শুরু হলো জ্যান্ত মানুষ বিচ্ছিন্ন করার কাজ। একটা মানুষের সমস্ত কষ্টকে কেমন করে শুধু তার ফুসফুস, হৃদপিন্ড বা জরায়ুতে আবিষ্কার করতে হয় অন্য সব কিছু অস্বীকার করে, কেমন করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিকিৎসা করতে হয় সমগ্রের বিনিময়ে… সেই অপূর্ব রিডাকশনের শিক্ষা আজও চলেছে তার। শরীর থেকে মন, আর মন থেকে আত্মা কেটে বাদ দেবার সে এক অন্যতর ডিসেকশন। এইখানে এসে সে বাবার প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেল। এতটা নির্মোহ বাবা তাকে হতে বলেননি। নিজেও কখনো পারেননি তেমন হতে। আবেগ লুকোতে দার্ঢ্যের ভঙ্গি করেছেন, হাত-পা ছুঁড়ে দাপিয়েছেন প্রসেনিয়ামে। পর্দার পিছনে যত তাঁর গায়ে বিঁধেছে তীক্ষ্ন কুমেরু হাওয়া, তত বেশি করে সন্তানকে দিতে চেয়েছেন বর্ম। বর্মের উপর বর্মের উপর বর্ম। তার ভেতর থেকে সোমক বেরোতে পারে না, তাই শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

বাবা মারা গেছেন সাত বছর আগে জানুয়ারির ত্রিশ তারিখ। ছেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সোমক সোমকের বাবার মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করেছিল খুঁটিয়ে। বাবার মৃত্যু লিখতে চেষ্টা করেছিল গল্পে, অথচ তাতেও অভিজ্ঞতা খুঁজে পায়নি। যা দেখেছিল, যেমন দেখেছিল, তাই লিখেছিল। মৃত্যুর আগেও বাবার সঙ্গে সেভাবে কথা বলা হয়নি অনেকদিন। দুর্গাপুর ছেড়ে চলে আসার পর বাৎসরিক হাঁটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ ছাব্বিশে জানুয়ারি দু’হাজার একুশ সন্ধে সাতটায় দেবলীনাহীন, মিছিলহীন সোমক ঝুলন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সাত-চোদ্দ-একুশ বছরের পুরনো বাবার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। 

– বাবা, আমি দেখতে শিখে গেছি। আমি এখন বিজ্ঞান বলে দিই ক্যান্সারাক্রান্ত যুবকের পরিবারকে, আর নির্লিপ্ত দেখি কেমন করে তার মেয়েটা কাঁদে। আমি তার নিখুঁত বর্ণনা পারি, আমি তার অশ্রু পারি না। এরা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে এইসব ট্রাপিজের খেলা। নইলে এত মৃত্যুর মাঝখানে জীবনের বেসাতি করবে কী করে ডাক্তার? মানুষ বাঁচানোর গোড়ার কথা, এরা আমায় বলে দিয়েছিল, মানুষ থেকে সরে আসতে পারা। 

এই শিক্ষা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই শিক্ষা আমাকে হত্যা করেছে। 

দেবলীনা যেদিন প্রথমবার আমার, অথবা সোমকের ঠোঁট ছুঁয়েছিল, সেদিনও… সেই অসম্ভব মুহূর্তেও আমি সোমকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। ছাদের রেলিঙ ঘেঁষে একটা চারপাইয়ের উপর সোমক শুয়ে আছে। তার উপর ঝুঁকে আছে দেবলীনা। তেল না পাওয়া মেয়েলি চুলে ঢেকে গেছে দৃশ্যপট। আর আমি সেই চুলের বাইরে থেকে দেখছি, সেই চুলের ফাঁক দিয়ে দেখছি, মানুষ কেমন ভাবে চুমু খায়! একাকী দাঁড়িয়ে আমি দেখেছি তো চুম্বনের মহৎ কবিতা। আমি দেবলীনার ভালোবাসা দেখেছি, দাহ দেখেছি, উল্লাস-রিরংসা-ক্ষুধা-কান্না-শীত-ফাল্গুন দেখেছি। আমি তার আসা দেখেছি। আমি তার সরে যাওয়া দেখেছি। বিক্ষত সোমককে শুশ্রূষা না দিয়ে নির্দয় দেখেছি তাকে। তার বুকের ক্ষতের মাপ, তার মস্তিষ্কের ক্ষতের মাপ নিষ্ঠাভরে টুকেছি খাতায়। আমি তার পরাজয় দেখেছি। পরাজয় বেছে নেওয়া দেখেছি। তার কাটা ঘুড়ির উড়ে যাওয়া দেখেছি। তার সুতোয় মাঞ্জা দিইনি, পাছে ঘুড়ি উড়ে যাওয়া আর সোমকের মুখ চুপসে যাওয়ার দৃশ্যটা ফসকে যায়! সাহিত্যিক কি এইসব দৃশ্য ছেড়ে দিতে পারে?

তোমার মতো আমিও সারা জীবন ধরে মহৎ সাহিত্যের কথা ভাবতে থাকব। লিখব না। ছিঁড়ে ফেলব লেখা। তোমাকে ধ্বংস করতে করতে আমি বড় হয়েছি। দুনিয়ার হাতে মার খেয়ে তুমি লুকিয়েছ সোমকের ভেতরে। এখন প্রতিদিন সোমকের পরাজয় নিশ্চিত করে আর তোমার শেষ দুর্গের পতন দেখে দেখে পূর্ণতার পথে এগোচ্ছে আমার কৈশোরের সাবোতাজ। 

৩.
দেবলীনার ফোন নেটওয়ার্ক সীমার বাইরে এখনো। দিল্লি, হরিয়ানার বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনেট বন্ধ। হোয়াটস্যাপও কাজ করছে না। টিভিতে একজন কৃষকের মৃত্যুর কথা বলেছে। আর কোনো মৃত্যুর খবর নেই, সুতরাং দেবলীনার সঙ্গে আবার দেখা হবে নিশ্চয়। তবু উদ্বেগ বাড়ছে। সব খবর তো সবসময় পাওয়া যায় না, আহতের সংখ্যাও কম নয়। কোন দিকে যাবে এবার ঘটনাপ্রবাহ? সরকার কী ফন্দি আঁটছে গোপনে? রাত গহীন হলে কোন ডুবোজাহাজ তোপ দাগবে কোথা থেকে কে জানে? আচমকা দাঙ্গা লাগবে কি আবার? কৃষকদের কিছু ইউনিয়নের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। তাদের কারো সঙ্গে গোপন শলা হয়ে আছে কি শাসকের? নিজেদের মধ্যে মারামারি লাগাবার মতলব আছে? কাল সকালে ব্রেকিং নিউজ হবে কোনো সৌপ্তিক পর্বের কাহিনি? পারম্পর্যরহিত আপাত অযৌক্তিক সন্দেহ ভিড় করে মনে। দেশের বা কৃষকের স্বার্থ, জাতীয় পতাকার গৌরব অথবা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অজস্র ফেসবুক পোস্ট পেরিয়েও এসব বড় ব্যাপার নিয়ে ভাবতে পারে না সোমক। তার চিন্তা আর স্বার্থবোধ আটকে গেছে দেবলীনার অস্তিত্বে, তার শারীরিক সুস্থতাটুকুতে। 

এভাবে ভাবতে পছন্দ করে না সোমক, নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। দর্শনের, সাহিত্যের যে মহান উচ্চতায় পৌঁছানোর জন্য সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেখানে এভাবে ভাবার নিয়ম নেই। মন্দিরের দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ধর্মভীরু গৃহস্থের শুধু নিজের পরিবারের শুভায়ু ভিক্ষা করার মতো সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত আবেগ কেন অধিকার করবে সোমককে? নিজের যাবতীয় শিক্ষা একত্র করে সে নিজেকে নিজের ভেতর থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের উদ্বেগটাকে অণুবীক্ষণে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে। হেরে যায়। আবার চেষ্টা করে, আবার হেরে যায়। এই নতুন পরিস্থিতিতে সে বিপর্যস্ত বোধ করে। ‘বোধ’ করে! ভাবনা সরিয়ে বোধ আসছে কোথা থেকে? দৃশ্যগুলো আর দৃশ্য থাকছে না, দৃশ্যপটের মধ্যে বারবার ঢুকে পড়ছে দ্রষ্টা সোমক। কেন এমন হচ্ছে? বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এসব হলো? একুশ-বাইশ বছরের পুরনো বাবার পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে কৈশোর ফিরে এলো দেহমন সমেত? কিন্তু বাবার সঙ্গে এসব কথা বলতেই বা হলো কেন এত বছর বাদে? তাহলে কি সহস্রাধিক মাইল দূরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একটা মেয়ে তাকে কাবু করে ফেলল আচমকা? অথবা এই উত্তাল জনজোয়ারের ক্যাওস ভেঙে দিল তার মননের শৃঙ্খলা? এরকম কিছু দৃশ্য কি সে আগেও দেখেনি বিচ্ছিন্নভাবে? তাহলে আজ কী এমন হলো? 

গত কয়েকদিন ধরে দেবলীনা তার অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো বর্ণনা দিত ফোনে। আজ, ছাব্বিশে জানুয়ারি দু’হাজার একুশ, সহসা সেই বর্ণনা চলে গেল শ্রুতিসীমার বাইরে। দেবলীনা জনসমুদ্রে নিখোঁজ। তার অবস্থানটুকুও ধরা পড়ছে না চোখ বা কানের রাডারে। বহুবছর ধরে ধারালো করে তোলা দুটো জ্ঞানেন্দ্রিয় আচমকা অকেজো হয়ে যাবার ফলেই কি জেগে উঠছে এক নতুন ইন্দ্রিয়?

দেবলীনা আর তার জগত ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছিল বহুদিন ধরেই। তার জগতের দৃশ্যগুলোও সরে যাচ্ছিল ভাষা আর বর্ণনাযোগ্যতার নাগালের বাইরে। দৃশ্যগুলোর নাগাল না পেয়ে সোমক ক্রমশ এই সরে যাওয়াটাকেই দেখতে শিখেছিল, দেখছিল। আজ হঠাৎ সেই সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটাও দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। গত কয়েকদিন ধরে দেবলীনা তার অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো বর্ণনা দিত ফোনে। আজ, ছাব্বিশে জানুয়ারি দু’হাজার একুশ, সহসা সেই বর্ণনা চলে গেল শ্রুতিসীমার বাইরে। দেবলীনা জনসমুদ্রে নিখোঁজ। তার অবস্থানটুকুও ধরা পড়ছে না চোখ বা কানের রাডারে। বহুবছর ধরে ধারালো করে তোলা দুটো জ্ঞানেন্দ্রিয় আচমকা অকেজো হয়ে যাবার ফলেই কি জেগে উঠছে এক নতুন ইন্দ্রিয়? 

সহসা দেবলীনাকে জড়িয়ে ধরার তাগিদ অনুভব করে সোমক। এই মুহূর্তে তাকে চুম্বন করা প্রয়োজন। নিখোঁজ মেয়েটাকে কোলে নিতে হবে এখনই। রেলিঙে ভর দিয়ে চরাচরে কান পাতে সোমক। বারান্দার উপর ঝুঁকে পড়া কালচে এই আকাশ কোলকাতা ছাড়িয়ে গ্র‍্যান্ড কর্ড রেললাইন বেয়ে মোগলসরাই কানপুর হয়ে দিল্লি অব্দি বিস্তৃত। এর গায়ে কান ঠেকালে হয়তো কিছু শোনা যাবে ফিসফাস! বাহাদুর মাঠের দিক থেকে গানের আওয়াজ আসছে, কিশোর কুমার। মাঝেমাঝে গান থামিয়ে মাইকে কেউ কিছু বলছে অস্পষ্ট। এসব পেরিয়ে দেবলীনার গলা শুনতে পায় না সোমক। দিল্লির বাতাস এতদূর বয়ে আসতে কাল বিকেল হয়ে যাবে। এতটা উজান বেয়ে এই মুহূর্তে একাকী মেয়েটির কাছে একান্ত চুম্বনই বা পৌঁছে দেবে কী করে সোমক? ভুল হলো। দেবলীনা তো একা নয়। সে তো লবণের মতো সমুদ্রে মিশে যায়, সে এখন পাঁচলক্ষ। জনসমুদ্রের একান্ত ঢেউটির কাছে এখনই এক একাকী চুম্বন পৌঁছে দেবে কী করে সোমক? সে তো সমুদ্রে ভিজতেই শেখেনি। 

সমুদ্রের কাছে যেতে চাইলে সমর্পণ চাই হে ছোকরা, বিশ্বাস চাই। এই বয়সে হঠাৎ চাইলেই সেই বিশ্বাস আসে না, সমর্পণ আসে না। ধীরেধীরে পা ডোবানো শিখতে হবে, জল শিখতে হবে। চক্ষুকর্ণের অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় শিখতে হবে। সহজ নয়।

দেবলীনার কাছে পৌঁছতেই হবে, সোমক অনুভব করে। কাজটা সহজ নয়। কাল দুম করে দিল্লি চলে গেলেই তাকে খুঁজে পাবে কি? ছুঁতে পারবে? আগে তো সমুদ্রে নামা শিখতে হবে। সমুদ্রের কাছে যেতে চাইলে সমর্পণ চাই হে ছোকরা, বিশ্বাস চাই। এই বয়সে হঠাৎ চাইলেই সেই বিশ্বাস আসে না, সমর্পণ আসে না। ধীরেধীরে পা ডোবানো শিখতে হবে, জল শিখতে হবে। চক্ষুকর্ণের অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় শিখতে হবে। সহজ নয়। সোমক জানে, এই আবেগের মুহূর্ত থাকবে না। কাল আবার দেবলীনাকে ফোনে ধরতে পারলেই বুকে ধরার আকুতি পুরনো সেরে যাওয়া ব্যথার মতো শরীর ছেড়ে নেমে যাবে। তার আগে এই মুহূর্তটুকু বেঁচে নিতে হবে। এখন তার আর দেবলীনার মাঝেখানে অকেজো টেলিফোনের নজর এড়িয়ে শুয়ে আছে ভীষণ শরীরী এক রাত, সুস্পষ্ট এবং স্পর্শযোগ্য হাওয়া। দৃশ্যেরা ফিকে হয়ে গেছে। ভাষা হেরে গেছে বর্ণনার দায় ঝেড়ে ফেলে। নির্মোহভাবে দেখার, বোঝার মতো কিছু পড়ে নেই চোখের নাগালে। কালচে বাতাস সমুদ্র হয়ে আছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে শীতে। শরীর শিরশির করছে। শরীর জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব। সত্তা শারীরিক, ইন্দ্রিয়ময়। কেমন অদ্ভুতভাবে জীবিত এক সোমক… এই চল্লিশে, এতবছর পর আবার… হঠাৎ… জীবিত, যার কোনো ‘প্রিসিডেন্স’ নেই আদালতে, তাই এই বিষয়ে স্পষ্ট রায় দেবার আগে কদিন সময় চেয়ে নিলেন বিচারক… অতএব আজকের মতো আদালত বন্ধ, তাই এই মুহূর্তে আর আইন মেনে কথা বলার কোনো দায় নেই, তাই নিজের ইচ্ছেমতো যা ইচ্ছে বলতে বা ভাবতে পারে কেউ, যে কেউ… বাতাস, রাত্তির বা সোমক… ভাবতে পারে বা ভাবা বন্ধ করে চুপ করে থাকতে পারে, বাতাসে ডুব দিতে পারে… এক ঢেউ, দুই ঢেউ… নুলিয়া হো… নুলিয়া, ধর দেখি সমুদ্রে আরেকটু যাই…. যেতেই পারে আরও অনেক দূর জেলে নৌকো পেরিয়ে, ডুবোজাহাজ পেরিয়ে… যে কেউ, সাঁতারু, আনাড়ি বা সোমক সারারাত ভেসে যেতে বা ডুবে যেতে পারে, পারে এমনকি বেঁচে নিতেও, অন্তত একরাত… পুনরায় আদালত বসার আগে পর্যন্ত, বাঁচতেই পারে, যেহেতু সংবিধান ও সংহিতা বন্ধ করে বিচারক বিশ্রামে গেছেন, অতএব এই তো সময়… 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।